মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৯৭- নকশী ভালবাসা -তাহসিনা ফেরদৌস শান্তা

গভীর রাতেও গাড়ি চলাচলের বিরাম নেই। আমার বাসাটা হাইওয়ের পাশেই, তাই রাতের ঘুমটা প্রায়শ ডিস্টার্ব হয়। গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় স্ট্রিটলাইট জ্বলে। তারপর একসময় কে বা কারা নিভিয়ে দেয়, জানি না। এই মুহূর্তে সড়কবাতি আলো ছড়াচ্ছে, তার কিয়দংশ জানালার কাচ ভেদ করে ঢুকছে আমার ঘরে, এক রুপবতীর শরীরে ঢলে ঢলে পড়ছে। দু' হাতের উপর মাথা রেখে একপাশ ফিরে চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কোন হুশ নেই যেন, প্রাণহীনের মত ঘুমুচ্ছে। ওর জীবনটা যেমন প্রাণহীন, ঘুমটাও। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েদের নাকি রুপবতী দেখায়, কিন্তু আমার সেরকম মনে হচ্ছে না। বরং ওর বুজে রাখা চোখে এক ধরণের অতৃপ্তি, মুখাবয়বটা অসহায়। কানিজকে আমি বিয়ে করেছি প্রায় এক বছর সাড়ে চার মাস হবে। কিন্তু আজ অবধি ওর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি আমার। সামিয়াকে ভালবাসতাম অনেক, তাই ও বেঈমানের মত চলে গেলেও ওর স্মৃতি আমার ভেতরটা জুড়ে মাকড়সার জালের মত বাসা বেধেছে। কানিজ সেই জালগুলো নিজ হাতে ছিঁড়ে ফেলতে চায়, আমাকে সব ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তবুও আমি দূরে থাকি, যতটা দূরে থাকলে ওর আমাকে অচেনা মনে হয়, ততটা। স্টার প্লাসের নাটকের মত, নিচে মাদুর পেতে ওকে শুতে হয় নি, আমার বিশাল বিছানার এক কোণায় ও চুপচাপ শুয়ে থাকে। নড়াচড়াও করে কিনা সন্দেহ আছে। রান্নাবান্না করে, ঘরদোর ঝাড় দেয়, আমার সব কাজে সাহায্য করে, এইতো, এটাই ওর জীবন হয়ে গেছে। কিন্তু আমিও তো কখনও জানতে চাইনি, কতটা কষ্ট পাচ্ছে ও ভেতরে ভেতরে। আমার বালিশটা টেনে ওর কাছাকাছি নিয়ে গেলাম। এক হাতের উপর মাথা রেখে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। এক গুচ্ছ চুল ওর বাম চোখ আড়াল করে বুকের ভাজে হারিয়ে গেছে। চোখদুটো কাঁপছে, মনে হয় স্বপ্ন দেখছে বেচারী। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলাম। চুলগুলো কানের ভাজে গুঁজে দিলাম। ও খুব স্পর্শকাতর, এটা আমার জানা ছিল না। আস্তে আস্তে চোখ মেলল ও, আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কি বলব বুঝে উঠতে পারলাম না, আর এই বোধটাই যেন আমার মাঝে অপরাধবোধ জাগিয়ে দিল। এভাবেই কিছু মুহূর্ত কেটে গেল, দুজনই চুপচাপ। নীরবতাটাও ভাঙতে ইচ্ছা হচ্ছে না, ওর নিঃশ্বাসের শব্দও পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। মেয়েটা ঘুম ঘুম চোখে একরাশ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমি কিছু বলব ভেবে। খুক করে কাশি দিয়ে বলার প্রস্তুতি নিলাম।
'কানিজ!'
'হু?'
'আজ.......মানে আজ, গরুর কিমা দিয়ে মুগডালটা দারুণ ছিল।'
এটুকু বলেই আমি চুপ মেরে গেলাম। আমি জানি, যতটা আগ্রহ নিয়ে ও তাকিয়ে ছিল, ততটা আগ্রহ এই সামান্য কথাটার জন্য নয়। বুকের গভীরতর কোনও কোণ থেকে ঝড়ো বাতাসের মত দীর্ঘশ্বাস এল আমার, কানিজের চুলগুলো এক মুহূর্তের জন্য আন্দোলিত হয়ে আবার শান্ত হয়ে গেল। ওপাশে ফিরলাম আমি, ওদিকের দেয়ালে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে অদ্ভুত সুন্দর নকশা। জানালার গ্রীলের ফাঁকেফাঁকে নারিকেলের ডাল দুলছে, আর নকশাটা নড়ছে। আমার অবয়বের গভীর কাল ছায়াটা মিশমিশে হয়ে আছে দেয়ালে। কানিজ এক হাতে জড়িয়ে ধরে রাখল আমাকে, বাধা দিলাম না আমি। বরং ওর আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে দিলাম। তাকিয়ে রইলাম সেই অদ্ভুতুড়ে নকশার দিকে। স্পন্দন নিয়ে পড়ে থাকা এক ছেলের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এক মায়াবতী!