মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৩২২- মা

লিখা,:- Gazi Mohammad Mominul Hoque

মন খারাপের গভীর রাত। পুকুরে পা
ডুবিয়ে চুপচাপ বসে আছি। পুকুর পাড়
জোছনার মায়াবী আলোয় ডুবে
আছে।
পুকুরের মধ্যে চাঁদের ছায়া পড়েছে।
আমি পা দিয়ে পুকুরে ছোট ছোট ঢেউ
তুলছি।
ঢেউয়ের তালে চাঁদটা দুলছে। দুলতে
দুলতে পুকুরের চারদিকে চাঁদটা
ছড়িয়ে যাচ্ছে।
চাঁদের আলোয় নেশা মেশানো
হাওয়া গাঁয়ে মেখে মেখে
আকাশের তারা গুনছি।
একটা তারা নিয়ে আমি বার বার
হিমশিম খাচ্ছি।
যে তারা'টাকে নিয়ে আমি
হিমশিম খাচ্ছি সে তারা'টাকে
আমি চিনি।
আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার
বাবা আমাকে তারা'টার সাথে
পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
তারাটা নাকি আমার মা। বেঁচে
থাকতে মানুষ ছিল, মরে গিয়ে নাকি
তারা হয়ে গেছে।
প্রথম প্রথম আমি বিশ্বাস করিনি। যখন
তারাটা প্রতিদিন আমাকে দেখতে
পুকুরের উত্তর পাড়ে আসত তখন আমি
বিশ্বাস করেছি।
পুকুরের উত্তর পাড়ে আমার মায়ের
কবর।
আমার মা অনেক দূরে। ঐ আকাশে।
মাঝে মাঝে আমার অসুখ হলে আমার
মা জানালার কাছে নেমে আসে।
তখন আমাকে কষ্ট করে পুকুর পাড়ে
যেতে হয় না। আমার মাকে আমি
জানালা দিয়ে দেখতাম।
আমার অসুখ ছাড়া মা জানালার
কাছে আসত না। মা যখন কাছে আসে
তখন খুব ভাল লাগত।
মাঝে মাঝে মাকে জড়িয়ে ধরতে
ইচ্ছা করে কিন্তু মা ওত কাছে আসত
না। নিষ্ঠুর মা।
মা মারা যাওয়ার পর আর একটা মা
আসে- নতুন মা। নতুন মা আগে আমাকে
খুব আদর করত। নতুন মা প্রথমে প্রথমে
আমার দাঁত ব্রাশ করে দিত।
সুন্দর করে গোসল করিয়ে দিত। তারপর
স্কুলের ড্রেস পড়িয়ে দিয়ে নাস্তা
খাইয়ে দিত।
নাস্তা খাওয়া শেষে চিরুনি দিয়ে
বাম দিক দিয়ে একটা সিঁতি করে
দিত। সিঁতি করতে আমার খুব ভাল
লাগে।
আমাদের ক্লাসের ফারিয়া
মেয়েটাও সিঁতি করে ক্লাসে আসত।
তাকে সিঁতি করে আসলে খুব সুন্দর
দেখায়।
নতুন মা আমকে প্রতিদিন স্কুল থেকে
আনতে যেত। আসার সময় নতুন মা
আমাকে চকলেট কিনে দিত।
মাঝে মাঝে ফারিয়াকেও কিনে
দিত। ফারিয়া ঠিকমত চকলেট খেতে
জানে না। সে চকলেট খেলে সারা
মুখে করে ফেলত।
তখন আমার খুব ইচ্ছে হত তার মুখটা মুছে
দিতে, কিন্তু নতুন মার জন্য পারি না।
এখন আর নতুন মা আগের মত আদর করে
না।
এখন নতুন মা নতুন বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত
থাকে।নতুন বাবুটা খুব সুন্দর।
দেখতে চাঁদের আলোর মত ফুটফুটে। নতুন
বাবুর সুন্দর একটা নাম রেখেছি।
কিন্তু নতুন মা নামটা ধরে ছোট
বাবুকে ডাকে না। নতুন বাবুকে সুন্দর
নামটা ধরে শুধু আমি ডাকি, আর কেউ
ডাকে না।
আগে বাবা আমার সাথে ঘুমাত।
কিন্তু এখন আর ঘুমাই না। এখন বাবা নতুন
বাবুর সাথে ঘুমায়।
আগে বাবা আমাকে ডেকে দিত
কিন্তু এখন আমি বাবাকে ডেকে দিই।
তারপর নিজে নিজে ব্রাশ করি।
ব্রাশ করার সময় পেস্টগুলো মুখের
চারদিকে লেগে যাই। গোসল করে
নাস্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য
নিজে নিজে তৈরি হয়।
মাথায় তেল দিয়ে আয়না দেখে
নিজে নিজে বাম দিক থেকে
সিঁতি করি। মাঝে মাঝে তেল একটু
বেশি হয়ে যাই।
তারপর বাবার সাথে স্কুলে চলে যাই।
আসার সময় একা আসি।
একদিন তাড়াহুড়া করে স্কুলে চলে
গিয়েছিলাম। সিঁতিটা ঠিকমত করতে
পারিনি। তেলও দিইনি।
এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
ফারিয়া আমার এলোমেলো চুলগুলো
দেখে একটু ক্ষেপে গিয়েছিল।
তারপর সে নিজ হাতে খুব সুন্দর করে
চিরুনি দিয়ে সিঁতি করে দিয়েছিল।
সিঁতি করে দেওয়ার সময় আমার একটু
লজ্জা লেগেছিল।
তারপর সেদিন স্কুল ছুটি শেষে আমি
ফারিয়াকে চকলেট কিনে
দিয়েছিলাম। ফারিয়া তো চকলেট
খেতে জানে না। তাই আমি নিজ
হাতে তাঁকে খাওয়ায় দিয়েছিলাম।
এখন নতুন মা তো বাবুকে নিয়ে
সারাদিন ব্যস্ত থাকে। আমি ছোট
তাই আমার কোলে বাবুকে দেই না।
নতুন মা এখন আমার সাথে আগের মত
কথা বলে না। আমিও বলি না বুয়া
আমার কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেই।
বাবাকেও এখন আগের মত কাছে পাই
না। বাবা কিরকম জানি স্বার্থপর
হয়ে গিয়েছে।
সারাদিন অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
আগে প্রতিদিন অফিস থেকে
আমাকে কল দিত। এখন আর দেই না।
বাবাকে কখন পরম মমতায় বাবা
ডেকেছি তাও ভুলে গেছি।
এখন সারাদিন স্কুলে থাকতে ভাল
লাগে। স্কুলে থাকলে সারাদিন
ফারিয়ার সাথে সময় কাটাই।
একদিন ফারিয়াকে আমাদের বাসায়
নিয়ে আসি।
সেদিন নতুন মা বাসায় ছিল না। আমি
আর ফারিয়া অনেকক্ষণ গল্প করেছি।
বুয়া আমাদের দুজনকে মজার মজার
খাবার রান্না করে খাওয়াল।
আমাদের বাসার বুয়াটা অনেক
পুরানো। আর সে খুব ভাল।
ফারিয়া যাওয়ার সময় আমার থেকে
জিজ্ঞাস করেছিল, ''আমার মা
কোথায়?''
আমি তাকে সোজা পুকুর পাড়ে
নিয়ে আসলাম। তারপর মায়ের কবর
দেখিয়ে বললাম, "এইখানে আমার মা
শুয়ে আছে। সারাদিন মা এইখানে
শুয়ে থাকে আর রাত হলে আকাশে
চলে যায়। আকাশ থেকে মা আমাকে
প্রতিদিন দেখে। মাঝে মাঝে আমার
অসুখ হলে মা আমার জানালার পাশে
এসে উঁকি দেয়।''
ফারিয়া তখন জিজ্ঞাস করেছিল,
"আগে যে প্রতিদিন আমাকে স্কুল
থেকে আনতে যেত সে কে?"
তখন আমি বললাম, "সে আমার নতুন মা।"
আমার নতুন মার কথা শুনে সে ভেউ
ভেউ করে কেঁদে দিয়েছে।
তাঁর কান্না দেখে আমিও কেঁদে
দিয়েছি। কিন্তু সে আমার চোখের
পানি দেখেনি।
কারণ মেঘবিহীন আকাশ থেকে এক
পশলা বৃষ্টি এসে আমার চোখের
পানি লুকিয়ে ফেলেছে।
আচ্ছা, মা কি আমার চোখের পানি
দেখেছে?