নুরুল হক সাহেবের বাড়িটা দুর থেকে অনেকটা বাগান বাড়ির মত
লাগ। বিভিন্ন রকমের গাছ গাছালি দিয়ে চারদিক ঘেরা,
সামনে পিছনে দুইটা বড় পুকুর। চৌদ্ধ কামরা বিশিষ্ট একটা বড় আধুনিক
দালান, যে দালানে মাত্র পাঁচজন মানুষ বাস করেন। নুরুল হক সাহেব, উনার
বউ, দশ বছরের ছেলে আসিফ, সাত বছরের মেয়ে সাবিনা এবং কাজের
মহিলা জলিকার মা। নুরুল হক সাহেবের পাঁচ ভাই, বাকী চার ভাই পরিবার সহ
বিদেশে থাকেন। উনিও একবার বিদেশে গিয়েছিলেন।
ভাইয়েরা চেয়েছিলেন উনিও যেন উনার
ফেমিলি নিয়ে বিদেশে উনাদের মত স্হায়ীভাবে থাকেন। কিন্তু উনার
বিদেশ ভাল লাগেনি, তাই দেশে ফিরে এসেছেন। উনি প্রায়ই
একটা কথা বলেন, উনার বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও
নাকি উনি শান্তিতে ঘুমাতে পারেন না। তাই উনি উনার পরিবার
নিয়ে দেশে স্হায়ীভাবে থাকেন। নুরুল হক সাহেব মানুষ হিসাবে কেমন
সে সম্পর্কে কেউ কোন সঠিক ধারনা দিতে পারে না। একেকজন
একেক কথা বলে, কেউ ভাল বলে কী আবার খারাপ বলে।
তবে উনার সুনামের চেয়ে দূর্নামই বেশি প্রচলিত। একবার
নাকি উনি উনার বাড়িতে এক চোর ধরা হয়েছিল।
সে চোরকে নাকি উনি নিজ হাতে জবাই করে ফেলেন। এলাকার
মানুষদের ফিস্ফাস করতে শুনা যায় – প্রতি মাসে নাকি উনার
বাড়িতে একটা আসর বসে, যেখানে মদের নেশা চলে আর বাজার
থেকে মেয়েদের আনা হয়। যদিও এরকম ঘটনার কোন সত্যতার প্রমান এখনও
বাস্তবে পাওয়া যায়নি। নুরুল হক সাহেবের ছেলে আসিফ ক্লাস
ফাইভে, আর মেয়ে সাবিনা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওদের স্কুলে,
মক্তবে নিয়ে যাওয়া আসার জন্যে জলিকার মাকে রাখা হয়েছে বাড়িতে। ঘরের
অন্যন্য কাজও করে। সে প্রতিদি সকালে নুরুল হক সাহেব ও উনার
স্ত্রী ঘুমে থাকতে থাকতেই আসিফ ও সাবিনা কে মক্তবে দিয়ে আসে।
মক্তবে দিয়ে এসে সকালের নাস্তা শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ
করে আবার ওদের মক্তব থেকে নিয়ে আসে। এভাবেই
জলিকার মার প্রতিদিন শুরু হয়। জলিকার মা একটু অদ্ভুদ টাইপের মহিলা। সে খুব কম
কথা বলে, কাজ ছাড়া কারো সাথে কোন রকম
কথা না বললেই চলে। সবসময় একা একা থাকতে পছন্দ করে। এরকম
থাকার পিছনে কিছু ঘটনা আছে বলে অনেকের ধারনা। তার
তের বছর বয়সে বিয়ে হয়, সতের বছর বয়সে সে বিধবা হয়ে পড়ে। তার
স্বামী সাপের কামড়ে মারা যায়। স্বামী মারা যাওয়ার পর সে তার
মেয়ে জলিকাকে নিয়ে নুরুল হক সাহেবের বাড়িতে থাকে। তার
মেয়ে জলিকা খুব চঞ্চল এবং খুব সুন্দরী ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বার বছর বয়সেই সে মারা যায়। কেউ জানে না জলিকা কিভাবে কেমন করে মারা গেল। ওর লাশ
পাওয়া গিয়েছিল গ্রামের দক্ষিন দিকে এক পরিত্যক্ত
পুকুরে ভাসা অবস্হায়। জলিকার মূত্যু নিয়ে একটা কথা প্রচলিত আছে,
সেটা হল কে বা কারা নাকি জলিকাকে ধর্ষন করে মেরে পুকুরে লাশ
ফেলে দিয়েছে। যদিও এর কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। এরপর
থেকে নাকি জলিকার মা এরকম কিছুটা অস্বাভাবিকের মত
হয়ে গেছে । একদিন জলিকার মা প্রতিদিনের মত
মক্তবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আসিফকে ঘুম
থেকে ডেকে তুলে। আসিফ ঘুম থেকে হাত মুখ ধোয়ে মক্তবে যাওয়ার
জন্যে প্রস্তুত হয়ে জলিকার মাকে জিজ্ঞেস করে সাবিনা কোথায়, ও প্রস্তুত
হয়েছে কিনা। জলিকার মা বলে ভাইজান আইজ আপারে একটু
দেরিতে নিয়া যামু, উনার একটু শরীর খারাপ,
আপনাকে দিয়া আইস্যা উনারে নিয়া যামু। উনি আরেকটু ঘুমাক। আসিফ আর
কিছু না বলে জলিকার মার সাথে মক্তবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
ঘর থেকে বেরুতেই আসিফের কেন জানি কিছুটা ভয় লাগল, তার মনে হল
এখনও সকাল হয়নি, রাত এখনও বাকি। আসিফ জলিকার মাকে জিজ্ঞেস করল
বুয়া আমার মনে হচ্ছে এখনও সকাল হয়নি। সে সাথে সাথে বলে উঠে কি বলেন
ভাইজান, দেখেন না চারদিক কেমন সাদা ধবধবা, আর আপনে বলতাছে এখনও
সকাল হয় নাই। আসিফ আর কিছু না বলে ওর সাথে হাঁটতে লাগল।
মসজিদের কাছে পৌছতেই হঠাৎ আসিফ দেখে জলিকার মা তার পাশে নাই।
সে থতমত হয়ে চারদিক তাকাল। দুইবার বুয়া বুয়া বলে ডাকল। দেখে তার
চারপাশে কেউ নাই, চারদিক নিরব। সে সাথেসাথে বোঝে নিল এখনও
সকাল হয়নি। চারদিক এত আলোকিত কারণ আজ ভরা পূনিমা। আসিফ
ভয়ে কাঁপতে লাগল। চিৎকার করতে চাচ্ছে কিন্তু মুখ থেকে কোন শব্দ
বের করতে পারছে না। তার হাত পা শক্ত হয়ে আসছে। কোনরকম বাড়ির
দিকে রওয়ানা দিল। এমন সময় পিছন থেকে শুনতে পেল ঘোড়ার ডাকের মত
শব্দ। পিছনে মসজিদের দিকে তাকিয়ে দেখে একটা উচু উলঙ্গ
মানুষ তার দিকে দৌড়ে আসছে, যার মুখ ঘোড়ার মত।
সামনে চেয়ে দেখে হাজার হাজার ভেড়া তার দিকে তেড়ে আসছে।
কান্না জড়ানো গোঙ্গানির শব্দে, উপরের দিকে চেয়ে দেখে তার ঠিক
মাথার উপরে কে যেন সাদা কাপড় পরে ঘোমটা দিয়ে শূন্যে বসে আছে।
নিচের দিকে চেয়ে দেখে তার দু’পা সাপের মত
কি একটা প্যাচিয়ে নিচ্ছে। পানিতে ডুবলে যে রকম শ্বাস বন্ধ
হয়ে আসে সে রকম যেন তারও শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
পরেরদিন সকালে আসিফ কে মসজিদের পাশে অজ্ঞান অবস্হায় পাওয়া যায়।
আর তার বোন সাবিনাকে অজ্ঞান অবস্হায় পাওয়া যায় পুকুর পাড়। কিন্তু
জলিকার মাকে সেদিন কোথাও খোঁজে পাওয়া গেলনা। এর ঠিক দুই দিন
পর জলিকার মার লাশ পাওয়া যায় গ্রামের দক্ষিন দিকে এক পরিত্যক্ত
পুকুরে যেখানে তার সুন্দরী মেয়ে জলিকার লাশ
পাওয়া গিয়েছল।