লেখাঃ 'Abid Ahmed Chowdhury
- ৩০'শে ডিসেম্বর ২০১৩, ভোর রাত ৪.০০
- ৩০'শে ডিসেম্বর ২০১৩, ভোর রাত ৪.০০
টা!
আমার রুমে বসে কম্পিউটারে কিছু একটা কাজ
করতেছি, এমন সময় পাশের রুম থেকে আব্বুর
মোবাইলে রিং বেজে উটলো। এত রাতে হঠাৎ
করে কে ফোন দিল, মনের মধ্যে একটা বিষ্ময়ের
সৃষ্টি হল। একটু কান দিলাম, বুঝতে পারলাম
ফোনটা রিসিভ করতেই আব্বু
বিছানা থেকে উঠে গেছেন। একটু আতঙ্কিত
হয়ে উঠে গিয়ে দরজাটা খুললাম...
- "আব্বু কি হয়েছে?"
- "তর চাচা ফোন দিয়েছেন, তর চাচির
অবস্থা ভালো না, ব্যাথাটা বেড়ে গেছে,
তাড়াতাড়ি যেতে হবে...!"
চাচিরা আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে থাকেন, আজ
২৭ দিন হল উনার ডেলিভারী হয়েছে, উনার
একটা বড় ছেলে আছে, বয়স ১২ বছর,
আরেকটা সন্তানের অনেক ইচ্ছে ছিল কিন্তু আগের
বার সিজার করে তার প্রথম ছেলের জন্ম হওয়ায়
ডাক্তারী ভাবে কিছু একটা সমস্যা হয়, প্রায় ৩
বার বাচ্চা নষ্ট হয়। বিগত কয়েক বছর
থেকে অনেক কান্নাকাটি আর শোকাবহ
অবস্থা ছিল তার, অবশেষে অনেক দোয়া-দুরুদ
করে আল্লাহতালার অশেষ মেহেরবাণীতে এই মাসের
৩ তারিখে আবারো সিজার
করে আরেকটি ফুটফুটে সন্তানের জন্মদেন তিনি।
কিন্তু ডেলিবারীর পর থেকে প্রায় নিয়মিতই পেটের
মধ্যে একটা প্রচন্ড ধরনের ব্যাথা উটার
প্রবনতা শুরু হয় তার। কয়েকদিন
হাসপাতালে ছিলেন, তবে ডাক্তারের পরামর্শে এখন
বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। ডাক্তার
বলেছে এভাবে আরো কয়েকদিন
ব্যাথাটি উটতে পারে, কিছু ঔষধ
দিয়েছে তবে বেশি ব্যাথা ধরলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার
কথা বলেছে। ব্যাথাটি হঠাৎ করে অসহনীয়
হয়ে উটায় চাচা আব্বুর কাছে ফোন দিয়েছেন,
আব্বু একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
তীব্র শীত, তার উপর প্রচন্ড আকারে কুয়াশা,
আর তাদের বাড়িটা একটা টিলার উপরে, প্রায়
৩-৪ তলা ভবনের সমান উচু। এমন অবস্থায় এত
রাতে তাকে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রায়
অসম্ভব ছিল। আব্বু তরাতরি করে কিছু ঔষধ
আর উনার চিকিৎসা সরঞ্জাম নিলেন। ঘরের সবাই
নির্ঝুম ঘুমে, আব্বুকে বললাম আমিও
সঙ্গে যাবো। চটপট করে গরম কাপড়
পরে মাথা বেঁধে দুজনে রওয়না দিলাম। এত
বেশী কুয়াশা আমি আর কোনদিন দেখিনি, আব্বু
আমার থেকে আনুমানিক ৫ হাত দূরে হেঁটে যাচ্ছেন
কিন্তু এরপরেও তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।
কয়েক মিনিটের মাথায় আমরা কোন
মতে গিয়ে পৌছলাম। চাচির চিৎকার আর
চেচামেচিতে পুরো বাড়ির লোকজন জড় হয়ে গেছেন।
দেখেই বুঝা যাচ্ছে অতিরিক্ত অসহনীয় অবস্থা,
খুবই হৃদয় করুণ করা পরিস্থিতি।
আমরা রুমে ঢুকতেই আব্বুকে উদ্দেশ্য করে চাচির
চিৎকারটা আরো বেড়ে গেল, "ও ভাই
আমাকে বাচাও, আমি মরে যাচ্ছি, আমি আর
পারছি না...!"। আব্বু চাচির কাছে গিয়ে তার
অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করলেন, এরপর কিছু জল
খাবার দিয়ে কয়েকটা ট্যাবলেট খাওয়ালেন। মিনিট
দশেকের মধ্যে বুঝা গেল ব্যাথাটা কমতে শুরু
করেছে, সাথে ঘুমের ঔষধ ছিল, চাচির
অবস্থা দেখে বুঝা গেল ঔষধ কাজ করছে।
উনাকে একটা বালিশে মাথা দিয়ে গায়ে কম্বল
জড়িয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হল। কয়েক
মুহুর্থের মধ্যে দেখা গেল উনি একটু নিরব
হয়ে গেছেন, চাচা চাচির মাথার পাশেই বসা, আব্বু
সামনের দিকটায় চেয়ারে বসা আছেন, বাকি সবাই
রুমের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি।
একটু নিরব পরিবেশ, চাচা তার বড়
ছেলেকে ইশারা করলেন চুলায় গিয়ে চা বসানোর
জন্য। তার সাথে আমিও গেলাম চা বানাতে। পাশের
ঘরেই আরেক চাচি, ছয় মাস হল উনার কোলেও
আরেকটি ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়েছে, এই চাচির
ব্যাথা উটার পর থেকে উনার কাছেই আপাতত
নতুন শিশুটাকেও রাখা হয়েছে। ঘরের এই
পরিস্থিতির সাথে সাথে দুই শিশুই
একসাথে কান্না করতেছে, এত রাতে তাদেরকেও
সামাল দিতে হচ্ছে। মোটামুটি বাড়িটা প্রায় মাথায়
উটে যাওয়ার মত অবস্থা, পাশের বাড়ি থেকে কেউ
যেন জেগে না যায় সেই প্রচেষ্টাই চালাচ্ছি আমরা।
কিছু মুহুর্থের মধ্যে আমি ছোট
কাজিনটাকে নিয়ে সবার জন্য চা বানিয়ে আনলাম,
কেমন বানিয়ে ছিলাম ঠিক বলতে পারবো না, সেই
সময় মাথায় কিছুই কাজ করতে ছিল না, শুধু
একনাগারে কানের মধ্যে চাচির চিৎকার আর
আহাজারির শব্দ গুলো ভেসে আসছিল মনে হচ্ছিল,
মৃত্যু যন্ত্রনায় বেঁচে থাকার আকুলতা নিয়ে ছটফট
করতে কোন মানুষকে প্রথমবার দেখেছিলাম
হয়তো সেজন্যই। সবার চা পান শেষে চাচির
অবস্থা একটু শান্তি দেখে আমি আর আব্বু
বাড়িতে ফিরার জন্য তৈরি হলাম। আসার সময়
আব্বু চাচির গায়ে আরো অতিরিক্ত একটা কম্বল
জড়িয়ে দিয়ে, চাচাকে কিছু কথা বলে আসলেন।
আসার সময় পথেই পড়ে মসজিদ,
ততক্ষনে ফজরে নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছিল।
আব্বু আমাকে নামাজটা পড়েই বাড়ি ফিরার
কথা বললেন, আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগতেছিল
তাই তাকে বললাম,
আমি ঘরে গিয়ে পড়বো তিনি যাতে পড়ে আসেন।
আব্বু মসজিদে গেলেন, আমি বাড়িতে চলে আসলাম।
আব্বু ওযু করে মসজিদের হুজুরকে ডাক দিলেন,
পরে নিজেই আজান দিলেন। ইতিমধ্যে কয়েকজন
মুসল্লী মসজিদে গমন করেলেন, সবাই সুন্নত
নামাজটুকু শেষ করে ফরজ নামাজের জন্য
দাড়িয়ে গেছেন, প্রথম রাকাতটা শেষ
করতে পারেননি আব্বু অনুভব করলেন তার
মোবাইলে ভাইব্রেট হচ্ছে। একবার, দুইবার
করে করে কয়েকবার মোবাইলটা ভাইব্রেট হল, কেউ
বার বার ফোন দিচ্ছেন। আব্বু সালাম
ফিরিয়ে তাড়াহুড়ো করে মোবাইলটা বের করলেন,
মোবাইল স্ক্রিনে চাচার নাম্বার।
সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করলেন,
- "ভাই ফোন দিয়েছিলে, সবকিছু ঠিক আছে তো?"
- "তর ভাবী এখন আর কোন সাড়া দিচ্ছেন না।
একদম স্তব্ধ হয়ে গেছেন, একটু জলদি করে আয়
আবার, এসে দেখতো কি হল?"
আব্বু সাথে সাথে মসজিদ থেকে বের
হয়ে আবারো চাচার বাড়ির দিকে রওয়না দিলেন।
সেখানে গিয়ে চাচির রুমে যাওয়ার আগেই
দেখতে পেলেন কান্নার রোল উটে গেছে,
সামনে এগিয়ে রুমে ঢুকলেন, বিছানার
পাশে গিয়ে চাচির হাতটা ধরতেই উনার চেহারাটাও
পালটে গেল।
আমি ততক্ষনে বাড়িতে গিয়ে নামাজটা পড়ে বিছানায়
যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় আব্বুর
ফোন...
মুহুর্থের মধ্যেই দৌড়ে গিয়ে আম্মু আর ছোট ভাই-
বোনদের কে ডাক দিয়ে তুললাম। তারা একেক জন
রুম থেকে বেরুবার আগেই আমি দরজা খোলে এক
দৌড়ে চাচার বাড়ি, পথে কোন জায়গায় আর
থামিনি, লম্বা সেই সিঁড়িটা পর্যন্ত দৌড়ে উটলাম।
দৌড়ানোর সময় কানের কাছে একটাই আওয়াজ
ভেসে আসছিল, সেটা ছিল চাচির কান্নার আর
চিৎকারের। চাচির রুমে গিয়ে ঢুকলাম,
আমি রুমে ঢুকতেই চাচির সেই ১২ বছরের
ছেলেটা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো,
"ভাইয়া... আমার আম্মু আর নাই!!!!" বলেই
কান্না শুরু করে দিল, পরিস্থিতি এতটাই করুণ
হয়ে উটলো আমার চোখের পানি গুলো নাক
বেয়ে তার কপালে পড়তে লাগলো। একটু
উকি দিয়ে বিছানার দিকে থাকালাম, চাচির নিথর
দেহটি পড়ে আছে, মাথার নিচের বালিশটাও এখন
সারানো হয়ে গেছে।
ধীরে ধীরে সূর্য উটতে শুরু করলো, কিন্তু বিদাতার
করুণ নিয়মের অনুরাগী হয়ে আমার চাচি তার
পরিবারের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলেন
একেবারে না ফেরার দেশে। আর চাচার
কাছে রেখে গেলেন, ১২ বছরের এক ছেলে আর
মাত্র ২৭ দিন বয়সি তার দুগ্ধ শিশুটিকে।
চোখটা ভালো করে মেলে দেখার আগেই যার মাথার
উপর থেকে চলে গেল 'মা' নামের সেই ছায়াটুকু।
- আজ ৩০'শে ডিসেম্বর ২০১৪, সেই
শুকভরা আবেগময় রাতটার আজ একবছর
পূর্তি হল। আজ সেই ২৭ দিনের
শিশুটি দেখতে দেখতে কিছুটা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু
আজও তার মুখটার দিকে থাকালে মনে পড়ে যায়
সেই রুদশ্বাস্য রাতটার কথা, কানের
কাছে ভেসে আসে চাচির সেই আহাজারি আর
"আমি মরে যাচ্ছি, আমাকে বাচাও,
আমাকে বাচাও!!!" বলে বলে সেই হৃদয় বিদায়ক
চিৎকারের স্বর। সেই
শিশুটা হয়তো আরো কয়েকদিন
পরে কথা বলতে শিখে উটবে, কিন্তু আর কোনদিনও
'মা' শব্দটি ধরে ডাকার মত
কাউকে খোঁজে পাবে না...