উৎসর্গ - " প্রিয় সালমা কে । "
অফিসে দেরি করে পৌছানোর রেকর্ড নেই হাসান আহমেদের। স্বভাব মতই আজও সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে গেছেন তিনি। কাজ শুরু করার আগেই হাসানের একমাত্র শ্যালক সেলিম আসলো তার সাথে দেখা করতে।
মাসের শুরুর দিকে হাসানের শ্যালক আসে তার সাথে দেখা করতে। তবে মাঝেমধ্যে এক মাসে কয়েকবারও আসে। দেখা করতে আসার কারণ দুলাভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়া।
হাসানের কাছ থেকে টাকা নেয়া নিরাপদ। কারণ এই লোকটি টাকা দিতে কখনো অসম্মতি জানায় না আর কাউকে বলেও না।
- দুলাভাই, কেমন আছেন?
-- আছি ভালই। তুমি আছো কেমন?
- জ্বী ভালই।
-- চা দিতে বলি??
- না থাক। একটা প্রয়োজনে এসেছিলাম।
-- কত লাগবে তোমার?
- দুলাভাই, আপনি আমার প্রয়োজনটা কিভাবে বুঝে ফেলেন! বেশি না মাত্র ১ হাজার।
হাসান মানিব্যাগ বের করতে করতে ভাবছিলো অনেকেই বলে শালা ছাড়া বিয়ে করবে। এর মর্ম এখন বুঝতে পারছে হাসান। শ্যালকরা দুলাভাইদের বানরের মত জালিয়ে যায়।
- এই নাও টাকা।
-- ধন্যবাদ ভাই। এখন গেলাম।
(দুই)
হাসান দুশ্চিন্তাতে পড়ে গেল। প্রতিদিন দুপুরে হাসান বাসায় ফোন দিয়ে তার স্ত্রী সালমার সাথে কথা বলে। আজকেও ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু মোবাইল কেউ ধরেনি। টানা ৮ বার দেয়ার পরেও কেউ রিসিভ করলো না।
দুশ্চিন্তাটা সেই কারণেই। কোন সমস্যা হলো নাকি!! না আবার রাগ করলো সালমা!
কোন সমাধান বের করতে না পেরে বিকেলের দিকেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো হাসান। স্বভাব মতই অফিসের পাশের মার্কেটে ঢুকে পড়লো হাসান।
(তিন)
বাসার ঢুকেই হাসান বুঝতে পারলো কিছু একটা হয়েছে। তবে কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি এটা দেখে স্বস্তি বোধ করলো হাসান।
কিছু একটা হয়েছে কারণ, সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে হাসানের ছেলে সালমান গেট খুলতে আসতো না। সব স্বাভাবিক থাকলে সালমা নিজে এসে গেট খুলে দিতো।
সালমান আগ্রহী হয়ে বাবার সাথে কথা বলতে আসলো।
- আব্বু, তুমি কেমন আছো?
-- খুব ভালো। তুমি কেমন আছো?
- আমি ভালো নেই!
-- কেন বাবা?
- তুমি আমার জন্য কিছু আনো নি, তাই!
-- কে বলল আনিনি? এই যে দেখো নতুন টাই এনেছি। এটা পড়ে কাল স্কুলে যাবে।
- থ্যাঙ্কিউ আব্বু, থ্যাঙ্কিউ।
তখন সালমাকে দেখা গেল রাগী রাগী মুখে দাড়িয়ে থাকতে। অবস্থা বেগতিক দেখে হাসান ছেলেকে বলল,
- বাবা, টাই টা পড়ে আসো তো।
-- আচ্ছা বাবা।
সালমান অন্য রুমে চলে গেল। সে নিজেও মাকে অনেক বেশি ভয় পায়।
হাসান প্রস্তুত হয়ে নিলো, কারণ ও জানে সালমা এখন কিছু বলবে। সালমা রাগী গলায় বলা শুরু করলো,
- আজ তোমার অফিসে সেলিম গিয়েছিলো?
-- হ্যাঁ।
- ১ হাজার টাকা চেয়েছিলো?
-- হ্যাঁ।
- তাহলে টাকাটা দিলে না কেন? তোমার কি টাকার অভাব? তুমি আমার ভাইয়ের সাথে এমন কেন করলে?
-- সেলিম বাসায় এসেছিলো?
- সেলিম এসেছিলো। আমি ওকে টাকা দিয়েছি। বলেছি তোমার অফিসে আর না যেতে। তুমি এমন কেন করলে বলো?
হাসান চুপ করে রইলো। সে এখন চাইলেই বলতে পারে, সে সেলিমকে টাকা দিয়েছে। কিন্তু সে বলল না। কারণ সালমা এতে অনেক কষ্ট পাবে। সে তার ভাইকে অনেক ভাল জানে।
হাসানের হাতে একটি প্যাকেট দেখে সালমা জানতে চাইলো,
- প্যাকেটে কি?
-- শাড়ি।
- আর কত শাড়ি আনবে! আমার যেই পরিমাণ শাড়ি আছে তা দিয়ে একটা শাড়ির দোকান দেয়া যাবে।
অন্য সময় হলে সালমা এমন কিছু বলতো না। আজ রেগে আছে তাই এমন বলছে।
- বেগুনি রং এর। বেশ পছন্দ হয়ে গেল, তাই আনলাম।
-- পছন্দ হলেই আনতে হবে? পুরো দোকানের সব শাড়ি যদি পছন্দ হয়ে যেত?
- বাদ দাও না। এখন শাড়িটা ইকটু পড়ে আসবে?
সালমা আর কিছু বললো না। শাড়িটা হাতে নিয়ে চলে গেল। হাসান হাফ ছেড়ে বাচলো। সে জানে ঝামেলা এখানেই মিটমাট হয়ে যাবে। সালমা এখন শাড়িটা পড়ে আসবে।
টাই হাতে সালমানকে আসতে দেখা গেল।
- আব্বু!
-- বলো বাবা।
- আমিতো টাই বাধতে পারিনা।
-- ও, আচ্ছা। আমি বেধেঁ দিবো।
- আব্বু, একটা কথা বলি?
-- বলো।
- আম্মু তোমাকে এত বকা দেয় কেন?
-- তোমার আম্মু আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে তাই বকা দেয়।
- অনেক ভালবাসলেই কি বকা দিতে হয়?
-- হ্যাঁ বাবা।
- তুমি কি আমাকে ভালবাসো না?
-- হ্যাঁ ভালবাসিতো।
- তাহলে আমাকে বকা দাও না কেন?
হাসান তখন পোড়া গন্ধ পেল। রান্নাঘর থেকে আসছে।
(চার)
রান্নাঘরে গিয়ে হাসান অবাক হয়ে গেল। সালমা চুলায় ফেলে শাড়িটা পুড়িয়ে ফেলছে। হাসান সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেল। বিয়ে হওয়ার এত বছর পরে এই প্রথম এমন আচরণ করলো সালমা। হাসান বললো,
- একি করলে তুমি!
-- পুড়িয়ে ফেললাম।
- ভাইয়ের জন্য?
সালমা কিছু বললো না। হাসান মোবাইল বের করে সেলিমকে ফোন দিলো। লাউডস্পিকার অন করলো।
- হ্যালো, দুলাভাই।
-- হ্যাঁ সেলিম। তুমি আজ আমার অফিসে এসেছিলে?
- জ্বী দুলাভাই।
-- ১ হাজার টাকা চেয়েছিলে। আমি কি টাকা দিয়েছিলাম?
- জ্বী দুলাভাই।
-- তুমি সালমাকে বাসায় এসে বলেছো আমি টাকা দেইনি।
- জ্বী দুলাভাই।
হাসান আর কিছু না বলে কলের লাইন কেটে দিলো।
(পাঁচ)
রাত ৯ টা বাজে। হাসান ছাদে বসে আছে। সন্ধ্যায় ছাদে উঠেছিলো, আর নিচে যায়নি। হাসানের মন খারাপ থাকলে সে ছাদে এসে বসে থাকে। চাঁদটা তার অনেক প্রিয়। সবাই বেঈমানী করলেও চাঁদটা বেঈমানী করে না।
চাঁদটা সবসময় স্নিগ্ধ আলোর স্বান্তনার পরশ ছুঁয়ে দেয়। মেঘে ঢেকে গেলেও বারবার চেষ্টা করে মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে আসতে।
আজকের চাঁদটা দেখা যাচ্ছে না। মেঘে ঢেকে রয়েছে।
- দুলাভাই!!
সেলিম হাসানের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়তো দুলাভাইয়ের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য সালমা তাকে ফোন দিয়ে আনিয়েছে।
-- বলো সেলিম।
- চলেন নিচে চলেন। আপা খাবার নিয়ে বসে আছে।
-- তুমি যাও, আমি পরে আসছি।
- ভাই, আমার জন্যেই এতকিছু হয়েছে। আমাকে মাফ করে দিন।
-- ভুল তোমার না ভুল আমারই। সালমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ৭ বছর আগে, বিয়ের আগে ৩ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। এই দশ বছরেও ও আমাকে চিনলো না।
- ভাই, ভুল আমার ...
-- আরে না তোমার কোন ভুল নেই। আমি রাগও করিনি। অভিমান করেছি। রাগ করতে পারিনা কারণ সালমাকে বলেছিলাম কখনো রাগ করবো না।
সেলিম কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো।
-- তোমার আপাকে বলো তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। গর্ভবতী অবস্থায় রাত জাগা ঠিক না।
সেলিম চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে সালমা নিঃশব্দে হাসানের পিছনে এসে দাড়ালো। নিঃশব্দে আসলেও হাসান ঠিকই টের পেল। যাকে সত্যিকারে ভালবাসা যায় তার শরীরের গন্ধ অনুভব করা যায়।
সালমা মাথা নিচু করে কাদতেঁ লাগলো। হাসান এবার চুপ করে থাকতে পারলো না। সে দশ বছর পেছনে চলে গেল।
- কিরে কাঁদিস কেন?
-- আমি কাঁদলে তোর কি??
- থাপ্পড় দিবো একটা!
-- থাপ্পড় দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলে, থাপ্পড় খেতে আপত্তি নেই।
হাসান সালমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।
- এই আর কাঁদিস না।
সালমা কিছু বললো না। তবে কান্নাও থামালো না। হাসান বললো,
- আজকে সারারাত ছাদে কাটিয়ে দিলে কেমন হবে রে?
সালমা কান্নাজড়িত গলায় বললো, " আমার আপত্তি নেই। "
ঠিক তখন চাঁদটা মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসলো। হয়তো চাঁদমামারও আপত্তি নেই।
|| সমাপ্ত ||