মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৮- অপূর্ণতা --রওনক ইসলাম

শায়নার সাথে সম্পর্ক বৈধ করার কাজটা সহজ ছিল না। অনেক বেশি আকাঙ্ক্ষার বস্তুগুলো সহজে পাওয়া যায় না কখনো। ধৈর্য্য ধরতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। বুকে পাথর বেধে অনেক ইচ্ছা-স্পৃহা বলি দিতে হয় নিজ হাতে।

আমাদের পরিচয়টা হয়েছিল ভায়োলিন ক্লাসে। সংগীতের প্রতি কমবেশি ঝোঁক থাকলেও বাদ্য বাজনার দিকে আগ্রহ আমার বরাবরই কম ছিল। ভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই একদিন স্কটিশ সিম্ফোনি শুনে ভায়োলিনের প্রতি আগ্রহ জাগে। হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াই ভায়োলিন শেখার পাঠশালা। গন্তব্য মেলে অনেক দিন পরে এসে। ততদিনে ভার্সিটি জীবন প্রায় শেষ।

যার কাছে শিখতে যেতাম, তার নাম সৌমিত্র আচার্য্য। আমরা ডাকতাম গুরুজি বলে। গুরুজি ছিলেন পাগলা কিসিমের মানুষ। তার জীবনের একমাত্র আফসোস ছিল অন্ধ হয়ে না জন্মানো। জন্মগত অন্ধ হলে নাকি সুরগুলো আরও গভীর থেকে অনুভব করা যায়। পাকধরা সাদা চুলে হাত বুলোতে বুলোতেই তার বেহালাটা নাড়তেন তিনি। আমরা গুণমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গুরুজির সবথেকে প্রিয় আর পুরনো ছাত্রী ছিল শায়না। মেয়েটার গায়ের রং কালো। কিন্তু সবসময়ই ডায়মন্ডের মতো আলোক বিচ্ছুরণ করতে থাকে চারপাশে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চোখ। চোখ দুটো দুরকম, কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। প্রথম দেখাতেই মেয়েটার প্রতি ভেতর থেকে একধরণের সম্মান চলে আসে। সেটা যতটা না তার বাহ্যিক রূপ দেখে, তারচেয়ে বেশি তার ব্যক্তিত্বের কারণে। এমন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মেয়ে আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। দেখিইনি বলা যায়।

তার অসম্ভব মিষ্টি একটা গানের গলা ছিল। আমার বন্ধু শুনলে বলত, “মনে হয় পানি দিয়ে গুলে খেয়ে ফেলি।” গুরুজির তোলা গম্ভীর সুরগুলোর সাথে তাল দিয়ে সে রাগ-বিরাগের গান গাইত। ওই সময়টুকু ঘরের ভেতরের প্রতিটি নর-নারী নিস্তব্ধ হয়ে যেত। মাঝে মধ্যে সম্মানে আমি উঠে দাড়াতে চাইতাম, লোক-লজ্জার ভয়ে পারতাম না।

একদিন ক্লাস শেষে মনে হল শায়নার সাথে কথা বলা উচিত। আমি যখন এগিয়ে গেলাম, সে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। সামনে দাড়িয়ে আমাকে ইতি-উতি করতে দেখে হালকা ভাবে হেসে ফেলল শায়না।

“কিছু বলবেন, দীপ্ত?”

আমি চুপ করে থাকি। কোনটা রেখে কোনটা বলি?

বললাম, “আপনি খুব সুন্দর বাজান। ছোট বেলা থেকেই বাজাচ্ছেন বুঝি?”

শায়নার মুখে ঠোটের কোণে সুক্ষ্ণ হাসিটা লেগেই আছে। সে বলে, “মোটামুটি ছোটই বলা যায়। এই ধরেন পাঁচ বছর বয়স থেকে।”

“বাপরে বাপ। আমি তো এখানে এসেই প্রথম হাত দিয়ে ভায়োলিন ধরলাম।"

“হঠাৎ এই বয়সে এসে ইচ্ছে হল যে?”

মাথা নাড়ি আমি। “কি জানি কেন। দেখা যাক কতদিন ইচ্ছে থাকে।” চুপ হয়ে যাই। আমাকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে শায়না বলে, “আর কিছু বলবেন?” তার জিনিসপত্র গোছানো শেষ।

“আপনার গানের গলাও সুন্দর, শুধু...”

“শুধু?”

“শুধু আপনি সবসময় কঠিন কঠিন গান ধরেন। সবই মাইনর স্কেলে। মেজর স্কেলের মিষ্টি কোন গান আপনার কণ্ঠে বেশি ভাল মানাত।”

এবার শব্দ করে হেসে ওঠে শায়না। এবারের হাসিটা একটু দীর্ঘমেয়াদি ছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর সে হাসি থামিয়ে বলে, “ঠিক আছে, আপনাকে শোনাব একদিন। আজ উঠি, দেরি হয়ে গেছে। নাকি আরও কিছু বলবেন?”

চোখের ব্যাপারটা বলা ঠিক হবে কি না ভেবে দেখলাম। পরে মনে হল আজ না বলাই ভাল। “আজকে না, যেদিন গান শোনাবেন সেদিন বলব।”

আস্তে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ে শায়না। ইচ্ছে হল বলি, চলুন না, বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। বলে লাভ নেই। তার গাড়ি আছে। আর আমি যাব বাসে। উল্টো সে-ই আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলে আলাদা কথা।

এরপর থেকে শায়নার সাথে অল্পবিস্তর আলাপ হত। কখনো ভায়োলিন ক্লাসের আগে নিচের চত্বরে দাড়িয়ে, আবার কখনো ক্লাসের শেষে। তাকে আমি যত দেখি, ততই মুগ্ধ হই। যদিও সে বাইরে দিয়ে প্রকাশ করে না, তবু বুঝতে পারি তার মনের ভেতরের চাপা কষ্টটা। তার সাথে দু:খের আলাপ হত না তেমন একটা। সবই সহজ স্বাভাবিক কথাবার্তা। ভায়োলিন সম্পর্কেও তার কাছে জ্ঞান নিচ্ছিলাম আমি। শেখার চেষ্টা করছিলাম। দু’তিনদিন এ বিষয়ে তার সাথে কথা বলেই বুঝে গেলাম, জিনিসটা আমার জন্য না। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভায়োলিন শিক্ষায় ক্ষান্ত দেয়ার সময় এসেছে।

শেষবারের মত শায়নার সাথে দেখা করতে গেলাম। আজও জিনিসপত্র গোছাচ্ছিল সে। আমাকে সামনে গিয়ে দাড়াতে দেখে বলল, “কি খবর, মিস্টার দীপ্ত?” ঠোটের কোণায় সেই রহস্যময় হাসি।

আমি ঠোট উল্টাই। “ক্লাস ছেড়ে দিচ্ছি। আজকেই শেষ।”

শায়নাকে একটু আহত মনে হল। কপাল কুঁচকে সে জিজ্ঞেস করে, “কেন?”

আমি মাথা নাড়তে থাকি। “আমার দ্বারা হবে না। অনেক আবেগ, অনেক অনুভূতি দরকার। আমার মধ্যে ছিটে ফোটাও নেই।”

মাথা ঝাঁকাল শায়না। “তা ঠিক বলেছেন। শুধু হাত দিয়ে তার নাড়লেই হয় না। সুরটা হৃদয়ের গভীর থেকে আসতে হয়। সে যাই হোক,” ব্যাগের ডালা বন্ধ করতে করতে বলল সে, “ভালভাবে চেষ্টা না করেই ছেড়ে দেবেন?”

আমি ভাবুক দৃষ্টিতে শূন্যে তাকাই। “যদি কোনদিন মনে হয় যথেষ্ট আবেগ জড়ো করতে পেরেছি, সেদিন আবার শিখতে আসব। থাকুন, যাই।” ঘুরে চলে আসতে থাকি। কেন জানি মনে হতে থাকে খুব আপন কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি। শায়না পেছন থেকে ডাক দেয়। “দীপ্ত শুনুন।” ঘুরে তাকালাম। শায়না এগিয়ে এসে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আমার হাতে।

“আমার কন্টাক্ট নম্বর আর ঠিকানা আছে এখানে। আপনি আমার গান শুনতে চেয়েছিলেন না? সময় পেলে একদিন ফোন দিয়ে বাড়িতে চলে আসবেন, কেমন?” সে হেটে গিয়ে গাড়িতে উঠতে থাকে। আমার মনটা কেন জানি ভাল হয়ে যায়। শায়না গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাসল। ঠোটের কোণে এখনো লেগে আছে সেই রহস্যময় হাসি।

বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ এক বিকেলে রওনা দিলাম শায়নাদের বাড়ির দিকে। ধানমন্ডির ওদের বাড়িটার সামনে এসে তব্দা খেয়ে গেলাম। বিশাল আকৃতির বাগান বাড়ি। দারোয়ান ঢুকতে দিচ্ছিল না। শায়না গেট পর্যন্ত এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে আমার আরও চক্ষু চড়কগাছ। ছোট দোতলা পাকা বাড়িটাকে কেন্দ্র করে চারপাশে নানান রকম ফুল-ফল গাছের সমাহার। বৃষ্টি হয়ে জায়গাটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। আমাকে অবাক হয়ে চারপাশ দেখতে দেখে হাসল শায়না।

“আমার দাদার তৈরি বাড়ি। দাদা খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন।”

শায়নার শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের কারণ কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারলাম। তার বাড়ির পরিবেশটাই অন্যরকম। ড্রয়িংরুম ভর্তি তৈলচিত্র, বিখ্যাত সব শিল্পীদের আঁকা। বই উপচে পড়া একটা লাইব্রেরি, যা দেখেই আমার মধ্যে একটা পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়ে গেল। সবশেষে শায়না আমাকে নিয়ে এলো ওদের সংগীতচর্চার ঘরে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে ওখানে। এই পরিবেশে বেড়ে ওঠার পর শিল্পীমনা না হবার কোন কারণ দেখি না আমি। একটু ঘুরে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, “ড্রামস কে বাজায়?”

শায়না হেসে উঠল একটু। “আমার ছোট ভাই।” আমার বিস্ময় রত দৃষ্টি দেখে সে যোগ করে দেয়, “আজকালকার যুগের ছেলে তো!...গান পরে হবে। চলুন, আগে চা খাবেন।”

ঘুরে ঘুরে আবারো বাগানে ফেরত আসি। বাগানে শায়নার বাবার সাথে দেখা হল। ভদ্রলোক চমৎকার। ভারিক্কি চালে মজার মজার কথা বলেন। আমাকে দেখে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “তোমাদের দেখলেই মনে হয়, ওই বয়সে আমরাও কত রকম চুলের স্টাইল করেছি...”, আমি আর শায়না দুজনেই হেসে ফেলি। চায়ে প্রতিবার চুমুক দিতেই ভেতরটা শান্তিতে ভরে যাচ্ছিল। শায়নার বাবা বললেন, “এক নম্বর বাংলাদেশী চা। বিদেশের ছিটেফোঁটাও নেই। এগুলোই বরং এক্সপোর্ট হয়ে বিদেশে যায়। আমাকে অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে।” আরও অনেক কথা হল শায়নার বাবার সাথে। শায়নার ভেতর শৈল্পিকতার বীজটা যে তিনিই বপন করে দিয়েছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চা শেষ করে এসে সংগীতঘরে ঢুকি। আমি আর শায়না। বাইরে যদিও পড়ন্ত বিকেল, ভেতরে তা বোঝার উপায় নেই।

“বাইরে গিয়ে গাইলেই তো হয়।” বললাম আমি। “এ ঘরে তো আলো বাতাসের আকাল।”

“আপনি বসুন, আমি ব্যবস্থা করছি।” বলে শায়না বড় পর্দাগুলো টেনে সরিয়ে কাঁচ সরাতেই ঝুপ করে আলো এসে পড়ে ঘরের ভেতর। শেষ বিকেলের সোনালি আলো। গাছ পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সে আলো ঘরের আনাচে কানাচে প্রবেশ করে। শায়নার মসৃণ চকচকে কালো রংয়ের ভায়োলিনটার ওপর পড়ে সে আলো অন্যরকম একটা দ্যুতি ছড়ায়।

জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে শায়না বলে, “এবার বলুন, কি গান শুনতে চান? আধুনিক?”

“নাহ,” মাথা নাড়লাম, “আপনি বরং একটা দেশাত্মবোধক গান শোনান। আপনার গলায় ভাল মানাবে।”

শায়না হেসে তার কালো ভায়োলিনটা হাতে তুলে নেয়। কেন জানি তার হাতে ওটা খুব ভাল মানিয়ে যায়। মনে হয় যেন তার আত্মার সাথে মিশে গেল। শায়না দু’চোখ বন্ধ করে কপাল কুঁচকে ফেলে। মনে হয় মনের ভেতরের আবেগ দিয়ে নাড়তে চায় প্রতিটি তার। সে বেহালার সুর তুলে, কড়া অথচ মিষ্টি। মনে হল যেন দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে। সেই তীক্ষ্ণ সুরের মাঝেই সে মিষ্টি গলায় গেয়ে ওঠে,

ধন-ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা,

তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা।

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা,

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি,

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।

শায়না পুরোটা গাইল। আমি শুনলাম। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। মিনিট দশেকের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। অন্য কোনও জগতের ভিন্ন কোনও মাত্রায়। গান শেষ করে চোখ মুছতে থাকে শায়না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কাঁদছেন কেন?” চোখ মুছতে মুছতেই হাসল সে, “অনেক বেশি অনুভূতির নাম আবেগ। সেই আবেগটাও যখন বেশি হয়ে যায়, চোখ দিযে অশ্রু ঝরে তখন” আমার তখনো ঘোর লেগে আছে। শায়না চোখ মুছে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি সেদিন আরও কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। আজ বলুন।”

ঘোরের মধ্যে ছিলাম। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না, বলে ফেললাম, “তোমার চোখজোড়া খুব সুন্দর। অনেক বেশি সুন্দর।”

শায়নাকে খুব বেশি অবাক মনে হল না, অবাক হলেও সে নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়েছে। তার যে ব্যক্তিত্ব, তাতে এতটুকু আশা করাই যায়। বেহালাটা নামিয়ে রেখে সে বলল, “আরেক কাপ চা খাবে?”

আমি মাথা নাড়লাম। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে হবে এ বাড়ি থেকে। নইলে কিছু একটা উল্টোপাল্টা করে বসব শেষে। দ্রুত হেটে বিদায় জানিয়ে চলে আসতে থাকি। গেট দিয়ে বের হবার পর হঠাৎ খেয়াল হল ব্যাপারটা।

শায়না আমাকে তুমি করে ডেকেছিল। তারমানে আমার কথাটাকে গুরুত্বহীনভাবে দেখনি সে। আমি ঘুরে তাকালাম, দোতলার ছাদে হাল্কা সান্ধ্য আলোয় শায়নার অবয়বটা বোঝা গেল। ঠোটের কোণে সেই রহস্যময় হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছিল সে।

আমরা জড়িয়ে গেলাম, একসাথে। যদিও মুখ দিয়ে কেউ একবারও উচ্চারণ করলাম না। করার প্রয়োজন ছিল না আসলে। আমরা একজন আরেকজনকে গভীরভাবে বুঝতে শিখেছিলাম। আমার ছোট ছোট বিষয়গুলো শায়না যেমন খেয়াল রাখছিল, আমিও তেমনি তার শিল্পচর্চার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছিলাম। শায়না ভাল ছাত্রী ছিল। ডিপার্টমেন্টে সেকেন্ড। তার এবং তার পরিবারের উচ্চাশা ছিল তাকে ঘিরে, যথেষ্ট পরিমাণ বেশি। এই একটা ব্যাপার শায়নাকে অবাক করত সবচেয়ে বেশি।

“আমার রেজাল্ট খারাপ হলে কি তুমি কষ্ট পাবে?”

মনোযোগ দিয়ে বাদাম ছিলতে ছিলতে বললাম, “তুমি কষ্ট পেলে আমি পাব। তুমি না পেলে আমি পাব না।”

শায়না বুঝতে পারে না। “মানে?”

বাদাম রেখে তার চোখে চোখ রেখে তাকাই। “তুমি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তোমার রেজাল্ট না।”

আমাকে পেয়ে অনেক বেশি খুশি ছিল সে। যদিও আর আট দশটা ছেলেবন্ধুর মত গিফটের পসরা সাজিয়ে বসতে পারতাম না ওর সামনে। পড়ালেখার প্রতি আমার উদাসীনতা দেখে অবাক হত সে খুব। বলত, “তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভয় হয় না?”

“হয়। ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাবার ভয় হয়।”

হাসল শায়না। “হা হা হা। ভবিষ্যৎ আবার হারায় কি করে?”

আমিও হাসলাম। “যদি ভবিষ্যৎ এমন মায়ামায়া নজর নিয়ে সামনে বসে থাকে, হারানোর ভয় তো থাকেই।”

জোরে জোরে হেসে ওঠার কথা ছিল শায়নার। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সে কেঁদে ওঠে। আমি তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলে সে কাঁদতে থাকে আর মাথা নাড়তে থাকে। বলে, “আমাকে এত ভাল বেসো না দীপ্ত। আমি সহ্য করতে পারি না।”

আর বাদবাকি যুগলদের সাথে আমাদের পার্থক্য ছিল, আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইছিলাম। শায়না আর আমি দুজনেই। বিয়ে ব্যাপারটা সম্পর্ককে মজবুত করে। আর আমারতো আছেই হারিয়ে ফেলার ভয়। দৃষ্টির আড়াল হতেই বুকে কাঁপুনি শুরু হয়ে যায়। প্রতিবার শায়নার সাথে দেখা হবার সময় মনে হয়, এরপর আর যদি দেখা না হয়!

শায়নার সাথে সম্পর্ক বৈধ করার কাজটা সহজ ছিল না মোটেই। একদিকে শায়নার পরিবার, যারা আরও উচ্চবংশীয় ছেলের প্রত্যাশা করে; অন্যদিকে আমার পরিবার, যারা লম্বা আর ফর্সা মেয়ে খোঁজে। শায়না সবসময় তার হাসির আড়ালে যে কষ্টটা লুকিয়ে রাখত, আমি কিছুটা হলেও বোধহয় বুঝতে পারতাম। বাহ্যিকভাবে জগতের যতগুলো অপূর্ণতা সম্ভব, সবগুলো দিয়েই যেন সৃষ্টিকর্তা শায়নাকে সৃষ্টি করেছিলেন। সমাজ আর মানুষ এই অপূর্ণতাগুলোকে খুব বেশি ফলাও করে দেখে। সাধারণ সামাজিকতা বজায় রাখার জন্য হলেও মানুষ তাই অপূর্ণতাগুলো থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়। আমার পরিবারও এর ব্যতিক্রম নয়।

শায়নাকে দেখে বাবা-মা শুরুতেই না করে দিলেন, আমাকে পড়াশোনায় আরও মনযোগী হতে বললেন এবং কাজকর্মে উদাসীন হবার কারণে যথেষ্ট পরিমাণ তিরস্কার করলেন। এরচেয়ে বেশি আমি আশাও করিনি অবশ্য। ফর্সা মেয়ের এক-দুইটা গুণ থাকলেই সেটাকে ঢালাওভাবে প্রচার-প্রসার করা হয়, কালো মেয়ে হলে ব্যাপারটা হয় উল্টো। বাবার কথা মতে, “হোক ভাল ছাত্রী। সমাজে সম্মান বলে একটা কথা আছে না?”

ওদের বাড়িতেও এ ধরণেরই একটা কিছু হল। পুরোপুরি বিস্তারিত আমাকে শায়না জানাল না, শুধু বলল, “সময় লাগবে। তোমার?”

আমি বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “আমারও সময় লাগবে।”

শায়নাকে একটু ওলট পালট মনে হয়। ও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ যেন তার আত্মবিশ্বাসের দেয়ালে চিড় ধরিয়েছে।

“দীপ্ত, আমরা ভুল করছি না তো?”

“মানে?” আমার হাত থেকে ঝালমুড়ির ঠোঙাটা পড়ে যায়।

শায়না আস্তে আস্তে বলে, “যদি এমন হয়, আমরা একজন আরেকজনের জন্য না, তখন? যদি আমরা ভুলের পথে পা বাড়াই, তখন কি হবে? আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎের কি হবে?”

আমি মাথা নাড়ি। আমার মধ্যে কোথা থেকে জানি চরম আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠে। “তোমার কিছু অপূর্ণতা রয়েছে, তুমি স্বীকার করো।”

সে মুখে কিছু বলে না, শুধুমাত্র আস্তে মাথা ঝাঁকায়।

আমি বলে চললাম, “আমিও স্বীকার করি আমার কিছু অপূর্ণতা আছে। পৃথিবীর কোনও মানুষই পূর্ণ নয়, সবার অপূর্ণতা আছে।” তার কাঁধ ধরে আমার দিকে ফেরালাম। “তোমার অপূর্ণতাগুলো পূরণ করার জন্যই আমাকে সৃষ্টিকর্তা তৈরি করেছেন। আর আমার গুলো পূরণ করবে তুমি।”

শায়না হাসি-কান্না কোনকিছুর ধার দিয়ে যায় না। এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন আমার সাথে আজ তার প্রথম দেখা।

“তোমাকে আজ নতুন করে চিনলাম দীপ্ত। আফসোস, চিনতে দেরি করে ফেলেছি। আরও আগে চেনা উচিত ছিল।”

“উহু।” বাধা দিলাম আমি। “দেরি হয় নি, এখনও সময় আছে।”

ইচ্ছাশক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি। তার নমুনা পেলাম। কি এক অলৌকিক উপায়ে দু-তিনদিনের মধ্যেই আমরা দুজন দুজনের পরিবারকে রাজি করিয়ে ফেললাম। কি করে রাজি করালাম সে গল্প না হয় আরেকদিন বলব। এখন সে গল্প করতে গেলে রম্য রচনা হয়ে যাবে। আর রাজি কিন্তু যেই সেই রাজি না, পাক্কা রাজি। মা যেমন শায়নাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তেমনি আমিও শায়নার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করার অনুমতি পেয়েছিলাম।

বিয়েতে রাজি করানোটা নিয়েই শুধু আমার দুশ্চিন্তা ছিল। পরিবারে শায়নার সাথে মিলেমিশে থাকা নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা ছিল না। একদিনের ভেতরেই শায়না আমার পরিবারের সাথে এত বেশি সহজভাবে মিশতে শুরু করল দেখে দ্বিধা হতেই পারে, মনে হতে পারে অনেকদিনের পরিচয়। শায়নার আরও একটা গুণের পরিচয় পাওয়া বাকি ছিল। বিয়ের তৃতীয় দিনের মাথায় খাবারের প্লেট চাটতে চাটতে সেটাও পেয়ে গেলাম। বাবা চুপিসারে বললেন, “এই মেয়েকে ছেলের বউ না বানালে অনেক কিছু অধরা থেকে যেত।” মা কড়া চোখে তাকাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাবাকে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখে হেসে ফেললেন।


এরপর ছিল শুধু আমাদের একান্তের সময়গুলো। আমি একটু পাগল কিসিমের মানুষ। শায়না আমার মত পাগল কিংবা চঞ্চল না, খুবই শান্ত আর ভদ্র মেয়ে। তবে মানতেই হবে, আমার ছোট বড় পাগলামিগুলোকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিত সে। মধ্যরাতে ওকে ঘুম থেকে তুলে এনে জোছনা দেখাতাম। আমার ঘরের জানালা দিয়ে ভরা জোছনা এসে পড়ে পূর্ণিমার রাতগুলোতে। ঘুম ঘুম চোখ কচলে শায়না আমার সাথে বসে বসে সেই জোছনা দেখত। আমাদের ভালবাসার রাতগুলো অনেক গভীর ছিল। একজন আরেকজনের ওপর মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকতাম। কোন্ ফাকে রাতের সময়গুলো পার হয়ে যেত টেরই পেতাম না। এমনই এক গভীর ভালবাসাময় মুহূর্তে হঠাৎ করেই আমরা একজন আরেকজনকে প্রতিজ্ঞা করে বসলাম- কেউ কাউকে ছেড়ে কোনদিন যাব না। হালকা আলোয় শায়নার সুন্দর গোল চোখদুটো জ্বলজ্বল করতে দেখি আমি। সে চোখের ভাষা স্বরলিপির মতই স্পষ্ট ছিল। সেখানে ছিল প্রতিজ্ঞা পালনের দৃঢ়তা, ছিল প্রতিজ্ঞা পালনের প্রতিজ্ঞা।

স্কুলজীবন থেকেই প্রতিজ্ঞা করে আসছি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে জীবনের প্রতিক্ষেত্রে...আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকব। কত হাজার বার সকালের সমাবেশে দাড়িয়ে এই প্রতিজ্ঞা করেছি। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার ওস্তাদ ছিলাম আমরা একেকজন। শায়না কে দেয়া জীবনদর্শনের প্রতিজ্ঞা যে আমি রাখতে পারব না শেষ পর্যন্ত, সেই ভয়ানক ব্যাপারটা জোর করে মাথা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতাম। ভয়গুলো চাপা দিতে চেষ্টা করতাম। যেন ভুলে শায়নার সামনে প্রকাশ পেয়ে না যায়। আবার মনে মনে প্রশ্ন জাগত, যদি শায়না তার প্রতিজ্ঞা রাখতে না পারে? তার কি ভয় হয় না?


প্রশ্নের উত্তর পাবার সময় চলে এলো যখন কানাডিয়ান এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষার প্রস্তাব এলো শায়নার জন্য। প্রথমে শুনে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম- “তুমি তো আর যাচ্ছ না।” শায়নার স্থির দৃষ্টি দেখে আমি থমকে যাই। তার সারাজীবনের কষ্ট আর স্বপ্ন পূরণের পথে কি শেষ পর্যন্ত আমিই বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলাম? শায়না বলল, “আমার সাথে পরিবার নিয়ে যাবার সুযোগ আছে। স্বামী বা সন্তান যদি থাকে। তুমিও যাবে আমার সাথে।”

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। বলে কি মেয়ে? অনেক কষ্টে চাকরি পারমানেন্ট করেছি কি ছেড়ে চলে যাবার জন্য? তাছাড়া এখানে বাবা-মা-ভাই-বোন সব আছে, তাদের ফেলে কি করে যাই?

শায়না তর্ক করল অনেক। “মাত্র চার বছর। চারবছরে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না নিশ্চয়?”

আমি শুনলাম না ওর কথা। গো ধরে বসে রইলাম “আমি যাব না” বলে। ধীরে ধীরে ওর যাবার সময় এগিয়ে আসতে থাকল। ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের মাঝে আর কথা হত না। শায়না আমাকে প্রথম দিনের পর আর বোঝানোর চেষ্টা করে নি। ও ওইরকম মেয়ে না, সে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমার অকারণ জেদ ভাঙাতে জোরাজুরি করার মত মানুষ না। বাবা-মা মাঝেমধ্যে বলার চেষ্টা করল, “চলে যা। আবার চলে আসিস।” আমার আরও জেদ চেপে গেল। প্রশ্নই আসে না যাবার।

শায়নার ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসছিল। যে রাতে ওর ফ্লাইট, সে রাতেও আমার বিশ্বাস ছিল, শায়না যাবে না। আমি ওকে সুন্দর মত সুটকেস গোছাতে দেখলাম। পাসপোর্ট, টিকেটগুলো ব্যাগে ভরতে দেখলাম, আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করতে দেখলাম। আর কিছু যখন সে করার পেল না, তখন আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ভাবছিলাম হয়তো সে আমাকে অনুরোধ করবে আরও একবার। সে তা করল না। ভাবছিলাম, হয়তো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কাঁধ ভিজিয়ে ফেলবে, সে তাও করল না। আমাকে অবাক করে দিয়ে নিচু হয়ে সে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করল। আর বলল, “আমার জন্য দোয়া কোরো।”

যাহ বাবা! এ কেমন মেয়ে? আমার রাগ উঠে গেলেও কিছু বললাম না। ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতেও গেলাম না। বাবা-মা-ছোটবোন সবাই গেল, শুধু আমিই গেলাম না। কেন জানি বিশ্বাস ছিল, ফিরে আসবে। আমাকে ছেড়ে এতদূর গিয়ে শায়না থাকতে পারবে না।

ঘড়ির কাটা টিকটিক করতে করতে যখন ওর ফ্লাইটের সময়ে স্থির হল- তখন তাজ্জব এক অনুভূতি হল। কেমন জানি একটা অনুভূতি। তবুও আমার বিশ্বাস ছিল শায়নার ওপর। হয়তো দেখব কাল সিনেমার মত পেছন থেকে এসে বলবে, “আবার ঘড়ি ফেলে রেখে এসেছ? তুমি শুধরালে না।”

হয় না। বাস্তব জীবন সিনেমা-নাটকের মত ওরকম হয় না। বাস্তব ভয়ানক রকমের কঠিন। আমি সাতদিনের মত শায়নার জন্য অপেক্ষা করলাম। ভাবছিলাম একরাত আমাকে ছাড়া ঘুমোলেই ওর আক্কেল হয়ে যাবে, ফিরে আসবে তখন। এক সপ্তাহ পর যখন চেতনা ফিরে আসে, তখন জ্ঞান হল- আমরা দুজনেই দুজনকে করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফেলেছি। কেউই প্রতিজ্ঞা রাখার কোনও চেষ্টা করিনি। শায়নাকে এরপর কবে দেখতে পাব, আমার কোনও ধারণা ছিল না। চারবছর, বা তার বেশিও হতে পারে। এত কিছুর মাঝেও কেন জানি একবারও মনে হল না- একবার ওকে অনুরোধ করি, তোমাকে ছাড়া টিকতে পারছি না, ফিরে এসো। আমি জানি সে কি বলবে। বলবে, এখনো সময় আছে, তুমি চলে এসো। একেই বুঝি বলে কম্প্লিকেটেড রিলেশনশীপ।


নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। চাকরি বাকরি আর অতিরিক্ত পড়াশোনা করে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। এই ব্যস্ত রাখার সুফল হিসেবেই কি করে জানি আমেরিকাতে আমার একটা স্কলারশীপ হয়ে গেল, এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শায়নার ওপর অভিমান থেকেই কি না কে জানে, এবার আমি ঠিকই সুড়সুড় করে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমালাম। বাবা-মা চেঁচালেন খুব, বললেন, “কানাডা যা, মেয়েটা একা একা আছে।” আমি কারও কোনও কথা শুনলাম না। অভিমান খুব খারাপ জিনিস। অভিমানী মন কোনও যুক্তি মানতে চায় না। কাউকে কোনও ঠিকানা না দিয়ে আমি চলে গেলাম। বাসার মানুষের সাথে যোগাযোগ হত ইন্টারনেটে ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে। কেউ আমার ঠিকানা জানতো না। আমি চাইতাম শায়না যেন আমার খোঁজ করলেও আমাকে খুঁজে না পায়।

গভীর দু:খ কিংবা তীব্র অভিমান যাই হোক না কেন- কিছু একটা আমাকে আর ফিরতে দিল না। আমি পড়ে রইলাম লিংকন-ওয়াশিংটনের দেশে। পার হয়ে যেতে থাকল বছরের পর বছর। এক বসন্তের পর আরেক বসন্ত আসে। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে না। চেষ্টা করতাম ভায়োলিনের মিউজিক নাইগুলোতে অ্যাটেন্ড করতে। মনের বেজায় দু:খ কষ্টগুলোকে চেষ্টা করতাম বেহালার সুরের মাঝে ধুয়ে ফেলে দিতে।

আমার কলিগ এলিস হাসাহাসি করত আমাকে নিয়ে, কাঠখোট্টা এই আমি অত বেশি মনোযোগ দিয়ে ভায়োলিন শুনতাম দেখে।

“তোমাকে দেখলে তো মনে হয় না তুমি এতটা আবেগপ্রবণ। কাহিনী কি?” এলিস চোখ টিপে বলে।

আমি মাথা নাড়ি, “তেমন কিছু না, ভায়োলিন শেখার শখ ছিল। শিখতে পারিনি।”

“কেন?” একটু দু:খী কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে এলিস। “পড়াশোনার জন্য?”

“না না।” হেসে উড়িয়ে দিলাম। “আমি কাঠখোট্টা যে, তাই।” এলিস আমার কথা শুনে শব্দ করে হেসে ওঠে।

“তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি কখনো ভেতরে আবেগ অনুভূতি তৈরি হয়...” আমার কথা থমকে যায়। কেন জানি গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতে চায় না। তাই তো! এতদিন ভুলে ছিলাম কি করে? শায়নার সাথে কথোপকথনটা মনে পড়ে যায় হঠাৎ করে।

“...যদি কোনদিন মনে হয় যথেষ্ট আবেগ জড়ো করতে পেরেছি, সেদিন আবার শিখতে আসব।”

আমার মাঝে এখন আবেগের কমতি নেই। বর্ষার টইটুম্বুর খালের মতই আমার মনে প্রাণে আবেগ যেন উপরে পড়ছে। অনেকগুলো অসমাধানকৃত সমীকরণ আর অনেকগুলো মাত্রা বিহীন চলক আমার জীবনটাকে পাক্কা একটা জটিল সংখ্যায় পরিণত করেছে। জটিল সংখ্যা, কাল্পনিক সংখ্যা। এর থেকে ভাল সময় আর কি হতে পারে বেহালার তারে সুর তোলার জন্য? ধীরে ধীরে বুঝতে পারি শায়নার এত ভাল সুর-শিল্পের রহস্য। তার শারীরিক অপূর্ণতার শেলগুলি বিধে বিধে অন্তরে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, সেই ক্ষতগুলোই শায়না তার ভায়োলিনের সুর দিয়ে ভরে দিতে চাইত।

আজ শায়নাকে জড়িয়ে আমার হৃদয়ের গভীরে যে ক্ষত, তা কি আমি বেহালার করুণ সুর দিয়ে ভরতে পারব? কেন জানি মনে হল পারব। সাথে সাথে খোঁজ লাগালাম। দু:খের বিষয় ছিল বছর তিনেক আগেই গুরুজির প্রয়াণটা। শুধুমাত্র ভায়োলিন শেখার জন্য দেশে আর ফিরতে ইচ্ছে হল না। জাঁকিয়ে বসলাম প্রবাসেই।

বাসা থেকে আধ-ব্লক দূরেই একটা স্কুলে শিখতে শুরু করলাম। শুরুর কিছু বেসিক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু এবার আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিল নিজেকে। বাজাতে থাকলাম একের পর এক সুর। দেশ থেকে কত ক্রোশ দূরে বসে ভালবাসার মানুষের হারিয়ে যাবার দু:খে এক তরুণ করুণ করুণ সুর তুলছে, “হেভেন'স মিউজিক একাডেমীতে” এই ঘটনা সাড়া ফেলে দিল। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত আমার সুর শুনতে। আমার তারে হাত বুলানো যতটা না মুগ্ধ করত তাদের, বোধহয় তারচেয়ে বেশি মুগ্ধ করত আমার ঐতিহাসিক পটভূমি। অনেকেই আমার গল্প শুনতে চাইত। আমি কিছু বলতাম না, শুধু বলতাম, “কষ্টের গল্প। মনে করতে চাই না। কষ্ট আরও বাড়ে তখন।”

মিউজিক একাডেমীর দিনগুলোতে একটা ভুল ধারণা আমার ধীরে ধীরে ভাঙতে লাগল, বেহালার সুর দিয়ে যে ক্ষতিপূরণ আমি করতে চেয়েছিলাম, সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। শায়নার জন্য ব্যাকুলতা কমার বদলে দিনদিন বাড়ছিল। কতদিন ওর সুরেলা রিনঝিন গলার গান শোনা হয় না, কতদিন সেই কাজল কালো চোখের দিকে তাকিয়ে ভালবাসি বলা হয় না। দেশে ফিরে শায়নার কাছে ছুটে যাবার এটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হচ্ছিল আমার মাঝে। কেন জানি সেটাকে নিয়ন্ত্রণের কোনও চেষ্টাই করছিলাম না। আমি নিজেকে বুঝতেই পারি না কখনো, অন্য মানুষদের আর কি বুঝব?

এমনি দোটানার মাঝে হঠাৎ একদিন নিজেকে আবিষ্কার করি এয়ারপোর্টে। যে সংক্ষিপ্ত লাগেজ নিয়ে এসেছিলাম, সেই সংক্ষিপ্ত লাগেজ নিয়েই ফেরার জন্য দাড়িয়ে থাকি আমি। কাউকে জানিয়ে আসা হয়নি দেখে একটু মন খারাপ ছিল। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সকল বন্ধু-বান্ধব–কলিগরা এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়। প্রথমেই একচোট গালিগালাজ করে আমাকে, না বলে আসার কারণে, তারপর একগাদা গিফটের বাক্স আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। আমেরিকান মেয়েদের বাঙালিদের মত এত নিয়ম কানুনের বালাই নেই। তারা বিব্রত বোধ না করেই কান্না ভেজা চোখে আমাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে বিদায় জানায়। এই সুদীর্ঘ বারো বছরের পরিচয়ে তারা আমার যথেষ্টই আপন হয়ে গিয়েছিল। মনে মনে ভাবলাম, আমেরিকান সরকার যত খারাপই হোক না কেন, মানুষগুলো ততটা খারাপ না।

দুবাই এয়ারপোর্টে কয়েক ঘণ্টার একটা যাত্রাবিরতি ছিল। খাওয়া দাওয়া সেরে চেয়ারে বসে ছিলাম। কাজকর্ম না পেয়ে কেস থেকে ভায়োলিনটা বের করে বাজাতে থাকলাম। নানান রকম নতুন পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। কতক্ষণ বাজিয়েছি, বলতে পারব না। ঘড়ি দেখার জন্য হাতের দিকে তাকাতেই দেখি ঘড়ি নেই। ভুলে ফেলে এসেছি তারমানে। এই একটা ভুল বোধহয় কোনদিন শুধরাবে না আমার। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

“আবার ঘড়ি ফেলে রেখে এসেছ? তুমি শুধরালে না।”

আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরালাম। যদি হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে, তাহলে এতক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মেলাল না। আমার চোখের সামনেই থাকল। সেই চোখ, সেই চুল। বাইরে থেকে থেকে গায়ের রং কিছুটা সাদা হয়েছে মনে হল।

চুড়ি পরা হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো সরাতে সরাতে কাছে এগিয়ে আসল শায়না। আমি শুকনো ঠোট জিভ দিয়ে চেটে বড় করে একটা ঢোক গিললাম। গলাটা শুকনো কাঠের মত খড়খড়ে হয় আছে, মনে হচ্ছে পাথর ঘষা দিলেই আগুন ধরে যাবে।

শায়নার ঠোটের কোণে এখনো সেই রহস্যময় হাসি। এই তের-চৌদ্দ বছরে একটুও মনে হচ্ছে বদলায়নি।

“কো-কোথায় যাচ্ছ?” তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

“দেশে ফিরে যাচ্ছি। তুমি?”

“আমিও।”

হয়তো ভেতরে ভেতরে অবাক হল সে, কিন্তু ওপর দিয়ে সেটা প্রকাশ করল না। শুধু তাই না, কোনও প্রকার আবেগ অনুভূতি বা উত্তেজনা লক্ষ্য করলাম না তার মাঝে। সেই নির্লিপ্ত চেহারা নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকা- মেয়েটা পারেও। অতিকায় হাতি দিয়ে ধাক্কা দিলেও সম্ভবত ভাঙবে না ওই ব্যক্তিত্ব।

“কফি খাবে?”

“হু?” ভাবনায় ছেদ পড়ল আমার। শায়না পাশের কফি-শপটার দিকে ইশারা করল। আমি কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাঁকালাম।

চেয়ার টেনে বসতে বসতে শায়না বলল, “তুমি অনেক বদলে গেছ। বিশেষ করে তোমার চেহারা। দাগ-টাগ পড়ে বিচ্ছিরি অবস্থা। এই অবস্থা কেন?”

আমি ঠোট উল্টাই। এই মুহূর্তে চেহারা নিয়ে ভাবার সময় নেই আসলে। আমি কথা খুঁজে পেতে ব্যস্ত। কোনটা ছেড়ে কোনটা জিজ্ঞেস করব ভাবতে থাকি।

কিছুক্ষণ কোন কথা হয় না। অবশেষে শায়না বলল, “এতদিন পর দেখা। কিছুই বলবে না?”

আমি কফি দিয়ে গলা ভিজিয়ে নেই একটু। তারপর বলি, “আমরা দুজনই আমাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। কেন করলাম এ কাজ?”

শায়নার হাসি হাসি মুখটা মলিন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বলে, “তুমি একবার ডাকলে আমি ফিরে আসতাম। তোমার ডাকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”

আমি ঝট করে মাথা তুলে তাকাই। প্রথমবারের মত জীবনে শায়নার চোখে পানি দেখি আমি। সে অশ্রু অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারে না।

“আমিও তো তোমার ডাকের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তুমি কোনদিন যোগাযোগ করলে না কেন? আমি দুই বছর দেশে ছিলাম।”

শায়না মুখ ফিরিয়ে নেয়। টেবিলের এ পাশে বসেও আমি বুঝতে পারি, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আগে খুব ইচ্ছে হত, শায়না যদি কখনো কাঁদে, ওর মাথাটা আমার বুকে আঁকড়ে ধরে রাখব। ওর চোখের জলে আমার শার্ট ভিজে যাবে। এখন আর সে ইচ্ছে হয় না কেন জানি। চৌদ্দ বছর অনেক সময়, মানুষকে বদলে দেবার জন্য।

চোখ মুছে নাক টানল শায়না।

“ভায়োলিন শিখে গেছ দেখলাম। সবসময় কি এই সুরটাই বাজাও?”

ধনধান্য পুষ্পভরা বাজানোর সময় শায়না শুনে ফেলেছে তার মানে।

“হুমম। দু:খ ভুলতে সাহায্য করে।”

শায়না সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি যে মিথ্যে বলেছি সেটা ধরে ফেলেছে সম্ভবত।

“দেশে ফিরে যাচ্ছ কেন?”

আমি আবার ঠোট উল্টাই। “বিদেশে ভাল লাগছিল না আর। বাবা-মায়ের সাথে দেখা হয়না অনেকদিন। তুমি?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়না। “বাইরের সংস্কৃতি খু্ব খারাপ। ওই দেশে মেয়ে বড় করলে সমস্যা। তাই একেবারেই ফিরে যাচ্ছি।”

ও। মেয়েও আছে তাহলে!

“আর তোমার হাজব্যান্ড? সে আসবে না?”

শায়না আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তারমানে। ভালবাসা জিনিসটা এক মোহ, প্রহসন। সময় গেলেই ফুরিয়ে যায় ধীরে ধীরে।

“তোমার কি- ” কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল শায়না। পেছন থেকে বাধা দিল একটা কণ্ঠ।

“শায়না, আমি একটু ওদিকটায় যাচ্ছি। তোমার মেয়েকে রাখো।”

“ঠিক আছে, শারমিন। এদিকে এসো হানি।” মেয়েটাকে ডাক দিল সে। এগার-বার বছর বয়স। মোটেই মায়ের মত হয়নি। বাবার মত হয়েছে বোধহয়। লাজুক লাজুক ভঙ্গিতে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে।

“Who is this, mommy?” ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করে মেয়েটা। “Who is this man?”

শায়না কি বলবে ভেবে পায়না। তাকে দেখে অপ্রস্তুত মনে হয়। আমি তাকে বাঁচিয়ে দিলাম।

“I am nobody.” বললাম আমি।

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে, “কি বলে এসব! কেউ nobody হয় কি করে?”

তার স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ শুনে ধাক্কা খাই একটা। পরক্ষণেই নিজেকে গাল দিতে ইচ্ছে হল। মা যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সেই মেয়ে বাংলা বলতে পারবে না, তা কি করে হয়?

“মা, এই লোকটা কি বলে এসব?” হা হা করে হেসেই চলেছে।

“ছি দিশা। এভাবে বলে না। সম্মান দিয়ে কথা বল।”

আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বিয়ের সময় আমরা দুজনে ঠিক করেছিলাম, ছেলে হলে নাম রাখব সাদি, আর মেয়ে হলে দিশা- আমাদের দুজনের নাম মিলিয়ে। নিজের মেয়ের নাম দিশা রেখেছে কেন শায়না? কি বোঝাতে চায় সে এটা দিয়ে? এখনো ভালবাসে আমাকে? নাকি ভিনদেশী স্বামীর ঘরে সুখ খুঁজে না পেয়ে এখন আমার কাছে আসতে চায়? আমার ভাল লাগল না। টেবিলে বিল রেখে উঠে পড়লাম।

“চলে যাচ্ছ?” জিজ্ঞেস করল শায়না।

“হুমম। আমার ফ্লাইট আছে।”

“ও। দিশা। Goodbye বলো। Say goodbye to your dad.”

আমি প্রায় চলেই আসছিলাম। ঝট করে ঘুরে তাকালাম। Your dad? মানে কি? আমাকে কথা বলানোর চেষ্টা চলছে?

শায়নার দিকে তাকালাম। তার ঠোটের কোণায় সেই রহস্যময় হাসি ফিরে এসেছে আবার।

“নিজের মেয়েকে কোলে নেবে না একবার?”

অবাক নয়নে দিশার দিকে তাকালাম। আমার মেয়ে? আমার নিজের মেয়ে? এখন আমি ভাল করে লক্ষ্য করি। চোখ আর নাকগুলো আমার মতই হয়েছে। আমার মতই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দিশা।

“This is dad? এটা বাবা?” কিন্তু এই বাবার সাথে তো ফটোগ্রাফের বাবার সাথে একদম মিল নেই মা। ফটোগ্রাফের বাবা কত হ্যান্ডসাম ছিল...”

আমি জাপটে ধরে কোলে তুলে নেই দিশাকে। দিশা, আমার মেয়ে, আমার নিজের মেয়ে। বুকের ভেতর চেপে ধরে রাখি। বাচ্চা মেয়েটা, যে কোনদিন বাবার আদর পায়নি, বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। হয়তো মনে মনে ভাবছে, একেই বুঝি বলে বাবার আদর?

আমাদের ফ্লাইট আলাদা ছিল। আমরা আলাদা প্লেনে দেশে ফিরে গেলাম। যাবার পুরোটা রাস্তা একটা কথাই চিন্তা করলাম শুধু।

অপূর্ণতা আমাদের দুজনেরই ছিল। আমার দুজন এক হবার পরও আমাদের অপূর্ণতা ঘোচেনি। আমাদের সেই অপূর্ণতায় পূর্ণতা দান করেছে আমাদের ছোট মেয়িটি, দিশা। আর প্রতিজ্ঞা?

আমি দিশাকে কোলে নিয়ে আদর করার পর শায়না বলেছিল, “আমরা কেউই আমাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিনি দীপ্ত।” আমার প্রশ্নাতুর চোখের দিকে তাকিয়ে শায়না বলে, “যাদেরকে ভালবাসবে, তারা কোনদিন তোমাকে ছেড়ে যাবে না, সবসময় এইখানে থাকবে।” বলে আমার বুকের ওপর হাত রাখে সে।

যদিও সংলাপটা একটা বিখ্যাত বই থেকে ধার করা, তবু পরিস্থিতি বিবেচনায় শায়নার ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করতেই হয়।