মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৬৮- পুস্পিতার গল্প

[এক]

বন্ধুরা না থাকলে হয়তো আজকের দিনটা এতো সুন্দর কখনোই হতো না। যা করার সব ওরাই তো করলো।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কাছের গোটা বন্ধু সার্কেলটাকে জড়ো করা, সবাইকে যার যার কাজ বুঝিয়ে দেয়া, মালা কেনা, মন্দিরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ছোট্ট একটা দু’ রুমের বাসা ভাড়া করা, একদিনের মধ্যে সেটাকে লোক লাগিয়ে বা কখনো নিজেরাই হাত লাগিয়ে ধুয়ে মুছে ঝক ঝকে করা, একটা ঘরকে ফুল আর রঙ্গিন কাগজে মুড়িয়ে বাসর ঘরের একটা আদল দেয়া, টুকটাক জিনিসপত্র কেনা – যা করার কাছের বন্ধু গুলোই তো করেছে। নতুন কিছু শুরু করতে গেলে আয়োজনের পাশাপাশি চাই আশীর্বাদ, আর জীবনের নতুন পথে পা বাড়াতে গেলে কাছের মানুষের শুভকামনা লাগবেই। আজকের দিনে এই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইমন আর পুস্পিতা।

পুস্পিতা আর ইমনের বিয়ে হলো আজ।

দীর্ঘ পাঁচ বছরের টোনাটুনির প্রেমের গল্প, তারপরেই ভেবে চিন্তে বিয়ে। বলাই বাহুল্য পরিবারকে না জানিয়েই জীবনের এই পথের পথিক হয়েছে দু’জন। পরিবারকে জানানো যায়, তবে থাক না আরো কিছু দিন। যাক না এভাবে আরো কিছু স্বপ্নের প্রহর।

সকাল বেলা থেকেই ইমন ক্লান্ত। কারন সারা রাত সে ঘুমায় নি। নতুন একটা জীবন, নতুন একটা মানুষ, অনেক বড় একটা দায়িত্ব। এতোদিন যে ভাবনা গুলো সিঙ্গেল ছিলো, আজ থেকে তা মহাপরিক্রমায় ডাবল। আজ থেকে ভাবনা শুধু নিজেকে নিয়ে না। আজ থেকে ভাবনা একটা স্বপ্নকে নিয়ে, যাকে পূর্ণতা দিতেই হবে। রাতে যখন ঘুম আসে নি মনে মনে দু-একবার ভেবেছিলো পুস্পিতাকে কল দেবে। কিন্তু না থাক, ও ঘুমাক। কাল একটা মেয়ে হিসেবে ওর জীবনের মাহেন্দ্রপ্রহর, তাই আজ রাতটা ওকে স্বনিমগ্ন রাখি।

যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিলো ইমনের আজকের এ দিনের জন্য। গত তিন বছর পাগলের মতো টিউশনি করেছে। তিলে তিলে বাড়িয়েছে সোনালী ব্যাকের হিসেবের খাতার সংখ্যাগুলো। তাই আজকের আয়োজনে কোন কিছুর আধিক্য না থাকলেই কমতি ছিলোনা কোথাও। বন্ধুদের খাওয়া-দাওয়া থেকে পুস্পিতার নীল বেনারসি, সবই ইমনের ছকে আঁকা। ইমনের প্রিয় রঙ নীল।

পুস্পিতা তো তিন দিন আগে বলেই বসলো, “এই, নীল শাড়ি পড়ে কেউ বিয়ে করে নাকি?”

- আহা কেউ করেনি বলে আমরাও করবো না তাই কি হয় নাকি?

- তাই বলে নীল! বিয়ের শাড়ি নীল, কী বলবে সবাই।

- সবাই বলবে আজ তুমি আকাশ, আজ তুমি ইমনের আকাশ।

- (কিছুটা ভেঙ্গিয়ে) আর তুমি কি, মাটি!

- হুম, ঠিক ধরেছো, আমি হবো মাটি। আমাদের মিল হবে দিগন্ত রেখায়। দিগনের সীমানায় প্রতি ভোরে প্রতি বিকেলে মাটি আকাশকে তার ভালোবাসার কবিতা শোনাবে।

- এই তুমি কয়েকদিন কবিতা লেখো নাই কেন?

- বিয়ের কাছাকাছি সময় তো, তাই।

- কেন? বিয়ের আগে কবিতা লেখা নিষেধ নাকি? বিয়ের পর কবিতা লিখবেনা?

- বিয়ের পর একজন কবি মারা যায়। জন্ম হয় একজন পুরুষের। ওসব পুরুষেরা যা লেখেন তা কবিতা না, আর কবিতা হয়ে গেলেও তা মুখে তোলা যায় না।

- যত্তোসব ফালতু কথা! আমি নীল শাড়ি পড়লে তুমি কী পড়বে?

- আমি গেড়ুয়া নেবো, মানে মাটির রঙ এ পাঞ্জাবী।

- ঠিক তো?

- দেখা যাক।



বছর পাঁচেক আগে ইমনের সাথে পুস্পিতার পরিচয় হয় মেডিকেল কলেজের একটা কালচারাল প্রোগ্রামে। পুস্পিতা ওখানে পারফর্ম করেছিলো। রাত সাড়ে ১২টার দিকে শেষ হয় অনুষ্ঠান। রাত বেড়ে যাওয়ায় মেয়েদেরকে ছেলেরা হোস্টেল অব্দি দিয়ে আসবে এই প্লান হয়। হাটঁতে হাঁটতে পুস্পিতার কথা হয় ইমনের সাথে।

- অনেক টায়ার্ড লাগছে, মনে হচ্ছে স্টেজের ওপরেই ঘুমিয়ে রাত পার করে দেই।

- ওপরওয়ালাদের বলবো নাকি পারফর্মার দেরকে কোলে করে হোস্টেলে দিয়ে আসতে?!

- ধ্যাত! এটা কোন কথা হলো, আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছেনা, মনে হচ্ছে উড়ে উড়ে হোস্টেলে যাই।

- হা হা, অতিথি পাখি।

- অতিথি পাখি কেন?

- রাতের বেলা তো আর ওড়ার সময় না, বেটাইমে উড়লে তো অ-তিথিই বলবো।

- আচ্ছা অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে উড়ে আসে কেন, খাবারের জন্যে?

- অতিথি পাখিরা উড়ে আসে কারন ওদের পাখা আছে, পাখা না থাকলে তোমার আমার মতো হেঁটেই আসতো। কিংবা বড়জোর রিকসা ভাড়া নিতো।

- উফফ, বিরক্তিকর।

সেই রাতের বিরক্তিকর ইমন আজ কতোখানি কাংক্ষিত পুস্পিতার কাছে তার প্রমাণ আজকের দিনটা। কীভাবে ইমনের সাথে বন্ধুত্ব হলো, আর কীভাবেই বা তারা দিনের হিসেবগুলোকে প্রেমের গল্পে পালটে দিলো তা ওরা নিজেরাও জানেনা।

আসলে কিছু জিনিসের মেকানিজম কখনোই বোঝা যায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ প্রেম।

সবকিছুর টাইমলাইন থাকে, থাকে না ভালোবাসার ইতিহাসে। কেউ হলপ করে কখনোই বলতে পারবেনা এই দিনের এই সময়ে কাউকে তার ভালো লেগেছে, কিংবা ঠিক এই সময়ে কেউ আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে। প্রেম একটি অব্যাখ্যাযোগ্য প্রক্রিয়া, আপনি জানতেও পারবেন না আপনি এর মাঝে আছেন নাকি নেই।

ব্যস্ত একটা দিন শেষ হলো ইমন আর পুস্পিতার। আড্ডার আসরও শেষ, বন্ধু-বান্ধবীরা সবাই চলে গেছে। ইমনে ঘরে এসে দেখলো একটা লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পুস্পিতা ওর কানের দুল খুলছে। ইমন ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো।

আয়নায় প্রতিফলিত হলো আকাশ আর মাটি। এরই নাম কী তবে দিগন্ত?


[দুই]

একটা ব্যাপার অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে পুস্পিতা। ইমন রাতে ভালো করে ঘুমায় না। কিছু একটা নিয়ে ভাবে। ঘুম থেকে উঠে পায়চারি করে। আবার কম্পিউটারে কী যেন করে। টুক টাক করে অনেক কিছু কিনেই ঘর সাজিয়েছে ওরা। এই কম্পিউটারটি তারই নতুন সংযোজন।

কী নিয়ে ও ভাবছে, জানতে চায় পুস্পিতা। না বলার মতো করেই যা মনে আসে বলে ইমন। পরিষ্কার করে কিছু বলে না। কয়েকবার এ নিয়ে মন খারাপও করেছে পুস্পিতা।

বিয়ের ৩ বছর পার হয়ে গেছে। দুজনের পরিবারই জানে এখন সবকিছু। প্রথমে সব কিছু ওলট-পালট থাকলেও এখন সব কিছু আবার আগের মতো। মা-বাবার আশীর্বাদ নিয়ে ওরা বহাল তবিয়তেই আছে।

- এই, তুমি রাতে ঘুমাও না কেন?

- ঘুমাই না?! আমি নাইটগার্ড নাকি?

- ফাজলামো করো না, আমি দেখেছি তুমি বেশ রাতে উঠে যাও আর হাঁটাহাটি করো, মাঝে মাঝে কম্পিউটারে কী যেন করো।

- বাপ রে, ঘরের মধ্যে দেখি ফেলু দি। দিদিমনি আমি ভদ্রবেশী ডাকাত। ডাকাতি করতে এসেছি তোমার সব কিছু। উঃ হা হা হাঃ

- তুমি বলবে সিরিয়াসলি।

- আমি আসলে একটা মেয়ের সাথে প্রেম করি। রাতে ওর সাথেই চ্যাট করি।

- কী বললে?

- কিছু না।

পুস্পিতা এর পরে আর কিছু নিয়েই কোন প্রশ্ন করে না। ইমনের এসব ও সহ্য করতে পারছেনা। কিন্তু মুখেও বলার কিছু নেই।

একদিন দেখলো ইমন সারারাত বসে বসে চ্যাট করলো। একটুও ঘুমালো না। দুদিন পরে একই ঘটনার পুণরাবৃত্তি ঘটলো। এরকম চললো পর পর তিন দিন। এমন করেই পার হলো আড়াইটা মাস।

ঘরের মাঝে পুস্পিতার কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে শুরু করে। কোন কিছুই ওর ভালো লাগেনা। ইমন কতোখানি দূরে সরে গেছে ওর কাছ থেকে। আই কী সেই ইমন যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলাম – পুস্পিতা ভাবে। এভাবে ঘর করা যায় না। নিজের ঘরে নিজেকে অচেনা করে রাখা যায় না। নিজের সাজানো সংসারে নিজেকে এভাবে একা করে রাখা যায় না।

তবে কী আমি ইমনকে ছেড়ে দেবো – পুস্পিতা ভাবে, কিন্তু আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে। কে রাতের বেলা কাথা টেনে দেবে ওর বুকের উপর। কে ওরা জামাগুলো থরে থরে গুছিয়ে রাখবে। ঘুমিয়ে গেলে কে ওর চোখের চশমা খুলে দেবে। চ্যাটের ঐ মেয়ে এসে করবে এসব? এতো নিচে নেমে যাবে ইমন। ইমনের জন্য কাঁদতে থাকে পুস্পিতা।

আজ রাত পেরিয়ে কাল ভোর। কাল ওর জন্য রান্না করে রেখে বিকেলে বের হয়ে যাবে পুস্পিতা। ইমনের ঘরটা শেষ বারের মতো পরিষ্কার করে রেখে যাবে। ওর ব্রাশে পেস্ট ভরিয়ে রেখে যেতে হবে। ওর গামছা, ওর ট্রাইজার – সব কিছু জায়গা মতো রেখে যাবে ও।

পরদিন সকাল। নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে গেছে ইমন, কী যেন একটা কাজ আছে বললো। দুপুর একটা পার হলো। পুস্পিতার সব গোছানো শেষ। দুপুর তিন টে বাজে। নীল আরেকটা শাড়ি পড়েছে ও। কলিংবেল বাজলো। দরজা খুলে দেখলো ইমন দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হলো ও। কারন ও এখনই ঘর ছাড়বে আর এখনই ইমন এলো। ওর গোছানো স্যুটকেসটা দেখলেও তো ইমন অনেক কষ্ট পাবে।

ইমনের বুক পকেটে একটা সাদা খাম। আর হাতে দু’প্যাকেট মিষ্টি, সাথে প্যাকেটে মোড়ানো কিছু একটা। সাদা খামটা ইমন এগিয়ে দিলো পুস্পিতার দিকে। দরজা আটকে খামটা খুলতেই বেরিয়ে এলো আশি হাজার টাকার একটা চেক।

- এটা কী? কীসের চেক? মানে, কীসের টাকা এটা? জানতে চাইলো পুস্পিতা।

- তোমার যত-যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর এটা। এই বলে ইমন প্যাকেটটা এগিয়ে দিলো পুস্পিতার দিকে।

পুস্পিতা প্যাকেট খুলে দেখলো ইমনের নিজের লেখা একটা বই। “পুস্পিতার গল্প”।

পুস্পিতা ইমনের দিকে তাকালো। তারপর পাগলের মতো পাতা ওল্টাতে লাগলো। হ্যাঁ, সব আছে, সব। ইমন আর পুস্পিতার জীবনের প্রত্যেকটা ঘটনা লিখেছে ইমন। ছোট বড় সব কথা লিখেছে ইমন। কিচ্ছু বাদ দেয় নি ও। এতো ঘটনা ও মনে রাখলো কীভাবে। হ্যাঁ সব আছে, সব আছে এই বইয়ে। আর সাধারণ সাধারণ সব কথা গুলো কী অসামান্য হয়ে উঠেছে ওর লেখায়। পুস্পিতার চিতকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো। পারলো না। এর পরিবর্তে ঝর ঝর করে চোখের জল পড়তে লাগলো। তাহলে ইমন একারনে এতোদিন চিন্তিত ছিলো আর রাত জেগে লিখেছে আমাদেরই ভালোবাসার গল্প।

- এবার আশা করি তুমি স্যুটকেসটা ভেতরে রেখে আসতে পারো।

- তুমি জানতে আমি আজ চলে যাবো?

- আমি ভালোবেসে তোমাকে জীবনে জড়িয়েছি। তোমার প্রতিটা চুলের খবর আমি রাখি, আর মনের খবর রাখবো না?

পুস্পিতা এবার ইমন কে জড়িয়ে ধরে চিতকার করে কাঁদে। অবুঝের মতো সে কান্না। বাঁধনহারা সে কান্না।

কান্না থামিয়ে ইমন পুস্পিতাকে বলে, বইয়ের শেষ পাতাটা দেখবে একবার।

পুস্পিতা শেষ পাতাটা খোলে, সেখানে লেখা আছে – “ বইটা যখন ওরা হাতে দিলাম ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। এরকম অবাক হয়ে ও যখন তাকায় মনে হয় ওর মতো এতো মায়াবতী পৃথিবীর আর কোন মেয়ে হতে পারেনা। এই মায়াবতীকে ভালোবেসে আমি ধন্য। বইয়ের কয়েকটা পাতা পাগলের মতো উল্টেই ও কেঁদে ফেললো। আমি ওকে যখনই বললাম, এবার তুমি স্যুটকেসটা ভেতরে রেখে আসতে পারো, ও আমাকে জড়িয়ে বাচ্চা একটা মেয়ের মতো চিতকার করে কাঁদলো। আমার মনে হলো, কতো বড় দায়িত্ব আমার কাঁধে। একটি মেয়ের সারাজীবনের হাসি-কান্নার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। তারপরও আমাদের গল্প এগিয়ে চলে, গল্পের বইয়ে একটি একটি করে পাতা বাড়ে। প্রতি ভোরে প্রতি বিকেলে উষ্ণ আলিঙ্গনে হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে বাড়ে আমাদের ভালোবাসা, নীল আকাশ, গেড়ুয়া মাটি আর পুস্পিতার গল্প। ”