মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৮১- নন্দিনি -(শাকিল বখতিয়ার)

নন্দিনি'র মনটা খুব খারাপ। উচ্চশিক্ষিতা মেয়ে। কী সুন্দর
একটা চাকুরি ছিলো দেশে। বেচারি মন ভারি করে বিকেলবেলা ঘর থেকে বের হয়।
ঠিক এই সময় প্রতিদিন বিকেলবেলা হাঁটতে বের হন পাশের
বাড়ীর অজিতকাকু।অসাধারণ এক গুনী মানুষ। কিছুক্ষণ কথা বললেই
মনটা সতেজ হয়ে যায়। অনেককেই দেখা যায় খুব সুন্দর কথা বলেন । নীতিবাক্য, অনুপ্রেরণার গল্প শুনান। কিন্তু নিজেরা তার আশে পাশেও নাই। অজিতকাকু এদিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন । বিনয়, মার্জিত স্বভাব ,কথাবলার ধরণ,সদা হাসিমাখা মুখ ইত্যাদিতে বুঝা যায় উনি কতবড় একজন মানুষ।প্রায় ১ বছর আলাপ পরিচয়ের পর নন্দিনি জানতে পারে উনি নরওয়ে সরকারের একজন অতি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। অথচ মানুষ হিসাবে কত নিরহঙ্কারি। নন্দিনি- হাঁটতে হাঁটতে জিগ্গাসা করে-কেমন
আছেন কাকু? ভালো আছি মা। তা তোমার খবর কি?
কোনো চাকুরির ব্যবস্থা করতে পারলে?
জ্বিনা কাকু। কিছুইতো হলোনা। পড়ালিখাটা মনে হয় জলে গেলো। মন খারাপ করোনা মেয়ে। দেখবা হঠাৎ করেই চাকুরি হয়ে গেছে। তখন আর বিকালে এভাবে আয়েশ করে হাঁটার ফুরসত পাবানা।
শোনো,আমার একটা সুখবর আছে।
কি কাকু? নতুন কোনো প্রমোশন নিশ্চয়ই। আরে না। সুখবরটা হলো-
আগামী সপ্তাহেই চাকুরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। ও, তাহলে আরো কোনো ভালো চাকুরি পেয়েছেন বুঝি। তা ও না। একেবারেই অবসর। যেটাকে বলতে পারো খুব ঠান্ডা মাথায়
চিন্তা ভাবনা করে স্বেচ্ছায়
ছুটি নিলাম।
কি বলেন কাকু! এতো ভালো,সম্মানজনক, উচ্চ মর্যাদার একটা চাকুরি ছেড়ে দিবেন। আর
আপনারতো অবসর নেয়ার বয়সই হয়নি। হ্যাঁ মা।তা হয়নি বটে। আরো দশ বছর
চাকুরির বয়স ছিলো।এরপর নিজের সাথে এই কয়েকসপ্তাহ বোঝাপড়া করেই সিদ্ধান্ত নিলাম-দশের জন্য একশত বিশ বছরের চাঁদতো আর
ধুলোমাখা করতে পারিনা। বুঝলামনা কাকু। দশ,একশতবিশ বছর এসব
কি বলছেন? তুমিতো জানো আমার অতি আদরের
দুটো ফুটফুটে নাতি রয়েছে। শশী আর চাঁদ। ওদের মা-বাবা দুজনেই
চাকুরি নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। অফিস, বাসা, চাকুরি ,ডে কেয়ারে ছুটোছুটি করতেই
ওদের নাভিশ্বাস। শিশুদুটোকে মনে হলো দিনদিন
একটা রোবট হয়ে ওঠছে। এই দুটো যন্ত্রপুতুলকে আমি দশ বছরে মানুষ
বানাতে চাই। কিন্তু আমিও যদি আমার চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তবে ওরা আর
মানুষ হবেনা।যন্ত্র পুতুল হয়ে যাবে। ধরো, একটা মানুষের গড় বয়স ৬০ বছর। তবে দু
নাতির বয়স হয় ১২০ বছর। আমি মনে করি, আমার এই দশ বছরের চেয়ে ওদের ১২০ বছরই সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। নন্দিনি ভাবনায় পড়ে যায়।অবাক
চোখে অজিত কাকুর দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে-
ডে কেয়ার,চাইল্ড কেয়ার ইত্যাদিতেও কাকু বেশ ভালো সেবা যত্ন করে।
আমিতো মনে করেছিলাম- আমার একটা চাকুরি হলে।আমার
বাচ্চা দুটোকে আমিও ডে কেয়ারে রেখে কাজ শুরু করে দিবো।
কাকু বলেন, এখানে যে অত্যন্ত বিলাশ বহুল ওল্ড হোম আছে ।সেখানেও
কি বৃদ্ধা বাবা মায়ের কম সেবা য্ত্ন হয় ? "ডে কেয়ার হলো-দে কেয়ার।"।
সেটা হলেতো আর হবেনা। আমার সন্তানের যত্ন যে আমাকেই নিতে হবে।
তাদেরকে দিয়ে নয়। গতকালই একটা জার্নালে দেখলাম-ওল্ড হোমের
৯৩% বাসিন্দারা নিজেদের সন্তানদের হয় ডে কেয়ারে বড় করেছেন
অথবা শৈশবে নিজেদের বাচ্চাদের প্রতি তেমন সুবিচার করেননি।
কিন্তু কাকু, আমিতো দেখলাম অনেক উচ্চ শিক্ষিত, বেশ অবস্থাপন্ন
ভালো চাকুরি করা সন্তানরাও বাবা- মাকে ওল্ড হোমে পাঠাতে।
দেখো মা। উচ্চ শিক্ষিত আর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হলেই ভালো মানুষ হয়না।
মায়ামমতা,আদর,স্নেহ,সোহাগ,সম্প্রী তি,ভালোবাসা আর
সর্বোপরি পারিবারিক বন্ধনে বেড়ে ওঠা সন্তান
কোনো অবস্থাতেই তার বৃদ্ধ বাবা- মাকে ওল্ড হোমে পাঠাতে পারেনা।
তাদের কোমল হৃদয়ের পলি জমিতে একেবারে শৈশবে সেই
মমতার বীজ বুনে দিতে হয়। তা না হলে যাদেরকে আজ
আমরা ডে কেয়ারে বড় করছি।ওরাই একদিন আমাদের ওল্ড কেয়ারে বড় করবে।
আমি চাই , আমার নাতি দুটো ফেসবুকের পাশাপাশি আসল ফেসও চিনুক।নতুন
বেড়ে হওয়া প্রজন্মকে দেখা যায়- হাজার হাজার ফেসবুক বন্ধুদের চেনে।
কে কোথায় কি করলো-সব কিছুই ওদের নখদর্পনে। কিন্তু রক্তের আত্মীয় যেমন,
ঠাকুরমা, পিসিমা, মাসীমা,জ্যাঠু কাউকেই ওরা চিনেনা। এই
মুখগুলোকে যেন ওদের অন্য গ্রহের মানুষ বলে মনে হয়। আর ওদের দোষ দিয়ে লাভ
কি? সমুদ্র জলে ডুবন্ত মানুষ যেমন একটা খড়কুটো পেলেও
আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।ঠিক তেমনি- কর্মমূখর যান্ত্রিক সভ্যতার এই নিঃসঙ্গ
সমূদ্রে ওরাও কিছু একটা আকঁড়ে ধরে থাকতে চায়। ওদের
নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা তখন এই যন্ত্র গুলোই দূর করে। আর পাশাপাশি নিজেরাও
একসময় যন্ত্রে পরিণত হয়। এরকম করেতো কখনো ভাবিনি। আপনার
কথাগুলো শুনতে খুবই ভালো লাগছে। চলুন কাকু ঐ বেন্চে গিয়ে বসি।
জানো মা। তুমি যে আমাকে আঙ্কেল না বলে কাকু বলে ডাকো।
শুনতে কি যে ভালো লাগে। এখনতো হলো- আঙ্কেল,
আন্টি,ইয়ো ব্রো আর হোয়াটস আপ'র মেকি যুগ। এই শব্দগুলো শুধু ঠোঁট
থেকে আসে।কিন্তু কাকু, মামা, খালা,খালু,মাসীমা,চাচা,
চাচী এগুলো একেবারে অন্তরের গভীর থেকে নিঃসৃত হয়।
আমি চাই আমার নাতিরা এই দশবছরে শুধু আপন পরিজনের মুখগুলোই নয়।নিজেদের
শেকড় সম্পর্কে জানবে। আমার ঘরে ইংরেজী বলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
ইংরেজিতো ওরা স্কুলে,বাইরে,বন্ধুদের সাথে এমনিতেই শিখবে। আমার
ভাষাকে আমাকে ওদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
না হলে যে আমি বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবো। এরপর ওরা ওদের
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এ ভাষার মাধুর্য্য পৌঁছে দেবে। কিন্তু এখন শুরু
হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি সংস্কৃতি। আমরাই রুদ্ধ করে দিচ্ছি ওদের শেখার পথ।
ফলে চিন্তা করো ওরা ওদের পরবর্তী প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে যাবে।
ওরা শিখবে -কীভাবে বিনম্র হতে হয়। বড়জনের সামনে পায়ের ওপর
পা রেখে নাড়াতে হয়না । যুগের সাথে নিজেকেও আধুনিক
করে তোলতে হবে। সেটা ঠিক।কিন্তু তার মানে এই নয় যে,সারাক্ষণ
গেজেটগুলো'র ভিতর ডুবে থাকতে হবে। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের
কর্তব্যবোধ যেন ওদের হৃদয়ের মাঝে সেই শৈশবেই রোপিত হয়।
আমি এ্যালবামখুলে ওদেরকে আমার আপনজনের মুখগুলোর সাথে পরিচয়
করিয়ে দেবো। মমতার মানুষগুলোকে না চিনলে ওদের
মাঝে মমতা কেমন করে তৈরী হবে? এই দশ বছর শেখার সবচেয়ে বড় উত্তম সময়।
এটাই তৈরী করে দিবে ওদের জীবনে মানবিক মানুষ হওয়ার
সবচেয়ে মজবুত ভীত। ভীত শক্ত না হলে ওপরের দালান যতই চাকচিক্যময়
হোক তা কোনোদিন ঠিকে থাকবেনা। তাই আমি আমার চাকুরির শেষ দশ বছর এই
১২০ বছরের পেছনে ব্যয় করতে চাই। আর এটাই হবে আমার সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ।
কয়েকদিন আগের খুব একটা মর্মান্তিক অনুশোচনার ঘটনা শোনো। অফিস
থেকে বের হয়ে টুটুলকে দেখতে গেলাম।
হসপিটালের বেডে একেবারে নিঃসঙ্গ অসহায়
হয়ে শুয়ে আছে বেচারা। আমাকে দেখে মনে হলো পুরো পৃথিবীটাই
যেন ওর রুমে চলে এসেছে। আনন্দ ওর চোখে মুখে ।
বললাম, আর কেউ নেই? না কাকু। নার্স ঔষধ দিয়ে চলে গেছে।
আর বউ কাজ শেষ করে ফিরার পথে দেখে যাবে।
ও আচ্ছা। আর কেউ আসেনি? আমি ওর পাশের চেয়ারে বসলাম।
মাথায় হাত রাখলাম। কি বলবো বুঝতে পারছিনা।এমন সময়
টুং করে একটা শব্দ হলো। দেখলাম, টুটুল পাশ থেকে ল্যাপটপ টা ওর
বুকের ওপর নিয়েছে। একটু হাসলো। আবার একটু মন খারাপও যেন
করলো। আমি জিগ্গাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।
বললো- আমার অসুসস্থতার খবর পেয়ে বন্ধুরা স্ট্যাটাস দিচ্ছে,কমেন্ট
করছে, লাইক করছে। কেউ ফুলের তোড়ার ছবি দিয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করছে।
হাওয়ার ভূবনে কত কিছু হচ্ছে।অথচ আসল দুনিয়ায় আমি কত নিঃসঙ্গ একা। এক মুমুর্ষু রোগী হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। আশেপাশে আমার কেউ নেই।
বললাম, কাকু। এটা খারাপ কি। অন্ততঃ টুটুলতো নিজের মাঝেই নিজের
একট ভুবন তৈরী করে নিয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকেই
বন্ধুরা সহমর্মিতা প্রকাশ করছে। এটাওতো একরকমের ভালোবাসা পাওয়া।
তা না হলেতো উনি আরো একা হয়ে পড়তেন।
তখন যে সময় কাটানো আরো কষ্টকর হতো।
সেটা ঠিক বলেছো। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে এটাও
মনে রেখো শতকোটি হাওয়ার ভুবনে আর
কারো কপালে সরাসরি হাত রেখে ভালোবাসার চুম্বনে অনেক
ফারাক। অনেক অনেক। দুটোকেই ব্যালেন্স করে রাখতে হয়। আমরা যেন
আমাদের আসল প্রিয়জনের মুখগুলো কোনোদিন ভুলে না যাই।
কিছুদিন পর টুটুল একেবারেই না ফেরার দেশে চলে গেলো।
নামাজে জানাযায় বলতে গেলে তেমন মানুষ হয়নি।
ফেসবুকে বন্ধুরা শোক প্রকাশ করেছে। অথচ,পাশের প্রতিবেশীরা তার অকাল
প্রয়াণের খবরও জানেনি। আর দেখো, রহমত যখন মারা যায়। তখন কত
মানুষ যে দেখলাম শেষ যাত্রায় এসেছে। বুঝলাম, রহমত শুধু ফেসবুক
বন্ধুদেরকেই চেনেনি। আসল আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্দবদের
ফেসগুলোও সে চিনেছে। তাদের কদর করেছে।
ঠিক এমন সময় একটা গাড়ী এসে থামলো। দেখলাম, শশী আর চাঁদ
গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে দাদু'র কাছে আসছে।
অজিত কাকু বললেন- সন্ধ্যা হয়ে আসছে মা। চলো এবার ওঠি।
আমি বললাম, সত্যিই
চাকুরি ছেড়ে দিচ্ছেন?
হ্যাঁ । কারণ, চিন্তা করে দেখলাম। আমার ঐ চাকুরীর শুন্যস্থান পূরণের জন্য
কতজন আসবে। কিন্তু এই মমতার জায়গা পূরণের জন্য এই পৃথিবীতে আর
কেউ আসবেনা। এটুকু বলেই অজিতকাকু দুহাত দিয়ে দু
নাতিকে ধরে হাঁটতে লাগলেন। নন্দিনির মনে হলো- একজন নিবেদিত
প্রাণ মানুষের হাত ধরে দশ বছরের ত্যাগের বিনিময়ে একশত বিশ বছরের
দুজন প্রকৃত মানবিক মানব একটা মমতার কুটিরের দিকে পা বাড়ালো।
যে মমতার বার্তা প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হাতে হাত
ধরে হয়তোবা এভাবেই পৌঁছে যাবে। নতুন আশার বীজ বুননের স্বপ্ন
নিয়ে নন্দিনিও নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ায়।