এক পাশে সমরেশ মজুমদার’ এর ‘গর্ভধারিণী’ অন্য পাশে ‘ম্যাক্সিম গোকি’ এর ‘মা’ নামক বই দুটি আর মাঝখানে বসে লিখছি মাজেদা মায়ের জীবনের গল্প। অবশ্য একে গল্প বলাটা ঠিক হবে না। এটা মাজেদা বেওয়ার সেই জীবন কাহিনী। মাজেদা কখনও লিখবেন না নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া বিন্দু বিন্দু সুখ-দুঃখের ঘটনাগুলো- ‘আমার মায়ের কান্না আমি সইতে পারি না, দোহাই ও আল্লাহ তুমি নীরব থেকো না।’ এটা আমাদের খুব জনপ্রিয় একটি গান, এই সামান্য লাইনেই বুঝতে পারা যায় সন্তান তার মায়ের কষ্ট সইতে না পেরে সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি জানাচ্ছে। এমনি নাড়িকাটা ৫ সন্তানের জননী মাজেদা। উচ্চ বংশীয় পরিবারের বড় সন্তান। ১৩/১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় মাজেদার। শ্বশুরবাড়িও উচ্চ বংশীয়। দুই পরিবারই যৌথ পরিবার। তার পরও বাবার বাড়িতে অনেক আদরে বড় হয়েছিল মাজেদা। ওর ছোট প্রায় ৮/৯ ভাই বোন। শ্বশুরবাড়িতে দেবর, ভাসুর, ননদ, শ্বশুর-শাশুড়ি আর ভাসুরদের সন্তানরাসহ অনেক বড় সংসার। উচ্চ বংশের মেয়ে হয়েও এই বাড়িতে এসে সবার সাথে মানিয়ে নিতে তেমন সময়ের প্রয়োজন হয়নি। তবে অল্প বয়সী বলে মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে মন চলে যেত ভাসুরের ছেলে-মেয়েদের মাঝে। ইচ্ছে হতো ওদের সাথে ঘুরে বেড়াতে, সাপলুডু খেলতে, সকাল-বিকাল বই পড়তে। কিন্তু সেসব হবে কিভাবে ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে শ্বশুর-শাশুড়ির চা, ওজুর গরম পানি, গরম গরম ভাত এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো মাজেদাকে। অবশ্য বিয়ের পর ২/৩ বার স্বামী-ভাসুরের সাথে শহরে এসেছিল মাজেদা, তখন দুপুরে খাবারের পর ভাসুরের ছেলে-মেয়ের সাথে বসে গল্প করতো, সাপলুডু খেলতো।
মাজেগদার স্বামী এনায়েত ছিল অনেকটা রাগী আর একরোখা ধরনের। শহরের বাড়িতে চাকরি পেয়েও ভাইয়ের সাথে মনোমালিন্য করে নতুন বউকে নিয়ে গ্রামে চলে যায়। গ্রামেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে। বিয়ের পর মাজেদা এসএসসি পাস করে অনেকিটা মায়ের চাপে পড়ে। মাজেদার বাবাও স্কুল শিক্ষক থাকায় পাস করতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। একজনের ইনকামে সংসার চলতে কষ্ট হয় বলে মাজেদা চাকরি করতে চায়, কিন্তু এনায়েত চাকরি করতে বাধা দেয়। এর মাঝে কেটে যায় প্রায় ১৫/১৭ বছর। যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হয়। মাজেদার কোলজুড়ে আসে ৬টি সন্তান। স্বামীর ইনকাম, জায়গা-জমি আর বাবাবাড়ির সহযোগিতায় চলছে মাজেদা-এনায়েতের সংসার। জন্মের পর এক সন্তান মারা যায়।
৫ সন্তানসহ মাজেদার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন। এর মাঝে এনায়েত পৌত্রিক বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করে সেখানেই থাকে। মোটামুটি চলছিল মাজেদার সংসার। কখনও মনের মাঝে আসে না সে বড়লোক বাবার সন্তান। জমিদারী বংশের সন্তান, শ্বশুরবাড়ি, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সিংহাসন গড়তে থাকে। হঠাৎ এক কালবৈশাখী ঝড়। আকাশে যেন স্তরে স্তরে কালো মেঘ জমা হতে থাকে। এনায়েত অসুস্থ। অসুস্থ শরীরেও অফিস চালিয়ে নিচ্ছে। শহর থেকে বড় ভাই চিকিৎসার জন্য এনায়েতকে ডাকে। এনায়েত শহরে আসে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার শরীরে টিবি রোগ ধরা পড়ে। যাকে আমরা এখন যক্ষ্মা বলে জানি। তখনও এই রোগের মোটামুটি চিকিৎসা ছিল। চিকিৎসা করাতে হলে এনায়েতকে শহরে থাকতে হবে। কিন্তু এতোগুলো বাচ্চা নিয়ে ভাইয়ের বাসায় থাকা সম্ভব নয়। টাকার অভাবে আলাদা বাসাও নেয়া যাবে না। এনায়েত একা শহরে থাকতে রাজি না। তার ওপর নিজের একগুয়েমী স্বভাব। ভাইয়ের সাথে মনোমালিন্য করে গ্রামে ফিরে যায়। এই অসুস্থ অবস্থায় মাজেদার ছোট ছেলে পাভেলের জন্ম হয়। পাভেলের বয়স যখন ১০ মাস তখন পৃথিবীর সব মায়াজাল ছেড়ে এনায়েত চিরনিদ্রায় চলে যায়। মাজেদার সংসারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি আর নেই। ৫টি সন্তনের সব দায়িত্ব মাজেদার ওপর। এনায়েতের মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় মাজেদার বাবা তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এনায়েতের চাচাতো ভাই ভাগিদাররা খুব একটা ভালো ছিল না। ওর মৃত্যুর পর সবার দৃষ্টি পড়ে মাজেদার ঘরবাড়ি, সম্পত্তির ওপর। মাজেদা ঘরবাড়ি রেখে বাবার সাথে চলে যায় বাবার বাড়ি। শুরু হলো মাজেদার নতুন এক জীবন। ২/১ দিনের মাঝেই মাজেদার বাবা জানতে পারে একটা চাকরির জন্য ট্রেনিং চলছে, ঐ ট্রেনিং-এ মাজেদাকে দিতে পারলে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু মাজেদার কোলে ১০ মাসের পাভেল। নিয়তি মাজেদাকে সন্তানকে বুকে রাখতে দেয়নি। মাজেদার মা একদিন মাজেদাকে নিয়ে যায় শহরে ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে পুরো ১৮ মাস তাকে ট্রেনিং নিতে হবে। মাজেদার ৫ সন্তান থাকে নানার বাড়িতে। আর ১০ মাস বয়সী পাভেলের সব দায়িত্ব পড়ে বড় বোন নাজমার কাঁধে। সামনে রাখা মোবাইলে বাজছে ‘১০ মাস ‘১০ দিন তোকে গর্ভে ধারণ কষ্টের তীব্রতা আমায় করেছে লালন...” সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে ‘মা’ নামের এই গানটি। আর আমার কলমে মাজেদা মায়ের জীবনের গল্প।
মাজেদা বেগম জন্মের ৩০-৩২ বছর বয়সেই মাজেদা বেওয়া হয়ে যায়। একটানা ১৮ মাস ট্রেনিং শেষ করে বাবার বাড়িতে ফিরে মাজেদা। শরীরে হাড় আর চামড়া ছাড়া যেন কিছুই নেই। দেখতে শুনতে অনেক সুন্দর ছিল মাজেদা। কিন্তু আজ দায়িত্বে বন্দী খাঁচায় মাজেদার সব রূপ-যৌবন আশা-আকাক্সক্ষা টান পড়তে থাকে। ১০ মাসের পাভেলের বয়স আড়াই বছর হলো। বড় সন্তান ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে আর ছোট পাভেল আড়াই বছর মাঝে আরো ৩ কন্যা সন্তান। বাড়ি এসে চাকরিতে যোগ দেয় মাজেদা। আস্তে আস্তে বাবার বাড়িতে একটা ঘর তোলে বাবা কিছু চাষাবাদের জমি দেয় সে জমিতে চাষ করে। চাকরিতে যোগ দেয়ার কিছুদিনের মাথায় ওর বাবা ওদের আলাদা করে দেয়। নিজের তোলা ঘরে মাজেদা ৫ সন্তানকে নিয়ে শুরু করে ভবিষ্যৎ জীবনের এক জগত। এক এক করে দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে বছর আসে। এর মাঝে মাজেদার বিয়ের জন্য অনেক প্রস্তাব আসে। কিন্তু মাজেদা সব ফিরিয়ে দেয়। এমনও প্রস্তাব আসে যে, ওর সন্তানদেরসহই মাজেদাকে ঘরে নিতে চায়, মাজেদা তাতে রাজি হয় না। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জীবনটাকে চাকরি, সন্তান, আর সন্তানদের নিয়ে স্বপ্নের জাল বোনার মাঝে রেখে দেয়। ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে বছর বছর করতে করতে প্রায় ১৫/১৬টি বছর পার হলো। মাজেদা ছোট ঘরটাকে বড় করেছে। ঘরের পাশে পাকা একটা ওয়াশ রুম করেছে। একটা রান্না ঘর। থাকার ঘরের খুঁটিগুলো পাকা করেছে। স্বপ্ন দেখছে একদিন এই ঘরে পাকা বাড়ি হবে। টাইলস বসাবে। মাজেদার বড় ছেলে বিয়ে করে তকে তকে ৩ মেয়েকে বিয়ে দেয়। ওর বাবাও মারা যায়।
এর মাঝে পাভেলও বড় হয় ভালো লেখাপড়ার জন্য শহরে যাবে। সম্মানিত লেখাপড়া করবে। বড় ছেলে শফিক শহরে লেখাপড়া করে চাকরি নিয়েছে। পাভেলকে পড়ানোর জন্য মাজেদা বাবার কাছ থেকে পাওয়া কিছু সম্পত্তি বিক্রি করে। মাজেদার যে ঘরে ৫টি সন্তান ছিল এখন সে ঘর খালি। ছেলেরা শহরে, মেয়েরা সবাই স্বামীর সংসারে। প্রতিদিন সকালে উঠে একটু রান্না করে কিছু খায় কিছুটুকু অফিস নিয়ে যায় সে। আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা। দিনে-রাতে মাঝে-মধ্যে সন্তানদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ। ওর বাবার মৃত্যুর পর বাড়ির পরিবেশ অনেকটা পাল্টে যেতে থাকে। মাজেদার মা ছেলেদের নামে সম্পত্তি লিখে দিচ্ছে। মেয়েদের অংশ ঠিকভাবে মেয়েদের বুঝিয়ে দিতে চায় না। উচ্চ বংশীয় পরিবারের সন্তানরা সম্পত্তি নিয়েও টানা হেঁচড়া করছে। গ্রামের জমি বিক্রি করে শহরে ফ্ল্যাট এপার্টমেন্ট কেনায় বয়সের চেয়ে আরো বেশি বয়সে চাকরিতে যোগ দেয়ায় চাকরির মেয়াদ থাকা অবস্থায় মাজেদা চাকরিতে ইস্তফা দেয়। ওর বাবার বাড়ির অবস্থা অনেকটা ঝামেলা হয়ে গেছে। এখানে বসবাস করার পরিবেশ দিন দিন নষ্ট হয়ে উঠছে। ঐদিক দিয়ে স্বামীর ঘরবাড়ি, সম্পত্তি সব দখল করে অন্যরা। শফিক, পাভেল নাজমা এদের স্থায়ী ঠিকানা হয় নানাবাড়ী। কিন্তু নানাবাড়ির এমন পরিবেশ কেউ মেনে নিতে পারছে না। মাজেদার বয়স হয়েছে এখন আর সকাল-সন্ধ্যা অফিস করতে পারে না। চাকরি শেষ করে কিছুদিন এই মেয়ে, ওই মেয়ে, ছেলের বাসায় বেড়াতে থাকে।
পরিবারের সবাই চায় একটা স্থায়ী ঠিকানা। কিন্তু সেটা কোথায় হবে। মাজেদা ছেলে-মেয়েদের সাথে আলাপ করে চাকরির শেষ জামানত দিয়ে জেলা শহরে এক টুকরো জমি কিনবে। জমি দেখে, পেনশনের টাকা পেয়ে জমি কেনে, এর মাঝে পাভেল লেখাপড়া শেষ করে চাকরি নেয়, বিয়ে করে। ওর বউ-এর বাবু হবে দেখে মাজেদা শহরে আসে পাভেলের বাসায় থাকে। পাভেলের বয়স ৩০ আর মাজেদার ৬০-৬৫ বছর।
মা এবং সন্তানের বয়সের মাঝে জেনারেশন পরিবর্তন হয়েছে অনেক। মায়ের কিছু যেমন সন্তানের সহ্য হয় না তেমনি সন্তানের কিছু চলাফেরা, কথাবার্তাও মায়ের সহ্য হয় না। তবুও মা-সন্তান বলে কথা। মাজেদা তার কেনা সম্পত্তিতে বাড়ি করবে সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু টাকা কোথায়। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া ১ খন্ড জমি ছিল যা মাজেদার বাবা বিধবা মেয়েকে নিজের কাছে আনার পর মেয়েকে দেয়। সেই সম্পত্তি বিক্রি করে বাড়ি বানানোর পরামর্শ হয়। মাজেদা গ্রামের খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানো মানুষ। গ্রামের সবুজ তাজা শাক-সবজি খাওয়া মানুষ। সকালবেলায় মাঝি তাকে তাজা দেশীয় মাছ দিয়ে যেত। দেশীয় শিং, মাগুর আর দেশীয় ডিম, গরুর দুধ খাওয়ার অভ্যাস। কিন্তু শহরে এসে সে পড়েছে বিপাকে। কয়েকদিন শহরের ফ্ল্যাট বাসায় থেকে দম বন্ধ হয়ে আসে। ২০ বছর যাবত ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত। শহরে হাঁটার জায়গা পায় না। ঘরে বসে বসে ডায়বেটিস বেড়ে যায়। শহরের শাক-সবজি তার ভালো লাগে না। এখানে নেই দেশীয় শাক-সবজি, নেই দেশীয় তাজা মাছ, নেই ঘরের গরুর গোয়ালী দুধ। সবই হলো বিদেশী। ফার্মের মুরগি আনলে নাক তোলে ওপরে। মাছ আনলে বলে গন্ধ লাগে। গরুর গোশত আনলে বলে গন্ধ লাগে। গরুর গোশত আনলে বলে ষাঁড়ের গোশত। এসব কিছুই ভালো লাগে না। এরই মাঝে জমিটা বিক্রি করে কেনা জমিতে বাড়ি তুলছে। শহরে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। সবকিছু অসহ্য লাগে। ফারদিনের জন্মের পর ৮/৯ মাস লাগাতার ওর কাছেই ছিল। অসহ্য হয়ে ফিরে যায় বাড়িতে। মানে জেলা শহরে। নিজের জমির পাশে মেয়ে থাকে সেই মেয়ের ভাড়া বাসায় নিজেও কিছু ভাড়া দিয়ে কয়েক মাস ছিল। পাভেল আর ওর বউ চাকরি করে। ফারদিনকে দেখার মতো কেমন কেউ নেই। শহরের খাবার ভালো লাগে না বলে তেমন খায় না। আবার খায় না বলে সবসময় সব খাবার আনাও হয় না। মাজেদা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে শহরে আসবে বলে।
এদিকে ছোট মেয়ে ময়না ফোন করে বলে ‘মা আমি একটা চাকরি খুঁজছি। চাকরিটা পেলে আমার মেয়ে অনু, বিনুকে তোমার কাছে রাখবো। তুমি ওদের দেখবে।’ মাজেদা হাসে আর হাসে। ফারদিন ওনার বংশধর। স্বামী এনায়েতের বংশধর। ওকে দেখাশোনা করতে হবে। বড় করতে হবে বলে আবার শহরে আসছে। ফারদিন এখন সারাক্ষণ ছোটছুটি করে। মাজেদা ভাবছে তিনি ফারদিনের পেছনে পেছনে ছুটতে পারবে তো। যাই হোক দেশী না হয় এবার বিদেশী ডিম দুধ-মাছ খেয়ে ওনার শরীরে শক্তি আনতে হবে। ফারদিনকে যে দেখতে হবে। ওর দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সোর্স- http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=166542