ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। মুহুর্তেই আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, হাত-পা শক্ত হয়ে গেলো, হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে লাগলো। অধিক শোকে পাথর হবার মত অবস্থা হল।
এই অবস্থায় যে কেউ আমাকে দেখে ভাববে, আমি ঘড়িতে কোন বড়সড় আকারের ভূত দেখে ফেলেছি।
বিছানা থেকে দীর্ঘলাফ দিয়ে নামতে গিয়ে উচ্চলাফ দিয়ে ফেললাম আর অমনি পা মচকে গেল।
ফোনের স্ক্রিন অন করে দেখি ৩৫টা মিসড কল। ঢোক গেলার চেস্টা করেও ব্যর্থ হলাম। শুকনো মুখে ঢোক গেলা সম্ভব না।
হঠাৎ মনে পড়লো, মায়া ৩৬ বার ফোন করেছিল তার মধ্যে একবার ঘুম ঘুম অবস্থায় রিসিভ করে বলেছি, বুয়া, এক কাপ চা দিয়ে যাও।
ঘুমের ঘোরে এমন উল্টাপাল্টা কথা মানুষ বলেই থাকে। কিন্তু মায়াকে আজ হয়ত সেটা বোঝানো যাবে না। আজ নির্ঘাত মারা পড়বো। বাঁচার সম্ভাবনা জিরো পারসেন্ট।
তাড়াতাড়ি করে রেডি হতে গিয়ে লুঙ্গির ওপরই প্যান্ট পড়ে ফেললাম। এক বোতল পানি আর ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম।
বেশ শক্তসামর্থ্য একজন রিকশাওয়ালা খুঁজে বের করলাম। রিকশায় চেপে বসে চাচাকে জোরে জোরে প্যাডেল চালাতে বললাম। উনি গম্ভীর ভাবে বললেন, 'ভাতিজা, এটা তো হাওয়াই জাহাজ না যে উইড়া উইড়া যাইব।'
অতঃপর, নির্ধারিত সময়ের ঠিক ১ ঘণ্টা পরে কাঙ্খিত গন্ত্যবে উপস্থিত হলাম।
মায়া আমার দিকে রক্তবর্ণ মুখে তাকিয়ে আছে। মেকআপ না করেও যখন মেয়েরা গাল লাল করতে পারে তখন শুধু শুধু টাকাপয়সা খরচ করার দরকারটা কি?
আজ নির্ঘাত পটল তুলব। ক্যালেন্ডারে ডেটটা নোট করে রাখতে হবে। একবছর পর আমার মৃত্যু বার্ষিকী।
আমি প্রায় লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম।
রিকশা ভাড়া দিয়ে মায়ার দিয়ে তাকিয়ে অসহায়ের মত মুখ করে বললাম, মায়া, আজ না রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল।
আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা চাচা বললেন, "কি কও ভাতিজা! রাস্তা তো পুরা ফকফকা, জ্যাম পাইলা কই?" একথা বলেই তিনি তার ৩২টা দাঁত কেলিয়ে হাসতে শুরু করলেন। ভাবটা এমন যেন তিনি এইচ.এস.সি-তে গোল্ডেন পেয়েছেন আর আমি ফেল করেছি বলে আমাকে দেখে দাঁত ক্যালাচ্ছেন।
আমি চাচার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম, চাচা, ভাড়া তো পাইছেন, এখন দয়া করে বিদেয় হন।
আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা চাচার মুখ থেকে গোল্ডেন পাওয়া টাইপ হাসিটা মিলিয়ে গেল। তিনি তার ধবধবে ৩২টা দাঁত মুখে গুঁজানোর চেস্টা করছেন কিন্তু প্রতিবারই ৪টা দাঁত অবাধ্যের মত বের হয়ে থাকছে।
আমি মায়ার দিয়ে মায়া নিয়ে তাকালাম কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হল বলে মনে হল না। ছেলেদের চেহারার এই এক দোষ, রাগ ছাড়া অন্য কোনকিছুই ঠিকভাবে খাপ খায় না।
মায়া মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার পরনে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি, হাতে নীল চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা নীল টিপ। প্রথম যখন মায়ার সাথে আমার
পরিচয় হয় তখনও ও ঠিক এই সাঁজে আমার সামনে এসেছিল। সেইদিন আর আজকের এই দিন, মাঝে পেড়িয়ে গেছে কয়েকটা বছর। সবকিছু ঠিক আগের মতই আছে
কিন্তু কি যেন একটা নেই। থাক, কিছু রহস্য চাপা পরেই থাক। সবকিছু জানতে হবে এমন স্বভাব আমার অতীতেও ছিল না আর বর্তমানেও নেই।
আমি মাথা নিচু করে অপরাধীর মত বললাম,'সরি, এর পরেরবার থেকে আর দেরি হবে না। আই সোয়্যার।
- এমন কথা বলা তোমার অনেক পুরনো অভ্যাস এটা কি তুমি জানো, কবির?
- ও, তাই নাকি! আচ্ছা, এই কানে ধরছি, আর এমন হবে না।
মায়া হাসছে। মায়াবী মুখের হাসি পবিত্র হয়। বাতাশে তার চুল উড়ছে। কিছু দুষ্ট প্রকৃতির চুল মায়ার মুখের সামনে এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
আমি হাত বাড়িয়ে চুলগুলো সরাতে গিয়ে আবার হাত ফিরিয়ে নিলাম।
মায়া লজ্জায় মুখ নিচু করলো।
পুকুরপাড়ে বসে আছি আমরা দুজন। দুজনই নীরব। আমি মায়ার মুখের ভাষা পড়ার চেস্টা করছি।
- নূপুর এনেছো??
- হু...
- দাও।
- আমি পরিয়ে দেই??
- না।
- এই অধিকারটুকুও কি আমি হারিয়ে ফেলেছি??
- আমাকে যেতে হবে।
- এত তাড়াতাড়ি চলে যাবা??
- একটু পর ফ্লাইট। আর দেরি করা সম্ভব না।
- মায়া, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
- বলো।
- কথা দাও, সত্যি বলবা।
- দিলাম। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি কি না- এই টাইপের কথা জিজ্ঞেস করবা না।
- ঠিক আছে।
- হুম, বলো, কি জানতে চাও?
- তুমি কি আমাকে ছাড়া সুখে আছো??
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আবার নীরবতা, নীরব আমরা দুজন। পুকুর পাড়ের পরিবেশও আমাদের নীরবতার সঙ্গী।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মায়া বললো,"হুম, অনেক সুখে আছি আমি। তোমাকে ছাড়া অনেক সুখে আছি। আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ। আমাকে অনেক ভালোবাসেন।"
কথাগুলো বলতে গিয়ে মায়ার কণ্ঠ জড়িয়ে গেল। নিষ্পাপ মুখে মিথ্যা কথা মানায় না। তাই খুব সহজেই ধরা পরে যায়।
আমি বিষন্নমুখে মায়ার দিকে তাকালাম, সে চোখ-মুখ আড়াল করে রেখেছে।
- কিন্তু আমি যে সুখে নেই, মায়া। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টা প্রতিটা মুহুর্তেই রক্তে ভিজে ওঠে।
- সবকিছুর জন্য তুমিই দায়ী।
- আমি দায়ী??
- হু, মনে পরে সেদিনের কথা? আমার কাছ থেকে কথা নিয়েছিলে?
- হুম, মনে আছে। মায়া, আমাকে কথা দিয়েছিলে বলেই কি তুমি তোমার মায়ের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছো??
-হুম। কেন তুমি আমার সাথে এমন করেছিলে,বলো? কি দোষ ছিল আমার ??
- পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছিল।
- ভালো, এখন তো সব দোষ পরিস্থিতির। তুমি যদি আমাকে সুখী দেখতে চাও তবে আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেস্টা করবে না। আমাকে ভুলে যাও।
- তোমার স্মৃতিগুলো আমার মস্তিষ্কের এক অনৈচ্ছিক পেশিতে জমা হয়ে আছে। আমি চাইলেও সেগুলো মুছে ফেলতে পারবো না...।
আমার কথাগুলো শেষ না হতেই মায়া উঠে চলে গেল।
আমি পুকুরপাড়ে বসে আছি, একা। মায়া যে জায়গাটায় বসেছিল, সে জায়গাটায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রোদের আলোয় চিকচিক করছে।
আমি বুকের বাঁপাশে হাত রাখলাম। মনে হল, জায়গাটা আবার ভিজে উঠেছে।