বক্তাঃ নোমান আলী খান
ইনশাল্লাহ আমি আজকে আপনাদের সামনে যা পরিবেশন করতে যাচ্ছি, তা কুরআন থেকে সংগৃহীত কিন্তু সম্প্রতি ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনা দ্বারা এটি অনুপ্রাণিত। এবং ঘটনাটি এখনও সংবাদে প্রচারিত হচ্ছে। এরকম ঘটনা যতবারই খবরে আসে, মুসলিম মন যেন বরফের মত জমে যায়, অবশ হয়ে যায়, আমরা কি প্রতিক্রিয়া জানাবো? আমরা একটি দুর্যোগ সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটা তারপর আরেকটা দুর্যোগ চলে আসছে। এবং এগুলো বিভিন্ন ধরণের। কখনও এগুলো এমন কোন ঘটনা যা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘটেছে এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে মুসলিমরা অন্যদের প্রতি করেছে। এবং উভয় ক্ষেত্রেই আমরা হতবুদ্ধি হয়ে যাই যে এর উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে! আমরা কিভাবে এর মোকাবিলা করব। শুধু ব্যক্তিগতভাবেই নয়, বরং সামাজিকভাবে এবং বিশদভাবে বললে এক উম্মাহ হিসেবে। প্রথমেই আমি বলতে চাই............ আমি আপনাদের প্রতি আজকে ৪ থেকে ৫ টি বিষয় তুলে ধরব ইনশাল্লাহ। আর আপনি এবং আমি উভয়েই যে হতাশা বোধ করছি এই ঘটনাগুলো নিয়ে তা সত্ত্বেও আমি আশা করি যে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট ও ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে পারব।
সর্বপ্রথম আমি আপনাদের যা বলতে চাই তা হল, অপরাধী সর্বদাই একজন অপরাধী। সে কোন ধর্মের এটা কোন বিবেচ্য বিষয় নয়। কেউ একজন যখন খুন করে, এমন কাওকে যার তা প্রাপ্য ছিলনা, এটা কোন ব্যাপার না যে সে মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি অথবা নাস্তিক। তারা আইনের চোখে সমান, তারা মুসলিমদের চোখেও সমান। এটা এমন নয় যে, কেউ অপরাধ করলো, আর সে একজন মুসলিম, তাই সে আমার বা আপনার কাছে কম দোষী মনে হবে। না এটা সত্য নয়। এটা ভেবে বিভ্রান্ত হবেন না যে, “ইন্নামাল মু’মিনু ইখ্বা” – সকল বিশ্বাসী ভাই ভাই, এটা আপনাকে ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে বলছে।
বাস্তবতা হল আল্লাহ আজ্জাওাযাল কুরআনে খুব পরিষ্কারভাবে আমাদেরকে ন্যায় বিচার করতে বলেছেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ ۚ ''হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও।''(নিসা ঃ ১৩৫) “ওয়ালাও আলা আনফুসিকুম”, তোমরা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে দৃঢ় হও এমনকি তা যদি নিজের বিরুদ্ধেও হয়। এবং মুসলিমরা যদি কোন খারাপ কিছু করে, তাহলে এটা আসলেই খারাপ কিছু, আপনি তা লুকাতে পারেননা বা এড়িয়ে যেতে পারেননা। অনেকের জন্যই একটি সহজ ভ্রান্তি হল যে তারা ন্যায় বিচার এবং প্রতিশোধ এর মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। ন্যায় বিচার ও প্রতিশোধ নিয়ে বিভ্রান্ত হন। আমি যা বুঝাতে চাচ্ছি যে, আমি শিশুসুলভ একটি উদাহরণ দেই, যাতে এই পয়েন্টটি পরিষ্কার হয়, যখন আপনার সন্তান কোন অপরাধ করে, আপনি তাকে বলেন যে তুমি অপরাধ করেছ, সে জবাব দেয়, আমার ভাইও এমন করেছে, সেও এটাই করেছে। তারমানে এই নয় যে আরেকজন কোন অপরাধ করলে আপনার অপরাধও ন্যায়সঙ্গত হবে। আপনি আপনার নিজের অপরাধের জন্য দায়ী। আর আপনি এটা বলে এড়াতে পারেন না যে, তাহলে তাদের কি হবে? না না, তাদের আলাদা বিচার করা হবে। সেটা আলাদা একটি সমস্যা। তাদের অপরাধ আর আপনার অপরাধকে এক করে ফেলবেন না। “وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ۖ ”-এবং তোমাদের উপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্যে তোমরা দায়ী।(২৪;৫৪) তোমাকে নিজের বোঝা নিজেকেই বইতে হবে। যা তুমি অর্জন করেছ।
আল্লাহ আমাদেরকে অন্যের ভাল কাজের ভাগ নিতে অনুমতি দেননি, এবং তিনি এটাও অনুমতি দেন না যে আমি অন্যের অপরাধ দ্বারা নিজের অপরাধকে ন্যায়সঙ্গত বলব। তিনি এর অনুমতি দেন না। لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُم مَّا كَسَبْتُمْ - তারা যা কিছু উপার্জন করেছে, তা তাদের নিজেদের জন্যই আর তোমরা যা উপার্জন করবে, তা তোমাদের জন্য। । এটা ছিল আমার বক্তব্যের প্রথম পয়েন্ট।
দ্বিতীয়ত, এ লোকেরা একধরনের লজ্জার কারণ যখন তারা ইসলামের নামে বা মুসলিম হিসেবে এই ধরণের অপরাধ করে। তারা অবশ্যই মুসলিমদের জন্য লজ্জার কারণ। কিন্তু তারা এর চেয়েও বেশি কিছু। আমারা লজ্জিত এবং অপমানিত যা ঘটছে তার দ্বারা। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। হ্যাঁ, আমি অপরাধী নই, আমি কোন কিছু করিনি, কিন্তু আমি তাদের সাথে কিছু জিনিষ শেয়ার করি। এরা মুসলিম, অন্তত তারা এটা দাবি করে। তারা ইসলামের নামে এসব করে। তাই যতক্ষণ তারা এটা দাবি করছে অন্তত কাগজে কলমে তাদের সাথে আমার একটি সম্পর্ক আছে। আর এতোটুকুই লজ্জা পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি এখন বলতে চাই যে, এটা আপনার আর আমার জন্য কী উপস্থাপন করে। সবার আগে আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, আমাদের সামগ্রিক দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর এটা হবে আমার আজকের খুৎবার শেষ অংশ। সামগ্রিক দায়বদ্ধতা বলতে কি বুঝায়? আজকে উম্মাহ এক বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে, এবং এই উম্মাহের প্রতিটি সদস্যের দায়িত্ব হল এমন কিছু করা যাতে এই বিশৃঙ্খলা দূর হয়। আমাদের নিজেদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমাদের তা করতে হবে। আমারা বিশ্বের সব বিশৃঙ্খলা দূর করতে পারবোনা, আমরা উন্মত্ততা আর পাগলামিও বন্ধ করতে পারবোনা, কিন্তু অন্তত পক্ষে আমাদের নিজেদের দায়িত্বের অংশটুকু করতে হবে। নিদেনপক্ষে এতটুকু। একটা জিনিস পরিষ্কার জেনে রাখুন, একটা জিনিস যা এই বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে এবং পাগলামি কে সাহায্য করছে তা হল, কিছু মুসলিম মনে মনে এই ধরণের লোকদের কাজকে ঠিক বলে মনে করে। তারা মনে করে, তারা যা করছে হয়ত তা কোনোভাবে ইসলামিক বলা যায়। আর আমি আপনাদেরকে কোন সংশয় ছাড়াই বলতে চাই, কোন বিভ্রান্তি ছাড়াই, আমি ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে এই দ্বীনের সাথে আছি, আর আমার মনে কোন দ্বিধা বা ভ্রান্তি নেই যে, এর কোন কিছুই ইসলামিক নয়। এমনকি তা ইসলামিক হওয়ার ধারে কাছেও নেই। বরং ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাকে এই উপদেশ দিব, আমি আমার ছেলেমেয়ে এবং বন্ধুদেরও এই পরামর্শ দিয়ে থাকি, ওইসব কার্টুন দেখবেন না, ওইসব ইউটিউব ভিডিও দেখবেন না বা ওইসব কমেন্ট বা বই পড়বেন না। আমি চাইনা যে আপনারা এসব পড়েন, এমনকি আপনারা দেখেন তাও চাইনা, এটা আপনার সময়ের যোগ্য নয়, কখনই নয়। কিন্তু আমি আপনাদের কিছু একটা বলব, ওই কার্টুনগুলো ঠিক যতটা ক্ষতিসাধক-- নবীজি (সা:) এর নামে, ইসলামের নামে, আল্লাহর নামে কিছু করা যা আসলে ইসলামের শিক্ষার বিরুদ্ধে, এটাও ঠিক ততটাই ক্ষতিসাধক। যখন তারা ইসলামের বিরুদ্ধে নোংরা অপপ্রচার চালাচ্ছে ইসলাম কে অপমানিত করার মাধ্যমে, তেমনি আপনিও ইসলামের অপপ্রচার চালাচ্ছেন হিংস্রতা, মৃত্যু আর অন্যায়ের মাধ্যমে। আর এটাকে আল্লাহ্র দ্বীন বলছেন। এটাও সমান অপরাধ, আর আমরা এটা দ্বারা সমানভাবেই আঘাত পাচ্ছি। এটা নিজেই একটি অন্যায়। এটা ছিল আমার দ্বিতীয় পয়েন্ট যার প্রতি আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।
তাদের কাছে কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ নেই। কেউ কেউ এক্ষেত্রে ‘কাব বিন আশরাফ’ এর ঘটনাটি উল্লেখ করতে চায়। যে একজন বিখ্যাত কবি ছিল মহানবী (সা:) এর সময়ে। অর্ধেক আরব, অর্ধেক ইহুদি। সে আল্লাহ্র নবী (সা:) এর প্রতি অত্যধিক শত্রুভাবাপন্ন ছিল। এমন ঘটনাও কয়েকবার ঘটেছে যে,সে কিছু মুসলিমদেরকে ডেকে নিয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ ) যা করতে বলেছেন তার উল্টোটা বুঝাতে চাইতো।
আর বিভিন্ন সময়ে তার কথোপকথন নিয়ে আয়াত নাজিল হয়েছে, এই লোকটি এতই খারাপ ছিল যে তার উপর আল্লাহ নাখোশ হয়ে আয়াত নাজিল করেছেন। সে ইসলামের সাধারণ কোন শত্রু নয়। কিছু লোক তাকে নিয়ে ভুল করে, কারণ সে ছিল একজন কবি। এবং সে মুসলিম নারীদের নিয়ে নোংরা কবিতা লিখত, নাম উল্লেখ করে। সে মুসলিম নারীদের নিয়ে নোংরা কবিতা লিখত, নাম উল্লেখ করে। শুধু মহানবী (সা:) এর বিরুদ্ধে কবিতা নয়, যা অবশ্যই খারাপ, বরং মুসলিম নারীদের নিয়েও। আপনারা চিন্তা করুন, কেউ যদি আমাদের মেয়ে, বোন বা মায়ের বিরুদ্ধে নোংরা কবিতা লিখে, আমরা কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবো? আর কিছু লোক বলে যে যেহেতু সে কবিতা লিখত তা নবী (সা:) বলেছেন, “মা আল্লি বি কাআব”- কে কা'ব কে হত্যা করবে আমার জন্য? এবং একজন সাহাবি উঠে দাঁড়ালেন এবং অবশেষে কা'বকে হত্যা করা হল। কারণ সে কবিতা লিখত। তাহলে এখন আমরা পেলাম যে, আপনি যে কোন কিছুই বলতে পারেন, এই লোক কবিতা লিখত তাই মহানবী (সা:) হুকুম করেছেন যে তাকে হত্যা করা হোক। একটু থামুন। এ হল সে লোক যে আল্লাহ্র নবী (সা:) কে হত্যা করতে চেয়েছিল তার খাবারে বিষ মিশিয়ে। আর মহানবী (সা:) এর খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনাও এর কাছ থেকেই এসেছিল। আর সে কয়েকবার নবীজিকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, এমনকি আবু সুফিয়ান মুসলিম হওয়ার আগে তার সাথেও গোপন চক্রান্ত করেছিল বদর যুদ্ধের পরেই। এটা ছিল কয়েকটা ঘটনার একটি। তাই তার নবীজি (সা:) এর বিরুদ্ধে সারা জীবনের এত শত্রুতা নিয়ে, আর এটাও মনে রাখতে হবে নবীজি (সা:) যখন মদিনায় বাস করছিলেন, তখন সে যে কোন উপায়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল, এর মানে কি জানেন? এর মানে যেন প্রেসিডেন্টকে হত্যার চেষ্টা করা। একে আপনি বলতে পারেন রাষ্ট্রের শত্রু। আর এর শাস্তি হল মৃত্যু। যে কোন রাষ্ট্রেই। আর এটাকেই ভুলে ভাবা হয় যে, এই লোকটি কবিতা লিখেছে তাই একে হত্যা করতে হবে। তাই যে কেউ ইসলাম বা মহানবী (সা:) বা কুরআনের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে হত্যা করতে হবে। এটা পাগলামি। আর শুধু এটাই নয়, এটা ঘটনার এক অংশ, কিন্তু এতে এটাও প্রকাশিত হয় যে মুসলিমদের চিন্তা করার ক্ষমতা কতোটা সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ সমগ্র কুরআনে সকল নবীর অসংখ্য দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও আপনি একটি ঘটনাকে বেঁচে নেন, যে ঘটনাটি আপনি নিজেও ঠিকমতো বুঝেন না, কিন্তু একে আপনি ব্যবহার করছেন কাউকে হত্যা করার জন্য।