লেখাঃ নওশাদুল ইসলাম নবীন
বাসায় কদিন ধরে বুয়া আসছে না ।রান্নার কাজ নিয়ে ব্যাপক চিন্তায় টিটু ।মধ্য দুপুরে এলাকার রাস্তায় হাঁটছে টিটু ।এমন সময় বুয়ার সাথে দেখা ।
-কি ব্যাপার বুয়া ,বাসায় আসছেন না কেনো ?
-মেরি জওয়ানি বাররাহি হে ।মে থাক গায়া হু ।
অর তুমারা বহত কমজোর হো ,ইতনিসি মাদাত নেহি কর সাকতা মেরি ।
মে নেহি করসাকতা তুমারা কাম । টিটুর তো মাথায় হাত ।এ কেমন কথা !টিটু
হিন্দী একটু আকটু বোঝে ,আর বুয়ার এই ভাষার কারণও বুঝলো সে ।তার বাসায় বুয়া অবসর সময়ে সিরিয়াল গিলত ।হায়রে সিরিয়াল !
-ইয়ে মানে বুয়া বুঝলাম না কি বললেন ...
-ওউ তুমি হিন্দীও বোঝ না ।শোন
পোলা ,আমি বুড়া হইয়া গেছি ।এখন আর অতকাজ করতে পারি না ।আর তোমরা তো সব ছেলে মানুষ ,সাহায্যও করতে পারো না ।তাই
আর কাজ করতে পারমু না । টিটু বুয়ার হিন্দীর মানে শুনিয়া অস্ফুষ্ট
স্বরে বলল ,মাইরালা কেউ আমারে মাইরালা । টিটুর নতুন কর্মসূচি হিসেবে সে তার ছাত্র
ছাত্রীদের পড়াতে বসে ।এলাকার একটি মাঠে । প্যান্ট না পড়া বাচ্চা থেকে শুরু করে নতুন
রিক্সাচালানো ছেলেটিও সেখানে থাকে ।টিটু তার ছোট বোর্ডে অক্ষরশিক্ষা দেয়া শুরু
করেছে তাদের ।প্যান্ট না পড়া বাচ্চা মানে তার বাবা মা এখনও বাচ্চাটিকে প্যান্ট কিনে দেবারপ্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি ।বাচ্চাটিও অন্য
ছেলেমেয়েদের সাথে মাথা নাড়ে । ওরা যতটা না পড়তে এসেছে ,এর চেয়ে টিটুর
দেয়া প্রতিদিনের টিফিনের জন্য এসেছে বেশি ।
এখন খাবারের লোভে আসলেও টিটুর বিশ্বাস এরা একদিন ঠিকই লেখাপড়ার মর্ম বুঝবে ।
অ তে অজগর ।অজগরটি আসছে তেড়ে । আ তে আম ।আমটি আজ খাব পেড়ে ।
বাচ্চাগুলোও তার সাথে পড়ে যায় । ইতোমধ্যে তারা তাদের শিক্ষকের নামেও লাইন
বানানো শুরু করেছে । ট তে টিটু ।টিটুর মাথায় লাগছে গিট্টু ।
এভাবে নাম বানিয়ে মজায় কেটে যায় ওদের ক্লাস ।টিটুও একরকম আত্মতৃপ্তি নিয়ে তার
মেসে ফিরে । প্যারাডাইস মঞ্জিল ।পাঁচতলা বাড়িটির মালিক
অতিশয় শিক্ষিত ব্যক্তি ।বাড়ির পাঁচতলায় টিটুর মেস ।জহির ,তপু আর টিটু একসাথে থাকে ।সবাই অনার্সে পড়ছে ।টিটুর এই জনদরদিমূলক কাজ
গুলোকে নিয়ে বরাবরের মতো হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকে জহির আর তপু ।কারণ আজ পর্যন্ত
কোন কাজেই সফল হয় নি টিটু ।এর আগে একবার এলাকার ভিক্ষুকদের কাজের জন্য
ট্রেনিং কর্মসূচি চালু করেছিল টিটু ।তাদের বদৌলতে খাওয়া দাওয়া ফ্রী ।কিন্তু তারা শুধু
ট্রেনিংই নিত কোন কাজের কাছেও যেত না । তো এরকম কিছু কর্মসূচি ভেস্তে যাবার পর টিটু হাতে নিল নিরক্ষর দূরীকরন কর্মসূচী যা এখনও চলছে ।তাদের কথায় কখনও দমে না টিটু । তবে কয়েকদিন ধরে তাদের হাসির খোরাকে নতুন
বিষয় হিসেবে নিতুর আগমন । বাড়িওয়ালার মেয়ে নিতু ।ছাদে আসলে টিটুর
সাথে মাঝে মাঝে কথা হয় ।টিটু মনোমুগ্ধ হয়ে সেসব কথা বারবার তার বন্ধুদের বলে আর লজ্জা পায় ।আসলে সে কাছের মানুষদের খুব
বিশ্বাস করে ।তাই সব কিছুই তাদের কাছে প্রকাশ করে ।অন্তরের কথা , বাহিরের
কথা সব ।এজন্য প্রায়ই ওর বন্ধুদের মুখে শোনা যায় , যাই হোক টিটুর মন কিন্তু
অনেক ভালো ,ফকফকা পরিষ্কার । তো একদিন
ছাদে নিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো । কানে হেডফোন গুজানো ।বসন্তের বাতাসে তার কেশের সাথে সাথে ওড়নাও উড়তে লাগলো ।টিটু
ভীত বুকে এসে পাশে দাঁড়ালো নিতুর ।নিতু টিটুর দিকে ফিরে একটা ছোট্ট হাসি দিল ।
-গান শুনো নিতু ?
-জি টিটু ভাই
-কি গান শুনছো ?
-হিন্দী গান ।ঐ যে দাবাং টু মুভির ফেবিকল
ছে গানটা
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো -তুমি বাংলা গান
শোন না ?
-কি যে বলেন টিটু ভাই ।ঐসব খ্যাত গানে সময়
নষ্ট করার মতো টাইম আমার নাই ।বাংলা গান
তো ছাগলেও শোনে না ।
-বাংলা গান খ্যাত গান ?ঠিকই বলছো বাংলা গান
ছাগলে শোনে না ,শোনে মানুষ । তোমাকে আমি কিছু গান দেই এরপর
তুমি মিলিয়ে দেখবে এর সাথে অন্য কোন ভাষার গানের তুলনা হয় কিনা ।
প্রতিটি লাইন তুমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবে ।এই ভাষায়
যে কি আবেগ ,অনুভূতি কাজ করে !এই ভাষার জন্য মানুষ প্রান পর্যন্ত দিয়েছে ।এমন
একটি ভাষা তোমার মাতৃভাষা ।তোমার তো বাংলা গান ,ভাষা নিয়ে গর্ব থাকা উচিত ।
টিটু নেমে আসল ওখান থেকে ।আর নিতু ঠায় দাড়িয়ে রইলো ।
টিটু কখনও অন্যায় কিছু শুনতে পারে না ।
তত্ক্ষনাত্ প্রতিবাদ করে সে ।৫ম শ্রেনীতে পড়ার সময় কি একটা কারণে শ্রেনীশিক্ষকের কথার জবাব দিয়েছিল ।পরে ঐ শিক্ষকই তাকে উপাধি দিয়েছিলেন "সত্সাহসী ।"
ওদিকে টিটু আবার মহা ফাপড়ে ।সে তার জ্ঞান
নিয়ে নিতুর ছোট ভাই সাফাকে ঝেড়ে এসেছে । দোষ আসলে সাফারই ।ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ার দরুন কথায় কথায় ইংরেজি চর্চা করছে ।
বাংলা ঠিকমত বলতেও পারে না । বিপত্তি হচ্ছে সাফা তার বাবার কাছে নালিশ
করেছে ।জহির আর তপু তো হেসেই খুন ।
-আহারে টিটু তো এবার গেলু ,গেলু রে গেলু
-তোরে আগেই কইছি সবাইরে জ্ঞান দিস না ।
যা শালা এবার মর ।পারলে তোর শ্বশুর
আব্বারেও জ্ঞান দিস ।হে হে ।
টিটু ভীতবুকে নিতুর বাবা জামাল সাহেবের
রুমে গেল ।
-সালাম চাচা ।কেমন আছেন চাচা ?
-এইতো ভাল ।শুনলাম
তুমি নাকি সাফাকে ইংরেজি শিখতে বারন
করেছো ?ইংরেজির মূল্য বোঝো ?
-না চাচা আমি তাতো বলি নি ।ও
তো বাংলা ঠিকমত বলতে পারে না ।তাই বলেছি বাংলা শেখো ।মাতৃভাষাকে কি একটুকুও
গুরুত্ব দিবেনা ?চাচা ক্ষমা করবেন আপনারও সমস্যা আছে ।নইলেকেউ বাসার নাম প্যারাডাইস -চুপ করো বেয়াদপ ।তোমার কাছ থেকে আমার
শিখতে হবে ?তুমি কিভাবে ভাবছো সাফা তোমার
ঐ বস্তির ছাত্রদের সাথে বাংলা শিখবে ?
-না চাচা আমিতো ওকে একথা বলিনি ।
-চুপ ফের মিথ্যে কথা ।কালই আমার
বাড়ি থেকে চলে যাবে ।যাও এখন ।
টিটু রুমে এসে ওদের সব জানালো ।জহির আর তপু তো চাচার কাছে যেতে উদ্যত হয় ।টিটু ওদের বারণ করে ।বলে ,শুধু শুধু আমার জন্য
ঝামেলা পড়বি কেনো তোরা ?
-তুই কিভাবে ভাবলি একা চলে যাবি ?আমরাও
থাকবো না ।
এমন সময় ওদের দরজায় টোকা পড়ে । দরজা খুলে দেখে নিতু আর সাফা দাঁড়ানো ।নিতু সাফাকে ইঙ্গিত করতেই সাফা টিটুর
কাছে ক্ষমা চাইল ।বললো সে তার বাবাকে মিথ্যে বলেছে । টিটু হতবাক হয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে আছে । সেই ছোট্ট হাসি ।নিতু সাফাকে নিচে যেতে বলল
।নিতু এবার টিটুকে বলল ,
-টিটু ভাই চলেন একটু হাঁটি ।
টিটু
নিতুকে নিয়ে শিশিরে জড়ানো ঘাসে হাঁটছে খালি পায়ে । গুনগুন করে বাংলা গান গাইছে নিতু ।এক অদ্ভুত মাদকতায় টিটুর মন ভরে গেলো । টিটুর সেই অক্ষরশিক্ষার কাজ অনেকদূর এগিয়েছে ।এলাকার অনেক কিন্ডারগার্ডেনের বাচ্চারাও আসে যাদের স্কুলে বাংলা শিখানো হয় না ।নিতুও মাঝে মাঝে বাচ্চাদের পড়ায় ।
পড়ায় - ব তে বাংলা ।বাংলা আমার মাতৃভাষা ।