মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৭১- রামন আর ইমলিপ্রিয়ার গল্প

অন্যান্য আর পাঁচটা টেলিমার্কেটিং কলের মতই এসেছিল এই কলটাও। রামন ৫ সেকেন্ড শুনেই বলে দিয়েছিল — “সরি ম্যাডাম। আমার ক্রেডিট কার্ডের প্রয়োজন নেই।” কিন্তু ওপার থেকে করুণ আবেদন ভেসে এল — “স্যার, এক মিনিট সময় নেব আপনার। তারপরও পছন্দ না হলে নেবেন না।”

রামন মনে মনে ভাবল, বেচারি মেয়েটা হয়ত সারাদিন একে-ওকে ফোন করে একটাও কার্ড গছাতে পারেনি। তাই অমন উতলা হয়ে তাকে কার্ডের ফিরিস্তি শোনাতে চাইছে। তা শোনাক। শনিবারের বিকাল, লোডশেডিং। টিভি চলছে না। ল্যাপটপও বন্ধ। মোবাইলে যে খুটখাট করে সময় কাটাবে, সে উপায়ও নেই; হাত দিয়েছে কি দেয়নি বেজে উঠেছে ফোন। তা এখন ফোনে গেমস খেলার থেকে না হয় ক্রেডিট কার্ডের চোদ্দ কাহনই শোনা যাক।

মেয়েটা ওপার থেকে গড়গড় করে শোনাতে আরম্ভ করেছে, ক্রেডিট কার্ডটা রামন নিলে কোন কোন সিনেমা হলে ছাড় পাবে, কোন রেস্তোরাঁয় বিশেষ অফার থাকবে আর কোন এয়ারলাইনে বেশি ফ্লায়ার মাইল জুটবে। এছাড়া, বিল পেমেন্টের জন্যেও হাজারো সুবিধা। প্রথম দু বছর কোনও চার্জও নেই। শুনতে শুনতে রামন মনে করার চেষ্টা করতে লাগল, গত মাসের ক্রেডিট কার্ড বিল মিটিয়েছে কিনা, কত টাকা আউটস্ট্যান্ডিং ব্যালেন্স আছে ইত্যাদি।

প্রায় মিনিটি পাঁচেক পর মেয়েটি থামল — “তাহলে স্যার, কী ঠিক করলেন?”

রামন একটা হাই তুলে বলল — “আমার ক্রেডিট কার্ড আছে। দরকার নেই।”

মেয়েটি সামান্য আশাহত — “তার মানে এতক্ষণ আমি এমনি এমনি এত বকলাম! আপনি বরং আরও একটু ভেবে দেখুন।”

রামন নির্লিপ্ত গলায় বলল — “ভাবাভাবির কিছুই নেই। আমি কার্ড নেব না।”

মেয়েটিও নাছোড়বান্দা — “আপনার যে কার্ড আছে তাতে কি আমাদের কার্ডের মত এত সুবিধা আছে?”

রামন এক মুহূর্ত ভেবে বলল — “তা নেই। তবে দুটো কার্ডেরই একটা মিল আছে। বিলটা আমাকেই মেটাতে হবে।”

মেয়েটি সুবিধার জন্যে উত্তরটা ছেঁটে নিল — “নেই। জানতাম নেই। এই সুবিধা আপনাকে আর কেউ দেবে না।”

রামন মনে মনে তারিফ না করে পারল না। বড় হলে এই মেয়ে সাংবাদিক না হয়ে যায় না, যেভাবে রামনের অত কথার মধ্যে থেকে শুধু দরকারি শব্দটা তুলে নিল। বাহ!

মেয়েটি কিন্তু থেমে নেই — “আপনাকে ভাবার জন্যে আরও দুদিন সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আপনার যদি মনে হয় আপনি কার্ডটা নেবেন, তাহলে এক কপি ফোটো, ড্রাভিং লাইসেন্সের ফোটোকপি, আপনার কোম্পানির এইচ আর লেটার তৈরি রাখবেন। আমাদের এক্সিকিউটভ আপনার সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ডকুমেন্টগুলো নিয়ে আসবে।”

রামন ফাঁদে পা দিয়ে ফেলল — “আমার তো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।”

“পাসপোর্ট তো আছে?” মেয়ে তো নয়, একেবারে বিদ্যাধরী — “ওরই একটা ফোটোকপি দিয়ে দেবেন।”

রামন একটু ভেবে বলল — “আচ্ছা।”

মেয়েটি আহ্লাদিত — “তাহলে কাল লোক পাঠাই?”

রামন থতমত খেয়ে বলল — “এই যে আমায় চিন্তা করার জন্যে দুদিন সময় দিলেন!”

শেষ পর্যন্ত ঐ দুদিনেই রফা হল। রামন মেয়েটির প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবে, তারপর কার্ডটা নেওয়ার ব্যাপারে মনস্থ করলে, সব ডকুমেন্ট তৈরি রাখবে। কেউ একজন এসে সেগুলো নিয়ে যাবে।

রামন মনে মনে ভাবল, “করো ফোন দুদিন পরে। ঐ একই জবাব দেব।”



সোমবার অফিসে এসে লাঞ্চের সময় কথায় কথায় রামন কথাটা বলেই ফেলল রাহুলকে। রাহুল রামনের থেকে পাঁচ-ছ মাসের সিনিয়ার। তাই সব বিষয়েই মাতব্বরি দেখানোটা তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের এক্তিয়ারেই পড়ে। সে একগাল হেসে বলল — “শোন, আমি কী করেছিলাম।

“কয়েক মাস আগে আমায় এরকমই একজন ফোন করেছিল। তা আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের ক্রেডিট কার্ডের ইনসিওরেন্স আছে? সে উত্তর দিল, তা আছে।

“আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তোমাদের ব্যাঙ্ক পারসোনাল লোন দেয়? সে উত্তর দিল, দেয়।

“তারপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমি ক্রেডিট কার্ড থেকে আমার পারসোনাল লোনের ই এম আই মেটাতে পারব? এবার লোকটা বলল, তা কী করে হয়?

“এবার আমি মোক্ষম চালটা চাললাম, কেন ক্রেডিট কার্ডের যে ইনসিওরেন্স আছে বললে? লোকটা আমতা আমতা করে ফোন রেখে দিল।”

গল্প শেষ করে রাহুল হো-হো হাসতে শুরু করল। সত্যি বলতে কী, রামন ব্যাপারটা ধরতেই পারল না। কেন যে ক্রেডিট কার্ড থেকে পারসোনাল লোনের ই এম আই মেটানো যাবে না, আর ইনসিওরেন্স থাকলেই বা কী হয়, এসব সে কিছুই জানে না। কিন্তু যেহেতু রাহুল হাসছে, অতএব ব্যাপারটা মজার এবং যেহেতু ওপারের লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিল, অতএব ব্যাপারটা কাজের — এমন সহজ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তার একটুও সময় লাগল না।



ফোনটা এল সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। রামন অফিস থেকে বেরোনোর তোড়জোড় করছে, ওপার থেকে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করল — “স্যার, তাহল কী ঠিক করলেন? কাল লোক পাঠাই?”

রামন দুপুর থেকে ভেঁজে রাখা মতলবের ভাঁজ খুলতে তৎপর হল — “ম্যাডাম, আপনাদের ক্রেডিট কার্ডে ইনসিওরেন্স আছে?”

ওদিক থেকে চটজলদি জবাব এল — “অবশ্যই আছে।”

রামন পরের চালটা চালল — “আপনাদের ব্যাঙ্ক পারসোনাল লোন দেয়?”

প্রশ্ন দুটির পারম্পর্য ধরতে না পেরে মেয়েটা সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল — “হ্যাঁ।”

রামন কিস্তিমাতের হাসি হাসল — “আমি যদি ক্রেডিট কার্ড থেকে পারসোনাল লোনের ই এম আই পে করি? চলবে?”

রামনের মুখ থেকে, কান থেকে বিজয়ীর হাসি গড়াতে শুরু করার আগেই মেয়েটা উত্তর দিল — “এর থেকেও সহজ সলিউশান আছে আমার কাছে। আপনাকে পারসোনাল লোন নিতেই হবে না।”

রামন যাকে কিস্তিমাত ভাবছিল, আসলে তা খেলার মোড়বদল মাত্র।

“আপনি ক্রেডিট কার্ড পেয়ে গেলে, তার থেকেই লোন পেতে পারেন। যে কোনও এটিএম থেকে ক্রেডিট কার্ডটা ইউজ করেই টাকা তুলতে পারবেন। তারপর সেই টাকা সময় মত শোধ করে দিলেই হল।”

মুখস্থ করা প্যাঁচ-পয়জারের বিপদ এই। দরকারের সময় কাজে লাগে কম। তাই রামন আকাশপাতাল অজুহাত খুঁজতে শুরু করল।

ওদিক থেকে আবার তাড়া এল — “তাহলে স্যার কাল আমাদের একজিকিউটিভকে পাঠিয়ে দিই? আপনার থেকে ডকুমেন্টগুলো নিয়ে আসবে।”

রামন এবার মরিয়া হয়ে বলে ফেলল — “ম্যাডাম, আমি সেদিন থেকেই বলছি আমার কার্ড দরকার নেই। আমার একখানা ক্রেডিট কার্ড আছে। আরও একটা নিলে বৌ মারধোর করবে।”

ওদিক থেকে কোনও উত্তর এল না। লাইন কেটে গেছে (বা দিয়েছে) মনে করে উৎফুল্ল রামন জিজ্ঞাসা করল — “হ্যালো?”

হঠাৎ ফোঁস ফোঁস একটা আওয়াজ এল। ব্যাপারটা বুঝতে পাঁচ সেকেন্ড লাগল। মেয়েটি কাঁদছে। রামন পড়ল মহা ফাঁপরে। একটা মেয়ে কাঁদছে, এমন সময় ফোন রেখে দেওয়ার মত পাষণ্ড সে নয়। আবার মেয়েরা কাঁদলে এক মিনিটে চুপ করিয়ে দেবে, তেমন অভিজ্ঞও সে নয়। বউয়ের কথাটা নেহাতই বানিয়ে বলা। নিজের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে মহিলাদের সঙ্গে তার একমাত্র পরিচয়ের জায়গা হল ফেসবুক। সেখানে কান্নাকাটি অনেকেই করে, কিন্তু সেসবে কান দেওয়ার দায় তার নয়।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় রামন তবু চেষ্টা করল — “আপনার নাম কি ম্যাডাম?”

ওদিক থেকে সোজা উত্তর এল না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অনেক চোখের জল এবং নাকের জলের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা গেল, মেয়েটি সারা মাসে অনেককেই অনুরোধ করেছে ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার। কিন্তু প্রায় সকলেই রামনের মত কথা দিয়েও পরে উলটো-পালটা অজুহাত দিয়ে শেষ পর্যন্ত ডুবিয়েছে। রামন মনেও করতে পারল না সে কখন কথা দিয়েছিল, প্রথম থেকেই সে বলে আসছে তার ক্রেডিট কার্ড দরকার নেই। দোষের মধ্যে সে বেশি জোর দিয়ে ‘না’ বলেনি, কারণ তেমনটা রামনের ধাতে সয় না। সেই যে একজন অমায়িক ভদ্রলোক ছিলেন, যিনি কাউকে চটে গিয়ে কিছু বলতে পারতেন না। একবার একটা গাড়ি বিপজ্জনকভাবে তাঁর গাড়িটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ায় রাগ করে বলেছিলেন — “Go to hell.” কিন্তু পরমুহূর্তেই স্বভাবসিদ্ধ অমায়িক গলায় জুড়েছিলেন — “Please.” রামনও তেমনই। কাউকে জোর গলায় কিছু বলা তার স্বভাবে নেই, সাহসেও কুলোয় না। তাই কথোপকথন শুরু করার জন্যে আবারও সে জিজ্ঞাসা করল — “ম্যাডাম, আপনার নাম কি?”

জানা গেল মেয়েটির নাম ইমলিপ্রিয়া। আশ্চর্যের ব্যাপার, তার অফিস রামনের অফিসের সামনেই। রাস্তার এদিক আর ওদিক।

রামন অনুনয়ের গলায় বলল – “রাত্রি বেশ হয়েছে। আমার খিদে পেয়েছে। আপনিও নিশ্চয় বাড়ি যাবেন। চাইলে আমরা রাস্তার ওপাশের পাঞ্জাবি ধাবাতে ডিনার করে নিতে পারি। খেতে খেতেই ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপারটাও ফাইনাল করে নেওয়া যাবে। আপনি চাইলে আমার গাড়িতে আপনাকে বাড়িও পৌঁছে দেব।”

ওদিকে দশ সেকেন্ডের নীরবতা। মেয়েটি বোধহয় বুঝে নিতে চাইছিল এপারের লোকটাকে। এতদিন জনে জনে ফোন করে প্রত্যাখ্যানই শুনেছে সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। জীবন তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে বিনামূল্যে ব্রেকফাস্ট পাওয়া যায় না। কিন্তু ডিনার? একটু ভেবেচিন্তে ইমলিপ্রিয়া বলল — “ঠিক আছে। কিন্তু আমার ডিনারের বিল আমিই দেব।” তারপর আরও একটু থেমে বলল — “আমায় সিল্ক বোর্ড মোড়ে নামিয়ে দিলেই হবে। ওখান থেকে অটো নিয়ে নেব।”



এই গল্পটা রামন বছরখানেক আগে আমায় শুনিয়েছিল। রামনও যে কোনও মেয়েকে ডিনারের জন্যে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, সেটার জানান দিতেই সম্ভবত শুনিয়েছিল আমায়। শেষ ছ মাস প্রোজেক্ট বদলের জন্যে রামন অন্য জায়গায় বসে, আর দেখা প্রায় হয়ই না বলতে গেলে। অনেকদিন পর আজ দুপুরে রামন এসেছিল আমার কিউবিকলে। একমুখ হেসে একটা কার্ড এগিয়ে দিল — “বিয়ে করছি।”

কবে, কোথায়, কখন এমন একরাশ প্রশ্নের শুরুতেই দেখি মেরুন খামের ওপর হলুদ কালিতে এমবসড করা ‘রামন ওয়েডস ইমলিপ্রিয়া’।

আর জিজ্ঞাসার কোনও মানে হয় না। মুচকি হেসে বললাম — “যাব।”

বিয়ে সামনের রবিবার।