আট বছরের ছেলে মন্টি। বায়না ধরে বসে আছে ভূত দেখাতে হবে। একটামাত্র ছেলে। যা চেয়েছে তা এবং যা চায়নি তাও পেয়ে তার অভ্যেস। সুতরাং ভূত দেখতে চাওয়াটা তার জন্য অন্যায় আবদার না। তবে হঠাৎ করে সে কেন যে এমন একটা ভয়ানক আবদার করে বসল এ নিয়ে পিতা-মাতার চিন্তার শেষ নেই। এদিকে মন্টি শ্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছে, ”এক কথা এক দাবী-ভূত দেখাতে কবে যাবি।”
তার পিতা-মাতা তার কোনো আবদারই অপূর্ণ রাখে নি। সে যখন যা চেয়েছে তাই এনে দিয়েছে। কিন্তু এবারকার আবদারটা এতই বেতাল ধরনের যে ইচ্ছা করলেই তার এ দাবি মেটানো যায় না। তার মা-বাবা উভয়েই একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেল। শত হোক সন্তানের আবদার!
মন্টির আর তর সয় না। উঠতে-বসতে, লিখতে-পড়তে ভূত দেখার বায়না। ভূত না দেখা পর্যন্ত সে শান্তি পাচ্ছে না। ভূত দেখাতেই হবে তাকে।
মন্টির মা-বাবা দুজনে এখানে-সেখানে ফিসফাস করে শলাপরামর্শ করে। কিন্তু কোনো কিনারা করতে পারে না। ভূতের নাম শুনলে যেখানে গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায়, কলজে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, সারা গতর থত্থর করে কাঁপে সেখানে ছেলেকে কীভাবে ভূত দেখানো যায় এ নিয়ে মেলা টেনশন ওদের। একটামাত্র আদরের ধন, তার ইচ্ছাটুকু অপূর্ণইবা রাখে কী করে?
এদিকে ভূত দেখার বায়না ধরে মন্টি গাল ফুলিয়ে পাল বানিয়ে বসে আছে। খাওয়া-দাওয়া, পড়া-লেখায় মন বসছে না মোটেও। শত যুক্তি-তর্ক করে বহুভাবে ভয় দেখিয়েও তাকে বিরত করা যায়নি। ভূত দেখবেই সে। নানা ভঙ্গিতে ভয় দেখিয়ে কাজের কাজ কিছুই হলো না বরং তার ভূত দেখার আগ্রহটা আরো বেড়ে গেল। মন্টির সাহস দেখে সবাই অবাক! আট বছরের ছেলে!
অন্ধকার রাত। মন্টির বাবা মন্টিকে বলল, তাড়াতাড়ি রেডি হও, এক্ষুনি ভূত দেখতে যাব।
মন্টি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, বাবা, ”কী পরে যেতে হবে? সাথে কী কী নিতে হবে? আর ভূতটা যদি কিছু খেতে চায় তাহলে তাকে কোন খাবারটা দিলে খুশি হবে বাবা? এসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত পিতা পরনের লুঙ্গিটা টাইড করতে করতে বলল, ওসব কিছুই লাগবে না। চট করে দেখে চলে আসব, রেডি হও।
মন্টি পুরনো হাফপেন্টটা বদলালো। নতুন সু পরল। ডিজাইন করা শার্টটা পরল। সে নির্ভয়ে বাবার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অন্ধকার উঠোনে পা রেখেই বাবার হাত টেনে বলল, ”বাবা, টর্চ লাইট নেবে না? এত অন্ধকারে যাবে কী করে?”
বাবা বললেন, দরকার নেই। কোনো আলোতে ভূত আসে না। অন্ধকারেই যেতে হবে, চলো। বাবার হাত ধরে চলছে মন্টি।
একটু সামনে গিয়ে মন্টি আস্তে করে বলছে, বাবা কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?
শ্মশানঘাটে।
মন্টি একটু থমকে গিয়ে বাবার হাতটা জোরে চেপে ধরে বলল, শ্মশানঘাটে কেন বাবা!
তুমি বুঝতেছ না কেন বাবা, তোমাকে দেখা দেয়ার জন্য তো ভূত উঠোন বাড়িতে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে না, ওকে দেখতে হলে পরে শ্মশানঘাটেই যেতে হবে। জোরে হাঁটো।
মন্টির চলার গতি কমে এলো। বাবা বলল, এত আস্তে হাঁটছ কেন সোনা, তাড়াতাড়ি চলো না। মন্টি হাতটা চেপে ধরে বলল, বাবা আমার একটু একটু ভয় করছে।
বাবা বলল, ভয় যখন করছে, মনে হয় আমরা শ্মশানঘাটের কাছাকাছি এসে গেছি। একটু পরেই ভূতের দেখা পাব।
মন্টি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, বাবা আম্মু তো ঘরে একলা, ভীষণ ভয় পাবে। চলো বাড়ি চলে যাই।
বাবা বলল, সে খুব ভয় পাক গে। ও নিয়ে তোমাকে চিন্তা করা লাগবে না। চলো আমরা আগে ভূত দেখে নিই।
মন্টি নিজের ভয় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েও রক্ষা পেল না। বাবা তার হাতটা চেপে ধরে শ্মশানঘাটের কাছে চলে এলো এবং একটা উঁচু ডিবির ওপর গিয়ে চুপ করে বসে পড়ল।
চিনাদী বিলের পাড়ে শ্মশানঘাট। এ ঘাটের অতি পরিচিত পোড়খাওয়া দেবদারু গাছটা, অতি প্রাচীন মন্দিরের ভাঙাচোড়া দেয়ালটি মন্টির কাছে বিশাল দৈত্যের মত মনে হতে লাগল। মন্টি তার বাবার দু’হাঁটুর মাঝখানে আশ্রয় নিয়ে নানান ভয়ানক সব কল্পনা করছে। তার বাবা টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। অন্ধকারে দুটি প্রাণী শ্মশানঘাটের পাশে একটা উঁচু ডিবিতে চুপ করে বসে আছে। একজনের সাথে আরেক জনের কথা হচেছ না; হাত চেপে, সাবধানে নড়ে-চড়ে, ফিসফিসিয়ে, আকার ঈঙ্গিতে, গরম নিশ্বাসে দু‘জনের ভাব বিনিময় হচ্ছে।
মন্টি হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে ফিসফিস করে বলল, বাবা দেখো, দেখো, ঐ যে ভূতটা এসে গেছে, কেমন দৌড়াদৌড়ি করছে, আমাকে দেখে ফেলল না তো আবার!!
মন্টির বাবা তাকিয়ে দেখলেন, সামনে একটা ক্ষুধার্ত শেয়াল খাবারের সন্ধানে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। বাবা বলল, কই, আমি তো কোনো ভূত-টুত দেখছি না রে!
মন্টি বলল, আরে, তুমি ভালো করে দেখো ত বাবা। ওই যে দেখো কেমন কুচকুচে কালো ভূত! ইয়া বড় দাঁত, তিনটা চোখ, একটা চোখ ট্যারা করে আমার দিকে কেমন তাকিয়ে আছে! ঐ যে মাথাটা কত বড় আর মাথার তিন পাশে লম্বামতন তিনটা মোটা শিং, আঙ্গুলে চিকন মত নখ, লম্বা লোম, ভয়ংকর পেট! বাবা এখন দেখতে পাচ্ছ তুমি?
তার বাবা ছেলের কথায় প্রথমে অবাক হয়ে এবং পরে মুচকি হেসে বলল, অ, তাই তো! বিরাট বড়ো ভূত! এখন কি তাহলে ভূতের সাথে কথা-টথা বলবে তুমি?
মন্টি আস্তে করে বলল, না বাবা, অন্যদিন এসে কথা বলব। এখন চলো সোজা বাড়ি চলে যাই। যা দেখার আমি দেখে ফেলেছি। ভয়ংকর ভূত!
দুজন দর্শক। একজন দেখল শেয়াল, আরেকজন দেখল ভূত। বাড়ি গিয়ে গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে মুখে কিছু না দিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।
মন্টির ভূত দেখার ঘটনাটি পাড়াময় জানাজানি হয়ে গেল। পরের দিন ছোটো-বড়ো ও তার সমবয়সীরা দল বেধে চলে এলো মন্টিদের বাড়ি। ভূত দেখার কথা শুনার জন্য উপুড় হয়ে পড়ল সবাই। তারা কৌতূহল ও ভয় মিশিয়ে নানান প্রশ্ন করতেই মন্টি একনাগাড়ে ভূতের চেহারা চরিত্রের ভয়ংকর সব বর্ণনা দিয়ে যেতে লাগল। সবাই অবাক হয়ে শুনছে আর শুকনো মুখে ঢোক গিলছে। নিজ চোখে ভূত দেখার বর্ণনা! সবাই সবিষ্ময়ে বিশ্বাস করল তার কথা। মন্টির ভূত দেখার গল্প শাখা-প্রশাখা মেলে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
ভূতের কথা বুঝি আর ফুরাতে চায়! যে-ই আসে সে-ই শুনতে চায় সামনা-সামনি দেখা ভূতের বর্ণনা। ভূতের অদ্ভুত গতর, ভয়ংকর চেহারা-চরিত্র, বেশামাল চলাফেরা আর খানাপিনা এমনি নানান কাহিনী বিচিত্রভাবে অনর্গল বলে যাচ্ছে মন্টি। একটা বিশাল ভক্ত-শ্রোতা টিম গড়ে উঠেছে তার।
মন্টির মুখে ভূতের এসব বৃত্তান্ত শুনে ও শ্রোতা-ভক্তের আনাগোনা দেখে মন্টির বাবা অবাক হয়ে মনে মনে বলছে, এভাবেই বুঝি যুগে যুগে মানব মনের কল্পনার রাজ্যে দাপটে বসবাস করে ভূতেরা!
ছেলের মুখে ভূতের আজগুবি কাহিনী শুনে তার বাবা বড় আবেগ-আহ্লাদে মন্টির মাকে ডেকে বলল, মন্টির মা, তোমার এ পোলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আর কোন চিন্তা করি না আমি। এ ‘গপ্পবাজ‘ পোলা ঠেকবে না কোথাও। তার ভবিষ্যৎ খুব পরিষ্কার।
মন্টির মা অভিমানে গাল ফুলিয়ে বলল, গপ্পবাজ হতে যাবে কোন দুঃখে, পোলা আমার বড় লেখক হবে। মায়ের মুখে ছেলের এমন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা শুনে মন্টির বাবার মুখটা আনন্দে চিকচিক করে উঠল