লিখেছেনঃ সাব্বির জাদিদ
==================
বর্ষাকাল শেষ হয়েছে সেই কবে অথচ বৃষ্টি থামছে না। রাস্তায় পানি জমে গেছে। মানুষের চলতে ফিরতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। মাঝে মাঝে দামি প্রাইভেট গাড়ি পথচারিদের কাদা মাখিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবু জীবন থেমে নেই।
বৃষ্টি হলে এক সময় খুব ভাল লাগত অামগাছটার। তখন তার যৌবন ছিল। পাতায় পাতায় ছাওয়া ছিল বিশাল শরীর। পাতা তো নয় যেন সবুজের পাহাড়। পাতার উপর টুপটাপ বৃষ্টি পড়ত। নাকি কান্নার সুরের মতো সেই শব্দ গাছটার বড় ভাল লাগত। কখনো কখনো ভিজতে ভিজতে ছুটে অাসত একঝাঁক কাক। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছের কোলে অাশ্রয় নিত। এখন অার সেই দিন নেই। অামগাছটা বুড়ো হয়ে গেছে অনেক অাগেই। পাতাবিহীন কয়েকটা ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে অাছে একলা। অনেক অাগেই তার মরবার কথা ছিল। মরতে মরতে বারাবর বেঁচে গেছে। তার পাশে অারো কয়েকটা গাছ ছিল। সবাই একই বয়সি। অথচ কেউ বেঁচে নেই। কাটা পড়েছে সবাই। পাল্লা দিয়ে বিল্ডিং উঠছে চারপাশে। বিল্ডিং হল গাছের শত্রু। যেখান বিল্ডিং ওঠে সেখানে গাছ থাকতে নেই। এটাই নাকি নিয়ম। অামগাছটার বন্ধুদের জায়গায় এখন উঁচু উঁচু বিল্ডিং। তার কপালেও এটা ঘটতে পারত। ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। কতবার কত ইঞ্জিনিয়ার এসে ফিতা টেনে মাফজোক করে গেল। খাপে খাপে পড়েনি বলে দুই বিল্ডিঙের ফাঁকে অাজো দাঁড়িয়ে অাছে সে। অবশ্য বেঁচে সে যে খুব সুখে অাছে তা কিন্তু নয়। এমন বৈচিত্র্যহীন জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।
বড় কথা বলা স্বভাব অামগাছটার। মানুষ বুড়ো হলে যেমন কথা বলা রোগে ধরে গাছ বুড়ো হলেও তেমন কথা বলা রোগে ধরে। বুড়োরা অনেক কিছু দেখে। দেখে দেখে নানান অভিজ্ঞতা জমা হয় বুকে। সেই জমা হওয়া কথা বলতে না পারলে মন খচখচ করে। বুড়োদের কথা বলা রোগের এটাই কারণ।
ন্যাড়া অামগাছটারও অাজকাল খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বলবে কাকে? অাশপাশে কোন গাছ নেই। এক সময় প্রচুর পাখি অাসত। পাখিদের সাথে গল্প করা যায়। কিন্তু ইদানীং পাখিরাও এড়িয়ে চলছে তাকে। কেউ তাকে সময় দেয় না। পৃথিবীতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। অথচ এক সময় সে কতভাবেই না পৃথিবীর প্রয়োজনে এসেছে। সেই স্মৃতিটা মনে পড়লে অাজও গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। মনে হয় জীবনটা একেবারে বৃথা যায়নি। সে তো ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। একাত্তরের অাগস্ট মাসের ঘটনা। তারিখটা ঠিক মনে নেই। বুড়ো হয়ে গেছে না! বুড়ো বয়সে কি দিন তারিখ অতসব মনে থাকে! তবে সেদিনটাও ছিল বৃষ্টির দিন। পষ্ট মনে অাছে। তখন গাছটার নতুন যৌবন। কৈশোর ছেড়ে সবে যৌবনে পা দিয়েছে। এই এলাকাটা তখন পুরোপুরি গ্রাম। এখনকার এসব বিল্ডিং ফিল্ডিং কিচ্ছু নেই। শুধু গাছপালা অার গাছপালা। অার এখন যে পিচঢালা রাস্তাটায় সাঁসাঁ করে গাড়ি চলছে তখন রাস্তাটা পাকা ছিল না। রাস্তা বলতে ছিল ইট বিছানো হেরিং। তখন খুব অাতঙ্কের দিন ছিল। সন্ধ্যা নামতেই কার্ফু। লোকেরা বিকেলের অাগেই ঘরে দুয়ার দিত। মানুষের জীবন ছিল পশুপাখির জীবনের মতো অতি তুচ্ছ। যখন তখন তাজা মানুষ লাশ হয়ে যেত।
এক সন্ধ্যায় অামগাছটা দাঁড়িয়ে ছিল। তার খুব মন খারাপ। প্রতিদিনই সে লাশ দেখছে। ট্রাক ভরে নদীর দিকে লাশ নিয়ে যাচ্ছে মিলিটারি। এত লাশ দেখে কি মন ভাল থাকে! থাকে না।
রাত একটু গভীর হতেই চারটা যুবক ঝুপঝাপ করে অামগাছটার গায়ে চড়ে বসল। বৃষ্টির রাত। ঘুুটঘুটে অন্ধকার। অামগাছটা যুবকগুলোর চেহারা দেখতে পেল না। তবে যুবকগুলোর কাছে যে রাইফেল অাছে সে টের পেল। কারণ তার গায়ে ধাতব যন্ত্রের অাঁচড় লাগছে। যুবকগুলো ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। এদিক দিয়ে নাকি অাজ রাতে এক প্লাটুন মিলিটারি যাবে। তাদের কুপোকাত করতে যুবকগুলো গাছে ওঁত পেতেছে। যুবকগুলোর উদ্দেশ্য জানতে পেরে কী যে অানন্দ হতে লাগল অামগাছটার! অানন্দে সে ডালপালা মেলে ধরল। পাতা ছড়িয়ে দিলো। শত্রুরা যেন ওদের দেখে না ফেলে। রাত যত গভীর হতে লাগল গাছটার গা শিরশির তত বাড়তে লাগল। একটু পরেই প্রলয় ঘটে যাবে। মিলিটাির মরবে। জয় বাংলা স্লোগান উঠবে। চোখের সামনে এতসব কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে অার তার গা শিরশির করবে না তা তো হয় না। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে মহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রাত দুটোর দিকে পুবের রাস্তায় চলন্ত অালো দেখা গেল। অালোটা ক্রমেই এগিয়ে অাসছে। স্তব্ধ রাত। স্তব্ধতা ভেঙে সাজোয়া যানের কর্কশ ধ্বনি কাছে অাসতে লাগল। যুবকগুলো শেষ মুহূর্তে কী যেন বলাবলি করে নিল। তারপর চটের ব্যাগ থেকে গোলাকার কয়েকটা বস্তু বের করল। অামগাছটা চোখ বড় বড় করে গোলাকার বস্তুগুলো দেখতে লাগল। এর অাগে কখনো সে এই জিনিস দেখেনি।
মিলিটাির গাড়ি নিকটবর্তী হলে যুবকগুলো গোলাকার বস্তু ছুঁড়ে মারল। প্রচণ্ড বিস্ফারণে কেঁপে উঠল এলাকা। গাড়িতে অাগুন ধরে গেল। গাড়ির বিভিন্ন অংশ এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ল। অাগুন বেড়ে গেলে অাঁচ এসে অামগাছটার গায়। যুবকগুলোর মুখে অাগুনের ছায়া পড়ল। অামগাছটা এবার ভাল করে চার যুবককে দেখল। সে ভেবেছিল যুবকগুলো ভারি বয়সের হবে। এত সাহসের কাজ যখন। কিন্তু তার ধারণা ভুল। ওদের বয়স একেবারেই কাচা। যুবক না বলে ছেলে বলাই ভাল। দাড়ি গোঁফ ঠিকমত গজায়নি। রোগাশোকা মুখ। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দিন ভাল মন্দ খাবার পেটে পড়েনি। গাছটার বড় মায়া হচ্ছে। ডালপালা দিয়ে ছেলেগুলোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেই সুযোগ পাওয়া গেল না। বিস্ফোরণের পরপরই ওরা ঝুপঝাপ নেমে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে গাছটা বুঝতেই পারলা না কী হল। সে চারপাশে তাকিয়ে ছেলেগুলোকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু দাউ দাউ অাগুন ছাড়া নজরে কিছুই পড়ল না। এরপর ছেলেগুলোকে অনেক খুঁজেছে অামগাছটা। রাস্তার দিকে হা করো তাকিয়ে থেকেছে বছরের পর বছর। ছেলেগুলোর দেখা পায়নি। তারা বেঁচে অাছে না মরে গেছে তা-ও সে জানে না। একাত্তরের গল্পটা বুড়ো অামগাছ যাকে পেয়েছে তাকেই শুনিয়েছে। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়েছে। ঈর্ষার গলায় বলেছে, হে অাম্রবৃক্ষ! তুমি বড় ভাগ্যবান। তুমিও মুক্তিযোদ্ধা। তোমাকে নিয়ে ইতিহাস লেখা হবে।
এসব কথা শুনে অামগাছটার কী যে ভাল লাগত! অাবেগে চোখে পানি চলে অাসত। এখন অার চোখে পানি অাসে না। অাবেগি কথাবার্তায় এখন অার সে অাপ্লুত হয় না। দিনকাল খুব খারাপ পড়েছে। একাত্তরের বীভৎস দিনগুলো অাবার যেন ফিরে এসেছে। সবখানে মারামারি, হানাহনি, রক্তপাত। অামগাছটার বড় কষ্ট হয়। তার চারপাশে অনেকগুলো গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরিতে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করে। মালিকপক্ষ ঠিকমত বেতন দেয় না তাদের। যা দেয় তাতে মৌলিক চাহিদাও পূরণ হয় না। শ্রমিকদের শুকনো মুখ দেখলেই বোঝা যায় তারা বঞ্চিত। অথচ তাদের ভুড়িমোটা মালিকরা এসি গাড়িতে অানন্দ ফূর্তি করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে অামগাছটার ইচ্ছে হয় মোটা একটা ডাল ভেঙে গাড়ির উপর ফেলে। রক্তচোষা মালিকদের ছাতু বানিয়ে দেয়। কিন্তু ইচ্ছেটা বাস্তবে রূপ দেয়া হয় না। মানুষ পশু হতে পাের কিন্তু বৃক্ষ তো পশু হতে পারে না।
সেদিন হঠাৎ শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বেধে গেল। শ্রমিকরা সর্বনিম্ন অাট হাজার টাকা বেতনের দাবিতে অান্দোলনে নেমেছে। মালিকপক্ষ দাবি মানবে না। অান্দোলন দমাতে তারা পুলিশ ভাড়া করেছে। অল্পক্ষণেই সংঘর্ষ ভয়াবহ অাকার ধারণ করল। শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুঁড়ছে। পুলিশ জবাব দিচ্ছে বুলেট ভাষায়। গুলির মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না শ্রমিকরা। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা যে যেদিকে পারল পালাতে লাগল। মাঝবয়সী এক শ্রমিক একা হয়ে পড়েছে। সে দৌড়ে অামগাছটার কাছে চলে এলো। অামগাছের অাড়ালে লুকিয়ে পড়ল বড় বড় চেখে চারপাশে তাকাতে লাগল। মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। হাঁপানি রোগির মতো হাঁপাচ্ছে। হা করে শ্বাস নিচ্ছে। হঠাৎ এক বুলেট এসে লোকটার মাথায় লাগল। মরণ চিৎকার করে লোকটা লুটিয়ে পড়ল। গাছের শুকনো গোড়া ভিজে উঠল রক্তে। অামগাছটা ক্রোধে চিৎকার করতে চাইল। পারল না। রক্ত দেখে তার কণ্ঠ রোধ হয়ে গেছে। চিৎকার করার শক্তি নেই। অামগাছটার খুব অাফসোস হতে লাগল। লোকটা তার কাছে অাশ্রয় নিয়েছিল। সে অাশ্রয় দিতে পারেনি। তার শরীর অারেকটু মোটা হলে নিশ্চিত সে লোকটাকে রক্ষা করতে পারত। কেন সে অারেকটু মোটা হল না! তার খুব কান্না পেতে লাগল। একদা সে চারজন মহান মুক্তিযোদ্ধাকে অাশ্রয় দিয়েছিল। অাজ একজন বঞ্চিত শ্রমিককে অাশ্রয় দিতে পারল না। এ জীবন রেখে কী লাভ!
পরদিন পথচারীরা এক অবাক দৃশ্য দেখল। ন্যাড়া অামগাছটা রাস্তার উপর কাৎ হয়ে শুয়ে অাছে। তার গায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে অাছে পাঁচটনি এক ট্রাক। সবাই ভাবল ঘাতক ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বুড়ো অামগাছের সাথে টক্কর খেয়েছে। কিন্তু মনের দুঃখে অামগাছটাও যে ট্রাকের নিচে অাত্মহুতি দিতে পারে এই সম্ভাবনার কথা কেউ ভাবল না।