সূর্য তখনো উঠেনি। রক্তিম
পূর্বাকাশ। মাহমুদ কোরআন
পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
তারপর ড্রেসিং রুমে প্রবেশ
করে, কিছুক্ষণ পর
ধনী ইহুদী ব্যবসায়ীর সাজ
পরে বেরিয়ে এল এবং পশ্চিমের
ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
জাফা বন্দরে মাহমুদের
এটি একটি নতুন
আস্তানা ভূমধ্যসাগরের
তীরে পাঁচতলা এই বাড়ী।
ইজি চেয়ারে অর্ধশায়ীত মাহমুদ
পলকহীন দৃষ্টিতে ভূমধ্যসাগরের
নীল জলরাশির
দিকে চেয়ে ছিল। দূরে পশ্চিম
দিগন্তে একটি জাহাজের
চিমনি দেখা যাচ্ছিল।
ধীরে ধীরে পশ্চিম
দিগন্তে তা মিলিয়ে গেল।
জাহাজটির সাথে যেন
মাহমুদের মনটিও ছুটে গেল দীগন্ত
পেরিয়ে জীব্রালটার অতিক্রম
করে। জিব্রালটার - জাবালুৎ
তারিকের কথা মনে পড়তেই
মাহমুদের মন ছুটে গেল চৌদ্দ শ ’ বছর
আগের একটি ঘটনার দিকে।
সিপাহসালার তারিক সাতশ’
সৈন্য নিয়ে শত্রু অধ্যুষিত
স্পেনের মাটিতে নামলেন।
তারপর পুড়িয়ে দিলেন ফেরবার
একমাত্র উপায় নৌযানগুলো।
তাদের সামনে রইল সুসজ্জিত
অগণিত শত্রু সৈন্য আর
পেছনে তরঙ্গ - বিক্ষুব্ধ সমুদ্র।
আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়
সম্পর্কে কি দৃঢ় প্রত্যয়। মুসলিম
সিপাহসালার তারিকের এ
আত্মপ্রত্যয় অবাস্তব ছিল না।
শীঘ্রই সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক
মুসলমানদের হেলালী নিশান
স্পেনের
সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সের
প্রান্তদেশ পারেনিজ
পর্বতমালার বুকে মাথা উঁচু
করে দাঁড়িয়ে ইসলামের জয়
বার্তা ঘোষনা করল। শুধু কি তাই?
মুসা আর
তারিককে যদি দামেস্কের
দরবারে ফিরিয়ে না আনা হতো,
তাহলে ‘ ওয়াশিংটন আরভিং এর
ভাষায়, ‘‘ আজ প্যারিস ও লন্ডনের
গীর্জাসমূহে ক্রসের
বদলে হেলালী নিশানই
শোভা পেত।’’ এই ভূমধ্যসাগরের
প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে একদিন
মুসলমানদেরই হুকুম চলত। কিন্তু আজ?
মাহমুদের মন বেদনায় ভরে যায়,
যে স্পেনকে মুসলমানরা আট শত
বছর ধরে গড়ে তুলল আপন করে, সেই
স্পেনে আজ মুসলমানদের সাক্ষাত
মিলে না। তারা বিধ্বস্ত ও
বিতাড়িত। কিন্তু কেন এই পতন?
ইতিহাস মুসলমানদের
দুর্বলতা আত্মকলহকেই এর জন্য
দায়ী করেছে। কিন্তু এই আত্মকলহ
আর দুর্বলতা এল কোত্থেকে?
সে কি আদর্শচ্যুতি থেকে নয়?
মাহমুদের মনে পড়ে যায় একজন
লেখকের কথা, ‘‘ মুসলমানরা আপন
উসূল এবং ইসলামী জোশ হতে যখন
দূরে সরে পড়ল, তখন খোদা তাদের
এ নিয়ামত কেড়ে নিলেন। এরই
ফলে আবার একদিন খৃষ্টান
শক্তি সেই বিজয়ী মুসলমানদের
উত্তরাধিকারীদেরকে এসব দেশ
হতে এমনই ভবে বের করে দিল যে,
সে সব দেশের মুসলমানদের
নামের আর কোন চিহ্নই থাকল না
। ’’ পূর্বসুরীদের ভুল
কি আমরা শুধরে উঠতে পেরেছি?
মাহমুদ ভেবে চলে। যদি পারতাম,
তাহলে ক্ষুদ্র ইসরাইলের
হাতে এমন করে আমরা মার খাব
কেন? আফ্রিকা আর এশিয়ার
বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা এমনই
করে নির্যাতীতই
বা হতে থাকবে কেন? মধ্য এশিয়া
, ফিলিপাইন, সাইপ্রাস,
ইরিত্রিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া,
মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশের মজলুম
মানুষের আমানুষিক
দুর্দশা মাহমুদের
মনকে ভারি করে তুলে। প্রশ্ন
জাগে তার মনে, এদের মুক্তি কত
দূরে? মুসলিম
তরুণরা কি জাগবে না?
তারা কি এগিয়ে আসবে না মজলুম
মানুষের মুক্তির জন্য? আমাদের
চেষ্টা কি বৃথা যাবে?
এই সময় ধীর
পায়ে নাস্তা নিয়ে সেখানে প্রবেশ
করল আফজল। আফজল এই বাড়ীর
প্রহরী, দারোয়ান, রাধুনী,
পরিবেশক সবকিছু। পায়ের
শব্দে মাহমুদের চিন্তা সূত্র ছিন্ন
হয়ে গেল। মাহমুদ
পিছনে ফিরে আফজলকে দেখে মৃদু
হেসে বলল, আজকে নাস্তা খুব
সকাল সকাল মনে হচ্ছে না?
-সকালেই তো জনাবের
কোথাও বেরুবার কথা ছিল।
মাহমুদের মনে পড়ে গেল,
আগামীকালের ‘ ওসেয়ান কিং ’
জাহাজের প্রোগ্রামের
ব্যাপারে অনেক কাজ
আছে বাইরে। যেমন করে হোক
সহজ উপায়ে ওসেয়ান
কিং জাহাজের ভোজসভায়
প্রবেশের একটি পথ করে নিতেই
হবে। গভীর রাত পর্যন্ত মাহমুদ এইবষয়
নিয়ে চিন্তা করছে, কোন সহজ পথ
সে খুঁজে পায়নি। হঠাৎ এ সময়
এমিলিয়ার কতা মনে পড়ে গেল
মাহমুদের। ওসেয়ান কিঙ
জাহাজের
প্রীতিভোজে কাদের নিমন্ত্রণ
করা হবে? সে প্রীতিভোজ
থেকে ডেভিড বেনগুরিয়ানের
পরিবার কি বাদ পড়তে পারে?
মাহামুদের মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল।
নাস্তা শেষ করে মাহমুদ
আফজলকে বলল, এখন আর
বাইরে যাচ্ছি না,
তুমি ডিকশনারীটা বের কর।
ডিকশনারী ডসিয়ারের ছদ্মনাম।
নাস্তা শেষ করে রুমালে মুখ
মুছতে মুছতে সে উঠে দাঁড়াল।
প্রবেশ করল তার ষ্টাডি রূমে।
ডসিয়ারের
পাতা উলটিয়ে বের করল
এমিলিয়ার নাম। তার পুরো নাম
‘পলিন ফ্রেডম্যান ’ এমিলিয়ার
অভ্যেস আচরণ সম্পর্কে বিবরণীকার
লিখেছেন, উঁচু মহলে অবাধ গতি।
অত্যন্ত মিশুক। কিন্তু
আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত
সচেতেন। মুক্তি ও সৌন্দর্যের
পূজারী।
গোঁড়া জাতীয়তাবাদীদের
সাথে তার কোন মিল নেই। ...
হোটেল বারগুলো তার
কাছে ড্রইং রুমের মতো। সাগর
বেলার
দি মিষ্টী হোটেলে তাকে রাত
৯ টার পরে প্রায় প্রতিদিনই
দেখা যায় ’’ ।
মাহমুদ ডসিয়ারের
পাতা বন্ধ করল। মনে মনে বলল,
খোদা সহায় হলে আজ
দি মিষ্টীতে আবার এমিলিয়ার
সাথে দেখা হবে। রাত ন ’ টা।
দি মিষ্টী’ র বলরুম। বিরাট হলঘর।
অর্ধেক চেয়ার টেবিল এখনও
খালি পড়ে আছে।
দরজা থেকে পরিস্কার
চোখে পড়ে এমন
একটি চেয়ারে মাহমুদ বসে আছে।
এমিলিয়া তখনো আসেনি।
মাহমুদের স্বভাব শান্ত মনে কোন
চাঞ্চল্য নেই বটে, কিন্তু
মনে তার প্রশ্ন জাগছে,
সে আসবে কি?
অবশেষে পরম লগ্নটি এল।
বলরুমের দরজায় এসে মুহূর্তের জন্য
দাঁড়াল এমিলিয়া। লাল
পোশাকে এমিলিয়াকে অদ্ভুত
সুন্দরী মনে হচ্ছে। মাহমুদ চোখ
সরিয়ে নিল। ইচ্ছা মাহমুদের আগ্রহ
যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ পরে চোখ তুলে মাহমুদ
দেখল, কয়েক টেবিল
সামনে একটি খালি টেবিলে এমিলিয়া
এসে বসেছে। এমিলিয়ার
দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ
তার
সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।
চোখাচোখি হওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং এর
মতো এমিলিয়া উঠে দাঁড়াল।
মাহমুদ ঈষৎ হেসে উঠে দাঁড়াল।
এমিলিয়া মাহমুদের
পাশে এসে বলল কেমন আছেন?
আপনাকে দেখে যে কতো খুশি হয়েছি তা বোঝাতে পাবো না।
বলে মাহমুদের সামনের
চেয়ারে এমিলিয়া বসে পড়ল।
বলল, আপনার টেবিলে একটু
বসতে পারি?
-এ ধরনের বৃটিশ এটিকেট
কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে খুবই
খারাপ, অভদ্রতা সূচক।
-যেমন? এমিলিয়া ঈষৎ
হেসে বলল।
-যেমন আমাদের এই
ক্ষেত্রে। ‘ আপনার
টেবিলে কি একটু বসতে পারি’
বললে কি আপনি খুশি হতেন?
বিশেষ করে সম্পর্ক
যেখানে ঘণিষ্ঠতর সেখানে ... ...
মৃদু হেসে কথা অসম্পূর্ণ
রেখে মাহমুদ চুপ করল।
-সত্যই তাই। এ ধরনের
ফর্মালিটি আমার কাছে খুবই
পীড়াদায়ক। একটু
থেমে এমিলিয়া বলল, কি অর্ডার
দেব বলুন, হুইস্কি, জিন, ভারমুখ।
-আমি মদ খাই না।
-সত্যি? বলে বিস্ময়ের
সাখে মাহমুদের দিকে চোখ তুলল
এমিলিয়া।
-সত্যি। আপনার নিশ্চয়
অসুবিধা করলাম।
-অসুবিধা নয়। কিন্তু
আমি অবাক হচ্ছি। এই
সমাজে এটা কম বিস্ময়ের
কথা নয়।
বলে এমিলিয়া ওয়েটারকে ডেকে দু ’ বোতল
কোকা কোলার অর্ডার দিল।
মনে হল পরিচিত ওয়েটার
কিছুটা বিস্মিত হলো। ওয়েটার
চলে গেলে মাহমুদ বলল, ‘ বোধ হয়
আজকের সন্ধ্যা আপনার আমি নষ্ট
করলাম।’
-কৃত্রিম আনন্দের উৎসের
চেয়ে অকৃত্রিম আনন্দের উৎসই
কি বেশী সুখকর নয়? মুখ
টিপে হেসে বলল এমিলিয়া।
-উৎসটি যদি অকৃত্রিম হয়
তবেই।
-উৎসটিতে যেহেতু
কৃত্রিমতা নেই, তাই
ওকথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
-না পরখ করেই কি এত বড়
সার্টিফিকেট দেয়া চলে
-পরখ করতে কত সময়
লাগে বলুন?
ইতিমধ্যে ওয়েটার দু ’ বোতল
কোকো কোলা এনে দিল।
কোকা কোলা পান
করতে করতে তাদের অনেক আলাপ
হলো মাহমুদ অনুভব করল, মেয়েটির
মধ্যে তীব্র
আকর্ষণী শক্তি রয়েছে, আর
রয়েছে মানুষকে আপন
করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা।
মাহমুদের মনে পড়েছে ‘ ওসেয়ান
কিং ’ জাহাজের অনুষ্ঠানের
কথা কিন্তু প্রাসঙ্গিক কোন
আলোচনা না তুলে তা জেনে নেয়া যাবে না।
কিন্তু এসব কিছুর পূর্বে মেয়েটির
সাথে আরো কিছু ঘনিষ্ঠতর
হতে হবে।
মাহমুদরা ঠান্ডা পানীয়
ছাড়া আর কিছুই খেল না। জিন,
হুইস্কি, ভারমুখ প্রভৃতি বিভিন্ন
রকমের দামী মদের ফেনিল
উচ্ছ্বাসে তখন হল ঘরটি পূর্ণ। প্রায়
প্রতিটি টেবিলেই একটি যুগল
মুখোমুখি। তাদের প্রকৃত সম্পর্ক কি,
তা করো জানার উপায় নেই।
কিন্তু যে সম্পর্কই থাক, আজ এ হল
ঘরে এ চত্তরে এক সমান
হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। তাদের
ইচ্ছার সামনে বাধ সাধবার কেউ
নেই। ঐ যে সামনের শ্বেতাংগ
তরুণ যুগলটি। শ্বেতাংগিণীর
ঠোঁটের লিপষ্টিক
শ্বেতাংগটির ঠোঁটকে ও রঞ্জিত
করেছে। প্রত্যেকের চোখেই
আদিম নেশা।
এমিলিয়া বলল, এমন সুস্থ
চোখে কখনো কোন দিন আমি হল
ঘরের এ পরিবেশকে দেখিনি। মদ
আমাকে মাতাল করে না বটে,
কিন্তু নেশায় কাতিয়ে দেয়।
এই সময় হলের উজ্জ্বল
আলো নিভে গিয়ে ম্লান
নিলাভ আলোতে ভরে গেল হল
ঘরটি। হলের কোণের ষ্টেজ
থেকে ইংরেজী সুরে বাজনা বেজে উঠল।
প্রতিটি যুগল হাত
ধরাধরি করে উঠে নাচের জন্য
হলের
মাঝখানে গিয়ে জমা হতে এমিলিয়া তার
ডান হাত মাহমুদের
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চলুন।
মাহমুদ এমিলিয়ার হাত
ধরে উঠে ধরে উঠে দাঁড়াল। এই
স্পর্শের জন্যই হোক বা মাহমুদের
নৈতিকতা বোধে আঘাত লাগার
জন্যই হোক মাহমুদের হাত যেন
কেমন কেঁপে উঠল। এই কম্পনই
এমিলিয়ার মধ্যে সংক্রামিত
হলো। তার দেহের জাগল শিহরণ।
মাহমুদের দিকে চেয়ে মুখ
টিপে একটু হাসল এমিলিয়া।
নাচ শুরু হল।
নেচে চলছে সবাই। মাহমুদরাও
নাচছে। এমিলিয়ার তপ্ত
নিঃশ্বাস মাহমুদের গলায়
এসে লাগছে। দু ’ টি দেহের
মধ্যে যে ব্যবধান, তা বেশী কিছু
নয় মোটেই। দু ’ জনেই দু ’ জনের
দেহের উত্তাপ অনুভব
করতে পারে। আর মানুষ
যদি ফেরেশতা না হয়, তাহলে এ
উত্তাপ নারী পুরুষের
হৃদয়ে রোমাঞ্চ জাগাবেই। মাহমুদ
জানে, মানুষ মানুষই,
ফেরেশতা নয়। এ কারণেই আল্লাহ
স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য
নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও
মেলামেশার
একটি সীমারেখা নির্দিষ্ট
করে দিয়েছেন।
সীমারেখাতিক্রম
করলে সামাজিক বিপর্যয়ের
সৃষ্টি হবে। মদের টেবিল আর এই বল
নাচের মঞ্চ কত স্বামী স্ত্রীর
বিচ্ছেদ এবং কত কুমারীর
কুমারীত্বের অপকৃত্যুর যে উৎস তার
ইয়ত্তা নেই। তবুও এটা চলছে চলবে।
মাহমুদের
চিন্তা স্রোতে বাধা পড়ল।
এমিলিয়া ফিস ফিস করে বলল,
তোমাকে কেমন উদাসীন
দেখাচ্ছে। কিছু ভাবছ?
ভালো লাগছে না বুঝি?
মাহমুদ এমিলিয়ার
চোখে চোখ রেখে বলল,
ভাবছি আজকে আমিই বোধ হয়
সবচেয়ে বেশী ভাগ্যবান।
-কেন?
-ডেভিড বেনগুরিয়ানের
নাতনী এমিলিয়াকে আমার
চেয়ে নিবিড়
করে কে পেয়েছে আজ?
এমিলিয়া মাহমুদের কাঁধে মৃদু
চাপ দিয়ে বলল, কথাটা কিন্তু
সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
-মাফ চাচ্ছি।
-মাফ চাইলেই
বুঝি কথা উঠে গেল?
-তাহলে কি করব?
-কিছু করার দরকার ...
এমিলিয়ার কথা শেষ হলো না।
বিজলি বাতি নেভে গেল। হল
ভরে গেল নিকষ
কালো অন্ধকারে।
মাহমুদরা থেমে গেছে।
বাজনা কিন্তু
তখনো বেজে চলেছে।
বোঝা গেল এ
আলো নিভে যাওয়া অস্বাভাবিক।
পরমুহূর্তেই ঘোষকের কণ্ঠ
শোনা গেলঃ ভদ্র মহিলা ও ভদ্র
মহোদয়গণ, আমরা দুঃখিত যে,
যান্ত্রিক গেলিযোগের জন্য
আলো নিভে গেছে, এক
মিনিটের মধ্যেই
আলো ব্যবস্থা হচ্ছে। মনোযোগ
নিজের দিকে কেন্দ্রীভূত হতেই
মাহমুদ অনুভব করল,
এমিলিয়া মাহমুদের বুকে মুখ
গুঁজে রয়েছে এবং দু ’ হাতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে।
মাহমুদ তার অভিনয়ের এ
পর্যায়ে এসে কেঁপে উঠল অপরাধ
বোধের এক তীব্র খেলায়।
কট করে একটি শব্দ হল, তারপর
আলো জ্বলে উঠল আবার।
এমিলিয়া আগেই
সরে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তার আনত,
আরক্ত। কিন্তু
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল।
মুখ তুলে হেসে মাহমুদকে বলল, চলুন
এবার যাওয়া যাক।
দু ’ জন হাত
ধরাধরি করে হোটেল
থেকে বেরিয়ে এল। মাহমুদের
হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল
এমিলিয়া, কোলাহল ভাল
লাগছে না, চলুন পার্কে যাই।
-কোন পার্ক?
-ভিক্টোরিয়া।
গাড়ীতে উঠে মাহমুদ
ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ী ষ্টার্ট
দিতে দিতে বলল -
পার্কটা বড় কুলক্ষণে।
এমিলিয়া মাহমুদের
কাছে সরে এসে তার
কাঁধে মাথাটি হেলান
দিয়ে বলল, কিন্তু ঐ পার্কটিতেই
তোমার সাথে আমার সাক্ষাত!
-তা বঠে। মাহমুদ অনুচ্চ
সুরে বলল। তার মনে তখনো ঝড়।
ওসেয়ান কিং জাহাজে যাবার
উপায় কি?
এমিলিয়ারা কি আমন্ত্রিত
সেখানে? ওদের
সাথে ওখানে প্রবেশের কোন পথ
করা যায়?
পার্কে এসে তারা একটি ছায়া ঘেরা জায়গা দেখে বসে পড়ল।
আকাশে তখন নবমীর চাঁদ। সামনের
গাছটিকে আলোকিত করেছে।
মাহমুদের
কোলে মাথা রেখে এমিলিয়া শুয়ে পড়েছে।
মাহমুদের একটি হাত এমিলিয়ার
দু ’ হাতের মুঠোয়।
ধীরেধীরেএমিলিয়াবলল,
দানিয়েল। তুমি হয়তো ভাবছ
মেয়েটি কি নির্লজ্জ। কিন্তু
বিশ্বাস করো তুমি,
তুমি আমাকে মাতাল করেছ। মদও
কোনদিন আমার আমিত্বকে এমন
করে কেড়ে নিতে পারেনি। বল
নাচে অংশ নিয়েছি অসংখ্যবার,
কিন্তু কোন পুরুষ আমাকে তার
বুকে টানতে পারেনি।
তুমি কি যাদু জান দানিয়েল?
-যাদু নয় এমিলিয়া,
নারী পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ।
বলল মাহমুদ।
-আমি এটা মানিনা পুরুষের
সাথে অনেক মিশেছি। কিন্তু
এমনতো হয়নি। প্রথম সাক্ষাতের
দিন থেকেই আমি বারবার
হারিয়ে ফেলছি নিজেকে।
-এটা হয়তো স্রষ্টার
ইচ্ছা এমিলিয়া। বলে কিন্তু
মাহমুদ নিজেই চমকে উঠল? একি,
এমিলিয়ার জীবনের
সাথে সে কি তাহলে জড়িয়ে যাচ্ছে না
? চাঁদ আর একটু পশ্চিমে সরে গেল।
চাঁদের যে আলোটুকু ছিলো,
তা সরে গেল। যতই সময়
যাচ্ছে মাহমুদের মন
উদ্বেগে ভরে ইঠছে ওসেয়ান
কিং জাহাজের
ব্যাপারটা নিয়ে।
কিভাবে সে কথাটা তুলতে পারে
? হঠাৎ মাথায় তার
একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মাহমুদ
কোল থেকে এমিলিয়ার
মাথা তুলে নিল। বলল, কাল
রাত্রের খানা আমার
ওখানে খাবে এমিলিয়া?
-তুমি বললে যাবো অবশ্যই।
কিন্তু কাল সন্ধ্যায়
একটি পার্টি আছে, আব্বা কাল
সকালে বিলেতে যাচ্ছেন
বলে তিনি যেতে পারছেন না।
তাই আমার
যাওয়া সেখানে জরুরী ছিল।
মাহমুদ বলল -কোথায়
পার্টি জানতে পারি কি?
-নিশ্চয়ই, ‘ ওসেয়ান কিং ’
জাহাজে। তুমি বরং চল
না দানিয়েল সেখানে আমার
সাথে?
-মাহমুদের গোটা শরীর শীর
শীর করে উঠল। মনে মনে আলহামদু
লিল্লাহ উচ্চারণ করল। মুখে বলল,
আমি কি সেখানে অনাহূত হব না?
-নিশ্চয় না। আব্বা যাচ্ছেন
না, মা অসুস্থ। আমি ইচ্ছামত
সাথী নিতে পারি। নিমন্ত্রণ
পত্রও আছে সে রকম। মাহমুদ
মুখটি একটু নিচু করে বলল, ঠিক
আছে আমার আপত্তি নেই।
এমিলিয়া? কিন্তু আমার
ওখানে যাচ্ছ কবে তুমি?
-এমিলিয়া মুখটি উঁচু করল।
এমিলিয়ার ঈষৎ কম্পনরত ঠোঁট
দু ’ টি মাহমুদের মুখের
কাছাকাছি এল। মাহমুদ মুখ উঁচু করল।
এমিলিয়া তার মুখটি আবার
নামিয়ে নিয়ে বলল, আমি যত
কাছে আসছি তুমি তত সরে যাচ্ছ
দূরে।
-আরো কাছে টানতে চাই
হয়তো। বলল মাহমুদ।
-আমি জানি দানিয়েল,
বুঝি। কিন্তু তোমার চরিত্রের এ
পবিত্রতাই আমাকে মুগ্ধ
করেছে সবচেয়ে বেশী।
এমিলিয়ার কথাগুলি গম্ভীর।
দূরের কোন
পেটা ঘড়িতে ১২টা বেজে গেল।
মাহমুদ বলল, চল আজ উঠা যাক। দু ’ জনই
উঠে দাঁড়াল। এক ঝলক
দমকা বাতাস এসে ঝাউ
গাছে শোঁ শোঁ শব্দ তুলল।
চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ।
মাঝে মাঝে নিঃশব্দে ছুটে চলা মোটর
কারের ভেঁপুর নীরবতার
মাঝে কম্পন তুলছে শুধু।
মাহমুদরা হাত
ধরাধরি করে বেরিয়ে এল পার্ক
থেকে। (চলবে......)