০১
-আসসালামুয়ালাইকুম স্যার, আসতে পারি?
-না, আসতে পারস না। ঐখানে দাঁড়া।
-জ্বী স্যার।
আল্লাহ মাফ চাই।রহমত স্যারের মেজাজ খারাপ আজ। চোখ বড় বড় করে ফেলেছেন। পুকুর থেকে কাতল মাছ ধরে আনলে মাছটি কিছুক্ষণ দাপানোর পর এরকম চোখ বড় করে পড়ে থাকে। স্যার রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন। ‘কয়মিনিট লেট করেছিস আজ আবার?’
-ছয় মিনিট স্যার। মিন মিনে গলায় উত্তর করল শুভ।
-ছয় মিনিট দাঁড়িয়ে থাক গেটে।
রহমত উল্লাহ সাহেব সাধনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। অত্যন্ত কড়া । ইংরেজী পড়ান। ‘প্রত্যেক প্রকার টেন্সের উদাহরণ বল’ জাতীয় কঠিন প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলেও বেধড়ক মার দেন। মার দেবার পর কাপড় তুলে দেখেন। বেতের বাড়ি যেখানে পড়েছে সেখানে এক দেড় ইঞ্ছি ফুলে না গেলে শান্তি পান না। মনের ভেতর খচ খচ করে।
পূর্বের যে কোন দিনের তুলনায় রহমত সাহেব আজ বেশ দয়ালু। শুভকে তেমন কোন শাস্তি পেতে হল না। তবে ক্লাসের বন্ধুরা খুব মজা নিচ্ছে। অনেকেই মিটমিট করে হাসছে। বোকা ফজলুটা ফিক ফিক করে হাসছে।
হঠাৎ স্যার ফজলুর দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। ‘ঐ ব্যাটা হাসছিস কেন? ট্রান্সলেশন বল, ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগীটি মারা গেল... এখানে কোনটা কোন টেন্স?’
ফজলুর হাসি বন্ধ। সে কোন কথাই বলতে পারছে না। শুধুমাত্র ঠোটদুটো ফাক হয়ে আছে। স্যারের গলার আওয়াজ পূর্বের চেয়ে চড়ে গেল। বাজখাঁই গলায় আদেশ দিলেন ‘ ঐ লাবু, আমার চিকন বেতটা নিয়ে আয়’। পেছন বেঞ্চ থেকে লাবু শুড়শুড় করে বের হয়ে গেল।
রহমত স্যারের দুটা বেত। প্রাইভেট। এগুলো অন্য কোন স্যাররা ব্যাবহার করেন না। একটা মোটা, একটা চিকন।
তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? আয় ভেতরে আয়। দেখি তোর বিদ্যের দৌড় কতটুকু? স্যারের নজর গেটে দাঁড়ানো শুভর দিকে সরে গেল।
ক্লাসে পাঁচ দশ মিনিট দেড়ীতে আসা শুভর জন্য আজই প্রথম নয়। কেন যেন সে এটা নিয়মিত করে থাকে? ক্লাস সিক্সের সব ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে স্কুল থেকে তার বাড়ি সবচেয়ে কাছে। স্কুল থেকে এক দৌড়ে তিন মিনিটের পথ। তবে বদভ্যাস শুভকে পেয়ে বসেছে। সপ্তাহে দুই-তিন লেট হওয়া রুটিন হয়ে গেছে। বিশেষ করে সোমবার ও বুধবার। এই দুদিন আবার রহমত স্যারের দিনের প্রথম ক্লাস।
স্যারের রামধমকে মাথা নিচু করে শুভ ক্লাসের ভেতর পেছনের বেঞ্চের দিকে গুটি গুটি পায়ে আগায়। বসার পূর্বমূহুর্তেই মেঘের গর্জন। স্যার চেচাচ্ছেন, এই কান ধর। কান ধরে পাচঁবার বল,আই শ্যাল নট বি লেট ইন দ্যা ক্লাস এভার ফ্রম টুমরো।
আলতো আঙ্গুলে দুই কানে হাত বুলিয়ে শুভ আবৃত্তি করছে, আই শ্যাল নট বি লেট ইন দ্যা ক্লাস এভার ফ্রম টুমরো। আই শ্যাল নট......
ওদিকে চিকন লম্বা বেত নিয়ে হাজির লাবু। স্যার বেত হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন ফজলুর দিকে। ‘আমার ক্লাসে হাসাহাসি, এত বড়......’
০২
দিনটাই আজ খারাপ গেল । রহমত স্যার দিয়ে শুরু। রোজিনা ম্যাডামের মত নরম নিরীহ মহিলা জেনারেল সাইন্সের ক্লাসে কত কথা শুনালেন। অমুক বিজ্ঞানী কত সালে নোবেল পেয়েছেন, কত সালে মারা গেছেন? এটা জেনে কার কি লাভ? যতসব ফালতু প্রশ্ন। স্কুল থেকে ফিরে শুভ ধপাস করে ব্যাগ রাখল টেবিলে।
ক্লান্ত লাগছে। একইসাথে বিরক্ত। আর যাই হোক আজ আর খেলতে যাওয়া যাবে না। মন টানছে না। সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল শুভ। মিনিটখনেক ঘুমের ভান করে টেবিল হতে ফেলুদা টেনে নিল। দেখা যাক তপসে কতদুর এগুলো?
এবার মনে খেলা ভালই জমবে। জটায়ুর খবর আছে।
পনের বিশ মিনিট পর দরজা খুলে গেল নিঃশব্দে। পাশ ফিরে দেখল মা দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
উকিঝুকি দিয়ে মা হতাশ গলায় বললেন, কি করছিস, এসেই আবার আউটবই? এই করেইতো জীবনে কোনদিন ফার্স্ট হইতে পারলি না। ছেলে আমার পন্ডিত হইছে। সারারাত গল্পের বই পড়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে বারটার সময়। স্কুলে যায় স্কুল ছুটির সময়।
শুভ কোন কথা বলল না। কারণ মা ঠিক বলছে না। সে কখনো বারটার সময় উঠে না। তবে ঘুমাতে একটু দেরি হয়। ইদানীং প্রায়ই দেড়টা-দুটা বেজে যাচ্ছে। গ্রামের মধ্যে এটা অনেক রাত। ক্লাস সিক্সের বাচ্চার জন্য আরো বেশি। যাহোক আজ তার টানা বইটা পড়ে শেষ করতেই হবে।
আয়েশা বেগম আগে এরকম আগে ছিলেন না। এখন কেমন জানি হয়ে গেছেন। মাস কয়েক হল ছেলের পাঠ্য বইয়ের বাইরে কিছু পড়া সহ্য করতে পারছেন না।
০৩
-স্যার, আচ্ছালামুয়ালাইকুম।
লেট পন্ডিত সাহেব কিছু বলবি? রহমত স্যার খাতা কাটার ফাঁকে চোখ না উঠিয়ে বললেন।
স্যার রাগত কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তবে আজ বলতে হবে। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। খেলাধুলা পর্যন্ত মনে ধরছে না। রিস্ক নিয়ে শুভ বলল, স্যার লাইব্রেরী থেকে দু-একটা বই লাগবে।
গ্রামের স্কুল। লাইব্রেরি বলতে স্টিলের আলমারিতে শতিনেক বই। লাইব্রেরীর দায়িত্বে রহমত স্যার। স্কুলের দপ্তরী জমির চাচার কাছে আলমারীর চাবি থাকে।শুভর সাথে চাচার এক্সট্রা খাতির । তিনিই বইয়ের খোজ দিয়েছেন। তবে স্যার এ পর্যন্ত কাউকে বই দিয়েছেন বলে জনশ্রুতি নেই। অথবা কেউ সাহস করে স্যারের কাছে চেয়েছে বলে ইতিহাস নেই। আজ শুভ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল।
‘কি বই? গল্পের বই?’ রহমত স্যার আশ্চর্য হয়ে চোখ বড় করে ফেললেন। কাতল মাছের মত। কাতল মাছের ইতিহাস সৃষ্টি পছন্দ হয় নি। তিনি স্বর পরিবর্তন করলেন। ডেসিবেল বেড়ে গেল। ‘ইংরেজীতে কত পেয়েছিস? সমাজ বিজ্ঞানে ? ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছিস......? আসল পড়ার খবর নেই। তিনি চাইতে এসেছেন গপ্পের বই। যা ভাগ’।
শুভ খানিকটা অপমানিত বোধ করল । তার অপমানবোধ টনটনে। আস্তে আস্তে টিচার্স রুম থেকে বের হয়ে এল। বের হবার সময় স্যারকে সালাম দেয়নি।
০৪
পাচঁটা বাজে। স্কুল ছুটি হয়েছে। স্যাররা অনেকেই চলে গেছেন। ছাত্রছাত্রীরা আস্তে আস্তে স্কুল ফাঁকা করে দিচ্ছে। টিচার্স রুমে শুধু রহমত স্যারকে দেখা যাচ্ছে। দপ্তরী জমির চাচা মূল ভবনের ফটকে দাঁড়িয়ে পতাকা নামাচ্ছে। শুভ তার পকেটে হাত দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় চাচার দিকে।
পকেট থেকে একশ টাকার একটি নোট হাতে নিল শুভ। সকালে টাকাটা ম্যানেজ করেছে। ছোট চাচার মানিব্যাগ হতে। মানিব্যাগে ছয়শত ছিল। পাচঁশ রেখে দিয়েছে। একশ চুরি।
কাছে গিয়ে জমির চাচাকে শুভ ফিস ফিস করে বলল। ‘চাচা, তোমাকে আমি একশ দিব, তুমি আমাকে একশ দিবা। চাবি নিয়ে লাইব্রেরিতে চল’।
জমির চাচা ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল কি পারল না বোঝা গেল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত বাড়িয়ে দিল। সরু গলায় বলল, চল।
টিচার্স রুমের পাশের রুমটাই লাইব্রেরি রুম। এটা আসলে জুনিয়র টিচার্স রুম। একটা আলমারিতেই বইগুলো রাখা। টি্চার্স রুমে রহমত স্যার কিছু একটা মনোযোগের সাথে করছেন। সব কাজেই মনোযোগ। বেশী মনোযোগ ছাত্রদের শাস্তি দেয়াতে।
জমির চাচা তালা খুলে ঢুকলেন। শুভ এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল। কেউ ফলো করেনি। সে ফলো করল জমির চাচাকে। ভেতর ঢুকে দরজায় সিটকিনি দিল।
প্রায় পৌনে একঘন্টায় সবগুলো বই উল্টিয়ে পাল্টিয়ে লেখকদের নাম, বইয়ের নাম দেখল। বেশ কিছু ফালতু বই দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু আগেই পড়া। তবে অর্ধেক বই বেশ চমৎকার। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মানিক, বিভূতি, মূতীদের লেখা। সায়েন্সফিকশন আছে অনেকগুলো।
টেবিল হতে পুরোনো কাপড়ের কভারটি মাটিতে বিছাল শুভ। সার করে গুছিয়ে কভার দিয়ে বইগুলো বেধে ফেলল। এবার পার করতে হবে স্কুলের মেইনগেট। কেউ না দেখলেই হল। ‘কে জানে রহমত স্যার কি করছেন। এলোক কখন যে যাবে? বাসায় কি কোন কাজ নেই, স্যার সারাদিন স্কুল নিয়েই পড়ে থাকেন নাকি?’ পায়ে পা তুলে স্যারদের চেয়ারে বসে ভাবল শুভ।
ঠক।ঠক। ঠক।
চমকে উঠলো শুভ ও জমির চাচা। কে আসল?এ সময়তো কোনমতেই রহমত স্যারের জুনিয়র টিচার্স রুমে আসার কথা নয়। তাহলে কে?
দরজার ওপাশ থেকে রহমত স্যারের ভারী রাগী গলা ভেসে আসল, কিরে জমির ? ব্যাটা দরজা লাগিয়ে সন্ধ্যাবেলায় টিচার্সরুমে কি করিস? দরজা খোল।
ভয়ে শুভর গলা শুকিয়ে গেল। টেবিলের হাতল খামচে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। জমির চাচার দিকে তাকানোই যাচ্ছে না। তার চাকুরীটা বুঝি গেল। চাচার দিকে তাকিয়ে শুভ ঠোটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করল। দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে মুভ করল শুভ।
জমির চাচার দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল। রহমত স্যার ঢুকেই অগ্নিমূর্তি। ‘ব্যাটা কি করছিস সন্ধ্যা বেলায় দরজা বন্ধ করে। চুরি টুরি নাকি? গত সপ্তাহে ধর্ম শিক্ষক মৌলবী বদিউজ্জামান সাহেবের দামি আতরের শিশি নাকি হারিয়ে গেছে টিচার্স রুম থেকে। যা দেখি আমার সেভেনের ছাত্রদের হাজিরা খাতাটা বের করে দে। আজ যে কয়টা অনুপস্থিত ছিল কাল এদের ধরে চাবকাতে হবে। দেশে পড়াশোনা বলতে আর কিছু নাই।কাল আবার একটা এসেছিল গল্পের বই চাইতে। নিজের পড়ার খবর নাই আবার গল্পের বই’।
ভাষণের ফাঁকে জমির চাচা স্যারের হাতে হাজিরা খাতা তুলে দিল। হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে গিয়ে পেছন ফিরল রহমত স্যার। গলা খাকারী দিয়ে জিজ্ঞাসিলেন, কিরে জমির, বইয়ের আলমারি খোলা কেন?
স্যার একপা আলমারির দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আলমারির দরজার ফাঁক দিয়ে ওই স্কুল ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। ঐটা কার?
অনেকক্ষণ পর জমির চাচা কথা বললেন, ‘স্যার আইজ দুপরে আলমা্রিখান পরিষ্কার করতেছিলাম, বইগুলান ময়লাতে ধরছে’।
০৫
বিশ বছর পর।
ইতোমধ্যে মেঘনা যমুনার অনেক পানি শুকিয়ে গেছে। মোহনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরের অনেক লোনা পানি ভেতরে ঢুকেছে।
শাহাদাত মিরন শুভ এখন বড় অফিসের কর্তা। ডাকসাইটে অফিসার। তবে পূর্বের বদভ্যাস এখনো যথারীতি প্রবল। ঘুম থেকে দেরী করে উঠা। প্রায়ই অফিসে পাঁচ দশমিনিট দেরী করে যাওয়া। তিনি অফিস প্রধান। সমস্যা নেই।
তবে আরো একটি অভ্যাস তার গড়ে উঠেছে। যেখানে যান সেখানকার লাইব্রেরি, বইয়ের দোকানের খোঁজ নেন। ঢুঁ মারেন। দেদারসে বই কেনেন। পকেটে পাচঁহাজার থাকলে একহাজার টাকার বই কেনা ফরজ। গত পাঁচবছরে আনুমানিক দেড়লাখ টাকার বই কিনেছেন। পুরোনবই-নতুনবই। কমদামের-বেশিদামের। বাংলা-ইংরেজী। অরিজিনাল প্রিন্ট, ফটোকপি, কপিরাইটবিহীন প্রিন্ট সব ধরণের।
এতএত বই কিনলেও মিঃ শাহাদাত মিরন শুভর ব্যাক্তিগত কোন সংগ্রহশালা নেই। নেই কোন ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এমনকি নেই আলাদা কোন আলমারি। তিনি কি ইচ্ছে করেই এটা করেন?
শাহাদাত মিরন শুভ সাহেব বই কেনেন। সব হয়তো পড়া হয় না। কেউ ধার চাইলে না করেন না। যেখানে যান সাথে করে বই নিয়ে যান। তবে বেশিরভাগ সময় সেটা রেখে আসেন। নিজের ঘরের টেবিলে, অফিসের টেবিলে, বিছানায়, ড্রইংরুমে সবজায়গায় বই রাখেন। অগোছালো। বাসায় অনেক লোকজন আসেন। বলে না বলে অনেকেই অনেক বই নিয়ে যান। কেউ ফেরত দেন, কেউ দেন না। মিঃ শাহাদাত মিরন শুভ অবশ্যি কখনো ফেরত চেয়েছেন বলে শোনা যায় না। হয়তো ইচ্ছে করেই।
০৬
সন্ধা সাতটা। আজ আর এক্সারসাইজে গেলেন না মিঃ শাহাদাত মিরন শুভ। বিছানায় শুয়েই ছিলেন। কেন জানি আনমনা লাগছে তাকে। তিনি হঠৎ করে চমকে উঠে বিছানায় বসলেন। খাটের নিচ থেকে একটা পুরোনো ট্রাঙ্ক টেনে বের করে খুললেন। হাত দিয়ে পুরনো মলাটের একটা বই বের করলেন। আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের লেখা ‘তারার দেশের হাতছানি’।
ও, হ্যাঁ। স্কুলের ঐ ঘটনার নয়দিন পর কি জানি এক অজানা রোগে শুভর জমির চাচা তারার দেশে চলে গেছেন।
চিরতরে।