মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৫৪- নষ্ট ভ্রুন ও ডাক্তার এনামুল (রহস্য গল্প)



জহিরের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে, আবার মনে হচ্ছে জেগে আছে। ব্যাপার টা ঠিক ধরতে পারছেনা। মাথা উচু করে চারপাশে তাকাতে গেলো জহির, মাথা ও উচু করতে পারছেনা। একটা হাসি শুনা যাচ্ছে অনেক দূর থেকে ... কেমন যেন অদ্ভুত! খিল খিল হাসির শব্দ টা বেড়েই যাচ্ছে, মনে হচ্ছে ক্রমাগত কাছে আসছে শব্দ টা।
-এই তোমার কি হয়েছে?
ডাকটা শুনেই জহির উঠে যায় ঘুম থেকে, চার পাশে তাকিয়ে দেখে সেই চেনা ঘর আর সেই চেনা মুখ। শুকনো মুখে জহির বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যেয়ে হাতে মুখে পানির ঝাপটা দেয়। আবারো সেই স্বপ্ন টা দেখল জহির। তিথি এর দিকে তাকিয়ে দেখে আলুথালু চুলে বিছানার উপর বসে আছে তিথি। উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল_
এই তোমার কি হয়েছিলো? ঘুমের মধ্যে এমন করছিলে কেন?
জহির কিছু বলেনা, তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব মায়া হতে থাকে জহিরের। মায়াবতি এই মেয়েটার মনে যে কত কষ্ট তার কিছুই একটা ছেলে কখনো বুঝতে পারবেনা। সন্তান হারানোর ব্যাথা একজন মা ছাড়া আর কেউ অতটা পায়না। জহির গিয়ে বসে তিথির পাশে—দু হাতে তিথির মুখ খানি চেপে ধরে। কি মায়া এই মুখে ... চারপাশের দেয়ালের কটকটে শ্যাওলা রং এর মাঝে তিথির কাজল কালো চোখ দুটো দারুন লাগছে।
এই পাগল, ঘুমাও । জহিরের হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে তিথি বলে উঠে।
তুমি ঘুমাও, আমি তোমাকে দেখি। জহির বলল তিথির পাশে বালিশে হেলান দিয়ে।
তিথি মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল পাশে। জানে, এখন আর জহির এর ঘুম হবেনা। মাঝরাতে এভাবে ঘুম ভাঙলে দুষ্টু ভুত চাপে জহিরের মাথায়। অসভ্য হয়ে যায় একদম ছেলে টা, চুপচাপ তার সাথে সারা দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা তখন। তিথি জড়িয়ে ধরে জহির কে –
বাবুর বুঝি এখন দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করছে?
হুম... খুব ইচ্ছে করছে।
তোমাকে কে ধরে রেখেছে ? তিথি মুচকি হেসে জহির কে কাছে টেনে নেয়।


বাইরে থেকে কেমন জানি একটা বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ আসছে। ঘরের শ্যাওলা রঙের সাথে বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ টা খুব একটা খারাপ যাচ্ছেনা, প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে জহির শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে। আচ্ছা গন্ধের সাথে রঙের কি কোন সম্পর্ক আছে? নাকি এটা তার অদ্ভুত রকম কল্পনা? ঘরের লাইট টা অফ করা, জহির ডিম লাইটের আলোতে বাম পাশে তাকিয়ে দেখে তিথি জুবুথুবু হয়ে ঘুমাচ্ছে। অথচ গত একটা বছর জহির রাতের বেলায় ঘুমোতে পারেনা। পাশের রুম থেকে খিল খিল শব্দের হাসি টা আবার শুনতে পায়। আর না এবার ডাক্তার দেখাতে যেতেই হবে, এভাবে না ঘুমিয়ে প্রতিদিন সকালে অফিস করা টা এখন রিতিমত একটা ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে।



আপনার সমস্যা টা ঠিক কখন থেকে শুরু হয়েছে?
প্রশ্ন টা শুনে জহির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অবশ্য এর জন্য প্রশ্ন টা দায়ী নাকি পরিবেশ টা দায়ী সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা এই মুহূর্তে। বিখ্যাত ডাক্তার এনামুল হক এর চেম্বারে এখন জহির। টেবিলের ওপাশে পুরু চশমার ফাঁক দিয়ে ডাক্তার তাকিয়ে আছে জহিরের দিকে।
কি... সমস্যা টা কি বিয়ের আগে না পরে? ডাক্তার এনামুল সাহেব আবারো প্রশ্ন করলেন। এই ধরনের কেসে অধৈর্য হলে চলেনা সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন।
জি, আসলে সমস্যা টা যেহেতু আমার স্ত্রীর, আমি ঠিক তারিখ বলতে পারব না । তবে বিয়ের প্রায় এক বছর পর থেকে তার এই সমস্যা। আমার স্ত্রী এর নাম তিথি, সে আমাদের অসাবধানতা বসত কনসিভ করেছিলো। তখন আমার আর্থিক অবস্থা টা বেশ একটা ভালো ছিল না। দুজন মিলে আলোচনা করেই ঠিক করলাম আমরা এই বাচ্চা টা চাইনা। মিসকারেজ এর ঠিক ৮ মাস পর থেকেই এই সমস্যা টা হচ্ছে।
টেবিলের ওপাশ থেকে এনামুল সাহেব শুনলেন জহিরের কথা গুলো। সমস্যা টা বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে। তিথি হয়ত প্রেসারে পরে বাচ্চার ভ্রুন নষ্ট করতে রাজি হলেও ব্যাপার টা তার মাথার মধ্যে রয়ে গেছে।
আচ্ছা, তাহলে তো আপনার স্ত্রীর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত কিছু বলতে পারছিনা। চেয়ারে হেলান দিতে দিতে এনামুল সাহেব বলেন । এই ক্ষেত্রে এখন আমার কিছু করার নেই, আপনি বরং একবার আপনার স্ত্রী কে নিয়ে আসুন ।
জহির ইতস্তত করে বলে, স্যার আপনাকে সময় করে একবার আমাদের বাসায় যেতে হবে। আমি চাচ্ছিনা তিথি জানুক আমি তাকে কোন মানসিক ডাক্তার এর কাছে দেখাচ্ছি। আমি আপনার ডাবল ভিসিট দিব , প্লিজ স্যার একবার দয়া করে আমাদের বাসায় চলুন। জহিরের কণ্ঠে কাকুতি ঝড়ে পরে।
ডাক্তার এনামুল সাহেব বেশ বিব্রত বোধ করলেন, না না ভিসিট ডাবল দিতে হবেনা। আমি বাসায় যেয়েও রোগি দেখি আমাকে সেই ভিসিট টা দিলেও চলবে। বলতে বলতে এনামুল সাহেব লক্ষ্য করেন জহিরের হাতের মধ্যে ছোট বাচ্চাদের কামড় এর দাগ কয়েক টা।
আপনার হাতে কামড়ের দাগ কিসের? কোন ছোট বাবু বুঝি কামড়ে দিয়েছে?
জহির প্রশ্নের উত্তর দেয়না, চুপ চাপ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। জহির নিশ্চিত এই সমস্যার সমাধান একমাত্র ডাঃ এনামুল সাহেব ই করতে পারবেন। লোক মুখে তার অনেক ডাক নাম শুনেছে জহির। আর অনেক দিন ধরে আসব আসব করে শেষ পর্যন্ত তাই উনার কাছেই তার আসা।
স্যার আপনি কবে যাচ্ছেন আমাদের বাসায়? আজ ই চলুন না ? এখন তো মাত্র সন্ধ্যা ৭ টা বাজে , আমাদের সাথে চার টা ডালভাত ও খেয়ে আসলেন।
এনামুল সাহেব শুরু তে না করলেও জহিরের চাপাচাপি তে শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারলেন না । রাজি হলেন জহিরের সাথে তার বাসায় যেতে। চেম্বারেও আর রোগি নেই, জহির ই ছিল সর্ব শেষ রোগী। তাছাড়া জহিরের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হতে লাগলো এনামুল সাহেবের।



নিজের গাড়িতে করে জহিরের সাথে যেতে যেতে এনামুল সাহেবের বেশ অসস্থি হতে লাগলো কেন জানি। তার সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছে পকেটে হাত দিয়ে মাত্র টের পেলেন। সিগারেট ধরাতে খুব ইচ্ছে করছে। জহির সিগারেট খায় কিনা কে জানে, তার কাছে সিগারেট চাইবেন কিনা ভাবছেন এনামুল সাহেব।
স্যার কি সিগারেট খান? জহিরের এই প্রশ্ন শুনে এনামুল সাহেব হাফ ছেড়ে বাচলেন। জহির নিজ থেকেই একটা সিগারেট তার পকেট থেকে বের করে এনামুল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিল। সিগারেট নিতে নিতে এনামুল সাহেব আবারো লক্ষ্য করলেন জহিরের হাতের দাগ এর দিকে। জিজ্ঞেস করতে যেয়েও তিনি আর জিজ্ঞেস করলেন না । থাক জহির যখন এই ব্যাপারে কিছু বলতে চাচ্ছেনা তাহলে আর শুধু শুধু একই প্রশ্ন বার বার করে তাকে বিব্রত করার মানে নেই। এনামুল সাহেব দেখলেন, জহির ড্রাইভার কে ডিরেকশন দিচ্ছে কিভাবে কিভাবে যেতে হবে। এনামুল সাহেব সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বাইরে তাকালেন। বাইরে গতকাল এর মত আজকেও বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। বৃষ্টি আসবে কিনা কে জানে।
অবশেষে প্রায় আধা ঘণ্টা পর এ গলি ও গলি ঘুরে জহিরের বাসার সামনে গাড়ি টি দাঁড়ালো। এনামুল সাহেব নামতে নামতে জহির কে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনার স্ত্রীর ঠিক কি সমস্যা আরেক বার বলবেন কি? যাওয়ার আগে আরেকবার শুনে নেই।
জি স্যার, সে বাচ্চার ভ্রুন নষ্ট হবার ঠিক ৮ মাস পর থেকে একটা ছোট বাচ্চা দেখে ঘড়ের মধ্যে। প্রায় ই বাচ্চা টার সাথে সে খেলে , খিল খিল করে হাসে । কি করব স্যার ঠিক বুঝতে পারছিনা।
আচ্ছা আচ্ছা, তাহলে শুরুতেই আপনার পুরা বাসা টা একবার চক্কর দিতে হবে। ঠিক কি পরিবেশ আপনার স্ত্রীর উপর এই ইফেক্ট ফেলছে সেটা বুঝতে হলে এটা দরকার। আপনার স্ত্রী কে আমার কি পরিচয় দিবেন ঠিক করেছেন কি?
জি স্যার, জহির বলে। আমরা বেশ কিছুদিন থেকেই বাসা টা চেঞ্জ করার কথা ভাবছি। বলব আপনি আমার কলিগ, আমাদের বাসা টা ভাড়া নিতে চান আমরা চলে যাওয়ার পর। আজকে বাসা টা দেখতে এসেছেন।
এ কথা বলতে বলতে একতলা সিঁড়ী ভেঙ্গে জহির তার ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাড়াতেই ভিতর থেকে তিথি দরজা খুলে দেয়। এই সময় টাতে জহির অফিস থেকে বাসায় ফিরে, তিথি অপেক্ষা করতে করতে পুরো অসহ্য হয়ে যায়। দরজা খুলেই সাথে নতুন মুখ দেখে তিথি বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।
আরে, আমাদের বাসা টা দেখতে এসেছেন। উনি ভাড়া নিতে পারেন । এনামুল সাহেব আমার কলিগ। একটু চা নাশতা এর ব্যাবস্থা কর তো এখন। আর উনি কিন্তু রাতে আমাদের সাথে ভাত খেয়ে যাবেন। বলতে বলতে জহির ভিতরে ঢুকে এনামুল সাহেব কে নিয়ে।
নাশতা দেয়ার আগের এনামুল সাহেব জহির কে নিয়ে পুরো বাসা টা দেখে ড্রইং রুমে গিয়ে বসলেন। তার আগে তিথির সাথেও বেশ আলাপ হল এনামুল সাহেবের। তিথি কে তার বেশ ভালোই মনে হচ্ছে।
আচ্ছা! জহির সাহেব। আপনাদের ঐ বাচ্চার যে রুম টা । সেই রুমে দেখছি বাচ্চার খেলনা , জামা কাপড় অনেক কিছুই আছে। সেগুলোই মনে হয় আপনার স্ত্রীর মনের উপর সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট ফেলছে। ঐ রুম টার থেকে সব কিছু সরিয়ে ফেলতে হবে। বলতে বলতে তিথি কে নাশতা নিয়ে আসতে দেখে এনামুল সাহেব চুপ করে গেলেন।
এনামুল ভাই, খুব আন্তরিক স্বরে তিথি বলল। চা টা খেয়ে দেখেন ভালো লাগবে। সবাই আমার চা এর খুব প্রশংসা করে। আমি রান্না বান্না তেমন একটা ভালো না করতে পারলেও চা টা আমার খুব ভালো হয়। নিজের ই ভালো লাগে।
তিথির কথা শুনে এনামুল সাহেব চা টা নিয়ে চুমুক দিয়ে দেখলেন, আসলেই তো চা টা বেশ অসাধারন। এমন সময় পাশের রুম থেকে খিল খিল শব্দ শুনতে পেয়ে এনামুল সাহেব বেশ থমকে গেলেন। কারণ একটু আগেই তিনি সব গুলো রুম দেখে এসেছেন। এই বাসায় এই তিন জন মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি অবাক চোখে জহিরের দিকে চাইতেই জহির চোখ নামিয়ে নেয় ।
আমার ছেলে টার এতক্ষনে আসার সময় হল ! তিথি বলে ওঠে... বাবু সোনা ... আসো! দেখে যাও তোমার একটা চাচ্চু এসেছে।
এনামুল সাহেব বিস্ফোরিত চোখে দেখলেন , পাশের ঐ খালি রুম টা থেকে একটা আট নয় মাসের বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগিয়ে আছে ড্রইং রুমের দিকে। চকিতেই জহিরের হাতের কামড়ের দাগের রহস্য পরিষ্কার হয়ে আসলো তার কাছে। তিনি বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে থাকলেন, বাচ্চা টা দেখি তার দিকেই এগিয়ে আছে হামাগুড়ি দিয়ে, মুখ টা ঈষৎ হা করা । মুখের মধ্যে ছোট ছোট সুচালো দাত।