লেখকঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা
বললেই ছোটবেলায় গা ছমছম করত। সন্ধ্যেবেলায় ভূতের কথা উঠলেই মা ঠাকুমা বলতেন – ভয়কীরে! রাম নাম কর ভুত পালিয়ে যাব। দিদি বলত ভয় পেলেই জোরে জোরে বলবি- ভূত আমার পুত। পেত্নি আমার ঝি। তোরা আমার কী করবি, কী করবি কী! দেখবি সব পালাচ্ছে পড়ি মড়ি করে পালাচ্ছে। কিন্তু বর্ষার রাতে, শীতের অন্ধকারে ঘরের মধ্যে আলো নিভে গেল যেন ডাকাতে পারতুম না। কেন যেন গিলতে আছে। যেন ইয়া মুখ ইয়া নখ ইয়া চোখ এমনি পা এমনি হাত এমনি দাঁত । এমননি করতে করতেই বড়ো হলুম । লেখপড়ার জগতে চলেগেলুম। দেখি কেউ র ভূতের কথা বলছে না। বলতে যেন কারও সময়ই নে। দেখলুম, লোকে ভুতের গল্প লিখছে। পড়ে আনন্দ পাচ্ছি না।
কিন্তু এই কদিন হল 'সংবাদ' দৈনিকে নানা স্থানের খবরে ভুতের কথা শুনছি।
ভূতের গল্প নায় গ্রাম বাসীদের ওপর ভূতের উপদ্রবের কথা। ঠিক কথানয় নাকি সত্যিকারের ঘটনা। বর্ধমান জেলার কাটোয়া দাইহটা, কালনা, কেতুগ্রম এবং বীরভূম জেলার অজয় নদীতীরবর্তী অসংখ্যা অঞ্চলে নাকি আবছা অন্ধকারে পথচারীদের নানাভাবে অত্যাচার করছে ভূত – কাউকে কমড়ে দিচ্ছে কাউকে খামচে দিচ্ছে কাউকে কিল ঘুশি মারছে। কাকে ফেলে দিচ্ছে মাটিতে। এ নিয়ে লোকে রাতে বুঝতে পারছে না। এত অসহ্য গরমেও জানালা কপাট এমনকি ঘূলঘুলি পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে । একদিন নাকি নলহাটটিতে রিমোট ভূতের গাড়ি আটকেছিল গ্রামবাসীরা তাই স্থানে স্থানে পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ কর্তা, বুদ্ধিজীবীরা টহল দিচ্ছে। আর আমি বর্ধমান শহরে বসে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছি না। মনের মধে বিবিধ ভূতের নানা কথা ভেসে আসছে। মনে টোল খাচ্ছে নানা কাহীনি- সন্ধ্যা হয়েছে । মেঘ করেছে। বিদ্যুৎ খেলছে। দু এক ফোটা পড়ছে । আমরা কজন স্কুলে ঘরে গল্পে মত্ত। হঠাৎ কানে এল রাম- রাম- রাম- রাম- রাম- রাম, তারপরই বু- বু--বু- বু -উ-উ-। একটা ধপাস শব্দ। যেন কিছু পড়ে গেল। হ্যারিকেন নিয়ে আমরা ছুটে গেলুম । আরে মানুদা যে ! এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে গল্প শুনছিল। কখন এসেছে টের পাইনি। আমরা ওকে তুলে আনলুম। জলের ঝাপটা দিলুম। জ্ঞান ফিরতে বললেন, বিপাস্যা ভূত! পেচ্ছাব গেছি । যেই দাঁড়িয়েছি, আমনি গলাটায় ধরেছে। বরফের মতো ঠান্ডা হাত। লোহার মত শক্ত । বলেই গলাটায় হাত বুলোতে লাগলেন মানুদা। দেখ তো গলাটা। হ্যারিকেন আলোয় আলোয় ভালো করে দেখলুম। না কিছু না । মানুদা বললেন, নাঃ কিছু না বললেই হয়। গলাটা কাঠ হয়ে গেছে। এই হলো 'ভূত' । বাংলার গ্রামগুলো এখনও এমনি ভুতের ভয়ে অস্থির। এখনও তেমনি চারি দিকে কুসংস্কার, অলৌকিক বিশ্বাস, অশরীরী আত্মার প্রতি আতঙ্ক । সেই আদিম ভয়, আদিম ভাবনা। এই একুশ শতকের শেষ দিকেও গ্রামের মানুষ খুব একটা পালটায়নি। ভূতপ্রেত, দত্তিদানো, সন্ন্যাসী , কুদরা, ডাইনি এখনও তাদের মন থেকে উবে যায়নি । ওরা জানে, ভূত ডরডসায়( ভয় খাওয়ায়) । ভূত মটকে দেয় ঘাড়। বাঁকুড়ার বনকটির বুনো ওঝা সারেং বললেনঃ ইটা লিখা-পড়ার দিন বাবু । কিন্তুক সে জন্য লোকে ভূত মানছে না, তা লয়। ইখন সোব বনবাদাড় নষ্ট হইছে, বড়ো বড়ো গাছ লোকে কাটো ফেলেছে. এরোপেলেন টেরেন মটর দমতক ছুটছে, ভূতগুলান থাকবার আর জায়গা পাচ্ছে নাই। দলে দলে কামরুপ কামিখ্যায় চলি যাচ্ছে। একবার কামিখ্যায় মায়ের সেবায় গেছি। দেখি আমাদের চেনা ভূতগলান প্যাঁ প্যাঁ করি সরাই গেলি। আমি বললুম, তা ভূত কোথায় থাকে। অমনি ওঝার ফটাফট উত্তর, শ্মাশানে, শ্মাশানে তো থাকেই ডুংরিদাড়াং তড়াগড়ায় থাকে। ঝোপেঝাপে, বনেজঙ্গলে থাকে, নদীর গাবায় থাকে। পুকুরের মালজাটে থাকে, বাঁশবনে থাকে, তেঁতুল, বট, অশন্থ গাছে থাকে, শওড়া গাছে থাকে, আর সোব বড়ো বড়ো গাছে থাকে।
পাশেই বসেছিলেন সারেং এর চেলা দাশাই ওঝা। আমি হাসছি দেখে বলেন, তা যদি অতই অবিশ্বাম একবার ভররেতে মরাগাবায় যাবেন না। অমাবস্যার কালসন্ধ্যায়ই- পাড়ের তেঁতুলগাছে এক পা তো উপারের তেঁতুলগাছে আর এক পা। পুন্নিমের সন্ধ্যায় ধপধপা কাপড় পরে উনি ঘুরে বেড়াবে । মুখ দেখতে পাবেন না । পা দেখতে পাবেন না। আর যেই না এগোবেন অমিন খপ কর ডান হাতটায় ধরে বলবেন, কি রে বাপ! আমি চিৎ পটাং। প্রসঙ্গে পালটে বললুম, কী করে জন্মায় ওরা? বিজ্ঞের মতো হাত নেড়ে দাশায় বললেন, সে কী আর চাট্রিখানি কথা বাবু। নে ঢের কহানি । মানুষ অপঘাতে মরেছে ভূত হয়েছে। তবে সে ই ভূতগুলোন তেজি হয় যার মানুষটা মরেছে গলায় দড়ি নিয়ে। সবচেয়ে পাজি ভূত হয় যদি পুয়াতি বউ মরে। সে আর স্বামীটাকে ঘর করতেই দেয় না। নতুন বিয়ে করলেই উৎপাত করে। স্বামীর জ্বর হলে আর রক্ষা নাই কখন তাকে মারে, কখন একটু ফাঁক পায় ও সময় স্বামীর বিছানা ছেড়েছ কী সর্বনাশ হয়েছে । ঠুলকুসার বিমল দাদার মা তো দোজবরে পড়েছিল। তা বিমলদার বাপের একটু সর্দি কী কাশি হলেই ওর মা স্বামীর গায়ে হত্যা দিয় দিত। তাও পারল নাই। অকালেই স্বমীটাকেই হারাল। বললুম, যে কোনো মানুষই কি ভূত হয়। মাথা চুলকোতে চুলকোতে দাশাই বললেনঃ তা হয় বইকি। তবে মানুষ মরলেই ঘরের যত দরজা, জানালা খুলে দিতে হয়। ভুত তাহলে পালাতে পথ পায়। তুলসী তলায় যায়। তারপর মড়া তুলসী তলাঢ এনে হরিনাম করলে পালায় । আর আসে না। তবে ঘাট কামান, শ্রাদ্ধশান্তি না করলে আরও বিপদ। সে দুয়ার ছড়বেক নাই । আজ গোরু মরেছে। কাল বাছুর মরেছে। পরশু মদুন পড়ছে। সাতাবেক।
মনে মনে ভাবছি, দারুণ তো । ভূতেদের জন্ম ঠিকুজি যেন সব ওঁর হাতে। মায় স্বভাবটি পর্যন্ত। আমাকে অন্যমনস্ক দেখে দাঁশাই বললেন, কি বিশ্বাস হচ্ছে নাই? তাহলে দুটা পরমাণ দিই। বলেই গড়গড় করে বলতে লাগলেন। বাগান দিয়ে জরুরী কাজে যাচ্ছে। ঝড় বাতাস কুচ্ছুটি নাই । হঠাৎ গাছের ডালটা দুলদুলাই উঠল। মড়াৎ করে ভঙ্গে পড়ল আপনার সামনে। কী করে ভাঙ্গল? ই শালা ভূতের কাজ। রাত অনেক। সাড়াশব্দ নাই। গাছপাত লড়ে নাই। হঠাৎ আপনার দরজা, জানালা খুলে গেল। আবার দড়াম দড়াম করে বন্ধও হল। কী করে হল? - ই শালা ভূতের কাজ। কত লোকের গুয়ালের গোরু, বাছুরের পাঘা খুলে দিয়েছে । কত লোকের মোষের পিঠি চড়ে রাতভর ঘুরে বেড়াইছে। আর শুনবেন পৌষমাসে পিঠা পরব । কী কালীপূজায় গুড়াপিঠার পরব। পিঠা লুকাই রাখেন। অমনি রাতের বেলায় ই -ভাড়ে ঠুকাঠুকি । পিঠা ছুড়াছুড়ি। সকালে উঠে দেখবেন ভাড়ের পিঠা ঘরময় পড়ে আছো । গুণে গুণে রাখবেন। দেখবেন, ই ভাড়ে চারটা কম, তো উ ভাড়ে আটাটা কম। দেখছি, ওঝা যেন খুব খুশী। মুখটা ওর ক্রমশ যেন উজ্জ্বল হচ্ছে। উনি বললেন, চৌধুরীদের বাগানে একটা কুদরা থাকত। কী করে একবার খেপে গেল। পরদিন চৌধুরীদের বৈঠকখানা, রান্নাঘর, খাবার ঘরে আর ঢোকা যায় না। চারদিকেই পায়খানা। গন্ধে আঁত বেরিয়ে আসে। আমি অবাক হয়ে শুনছি দেখে, দাঁশাই -এর মুখে যেন গল্পের বন্যা এল। বললেন, এই তো সেদিন। ভাদর মাস। চরচর্যা ময়রার ছেলাটা অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। উয়ার বন্ধুর বেশে উটা আস্যে উকে ডাকে লিয়ে গেল তাল কুড়াতে। সকালে পুকুর যায়ে ময়রা দেখে ছানাটা মরে পড়ে আছে। এখনও বুড়াটা হুকাঁরে কাঁদে । আর যারা গলায় দড়ি নেয়, গলাস্যা ভূত তাদের ডাকে । কেউ টের পায় না। বনের ভিতর নিয়ে গিয়ে তামাশা করে। ফাঁসকী লাগায় সুখ শিখায়। লোকটা সানন্দেই ঝুলে পড়ে। আর নামতে হয় না। পুকুরের মাঝে থাকে মালজাট কাঠ। আমি কৌতুহলি হয়ে ভুতেদের নাম জানতে চাইলুম । উনি আরম্ভ করলেন -কত যে ভূত, তা কেউ বলতে পারে নাই। আমি কিছু জানি। শাকচুন্নি , নিশি, ছড়াকিনি ,খুবড়ি, পেচাঁশি, সনসনী, বামনী , তালবাঁশি কুদরা, পুসকেরা, পুসপুষা, শাবড়া, থুবড়া, কলথুয়ানা, বরমা, বিপস্যা ,সাড়াশ্যা গলাস্যা, শারজাট্যা, বেম্মদত্তি, স্কান্দকাটা, গোমুয়া।...নাম আর শেষ হচ্ছে না দেখে আমি বললুম, শুনেছি, মেয়েদের ওপরে নাকি....বলতে বলতেই এবার সারেং ওঝা উত্তর দিলেন, থুবড়া ভূত যুয়ান মেয়্যাদের উপর ভর করে। (ঝতুকাল) পালো ভূত ছাড়ানাই দায়। রাঁঢ়ী হলে কথাই নাই। যে গাছে থাকে, তার তলা দিয়ে মেয়্যাদের যাবার যো নাই । এজন্যিই মেয়ারা কুথাও গেলে লুয়া রাখে, বুকে থু থু দেই, মাথায় কাঁটা গুঁজে, কোমরে মাছজালের কাঁঠি পরে। দেখেন না, পুকুর পাড়ে কাপড় রাখলেই থু থু দিতে হয়। বুড়কিন ভূতও পাজি। মেয়্যার বেশে এসে ছকরাদের ডাকে । বরমভূত আরও পাজি । মেয়্যাদের সঙ্গে সহবাস করে।
শুনতে শনেত হঠাৎ থুবড়া আর বরম ভূতের কথা মনে এল। বললাম, অধিকাংশ ভূতইতো সর্বনাশ করে। ওদের তাড়ানো যায় না? এবার এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরগলায় সারেং বললেন, সব কথা বলতে নাইবাবু । মা কমিখ্যার দিব্যি আছে। অনেক পীড়াপীড়িতে ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন- ভূতের সবচেয়ে ভয় 'সরষেপড়া'কে । চৌহদ্দি বেধে সরষেপড়া দিলেই ওদের কী লাফালাফি, বাপ রে বাপ । কী উৎপাত -ই না করে । তাকে ঝাঁটা মেরে, লঙ্কার ধুয় দিয়ে, কান মুলিয়ে তবে ছাড়ে। তবে সাধারণত ভূত হলুদের গন্ধ, গুইয়া, বাবলা ছালের গন্ধ, মাদালপাতা, জালের কাঠিতেই পালায়। না পালালেই ঝাড়ফুক। তখন পালাবেই। তবে সব ওঝা পারে না।
যতই শুনছি, অবাক হচ্ছি ততই। আমরা কোথায় আছি! ওঝার শক্তপোক্ত কী রকম ব্যাখ্যা! এখন মানুষ চাঁদের মাটি আনছে, বজ্রবিদ্যুৎ ধরে রাখছে। টিভি, ভিডিও, অনুবীক্ষণ, দূরবীক্ষণ চন্দ্র- সূর্য-গ্রহ-তরার গতি মাপার যন্ত্র কী ন বের করছে মানুষ। আর আমরা গ্রামের দরিদ্র নিরক্ষর শ্রমজীবীরা, আমরা অনেকজনই এখনও বাঁশ বনের ভূতের ভয় এড়াতে পারছি না। রাতের অন্ধকারে অস্থির হচ্ছি পেছনে কে যেন আসছে। এই ধরল, এই ধরল। চারিধিকে এত আবিস্কার অথচ এদিকে ওঝাদের এখনও রমরমা বাজার । এখনও শেকড়বাকড় ঝাড়ফুঁক, তুকতাক মন্তর মনান্তর আউড়ে ওরা আমাদের অনেকের ঘাড়ে আরামসে চেপে আছে। এ ভুত কে নামাবে ? দিকে দিকে আজ বিজ্ঞানমঞ্চ, বিচিত্র গবেষণাগার, তুখোড় রাজনেতিক সভা, বুদ্ধিজীবীদের দাপাদাপি, সমাজতন্ত্রের উন্নত মাশুল, প্রশাসনিক উৎকর্ষ, শিক্ষার্থীদের মিছল- কিন্তু কেউ কি তাড়াতে পারছে এই সংস্কারপ্রসূত ভূতকে ? নাকি সেই সব কথিত ভূতই এখন ভোল পাল্টে সমাজের আনট- কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে ?