লেখা> মোঃ জাহিদুল হক সুবন।
.
"ভাইজান মেডাম আপনাকে ডাকে।
.
অফিসে যাব বাসের জন্য অপেক্ষা
করছি। ঠিক তখনি লোকটার কাছে এই
বাক্যটা শুনলাম। একটু অবাক হলাম
আমাকে আবার কোন মেডাম
ডাকবে?
.
"আপনার মেডাম কোথায়?
"গাড়িতে বসে আছে।
.
আমি তো কোন উচ্চবিলাসী
মেডামের সাথে চলাফেরা করি
না। আরে উচ্চবিলাসি দুরে থাক
মেয়ে মানুষের ধারে কাছে তেমন
একটা যাওয়া হয় না। তাহলে এই
মেডাম কে? যার দরকার সে আসবে।
আমি কেন যাব?
.
"আপনার মেডামকে এখানে আসতে
বলুন।
.
লোকটি তার মেডামের কাছে যায়।
আর আমি বাসের জন্য অপেক্ষা করতে
লাগলাম। ঠিক কিছুক্ষন পর Premio একটা
কালো গাড়ি থেকে একটা মহিলা
নামল। আসলে মহিলা বললে ভুল হবে
কেননা চেহাড়া দেখে মনে হচ্ছে
না উনি মহিলা। চোখে একটা সান
গ্লাস। চুলগুলো খোলা। আর পিং
কালারের একটা শাড়ি। খুব পরিচিত
মনে হচ্ছে। দেখেই বুকটা হাহাকার
করে উঠে। এই মুখটা যে ভুলার নয়। আজ
৭টা বছর পর ওর সাথে দেখা।
.
"বা ব্বাহ শেষ মেষ আমাকে আসতে
হলো। কেমন আছ সুবন?
.
"কে আপনি? আমি ঠিক চিনতে পারছি
না।
.
আমি না চেনার ভান করলাম। কি
দরকার অহেতুক কথা বলে মনের ধুলো
জমা কষ্টের দরজাটাকে খোলার?
.
"তুমি আমাকে চিনতে পারো নি?
আমি আফসানা। তোমার....
.
আফসানা কথাটা পুরো পুরি শেষ করল
না। কারন সে এখন আমার না।
.
"দুঃখিত আপনি ভুল করছেন। অন্য কারো
সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন।
.
বাস চলে আসছে। এই কথাটা বলে
আমি বাসে উঠে পড়ি। আশ্চর্য হলাম
আফসানাও আমার পিছন পিছন বাসে
উঠে পড়ল। ও আমার হাতটা ধরে বলে...
.
"আমাকে চেনে ও তুমি না চেনার
ভান করতেছো কেন? তুমি আমাকে
কখনো ভুলতে পারবে না। সেটা আমি
জানি।
.
কথাটা একদুম সত্য এই মেয়েটাকে
কখনো ভুলা সম্ভব না। তাছাড়া এই
মেয়ের কি লাজ শরম কিছুই নেই
কোথায় কিভাবে কথা বলতে হয়।
এমনিতে বাসে আছি। কিছু বললেই
পাবলিক উল্টো আমাকে মার ধর
করবে। কেননা সুন্দরী মেয়েদের
দিকেই পাবলিকের হাজিরা ৯০
শতাংশ।
.
"কি ব্যাপার চুপ করে আছ কেন?
.
আমি তারপরও চুপ করে থাকলাম। হঠাত্
ওর আচরন দেখে এতটা অবাক হলাম
কখনো কল্পনা করতে পারি নি।
ড্রাইবারকে বলে গাড়ি থামাল আর
আমার হাত ধরে টানতে টানতে
আমাকে নামাল। আমি কিছুই বললাম
না। কেন বললাম না কি কারনে
বললাম না, তা ঠিক জানি না।
.
"আজ অফিসে না গেলে হয় না? অনেক
বছর পর তোমার সাথে দেখা হলো।
"না তা হয়না আফসানা।
"এই তুমি না আমাকে চেনো না।
তাহলে নাম জানলে কিভাবে শুনি?
.
নিজের ধরাটা নিজেই খেলাম। ওর
বাড়াবাড়িতে গেলাম না অফিসে।
ও আমায় একটা পুকুর পাড়ে নিয়ে আসল।
দুজনে পা ডুবিয়ে বসে আছি। কি অদ্ভুত
মেয়েটা। আজো সেই ছেলে
মানুষিকা রয়ে গেছে তার মধ্যে।
.
"তোমার স্বামী কেমন আছে?
.
এই কথাটার উওর ও ঝটপট দিল না।
খানিক্ষন নিরবতা পালন করল। কথাটা
পাশ কেটে বলল..
.
"আইস্ক্রিম খাব। এই নাও টাকা দুটো
ক্রোন আইস্ক্রিম নিয়ে আসো। পুকুরে
পা ডুবিয়ে তার সাথে আইস্ক্রিম
খাওয়া অনেক মজা।
.
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
পুরোনো স্মৃতি গুলো মনে পড়ে গেল।
সেই ৭ বছর আগে ঠিক এমনি করে ও
বলেছিল..
"আইস্ক্রিম খাব সুবন। শোনো আইস্ক্রিম
কিন্তু একটা আনবা দুটো এনে টাকা
নষ্ট করার দরকার নেই।
.
আচ্ছা ফাযিল মেয়ে তো তুমি বসে
বসে আইস্ক্রিম খাবা আর আমি কি
আঙ্গুল চুষব। এই কথাটা বলার ইচ্ছে হলো
কিন্তু বলি নি কারন কিছু বললেই এখন
ছাগলের মত ম্যা ম্যা করে কাদঁতে
থাকবে। আইস্ক্রিম এনে ওকে দিলাম।
ও প্যাকেট টা খুলে যেভাবে খাওয়া
শুরু করল। সত্যি বলতে কি আমারো
জিবে রস আসতে লাগল। এটা কোন
ধরনের বেয়াদবী একটা জলজ্যান্ত
মানুষ বসে আছে চোখে কি দিয়ে
রাখছে।
.
"বাবু তুমি খাবা?
"না তুমি খাও আমি তোমার খাওয়া
দেখি।
"আমি জানি তো বাবু তুমি আইস্ক্রিম
খাও না। কিন্তু বাবু একটু খাও। তুমি
যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ
আমার পেট খারাপ হবে তো।
.
এই মেয়েটা তো আস্ত একটা বদ। কি
বলে এইসব।
.
"কি ব্যাপার আইস্ক্রিম নিয়ে আসো।
টাকাটা ধরো
.
এই সুবন এখনো ফকির হয়ে যায়নি যে
তোমাকে ক্রোন খাওয়াতে পারব
না।
.
"হ্যাঁ নিয়ে আসছি।
.
দুজনেই আইস্ক্রিম খাচ্ছি হঠাত্..
.
"কেমন লাগছে বাবুর আব্বু?
.
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
এই ডাকটা ৭ বছর পর ওর মুখ থেকে
শুনলাম। গা টা শিরশিরি দিয়ে উঠল।
চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করল।
.
"সুবন তুমি চমকিয়ে গিয়েছো তাই না?
হি হি হি আসলে এইভাবেই তো
তোমাকে ডাকতাম। কেন যেন ইচ্ছে
হলো তাই ডেকেছি কিছু মনে করো
নি তো?
.
বাবুকে নিয়ে কত ফাইযলামকি
করতাম। ও মাঝে মাজে ফোন দিয়ে
বলতো..
"এই বাবু কোথায়?
" বাবু তো তোমার কাছে।
"নাতো
" এটা কেমন কথা একটু বাসায় খুজেঁ
দেখো।
"পাচ্ছি নাতো
"কি করো বাসায়? একটা মাত্র
ছেলেকে দেখে রাখতে পারো না।
ওর কিছু হলে আজকে তোমার খবর আছে
বলে দিলাম।
"ছেলে তো বাবার মত দুষ্টু ওকে
ম্যানেজ করা এত কষ্ট আমি পারছি
না।
.
আমি হাসতাম এমন ভাবে কথা বলতাম
যেন আমরা সত্যিই বাবুর বাবা মা
হয়ে গিয়েছি।
.
"ওই দেখো তোমার ছেলে খাটের
নিচে ঢুকে বসে আছে। ওই ফাযিল
বাবার ফাযিল ছেলে বের হ ওখান
থেকে।
"ওই আমার ছেলেকে কিছু করবা না।
না হলে তোমায় আদর করব না। হা হা
হা
"বাবু তোর বাবাকে বলে দাও ওনার
আদর আমার দরকার নেই। হি হি হি
"ফাযিল মেয়ে
"কি আমি ফাযিল? বাবু তোর
বাবাকে বলে দে আজকে কপালে
ভাত নেই।
.
যদিও আমারা বিয়ে করি নি। আগে
থেকেই স্বামী স্রীরা কিভাবে
অভিমান করত তা নিয়ে ঝগড়া করতাম।
.
"আমি জানি আমার বাবুর আম্মু
আমাকে কখনো না খাইয়ে রাখে না।
যতই রাগ করুক।
"রাতেই টের পাবা। আজ থেকে
আলাদা খাট আলাদা রুম।
"আমি যে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমাতে
পারি না। তোমার আদর ছাড়া আমার
ঘুমই আসে না।
"যতই পাম দাও কিছুই হবে না।
.
কি বলব আমি? কেন এই সাতটা বছর পর
আমার সামনে হাজির হয়েছো?
আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? তোমার
কষ্ট দিতে ভাল লাগে তাই না? কি
করেছি আমি? যার কারনে আমার
বাহুডোর ছেড়ে অন্যের বাহুডোরে
চলে গিয়েছো? না থাক এই কথা গুলা
বলার দরকার নেই।
.
"না আমি কিছু মনে করি নি।
"একবার বাবুর আম্মু বলে ডাকবা? ৭টা
বছর যে তোমার মুখে বাবুর আম্মু
ডাকটা শুনি নি।
.
আমার চোখের অশ্রু আর ধরে রাখতে
পারলাম না। আমি কাদঁতে থাকলাম।
আফসানা আমার চোখের পানি মুছে
দিল। ওর দিকে তাকালাম দেখলাম
ওর চোখের কোনে পানি জমে
গিয়েছে। পরিস্হিতি স্বাভাবিক
করার জন্য হাসি দিয়ে বললাম।
"এত ধুলো এখানে চোখে কি যেন
পড়েছে তাই পানি গড়িয়ে পড়ল।
"বিয়ে করেছো সুবন?
.
এর উওর কি দিব আমি? কিছু বলার
দরকার নেই। ওরে বললাম চলো
তোমাকে কাচ্চি খাওয়াই।
.
"সুবন উওরটা পাই নি
"না। তবে শিগ্রই করব।
.
একদিন ও আমায় রাতে ফোন করে
বলল..
.
"সুবন তোমার সাথে আমার কিছু কথা
আছে।
"কি বলো।
"আমি জানি না কেমন করে বলব।
"কি হয়েছে আমাদের ছেলে
ঝালাতন করছে?
"না তা না। আর আমার এখন ফান করার
মুড নেই।
.
কথাটা ও খুব অসস্হিকর ভাবে বলল।
বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে।
.
"কি ব্যাপার কোন সমস্যা?
"না সেটা না।
.
খানিক্ষন ও নিরবতা পালন করে বলল..
.
"আমায় ভুলে যাও।
"মানে এসব কি বলছো তুমি?
"দেখো আমি কৈফিয়ত দিতে পারব
না। ভুলে যেতে বলছি ভুলে যাবা।
.
ওকে আমি অনেক বার ফোন করলাম।
দেখাও করলাম কিন্তু কিছুই বলে নি।
ওকে আমি একটি বারো জিজ্ঞেস
করি নি কেন ভুলে যাব? আর যদি
ভুলেই যাব তাহলে এতদিন প্রেম করলা
কেন? একটা কথাও জিজ্ঞেস করি নি।
শুধু এটুকুই জিজ্ঞেস করলাম কোন
সমস্যা? ও চুপ করে ছিল। আমি ঠিকি
কয়েক দিন পর বুঝতে পারলাম বাসা
থেকে ওর বাবা বিয়ে ঠিক করেছে।
আমাদের রিলেশনের খবরটা ওর বাবা
মেনে নিতে পারি নি।
কারন আমি তখন বেকার ছিলাম। আর
প্রত্যেক মা বাবারাই তাদের
সন্তানকে একটু সুখে রাখতে চায়।
.
যেদিন ওর বিয়ে সেদিন আমি ঘুমের
ঔষধ খেয়েছিলাম। না মরার জন্য না।
ঐ দিন যেন সারাদিন ঘুমের ঘোরে
থাকি সেই জন্য। কিন্তু হায় কপাল একটু
ঘুম আসে নি ঐদিন।
.
"সুবন তুমি না কাচ্চি খাওয়াবা
বললা ?
"হ্যা চলো।
.
টেবিলে বসে থাকলাম। আমার
খাওয়ার রুচি নেই। আফসানার কাচ্চি
খুবি পছন্দ ছিল। তাই ওকে খাওয়াতে
নিয়ে আসলাম। হঠাত্ ও আমার মুখে
নলা তুলে দিয়ে বলে..
.
"হা করো আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
.
আচ্ছা আফসানা কি এখনো আমায়
ভালোবাসে? আরে দুর
ভালোবাসলে কি আর না
ভালোবাসলেও কি? কিন্তু ওর চোখ
দিয়ে পানি পড়ছে। আমি কি ওর
চোখের পানি মুছে দিব? না থাক
এটা আমার কাজ না।
.
আফসানাদের বাসায় ভাল কিছু
রান্না করলেই ছোট একটা টিফিন
বক্সে করে আমার জন্য খাবার নিয়ে
আসত। আর নিজ হাতে খাইয়ে দিত।
ঠিক আজো আমাকে খাইয়ে দিতে
চাচ্ছে। আমি বললাম..
.
"আফসানা আমি খেতে পারব। আমার
হাত এখনো অকেজো হয় নি। কিছু মনে
করো না। আর চোখের জল টুকু মুছো।
তুমি খাও।
.
দেখতে দেখতে কিভাবে যেন
দিনটা কেটে গেল। প্রায় বিকেল
হয়ে গেল। রেল লাইনের ওপর দিয়ে
হাটছি। আমি যতবার রেল লাইনের
উপরে হেটেছি ওর হাতটা ততক্ষন ধরে
রেখেছি। একটি মুহুর্তের জন্য ছাড়ি
নি। কিন্তু আজ...
.
"সুবন আমায় বাসায় যেতে হবে। আজ
সকালে তোমাকে দেখে আর
নিজকে সামলাতে পারি নি। কেন
যেন মনে হলো তোমার সাথে কথা
বলতেই হবে।
.
কথাটা খুব ইতস্ত করেই বলল আফসানা। ও
ওর ড্রাইবারকে গাড়ি আনার জন্য
ফোন করে। কিছুক্ষন পর সেই কালো
গাড়িটা এসে হাজির হয়।
সেই ৭টা বছরের পুরোনো ব্যাথা আজ
আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
.
"ডাকবা না? শুধু একটা বার ডাকো
বাবুর আম্মু।
.
ওর চেহাড়াটা মলিন হয়ে গেল। আমি
চুপ করে আছি। কালো গাড়িটার
ভিতরে ও ঢুকে গেল। ওর চোখে জল
টলমল করে পড়ছে।
.
"বাবুর আম্মু
.
আমার ডাকটা শুনে আফসানা গাড়ি
থেকে নেমে আমার সামনে এসে
আমার কাধে মাথা রেখে অঝোড়
ধারায় কাদঁতে থাকে। আমিও
কাদঁতে থাকলাম। তারপর ও আবার
চলে যায় গাড়িতে। যাওয়ার সময়
আবার চোখের পানি মুছে দিল।
.
ওর গাড়িটা চলে যাচ্ছে। আস্তে
আস্তে দৃশ্যটা ঝাপসা হতে লাগল।
কেন এলে তুমি? কেন? কেন? চিত্কার
করে কাদঁতে কাদঁতে গাইতে
থাকলাম...
.
যেখানে স্বর্গ ভাসে তোমার আমার
আকাশ সেখানে
অন্য রঙে
আকাঁ আয়নায় মৃত জলছবি
সেই ছবিতে অন্ধ কবি আমি এক
হাতড়ে ফিরি আলোর সিড়ি।
তোমাকে যখনি চেয়েছি সত্তার
অন্তরালে সংগোপনে
তখনই জেনেছি আলো হয়ে তুমি আমার
আধারে
আর যখন এ ভেবেছি বাধবো সীমাচার
পাশে তোমাকে ঘিরে
তখনই ফেলেছি হারিয়ে তোমাকে
তোমাকে তোমাকে.....