মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ১০৫- অপার্থিব -আশরাফুল সুমন

‘এই বুম, আমার গেমস এর সিডিগুলা কোন ব্যাগে রাখছিস।’
‘ওই নীল রঙেরটায় আছে সবগুলা,’ অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলো মৃন্ময়ী। ওর নাম মৃন্ময়ী হলেও ওর মা ওকে আদর করে ডাকে মুম। আর ছোট ভাই ডাকে বুম।
ঈশ, আমরা আজ বিমানে চড়বো তাই না? আচ্ছা আমাদের বিমান যদি ওই মালয়েশিয়ান বিমানের মত হারিয়ে যায় তাহলে অনেক মজা হবে না? সবাই আমাদের গরু খোঁজা খুঁজবে। আর আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কাণ্ড দেখে খুব হাসবো..তাই না আপু?
‘চুপ করবি?’
‘না করবো না। আমার অনেক আনন্দ লাগছে। আমরা নতুন জায়গায় যাব, নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু, সব নতুন। জানিস আপু, এখানে না আমার একটা বন্ধুও নেই।’
‘তুই যাবি এখান থেকে? না গেলে আমি সত্যি সত্যি তোকে মার দিয়ে ভাগাবো এখান থেকে,’ রেগে গেলো মৃন্ময়ী। বদের হাড্ডি ছোট ভাইটা সেই সকাল থেকেই জ্বালাচ্ছে। এসব পিচ্চিদের সকাল বিকাল নিয়ম করে থাপড়ানো উচিত। লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে। এখন ঘাড়ের উপর বসে একটা একটা করে চুল টান দিয়া উঠাচ্ছে।
মৃন্ময়ীর আজ সকাল থেকেই মন খুব খারাপ। কেন, সে বুঝতে পারছে না। আজ সন্ধ্যায় ওদের ফ্লাইট। অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় যখন মৃন্ময়ী কোথাও টিকলো না, তখন বাবা হুট করে একটা বাড়ি কিনে নিলেন কলকাতায়। ওদের আত্মীয় সব ওখানে। তাই বাবার মন আর এখানে টিকছে না। মৃন্ময়ীর ভিতরে এটা নিয়ে খুব একটা ভাবান্তর ছিলো না। তার হিসাবে, ওর খুশি হওয়াই উচিত। কারণ এই বাংলাদেশে তার কোন বন্ধু নেই।
এমন কেউ নেই যার সাথে সব শেয়ার করা যেতো। এমন কেউ ছিলো না যাকে সে খুব মিস করতো। তাহলে...কেন তার এতো মন খারাপ? বার বার মনে হচ্ছে কি যেন ফেলে যাচ্ছে এখানে। খুব বড় কিছু। কিন্তু কি সেটা?
মৃন্ময়ীর হঠাত মনে হলো, তার কেউ ছিল না, এই কথাটা পুরোপুরি সত্য না। একজন ছিল। তাকে বন্ধু বলবে নাকি কি বলবে, সে জানে না।
ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই মোবাইলটা কখন হাতে তুলে নিয়েছে খেয়াল করেনি। অনেকটা আনমনেই কল দিলো একটা পরিচিত নাম্বারে।
‘হেলো,’ ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম গলায় কেউ জবাব দিল।
‘কেমন আছেন ভাইয়া?’
‘জানি না কেমন আছি, তুমি কেমন আছো মৃন্ময়ী?
‘আচ্ছা, কি মিল আমাদের মাঝে, তাই না? আপনি যেমন জানেন না কেমন আছেন, আমিও তেমনি জানি না আমি কেমন আছি।’
‘তোমার না জানার তো কিছু নেই। কারণ, তোমার খারাপ থাকার ও কিছু নেই। তুমি তো আমাকে আগেই বলেছ এই দেশে তোমার আপন বলতে তেমন কেউ নেই। অতএব তোমার তো ভালো থাকাই উচিত।
‘এভাবে বলছেন কেন ভাইয়া? আমি কি এমন বলেছি...আচ্ছা থাক বাদ দেন। আমি ওখানে যেয়ে আপনাকে মাঝে মাঝে কল দিব। ধরবেন কিন্তু। আর হ্যাঁ, চলেই তো যাচ্ছি। তাহলে শেষবারের মত কি একটু দেখা করবেন আমার সাথে?’
‘না।’
‘না কেন? আপনি আমার সাথে দেখা করবেন না?!’
‘না। দেখা না হওয়াটাই উভয়ের জন্যে মঙ্গল। তুমি ভালো থেকো মৃন্ময়ী। অনেক অনেক ভালো। আর দোয়া করি যাতে কলকাতায় যেয়ে অনেক অনেক বন্ধু পাও। বিদায় মৃন্ময়ী।’
লাইনটা কেটে দিলো শুভ। মৃন্ময়ী ভীষণ অবাক হলো। শুভ ভাই ওর সাথে কখনোই এমন করে না। দেখা করতে বললেই হাজার ব্যস্ততার মাঝেও চলে আসত সব ছেড়ে। তাহলে আজ কি হল উনার?
শুভ মৃন্ময়ীকে পড়াতো। প্রথম এক মাসে শুভর সাথে তার পড়ার বাইরে একটা কথাও হতো না। একদিন হঠাত পড়ানোর মাঝখানে মৃন্ময়ী শুভকে বলল,
‘ভাইয়া, আপনার কাছে কম্পিউটার গেমস হবে?’
‘হবে। কেন? কার জন্যে? ছোট ভাইয়ের জন্যে?’
‘না মানে...আমার জন্যে...আমি অনেক খেলি তো তাই।’
‘আচ্ছা এনে দেবো।’
খুব একটা অবাক হলো না শুভ। সে গত একমাসেই খেয়াল করেছে যে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কতটা উদাসীন মৃন্ময়ী। মাথা নিচু করে কলেজে যায়। নিচুই করে কলেজ থেকে বাসায় আসে। পড়তে বসে। গেমস খেলে। ঘুমায়। এই হচ্ছে ওর ডেইলি রুটিন। একটা বন্ধুও নাই। ওর কাছে সব কিছুই হচ্ছে ওর মা। আর মা চান না সে কারো সাথে মিশুক। কেন যেন সব সময় মেয়েকে আগলে রাখতে চান। কারো সাথে মিশতে দিতে চান না। আর বাবা? মৃন্ময়ীর বাবা তো সংসার নিয়েই উদাসীন। প্রচুর টাকা আয় করেন। সন্তানরা যা চায় দেন। কিন্তু একটা জিনিস বাদে। সময়।
এরপর থেকে মৃন্ময়ী অনেক কথা বলত পড়ানোর সময়। সারাদিন কি হয়েছে, মা বকা দিয়েছে, বাবা আজকেও খারাপ ব্যাবহার করেছেন মায়ের সাথে ইত্যাদি ইত্যাদি সব। মেয়েটার জীবনে কোন বন্ধু ছিলো না। এই প্রথম সে একজন বন্ধু পেল। যদিও এই অসম বন্ধুত্ব কেউই ভালো চোখে দেখবে না, কিন্তু মৃন্ময়ী সেদিকে ধ্যান দিত না। আসলে ও জগতের বিচিত্রতা সম্পর্কে কিছুই জানত না। বুঝতে পারত না যে ছেলে মেয়ের অসম বন্ধুত্ব তার সীমা রেখা অতিক্রম করে নতুন নাম পায়।
এইচ এস সি দেয়ার পর সে শুভকে নিয়মিত কল দেয়া শুরু করলো। আগে তো শুভ সপ্তাহে ৪ দিন বাসায় আসতো, এখন তো আর আসে না, তাই কথাও হয় না। আর ওর তো সব কিছু শেয়ার করার মত মানুষ আছে একজনই। শুভ। তাই শুভকে ওর প্রতিদিন অন্তত একবার কল দেয়া লাগবেই লাগবে। এভাবেই চলছিল সব। হঠাত একদিন আচমকা শুভকে কল দিয়ে মৃন্ময়ী বলে:
‘আজকে একটু এম এফ সির সামনে আসতে পারবেন?প্লিজ?’
‘কেন?’
‘এমনি। আমার সারাদিন বাসায় থাকতে ভালো লাগে না। মা কোথাও যেতে দেন না। আজকে একটু ঘুরবো। আড্ডা দিবো।’
ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিলো। হঠাত মায়ের কল পেয়ে মৃন্ময়ী দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটে পালাল। এতটাই নার্ভাস হয়ে গেলো যে বাই পর্যন্ত বলতে ভুলে গেল। দেখে শুভর খুব হাসি পেল। কি অদ্ভুত মেয়েটা!!
এরপর প্রায়ই মৃন্ময়ী শুভকে দেখা করতে বলত। দেখা হত। আড্ডা হতো। মৃন্ময়ীর এখন মনে হচ্ছে, ওর সবচেয়ে সুখের মুহূর্তগুলো ছিল তখন, যখন সে আর শুভ একসাথে সময় কাটাত।ওর মনে আছে, যখন শুভকে প্রথম জানায় তাদের কলকাতা চলে যাওয়ার কথা, তখন শুভর মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিল। এরপর শুভ আর হ্যাঁ হু ছাড়া একটা কথাও বলেনি। কে যেন বলেছিল, কষ্টের রং নীল। তাহলে কি সেটা কষ্ট ছিল যা শুভর চেহারায় দেখেছিল সেদিন? ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একা একা ভাবতে থাকে মৃন্ময়ী।
আচ্ছা, সব এমন এলোমেলো লাগছে কেন হঠাত? এই কালকেও তো অনেক মজা লাগছিল নতুন জায়গায় যাওয়ার কথা ভেবে। কিন্তু এখন কি হলো ওর? আচ্ছা, কয়টা বাজে এখন? সে কি!! এরই মাঝেই ২টা বেজে গেছে? সন্ধ্যা ৭টায় ফ্লাইট। সময় কি লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে নাকি? নাহ। শুভর সাথে একবার যে করেই হোক দেখা করতেই হবে। হোক সেটা ৫ মিনিটের জন্যে। কেন সেটা সে জানে না। শুধু জানে, দেখা তাকে করতেই হবে। টানা ২০ বার কল দিলো সে। সেকি!! কল ধরছে না কেন? মেসেজ দিল,
‘আমি কি আপনার সাথে একবার দেখা করতে পারি, শুধু একবার। প্লিজ?’
কোন জবাব এলো না। গম্ভীর হয়ে বিছানায় বসে পড়ল মৃন্ময়ী। অবশেষে...অবশেষে মৃন্ময়ী বুঝতে পারল যে এই বাংলাদেশে সে কি ফেলে যাচ্ছে!! বুঝতে পারছে কেন এমন অদ্ভুত বিষণ্ণতায় তার মন ছেয়ে আছে আজ সকাল থেকে। ভাবতে ভাবতে ওর গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
* * *
সন্ধ্যা ৭টা। মৃন্ময়ী তার কলকাতার ফ্লাইটে বসে আছে। প্লেন মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ল। প্লেনের সিটে গা এলিয়ে দিতেই চোখ ঘুমে অবশ হয়ে এলো। শুয়ে শুয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল মৃন্ময়ী।
সে আর শুভ একটা ফুলের বাগানে হাঁটছে। হঠাত আকাশটা কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল। প্রচণ্ড বাতাস বইতে শুরু করল। চারদিক অন্ধকার। এত অন্ধকার কেন? কেউ কি আলোটা নিভিয়ে দিয়েছে? প্লিজ কেউ আলোটা জ্বালিয়ে দাও...
অমানুষিক একটা ভয় এসে ভর করলো মৃন্ময়ীর উপরে। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সে শুভর হাত চেপে ধরেছে। একটা দমকা হাওয়া এসে তাকে আর শুভকে আলাদা করে দিল। সে আবার শুভর হাত চেপে ধরেছে। কিন্তু এবার আগের চেয়েও প্রচণ্ড জোরে একটা দমকা হাওয়া এসে ওকে শুভর থেকে আলাদা করে দিল। ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে শুভর হাতটা ধরে রাখার। কিন্তু পারছে না। পিছলে যাচ্ছে...পিছলে যাচ্ছে...সরে যাচ্ছে...অনেক অনেক দূরে সরে যাচ্ছে......
পেছন থেকে হা হা করে কে যেন হাসছে...ভয়ঙ্কর রকমের অপার্থিব সেই হাসি।
*সমাপ্ত*