মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৪১- ভালোবাসা কারে কয় -তানভীর আহমেদ তপু

কিছুদিন আগে হঠাৎ রাত আড়াইটার দিকে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে ফোন এলো।কলটা রিসিভ করতেই মোবাইলের অপর প্রান্তে একটি ছেলের বিকট কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলাম।ছেলেটি ঠিক শিশুদের মত হাও-মাও করে কাঁদছে!কান্নার ধরন দেখে মনে হল ছেলেটির বয়স বছর কুঁড়ির মত হবে।আমি অবাক হয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে তুমি ভাইয়া?এভাবে কাঁদছো কেন?কি হয়েছে?’
অনেক কস্টে কান্না থামিয়ে ছেলেটি তার পরিচয় দিলো...

পরে জানতে পারলাম,কান্নারত ছেলেটি আমার পরিচিত খুব কাছের এক ছোটভাই।তার কান্নার কারন,এবছর ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষায় তার কোথাও চান্স হয়নি এবং সেজন্য তার গার্লফ্রেন্ড তাকে ছেড়ে চলে গেছে!কারনটা জেনে মনে মনে হাসলাম আমি!তবে ছেলেটার জন্য কস্টও হল কোথাও চান্স হয়নি বলে।কি আর করা...
তাকে কিছু নীতিবাক্য মিশ্রিত সান্তনার বাণী শুনিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম!

তার দু’দিন পর ফার্মগেট গিয়েছি একটা কাজে।কাজ শেষে দাঁড়িয়ে থেকে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি।এমন সময় হঠাৎ আমার এক দার্শনিক বন্ধুর সাথে দেখা।তার হাতে একটি নেটের ব্যাগে কিছু ফলমূল আর ঔষধের বাক্স।অন্য হাতে একটি ইংরেজি বই।বইটি দেখে নতুন মনে হল।যেন মাত্র কেনা হয়েছে!বইটির নাম ‘ড্যাস ক্যাপিটাল’,লেখক-কার্ল মার্কস।আমার বন্ধুটি ফিলোসফি তে মাস্টার্স ডিগ্রী প্রাপ্ত।ঢাকায় টুকটাক টিউশানি করায় আর সারাদিন রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়!সে নাকি সমাজের নীচু তলার মানুষদের নিয়ে কী একটা গবেষনা করছে!বেশ মজার ক্যারেক্টার!দেখা হতেই বন্ধুটি আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আরে তপু যে...কেমন আছিস বন্ধু?এতদিন পর দেখা...ফেসবুক ছাড়া তো তোকে দেখার কোন উপায় নেই!লেখালেখি কেমন চলছে?’

আমি হাসিমুখে উত্তর দিলাম, ‘এইতো আছি মোটামুটি।লেখালেখি চলছে কোনমতে!তোর কি অবস্থা?এখনও কি ফিলোসফি নিয়েই পড়ে আছিস?নাকি জব-টব কিছু করছিস?আর হাতে কি এগুলো?কেউ অসুস্থ নাকি?’

বন্ধুটি সহাস্যে উত্তর দিলো, ‘ভালো আছি বন্ধু!দার্শনিকরা ভালোই থাকে।কারন তাদের চাহিদা সীমিত!আর জব-টব আমার দ্বারা হবেনা।জানিসতো,আমি সেলফ ফ্রিডমে বিশ্বাসী!দু’টা টিউশানি করাই আর লেখালেখি করি।আর ঘোরাফেরা তো আছেই।সময়টা বেশ ভালোভাবেই কেটে যায়!’

আমি হেসে বললাম, ‘তুই তো দেখছি সেই আগের মতই আছিস!একটুও বদলাসনি!সে যাই হোক,ওষুধ কার জন্য বন্ধু?কেউ অসুস্থ নাকি?’

ও বললো, ‘আর বলিসনা বন্ধু।কাল সন্ধ্যায় তেঁজগা সাত রাস্তা্র মোড়ে রিক্সায় আসার সময় অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলাম।আমার তেমন কিছু হয়নি।কিন্তু রিক্সাওয়ালা বেচারা বুকে আর হাতে বেশ আঘাত পেয়েছে।কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তার বাসার ঠিকানাটা রেখে দিয়েছিলাম।সে সামনে ট্রাক টার্মিনালের কাছেই রেললাইনের পাশে একটি বস্তিতে থাকে।দুপুরে নীলক্ষেত এসেছিলাম বই কিনতে।ভাবলাম,কিছু ঔষধ আর পথ্য কিনে বেচারা কে দেখে আসি!তোর হাতে সময় থাকলে তুইও আমার সাথে যেতে পারিস।সেই সুযোগে বস্তির মানুষদের জীবনযাত্রাও দেখে আসলি!তুই লেখক মানুষ,তোর এক্সপেরিয়েন্সটা কাজে লাগবে!হয়তো দেখা যাবে দুই-চারটা কবিতা প্রসব করে ফেলেছিস!হাঃ হাঃ হাঃ...কি?যাবি নাকি?’

এই স্বার্থপরতার যান্ত্রিক যুগে আমি বন্ধুটির উদারতা দেখে অবাক হলাম।মন্ত্রমুগ্ধের মত হাসিমুখে ওকে বললাম, ‘হুম যাবো!চল্,গিয়ে ঘুরে আসি!’

আমার কথা শুনে বন্ধুটি খুশিমনে ব্যানসনের প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে আমার হাতে একটি দিলো।তারপর দুই বন্ধু মিলে সিগারেট খেতে খেতে বস্তির দিকে এগিয়ে চললাম...

রেললাইনের পথ ধরে দুই বন্ধু সিগারেট টেনে টেনে হাঁটছি!দুই পাশে ঘিঞ্চিঘিঞ্চি বস্তি।ঢাকার শহরের উঁচু তলার মানুষগুলো যাদের কখনও এইখানে পা পড়েনি তারা এখানের জীবনযাত্রা কখনও কল্পনাও করতে পারবেনা।এত অসহায় মানুষ চারিদিকে...কী তাদের মানবেতর জ়ীবন!ছোট্ট শিশুগুলো ধূলি গায়ে মেখে আপন মনে খেলাধুলা করছে।জরাজীর্ন বৃ্দধ গুলো বিকেলের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে।মহিলারা রেললাইনের পাশেই ছোট্ট মাটির চুলোতে রান্নাবান্নায় ব্যাস্ত।মেয়েগুলো চুল খুলে উদোম শরীরে বসে আছে।এখানে যেন নেই কোন সংকোচবোধ,নেই কোন চক্ষুলজ্জার ভয়...সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটি পরিবেশ!

অনেক খোঁজার পর অবশেষে সেই হতভাগ্য রিক্সাচালকের ছোট্ট চালাটি খুঁজে পেলাম।চালার ভেতর একটুখানি যায়গা।কোনমতে দু’তিন জন মানুষ বসতে পারে।ভেতরে একটা পুরনো ভাঙ্গা জলচৌকিতে শুয়ে রিক্সাচালকটি যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে!একেবারে শুকনো লিকলিকে একটি ছেলে।বয়স বড়জোর পঁচিশের মত হবে।দেখতে ঈষৎ শ্যামবর্ণ,মুখটা দেখতে কিছুটা চাপাভাঙ্গা লাগে!ঘরে ঢুকতেই আমাদের দেখে সে যার পর নেই বিস্মিত,অভিভূত হয়ে কাঁতরাতে-কাঁতরাতে বলল, ‘আপনি আমারে দেখতে আসছেন ভাইজান?আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই আপনি আসবেন!এই কুসুম,জলদি পিড়া নিয়া আসো।ভাইজান গরে বইতে দাও!’

লক্ষ্য করলাম,চাঁদের মত ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে পরম যত্নে রিক্সাচালক ছেলেটির বুকে গরম তেল মালিশ করছিলো।মেয়েটির বয়স আঠারো কি ঊনিশ!দোহারা গঠন,চোখ দুটো প্রচন্ড মায়াবী!আমাদের দেখেই সে তড়িঘড়ি করে উঠে দুইটি পিড়ি নিয়ে এলো আমাদের বসার জন্য!আমার বন্ধুটি রিক্সাচালক ছেলেটিকে বলল, ‘না থাক।ব্যাস্ত হতে হবেনা।আমরা বসবোনা।এইদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম...ভাবলাম,তোমাকে একনজর দেখে যাই।এখানে কিছু ঔষধ আর পথ্য আছে।ঠিকমতো খেয়ো।চিন্তা কোরোনা।তুমি জলদি সেরে উঠবে!’

এই বলে সে ঔষধ আর ফলমূলের ব্যাগটা কুসুম নামের মেয়েটির হাতে ধরিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম,মেয়েটির চোখ এক অভূতপূর্ণ কৃ্তজ্ঞতায় ছলছল করছে।সে কাঁদো-কাঁদো কন্ঠে আমার বন্ধুকে বলল, ‘ভাইজান,আফনেরা বড় ভালা মানুষ।এই পরথম গরিবের বাড়িত আইছেন।একটু জলপানি খাইয়া যান!’

বন্ধুটি তাকে বলল, ‘না বোন।আবার আরেকদিন আসবো।তখন না হয় খেয়ে যাবো!আজ আসি।’
সঙ্গে সঙ্গে রিক্সাচালক ছেলেটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় আমার বন্ধুকে বলল, ‘ভাইজান,আমার বউডা বড়ই ভালা।কাল সারাডা রাইত জাইগা কান্দিছে আর আমার যত্ন আত্তি করছে।হেই এত কইরা কইতাছে।কিছু এডা অন্তত মুখে দিয়া যান।এই কুসুম,ভাইজানগো নারিকেলের নাড়ু দেও।’

কুসুম তড়িঘড়ি গিয়ে হাতে করে মাটির সানকি ভর্তি নারিকেলের নাড়ু আর জল নিয়ে এলো।আমরা দু’বন্ধু মিলে প্রায় সবগুলো নাড়ু তৃপ্তি ভরে খে্যে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এলাম।আমরা মহাখালীর দিকে রেললাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছি।পেছনে কুসুম নামের মেয়েটি অদ্ভুত এক পরিতৃপ্তি নিয়ে শান্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে...তার হাতে একটি মাটির সানকি আর দু’চারটি নারিকেলের নাড়ু!

কিছুটা এগিয়ে আমরা সিগারেট ধরালাম।রিক্সাচালকটির ঘর থেকে বের হবার পর দু’জনেই কোন এক অদ্ভুত কারনে একদম চুপচাপ ছিলাম।আমার দার্শনিক বন্ধুটি মৃদু হেসে নিরবতা ভেঙ্গে আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বুঝলি বন্ধু?’

আমিও মৃদু হেসে প্রত্তুত্যর করলাম, ‘একটা জিনিসই বুঝলাম।এর নাম ভালোবাসা!’

দেখতে দেখতে মহাখালী চলে এলাম।বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিরপুরের বাসে উঠলাম।জানালার পাশের সিটে বসে আছি।চারিদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।হঠাৎ সেই ছোট ভাইটির কথা মনে পড়লো...গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে চলে গেছে বলে যে মাঝরাতে আমায় কেঁদে-কেটে ফোন দিয়েছিলো।সে কি ভালোবাসার অর্থ জানে?ভালো ক্যারিয়ার,হাই প্রোফাইল,দামি বাইক অথবা ডিএসএলআর ক্যামেরা দেখে কি ভালোবাসা হয়?তারকা সমৃদ্ধ দামি রেষ্টুরেন্টে খেলেই কি আত্মতৃপ্তি আসে?এতই ঠুনকো আজকের ভালোবাসা?এতই ঠুনকো তার মূল্য?

নোংরা বস্তিতে সেই কুসুম নামের মেয়েটির চোখে তার স্বামীর জন্য যে স্বর্গীয় ভালোবাসা দেখে এলাম হয়তো তার সন্ধান কেউ কো্নদিন পাবেনা।তবু একটি কথা উপলব্ধি করেছি।ভালোবাসা আসলে প্রদর্শনযোগ্য নয়,এটা হৃদয়ের গভীরে খুব সযত্নে পুষে রাখার মত জিনিস।অথচ আমরা ক’জন তা পারি?

সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারে বাস ছুটে চলছে তার পরিচিত গন্তব্যে।হৃদয়টা কেমন যেন শুন্য লাগছে।এয়ারফোনে রবিঠাকুরের গান শুনছি আমি...পরিচিত সেই গান...

“সখি ভাবনা কাহারে বলে?সখি যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বল দিবস-রজনী, ‘ভালোবাসা...ভালোবাসা...’
সখি,ভালোবাসা কারে কয়?সে কি কেবলি যাতনাময়?
সে কি কেবলি চোখের জল?সে কি কেবলি দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে,কি সুখে কি তরে- এমন দুখের আশ্??”