মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ১০- অসম প্রেম।

পিচঢালা পথ পেরিয়ে আমাদের বহনকারী বাসটি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। মাঝ দুপুর। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস বইছে হুহু করে। মাসুদ মাথাটা আমার কাধের উপর রেখে ঘুমুচ্ছে। কখন যে ও ঘুমিয়ে পড়ল খেয়াল করেনি, ডুবে ছিলাম ভাবনার জগতে। ওর ছোট ছোট দাড়িতে খোচা পাচ্ছিলাম। মাসুদের দিকে তাকিয়ে মায়া হচ্ছে খুব। বুকের ভেতর কোথা হতে যে এত মায়া আসলো? বুঝিনা কেন এত ভালবাসি আমি ওরে! 
কত নির্ভরতায় ও ঘুমুচ্ছে আমার কাধে। বাতাসে ওর চুল গুলো উড়ছে। শিশুর মত পবিত্র লাগছে ওরে। আমার জন্য ওরে কত কষ্ট করতে হচ্ছে? 
আমার পরিবার ভীষণ আশ্চর্য হয়েছিল যখন তারা জানতে পারল তাদের পরিবারের সবচেয়ে চটপটে আর মেধাবী মেয়েটা কিনা মাসুদের মত বেকার একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে। তাছাড়া ওদের তুলনায় আমাদের পরিবার বেশ ধনী বলা যায়। সুতারাং তারা আশ্চর্য হয়েই কেবল থেমে রইলনা। নানা রকম কুটচাল আর বাঁধার দেয়াল তুলে দিল দু’জনের মাঝে। কত ঝড় যে বইলো আমাদের ছোট জীবনের উপর ? 
মা আর বড় আপা আমার গায়ে হাত তুললো, নজর বন্দিও করেছিল। তবে মাসুদের প্রতি আমার তীর্ব ভালবাসা সব বাধাকে বালির বাধের মত ভাসিয়ে নিয়ে গেল। 
কিছুক্ষন আগে যখন আমরা পদ্মা নদীতে লঞ্চে পাড় হতে ছিলাম, তখন আচমকা হঠাৎ করেই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলো। বিশাল বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো। লঞ্চটা তখন দুলতে ছিল ভয়ংঙ্কর ভাবে। ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। ভিতু চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও মৃদু হেসে আমার হাত ধরে বললো,ভয় পেওনা তোমার জন্য পদ্মা কেন সমুদ্রও পাড়ি দিতে পারি। 

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ও কথাটা বলছে আমায়। একজন নারীর জন্য এটা যে কত আনন্দের তা বুঝানো যাবেনা। প্রতিটি মেয়েই স্বপ্ন দেখে এমন স্বামীর যে কিনা সব সময় তাকে আগলে রাখবে। ভালবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিবে জীবন। তখনি আমার মনে হলো এই পৃথীবিতে আমার চেয়ে সুখি আর কেউ নেই। 

ঝড় থেমে গেল। প্রকৃতি বড় খেয়ালী, যখন যা মনে চায় করে। এইযে পদ্মা এক পাড় ভাঙছে, আবার অন্য দিকে নতুন চর সৃষ্টি করছে। এ যেন মানুষের জীবনের মতই। এই যে আমি সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে নতুন কোথাও ছুটে চলছি! 
মাওয়া ঘাটে নামতেই হাতের দুপাশে সারি সারি হোটেল। ভাজা ইলিশের ঘ্রাণে চারপাশ মৌ মৌ করছিল। সকালে আমাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই খুব খিদে পাচ্ছিল। মাসুদ বললো, চল হোটেল থেকে খেয়ে নেই। 
আমি জানি ওর পকেটে খুব বেশি টাকা নেই। আর আমাদের সামনে এখনও পুরো মাসটা পড়ে আছে। ক্ষিদেকে পাত্তা না দিয়ে মুখে কৃত্তিম বিরক্তি টেনে বললাম না না এসব ফুটপাতের হোটেলে খাওয়ার দরকার নেই। তার চেয়ে তুমি কলা আর কেক নিয়ে এসো, বাসে বসে খাব। 

ও মাথা দুলিয়ে সায় দিল। ওর পকেটে যে খুব বেশি টাকা নেই তা আমি ওরে বললাম না। পুরুষের আত্ম সম্মান বোধ প্রবল। তাতে আঘাত করতে নেই। আমি জানি এরকম দুঃসময় আমাদের সব সময় থাকবে না। একদিন আমরা যুদ্ধে জয়ি হব। যে যুদ্ধের প্রেরণা আমাকে দিয়ে ছিল সায়মা আপা। তার কথা মনে পড়ল হঠাৎ করেই। 
মাসুদ ছিল আমার ছোট মামার বাল্যবন্ধু। তাই ছোট বেলা থেকেই তারে মামা ডাকতাম। 

মামার আরো অনেক বন্ধুরা তার সাথে আসতো। কিন্তু আমার ভাল লাগতো মাসুদকেই। মাসুদ আমাকে কবিতা আবৃতি করে শোনাতো। গল্পের বই জোগাড় করে দিতো। তাই সে যখন মামার সাথে আমাদের বাসায় আসতো আমি তার সাথে সাথে থাকতাম। শিশু সুলভ তার নানা কাজ-কর্ম আমাকে ভীষণ মুগ্ধ করতো। মাসুদ মামা ভাল ছাত্র ছিল, সে তখন বলতো, অংক হলো গেমসের মত,একবার ভাল করে বুঝতে পারলে খুব মজা লাগবে তোমার। 

সে আমাকে অংকের জাহাজ বানিয়ে ফেলেছিল। তাই আমার মা মাসুদকে খুব পছন্দ করতো। আমি তার সঙ্গ খুব মিস করতাম। তাকে বাসায় প্রতিদিন আসতে বলতাম। আমার যে কখন কি হলো বুঝতে পারেনি। জানিনা কখন তার প্রেমে পড়ে গেলাম। 
তখন সবেমাত্র ইন্টারে ভত্তি হয়েছি। ছোট মামা আমেরিকায় চলে গেল। বাড়ির সবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। মামা সবার প্রিয় ছিলেন। আমার মন সবচেয়ে বেশি খারাপ হল। কেননা মামার বিদেশ যাবার পর মাসুদ মামাও আর আগের মত যখন তখন আমাদের বাড়ি আসতো না। সেও একা হয়ে গেল। কলেজে যাবার পথের রাস্তায় মাঝে মধ্যি তার সাথে আমার দেখা হত। কেমন আছো, কি খবর এই ধরণের কথা হত। আগের মত প্রাণখুলে কথা বলার সুযোগ ছিলনা। সে চলে যাওয়ায় তার প্রতি আমার টান অনুভব করলাম আগের চেয়ে বেশি। মনে হল আমি খুব একা হয়ে গেছি। আমি যেন আর আমার নেই। কিছুই ভাল লাগতনা তখন। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইত। উচ্ছাস উচ্ছলতা হারিয়ে গেল। দিন রাত তারে ভাবতাম। আহা সে আমার প্রথম ভালবাসা। ছোখ বন্ধ করে জেমসের গান শুনতাম মনে হত মাসুদ গাইছে। সিনেমা দেখার সময় মনে হত ভালবাসার সংলাপ গুলো মাসুদ দিচ্ছে। কিযে অসহ্য লাগতো! রাতে ঘুমুতে পারতাম না। দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম শুধু। এরচেয়ে বেশি কিছুই করার ছিলনা আমার। কেননা সে যে আমার মামার ঘনিষ্ট বন্ধু, মামা! মাকে বলতো আপা, আর তারে কি করে আমি প্রেমিক বলি? মনের ভেতর কত যে দন্দ হত! কত বার যে কিরা কসম কেটে ছিলাম, শপথ করে ছিলাম। কিন্তু তীর্ব ভালবাসার বানে ভেসে যেত সব। ভালবাসা বড় অন্ধ, জাত কুল মানে না। ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারতে ছিলামনা। লেখা পড়ায় পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। মা একদিন খুব বকলো আমি নাকি বদলে যাচ্ছি! 

ভালবাসায় হারিয়ে ফেললাম নিজেকে। না বলতে পেরে আরো বেশি যন্ত্রনায় পড়লাম। 
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখি চৌরাস্তার মোড়ে কানুদার দোকানে দাড়িয়ে চা খাচ্ছে মাসুদ। কাছে গিয়ে ডাকলাম, মামা এদিকে আসুনতো। সে চায়ের কাপ রেখে এগিয়ে এল। কাছে আসতেই তার দিকে তাকিয়ে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মাথায় খড়ের গাদার মত একপাল চুল। খোচা খোচা দাড়িতে মুখ ভরে গেছে। চোখ মুখ দেখে মনে হল সকালে গোছল পযন্ত করেনি সে। 
কি অবস্থা আপনার? 
এইতো চলছে আর কি! 
সকালে গোছল করেন নি তাইনা? 
না। কেন বলতো? 
সাদা র্শাট কেন পড়েছেন? আপনাকে না বলেছি সাদা শার্টে আপনাকে বিশ্রি লাগে। সকালে গোছল না করায় আপনাকে গন্ডারের মত লাগছে! কি যে হইছেন না? 
আমার আচমকা আক্রমনে মাসুদ ভারি আশ্চর্য হয়। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার মুখের দিক। ওরে এখন বোকা বোকা লাগছে। আমি তার হাত ধরে বললাম, সামনে চলেন । দোকানের লোকজন বেয়াদপের মত তাকিয়ে আছে। সে চুপ করে আমার পাশে হাটতে শুরু করলো। কিছুদুর গিয়ে থমকে দাড়ালো সে। আমিও থামলাম। 
শম্পা আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা কেন তুমি আমাকে শাসন করছো? তুমিতো জানো ঠান্ডায় আমার সমস্যা আছে, তাই গোছল কম করি। 
আমি হেসে ফেললাম তার যুক্তি শুনে। সে বাচ্চা ছেলেদের মত করে অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। 
আমি আবার তাকে প্রশ্ন করি,আচ্ছা মামা আপনি কি কোন মেয়েকে ভালবাসেন,কারো সাথে আ্যফায়ার আছে আপনার? 
এবার কড়া চোখে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বললো, তুমি কিন্তু বেশি পেকে যাচ্ছো? 
Ñ মামা আপনি কেন ভুলে যাচ্ছেন আমি এখন কলেজে পড়ি! 
কলেজে পড়লেই বুঝি এমন যাচ্ছে-তাই প্রশ্ন করতে হয়, না? 
হয়। আচ্ছা ছোট মামাতো আমেরিকায় গিয়ে ক্যারিয়ার গড়লো, আপনি কি ভাবছেন? কি করবেন? 
এবার সে হাটা দিল। আমি পিছু পিছু হাটতে লাগলাম। সে অধৈর্য হয়ে বললো, শম্পা আমাকে তুমি মাফ করে দাও। পোলাপানের মুখে এমন ভারী কথা শুনতে আমার অসহ্য লাগছে। আহত হচ্ছি। 
আমি বুঝলাম সে ভড়কে গিয়েছে। তাকে আরো বেশি ভড়কে দেবার জন্যই বললাম, আপনি কি জানেন আমি আপনার প্রেমে পড়েছি। পোলাপানের মামুলি প্রেম নয়, লাইলী মজনু টাইপের কঠিন প্রেম। আপনার জন্য আমার বুকের ভেতর কেমন যেন করে। 
মাসুদ ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মায়া হচ্ছিল খুব। বেচারার উপর দিয়ে যেন বুলডেজার চলে গিয়েছে। বিধস্ত অবস্থা কাটানোর জন্য তাকে মুক্তি দিলাম। সে দাড়িয়ে রইল, আমি হেটে চলে এলাম। বেশ দুরে চলে আসার পর আবার পিছন ফিরে দেখি সে রাস্তার পাশে লাইট পোষ্টের পিলারের কাছে আরেকটি পিলার হয়ে দাড়িয়ে আছে। 

আমি কখনো তাকে এতটা আহত আর বিস্মিত হতে দেখিনি। তার এই অবস্থা দেখে আমার খুব আনন্দ হচ্ছিল। প্রাণ খুলে হাসতে লাগলাম। যাক বাবা যারে ভালোবেসে মরে যাচ্ছি তারে বলতে তো পেরেছি মনের কথাটা। 
ফলাফলে আমি বেশ হতাশ হলাম। পরদিন কলেজে যাবার পথে আর আসার পথে একবারও তাকে দেখলাম না। চিলের মত করে দুর হতে খুজলাম সারা রাস্তা। নাহ কোথাও নেই সে। তিন দিন কেটে যায় তার কোন খোজ নেই। অস্থির হয়ে গেলাম। ক্লাসমেট সাইফকে পাঠালাম মাসুদকে খুজতে। পরদিন ও এসে জানালো মাসুদ মামা বাড়িতেই আছে। কোথাও যায়নি। বুঝতে বাকি রইলনা যে সে আমাকে এড়িয়ে চলছে। কিন্তু আমি কম না! জিদ্দি মেয়ে হিসেবে আমারও অনেক বদনাম আছে। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। সে আমার সাথে কেন এমন করছে! আমাকে আ্যাভোয়েট করছে? সারা মহল্লা যখন আমার সৌন্দর্য্যই মুগ্ধ। সে কি ভাবে নিজেকে? 


সোর্স- http://love-guru-for-u.blogspot.com/2013/02/blog-post_7068.html