(১)
হঠাৎ দু : স্বপ্নের মতো করে নিরবের ঘুম টা ভেঙে যায়। লাফ দিয়ে বেড থেকে উঠে দাড়িয়ে ধপাস করে আবার সেই বেড এই মুখে হাত গুজে বসে পরে।
অন্যান্য সকাল গুলোতে বিন্তি নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে কতো শত দুষ্টুমি করে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আর আজ কেমন করে যেনো অস্বস্তিদায়ক ভাবে ঘুম টা ভাঙলো। নিজের মনের মধ্যে চাপা অপরাধ বোধের দরুন নিজেই বিরবির করে বলে উঠলো "ধেত! এতো টা ভুল না করলেও হতো!"
.
নিরব ডোর খুলে পাশের রুমে যায়, কিন্তু বিন্তি কে খুজে পায়না, একে একে ড্রইং/ডাইনিং রুম পেরিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে এলেও কোথাও বিন্তি কে খুজে পায়না নিরব। কেমন যেনো এক অদ্ভুত মায়া কান্না বেরিয়ে আসে নিজ থেকে।
হঠাৎ করে পাশ ফিরে ড্রেসিং টেবিল এর উপর গ্লাসে চাপা এক টুকরো কাগজ দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয় নিরব, যেখানে বিন্তির হাতে লেখা গুটি কয়েক অক্ষর যা মুহুর্তেই নিরব এর পুরো দুনিয়াকে তছনছ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, কাগজে লিখা "ভালো থেকো, চলে যাচ্ছি, খুজতে যেয়োনা, পাবেনা"।
.
(২)
নিরব আর বিন্তি দুজোনের খুব ছোট্ট এক টা সংসার। কিন্তু যার মধ্যে ভালবাসার কোনো কমতি নেই। প্রেম করেই দুজনের বিয়ে। কতো কাঠখোর পুরিয়ে বাবা মা কে ম্যানেজ করলো বিন্তি শুধু মাত্র নিরব এর জন্য। অথচ সেই নিরবই একটুতেই এতো রেগে গিয়ে এভাবে চলে যেতে বললো। তাই বিন্তির এই সিদ্ধান্ত, আর কখনো ওর কাছে ফিরে যাবেনা। চলে যাবে দু চোখ যেখানে থামে। সাইফ কে বলে ঢাকা-কক্সবাজার এর একটা প্যাকেজ বুক করিয়েছে তিন দিনের জন্য। অথচ যদি কাল চাঁদ দেখা যায় তবে এরপর দিন ঈদ। বাসের জানালার পাশের সিট টায় মাথা টা কে হেলে দিয়ে বসে থাকে বিন্তি। এভাবে একা চলে এসেছে ভেবে অনুশোচনায় পরতে গিয়েই রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায় বিন্তির।
.
নিরব একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে বিয়ের আগে থেকেই। দিনে যায় রাতে ফিরে। বিন্তি সারাটা ক্ষণ বাসায় একা থাকে। শুধু যেদিন মাস্টার্স এর ক্লাস থাকে সেদিন সকালে বের হয় এ ছারা বাদ বাকি সময় ঘরে থেকেই নিরব এর জন্য টুকিটাকি এটা সেটা রান্না করতে থাকে। কতো পদ যে মাঝে মাঝে রেধে ফেলে তা সে নিজেই ভুলে যায়।
.
গতোকাল বিন্তির খুব অসুস্থতা অনুভব করে। বিন্তি ভেবেছিলো কাজের বুয়ো টা বিকেলে আসলে ওকে দিয়ে রাধিয়ে নিবে আজকের দিন টা। সেই ভেবে শুয়ে থেকে ঘুমিয়ে পরে বিন্তি।
আর সেই ঘুম ভাঙে নিরব এর ফোন কলে রাত আট টায়!
নিরবের সাথে কথা শেষ করে সব বুজে উঠতেই বিন্তির মাথায় হাত! যেই বুয়োর জন্য অপেক্ষা সেই বুয়োই আজ আসেনি!
.
বিন্তির মেজাস টা চরমে উঠে। তবুও অসুস্থ শরীর নিয়ে ধিরে ধিরে উঠে নিরবের জন্য ভাত আর ডিম ভাজি করে। ডিম ভাজা শেষ হতেই নিরব চলে আসে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেই আচমকা নিরব বিন্তি কে ঝারি দিয়ে বলে " এসব কি রেঁধেছ? , সারাদিন অফিস করে রোজা রেখে এসে কি আন্ডা খেতে বসবো? ফাজলামি করো?"
আগে থেকেই রেগে থাকায় বিন্তিও রেগে গিয়ে বলে উঠে "এই আমি কি তোমার বাসার কাজের বুয়ো যে সারাদিন খেটে খুটে তোমার জন্য শুধু রসোগোল্লা বানিয়ে রাখবো?"
বিন্তি কে অবাক করে দিয়ে নিরব প্রথম বারের মতো তেরে গিয়ে বিন্তি কে বলে উঠে " কি বললে তুমি? তোমার সাহস তো কম না! তোমাকে কাজের বুয়ো হয়ে থাকতে বলেছে কে? ভাল না লাগলে চলে যাও" কথা টা বলেই নিরব রুম এ ঢুকে বিকট শব্দে ডোর অফ করে দেয়। বিন্তি কিছু বুঝে না উঠতে পেরে হু হু করে কেঁদে দেয়। সারা রাত ড্রইং রুমে পরে থেকে বিন্তি কাঁদতে থাকে অথচ নিরব এর যেনো কোনো হুশ ই নেই। একটি বারের জন্যেও বিন্তির কাছে গিয়ে স্যরি বলেনি। বিন্তিও যে অসুস্থ থেকেও রোজা রেখে এ পর্যন্ত কিছু খায়নি তাও একবার জানতে চাইলোনা!!
কথা গুলো ভাবতেই বিন্তি হু হু করে আবারো কেঁদে উঠে।
.
(৩)
এদিকে সকাল থেকে নিরব হন্যে হয়ে বিন্তি কে খুঁজতে থাকে। বিন্তির বাবা-মায়ের বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পারে সেখানেও যায়নি। একে একে নিরব এর জানা থাকা বিন্তির সব কটা রিলেটিভ দের কাছে ফোন দিয়েও কোথাও খুজে পায়না বিন্তিকে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে তবুও বিন্তির না আসা নিরব কে যেনো উম্মাদ করে তুলে। ওদিকে বিন্তির চলে যাওয়ার খবর শুনে বিন্তি দের বাবা- মায়ের বাসায়েও তোলপার শুরু হয়ে যায়। সেখান থেকে নিরব কে অনবরত থ্রেড দেয়া হচ্ছে। সব কিছু গুলিয়ে ফেলে নিরব নিজের রুমে মেঝেতে লুটিয়ে পরে চিৎকার করে কাদতে থাকে আর নিজেই নিজের নোখ দিয়ে মুখ খামচে ধরে।
.
রাত ২টা। নিরব সেইই সকাল থেকে প্রতিটি টাইমে বিন্তির ফোনে কল দিচ্ছে। কিন্তু সেই একই কথা "এই মুহুর্তে আপানার কাং্খিত নাম্বারে সং্যোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা"।
নিরব নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে মাঝ রাতেই ঘর ছেরে বেরিয়ে পরে রাস্তায় হন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে বিন্তিকে।
হাটতে হাটতে সকাল হয়ে যায় তবুও নিরব এর কোনো হুশ হয়না।
.
(৪)
কক্সবাজার এ এসে বিন্তি যে হোটেল টায় উঠেছে সেখানে বিন্তির পাশের রুমেই এক বুড়ো বুড়ির জুটি এসেছে। সকালে ওই আন্টি নিজেই এসে বিন্তির সাথে পরিচিত হয়। সেখান থেকেই জানতে পারে তাদের পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে ছেলে রা জোর করে কক্সবাজার এ ঘুরতে পাঠিয়েছে।
বুরো বুড়ির এই বয়সের রোমান্স দেখে বিন্তি নিজেই অবাক হয়। আর তখন ই নিরব এর কাছে ফোন দেয়ার জন্য হাত টা বারাতেই একরাশ জেদ এসে সেই হাত টা কে সড়িয়ে নেয়।
.
বিন্তি আনমনে সমুদ্র পাড়ে হাটতে থাকে। কক্সবাজার এ আসার পর গতোকাল এর সারাটি সময় বিন্তি ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। বিন্তির কিছু দুর সামনেই ওই আন্টি-আংকেল এর জুটিটা হাটছে। বিন্তি ভাবতে থাকে এখন নিরব কে ফোন করলে কেমন হবে? হয়তো নিরব খুব চেঁচামেচি করবে না হয় কয়েকশো বার স্যরি বলবে। থাক তার চেয়ে ও ওর মতো থাকুক। যে মানুষ নিজের স্ত্রীর ভিতরের কথা টুকু ভাল করে বুজতে চায় না তার একা থাকাই ভাল।
.
বিন্তি হঠাৎ নিজের ঠোটের উপর নোনা জল এর অস্তিত্ব খুজে পায়, যার উৎপত্তি বিন্তির চোখ জোরা থেকে। "ভালবাসার রঙ গুলো খুব অদ্ভুত। কোনো কোনো সম্পর্কে পুরোটা সময় মনোমালিন্যতায় ভরপুর হয়ে থাকে। তবুও সম্পর্কের ভাঙন ধরেনা। আবার কিছু সম্পর্কের পুরোটা সময় জুরেই সুখের সুধা বইতে থাকে কিন্তু হঠাৎ ছোট্ট একটা ভুলের জন্য দুজনের মাঝে হয় পাহাড়সম ভাঙনের সৃষ্টি"।
.
(৫)
বিন্তির বাবা প্রথম থেকেই নিরব কে পছন্দ করতোনা। তবুও শুধু মাত্র বিন্তির জন্যই বিয়ে টা হয়েছিলো। এখন বিন্তির না আসার খবর শুনে চিন্তা আর এতো দিন এর খোব মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলে নিরব কে ঝাচ্ছেতাই বলছে -" এই ছেলে! পেয়েছো টা কি আমার মেয়েটা কে? সেই শুরু থেকেই কষ্ট দিয়েছ, ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েটাকে পাগল ও করেছ, আর এখন নিজেই গুম করে রেখে বলছো বিন্তি রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছে না? দাড়াও আমি তোমার শেষ দেখে ছারবো!"
.
পুরো ঘরের অবস্থাই থমথমে। একদিন পর ঈদ অথচ এখন ও বিন্তির কোনো খোজ নেই। নিরব দের পরিবার ও এ বাসায় চলে এসেছে। থানা- পুলিশ পর্যন্ত জিডিও হয়েছে। ঠিক তখন বিন্তির ছোট খালার ছেলে সাইফ এসে নিরব কে ডেকে নেয় "ভাইয়া, কিছু কথা ছিলো!"
.
(৬)
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। হোটেল রুম এর জানালার ধারে বসে সাগর পাড়ে চেয়ে থেকে বিন্তি কাঁদছে। শাওয়ার ছেরে ভিজতে ভিজতে খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে বিন্তির।
হঠাৎ রুম এর ডোর এ খট খট আওয়াজ শুনতে পায়। বিন্তি আসতে বলে, দেখে সেই আন্টি টা এসেছে।
"মা তোমার ফেস টা কেমন দেখাচ্ছে যে?"
"কেমন আন্টি? ঠিক ই তো আছি"
"কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তুমি কেঁদেছ?"
"না! আমি ঠিক আছি, কিছু বলবেন আন্টি?"
"না, তেমন কিছুনা, আকাশে আজ নতুন চাঁদ উঠলো যে, কাল তো ঈদ, তাই তোমার খোজ নিতে এলাম"
"তাই নাকি? ঈদ মোবারক আন্টি"
"ঈদ মোবারক! তা মা তুমি কি আরো কদিন থাকবে এখানে?"
"উম্ম এইতো দু/একদিন থাকবো, তো আপনাদের পঞ্চাশতম ম্যারেজ ডে কেমন লাগলো? ঈদ কোথায় করবেন?
"এইতো মা! ছেলেরা আনন্দ করে পাঠিয়েছে, আমরাও আনন্দ পেলাম, বুড়ো বয়সের আনন্দ, আর আমরা তো আজ রাতের গাড়িতেই চলে যাচ্ছি মা"
"ও! মিস করবো আপনাদের"
"আমরাও করবো মা, তবে যাওয়ার আগে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই যদি কিছু মনে না করো"
"নিশ্চই,বলুন আন্টি"
"তুমি কি ম্যারিড?"
"জি"
"হাসব্যান্ড এর সাথে ঝামেলা হয়েছে?"
"(!)"
"শোনো মা, কিছু মনে করোনা,সেই প্রথম থেকেই তোমার মন টা কেমন যেনো লাগছিলো তাই জিজ্ঞেশ করলাম, তবে একটা কথা কি, জীবনে চলার পথে নিজেদের মাঝে অনেক ঝামেলা হবে, অনেক খারাপ কিছু হবে, তাই বলে আলাদা হয়ে থেকোনা, হয়তো রাগের মধ্যে এখন কিছু করছো, কিন্তু একটা সময় ঠিক বুজতে পারবে। এই দেখোনা আমরা এখন ও এক সাথে আছি? তোমাদের মতো সময়ের হাজার ঝামেলা পেরিয়েই তো এখন ও এক সাথে আছি, হা হা হা"
"(-)"
"মন খারাপ করোনা, বুজলে মা? আমাদের জন্য দোয়া করো, যাই, তোমার আংকেল বসে আছে একা, ভাল থেকো"
.
(৭)
রাত এর ডিনার করে হোটেল রুম ছেরে বাহিরে এসে খোলা জায়গাটায় বসে থাকে বিন্তি। কাল ঈদ, অথচ যার সাথে বসে থেকে ঈদের দিনের প্ল্যান করার কথা সেই পাসে নেই। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম চিন চিন ব্যাথা অনুভব করে বিন্তি। পাচ সাত ভাবতে ভাবতে আনমনা ভাবেই ফোন টা অন করে নিরব কে কল দেয় বিন্তি, হঠাৎ বিন্তি হতচকিয়ে যায়! নিরব এর ফোন এর রিংটোনের সেইম রিংটোন স্পষ্ট ভাবে বিন্তির পিছনে বাজছে।
পিছনে ঘুরে দাড়াতেই বিন্তি দেখতে পায় নিরব দাড়িয়ে এক মনে বিন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হওয়া ভাব না কাটতেই নিরব বিন্তির হাত টা ধরে এক ঝটকা তে বুকের সাথে চেপে ধরে।
দুজনেই কাঁদতে থাকে। একজন কাঁদছে প্রিয় মানুষ টিকে খুজে পাওয়ার আনন্দে আর অন্য জন কাঁদছে প্রিয় মানুষ টির রাগ ভাঙানোর সুখে।
.
রাতের নরম প্রকৃতি তে বাস এর জানালার পাশে বিন্তি বসে আছে, কিন্তু এবার একা নয়, সাথে আছে নিজের জীবনে সবচাইতে আপন মানুষ টা।
নিরবতা ভেঙে নিরব বলে উঠে-
"এই শুনো, সাইফ যে একটা মেয়ের সাথে লুকিয়ে প্রেম করে এটা কিন্তু কাউকে বলবেনা, ও যদি তোমার লুকানো আস্তানার কথা না বলতো তাহলে আজ রাতেই আমি ডেড হয়ে যেতাম"
"উহহহ, ন্যাকা, ওইদিন এত্তো গুলো কথা বলে এখন সুফী সাজতে এসেছে। আর কোনো দিন ওসব বললে আর খুজে পাবেনা, কাউকে না জানিয়েই চলে যাবো"
"সেই সুযোগ টা আপনাকে আর দেয়া হবেনা মহা রানী, এখন থেকে আপনাকে আমার মধ্যেই বেধে রাখবো, আর কষ্ট দিবোনা"
"হুহ, মনে থাকে যেনো"
"থাকবে"
.
গাড়িতে থাকা সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে, বিন্তিও নিরব এর কাধে মাথা রেখে শুয়ে আছে, আস্তে করে ওদের সিটের জানালা টা খুলে দেয় নিরব। সাথে সাথেই এক ঝটকা বাতাসে বিন্তির চুল গুলো উড়ে এসে নিরব এর মুখ ঢেকে দেয়, গভীর আবেশে তলিয়ে যায় দুজন। নিরব ও নিজের মনে চোখ বুজেই শপথ করে ফেলে, " এই পথচলার হয়তো শেষ আছে, কিন্তু কখনো যেনো নিজেদের এক সাথে চলার পথ টি শেষ না হয়"।
বা হাত টা দিয়ে বিন্তির বাহু চেপে ধরে নিরব। দু-জনেই চোখ বুজে অনুভব করতে থাকে পবিত্র কিছু মুহুর্ত কে।
.
"সত্য ভালবাসা গুলো এমন ই। এর কোনো সমাপ্তি নেই। কেননা পবিত্র ভালবাসার প্রতিটি মুহুর্তই একেকটি নতুন অধ্যায়ের জম্ম দেয়"।
.
Written By : অদৃশ্য ইকারাস
হঠাৎ দু : স্বপ্নের মতো করে নিরবের ঘুম টা ভেঙে যায়। লাফ দিয়ে বেড থেকে উঠে দাড়িয়ে ধপাস করে আবার সেই বেড এই মুখে হাত গুজে বসে পরে।
অন্যান্য সকাল গুলোতে বিন্তি নিরবের মাথায় হাত বুলিয়ে কতো শত দুষ্টুমি করে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আর আজ কেমন করে যেনো অস্বস্তিদায়ক ভাবে ঘুম টা ভাঙলো। নিজের মনের মধ্যে চাপা অপরাধ বোধের দরুন নিজেই বিরবির করে বলে উঠলো "ধেত! এতো টা ভুল না করলেও হতো!"
.
নিরব ডোর খুলে পাশের রুমে যায়, কিন্তু বিন্তি কে খুজে পায়না, একে একে ড্রইং/ডাইনিং রুম পেরিয়ে আবার নিজের রুমে ফিরে এলেও কোথাও বিন্তি কে খুজে পায়না নিরব। কেমন যেনো এক অদ্ভুত মায়া কান্না বেরিয়ে আসে নিজ থেকে।
হঠাৎ করে পাশ ফিরে ড্রেসিং টেবিল এর উপর গ্লাসে চাপা এক টুকরো কাগজ দেখতে পেয়ে হাতে তুলে নেয় নিরব, যেখানে বিন্তির হাতে লেখা গুটি কয়েক অক্ষর যা মুহুর্তেই নিরব এর পুরো দুনিয়াকে তছনছ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট, কাগজে লিখা "ভালো থেকো, চলে যাচ্ছি, খুজতে যেয়োনা, পাবেনা"।
.
(২)
নিরব আর বিন্তি দুজোনের খুব ছোট্ট এক টা সংসার। কিন্তু যার মধ্যে ভালবাসার কোনো কমতি নেই। প্রেম করেই দুজনের বিয়ে। কতো কাঠখোর পুরিয়ে বাবা মা কে ম্যানেজ করলো বিন্তি শুধু মাত্র নিরব এর জন্য। অথচ সেই নিরবই একটুতেই এতো রেগে গিয়ে এভাবে চলে যেতে বললো। তাই বিন্তির এই সিদ্ধান্ত, আর কখনো ওর কাছে ফিরে যাবেনা। চলে যাবে দু চোখ যেখানে থামে। সাইফ কে বলে ঢাকা-কক্সবাজার এর একটা প্যাকেজ বুক করিয়েছে তিন দিনের জন্য। অথচ যদি কাল চাঁদ দেখা যায় তবে এরপর দিন ঈদ। বাসের জানালার পাশের সিট টায় মাথা টা কে হেলে দিয়ে বসে থাকে বিন্তি। এভাবে একা চলে এসেছে ভেবে অনুশোচনায় পরতে গিয়েই রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায় বিন্তির।
.
নিরব একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে বিয়ের আগে থেকেই। দিনে যায় রাতে ফিরে। বিন্তি সারাটা ক্ষণ বাসায় একা থাকে। শুধু যেদিন মাস্টার্স এর ক্লাস থাকে সেদিন সকালে বের হয় এ ছারা বাদ বাকি সময় ঘরে থেকেই নিরব এর জন্য টুকিটাকি এটা সেটা রান্না করতে থাকে। কতো পদ যে মাঝে মাঝে রেধে ফেলে তা সে নিজেই ভুলে যায়।
.
গতোকাল বিন্তির খুব অসুস্থতা অনুভব করে। বিন্তি ভেবেছিলো কাজের বুয়ো টা বিকেলে আসলে ওকে দিয়ে রাধিয়ে নিবে আজকের দিন টা। সেই ভেবে শুয়ে থেকে ঘুমিয়ে পরে বিন্তি।
আর সেই ঘুম ভাঙে নিরব এর ফোন কলে রাত আট টায়!
নিরবের সাথে কথা শেষ করে সব বুজে উঠতেই বিন্তির মাথায় হাত! যেই বুয়োর জন্য অপেক্ষা সেই বুয়োই আজ আসেনি!
.
বিন্তির মেজাস টা চরমে উঠে। তবুও অসুস্থ শরীর নিয়ে ধিরে ধিরে উঠে নিরবের জন্য ভাত আর ডিম ভাজি করে। ডিম ভাজা শেষ হতেই নিরব চলে আসে। হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসেই আচমকা নিরব বিন্তি কে ঝারি দিয়ে বলে " এসব কি রেঁধেছ? , সারাদিন অফিস করে রোজা রেখে এসে কি আন্ডা খেতে বসবো? ফাজলামি করো?"
আগে থেকেই রেগে থাকায় বিন্তিও রেগে গিয়ে বলে উঠে "এই আমি কি তোমার বাসার কাজের বুয়ো যে সারাদিন খেটে খুটে তোমার জন্য শুধু রসোগোল্লা বানিয়ে রাখবো?"
বিন্তি কে অবাক করে দিয়ে নিরব প্রথম বারের মতো তেরে গিয়ে বিন্তি কে বলে উঠে " কি বললে তুমি? তোমার সাহস তো কম না! তোমাকে কাজের বুয়ো হয়ে থাকতে বলেছে কে? ভাল না লাগলে চলে যাও" কথা টা বলেই নিরব রুম এ ঢুকে বিকট শব্দে ডোর অফ করে দেয়। বিন্তি কিছু বুঝে না উঠতে পেরে হু হু করে কেঁদে দেয়। সারা রাত ড্রইং রুমে পরে থেকে বিন্তি কাঁদতে থাকে অথচ নিরব এর যেনো কোনো হুশ ই নেই। একটি বারের জন্যেও বিন্তির কাছে গিয়ে স্যরি বলেনি। বিন্তিও যে অসুস্থ থেকেও রোজা রেখে এ পর্যন্ত কিছু খায়নি তাও একবার জানতে চাইলোনা!!
কথা গুলো ভাবতেই বিন্তি হু হু করে আবারো কেঁদে উঠে।
.
(৩)
এদিকে সকাল থেকে নিরব হন্যে হয়ে বিন্তি কে খুঁজতে থাকে। বিন্তির বাবা-মায়ের বাসায় ফোন দিয়ে জানতে পারে সেখানেও যায়নি। একে একে নিরব এর জানা থাকা বিন্তির সব কটা রিলেটিভ দের কাছে ফোন দিয়েও কোথাও খুজে পায়না বিন্তিকে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে তবুও বিন্তির না আসা নিরব কে যেনো উম্মাদ করে তুলে। ওদিকে বিন্তির চলে যাওয়ার খবর শুনে বিন্তি দের বাবা- মায়ের বাসায়েও তোলপার শুরু হয়ে যায়। সেখান থেকে নিরব কে অনবরত থ্রেড দেয়া হচ্ছে। সব কিছু গুলিয়ে ফেলে নিরব নিজের রুমে মেঝেতে লুটিয়ে পরে চিৎকার করে কাদতে থাকে আর নিজেই নিজের নোখ দিয়ে মুখ খামচে ধরে।
.
রাত ২টা। নিরব সেইই সকাল থেকে প্রতিটি টাইমে বিন্তির ফোনে কল দিচ্ছে। কিন্তু সেই একই কথা "এই মুহুর্তে আপানার কাং্খিত নাম্বারে সং্যোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছেনা"।
নিরব নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে মাঝ রাতেই ঘর ছেরে বেরিয়ে পরে রাস্তায় হন্ত হয়ে খুঁজতে থাকে বিন্তিকে।
হাটতে হাটতে সকাল হয়ে যায় তবুও নিরব এর কোনো হুশ হয়না।
.
(৪)
কক্সবাজার এ এসে বিন্তি যে হোটেল টায় উঠেছে সেখানে বিন্তির পাশের রুমেই এক বুড়ো বুড়ির জুটি এসেছে। সকালে ওই আন্টি নিজেই এসে বিন্তির সাথে পরিচিত হয়। সেখান থেকেই জানতে পারে তাদের পঞ্চাশতম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে ছেলে রা জোর করে কক্সবাজার এ ঘুরতে পাঠিয়েছে।
বুরো বুড়ির এই বয়সের রোমান্স দেখে বিন্তি নিজেই অবাক হয়। আর তখন ই নিরব এর কাছে ফোন দেয়ার জন্য হাত টা বারাতেই একরাশ জেদ এসে সেই হাত টা কে সড়িয়ে নেয়।
.
বিন্তি আনমনে সমুদ্র পাড়ে হাটতে থাকে। কক্সবাজার এ আসার পর গতোকাল এর সারাটি সময় বিন্তি ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। বিন্তির কিছু দুর সামনেই ওই আন্টি-আংকেল এর জুটিটা হাটছে। বিন্তি ভাবতে থাকে এখন নিরব কে ফোন করলে কেমন হবে? হয়তো নিরব খুব চেঁচামেচি করবে না হয় কয়েকশো বার স্যরি বলবে। থাক তার চেয়ে ও ওর মতো থাকুক। যে মানুষ নিজের স্ত্রীর ভিতরের কথা টুকু ভাল করে বুজতে চায় না তার একা থাকাই ভাল।
.
বিন্তি হঠাৎ নিজের ঠোটের উপর নোনা জল এর অস্তিত্ব খুজে পায়, যার উৎপত্তি বিন্তির চোখ জোরা থেকে। "ভালবাসার রঙ গুলো খুব অদ্ভুত। কোনো কোনো সম্পর্কে পুরোটা সময় মনোমালিন্যতায় ভরপুর হয়ে থাকে। তবুও সম্পর্কের ভাঙন ধরেনা। আবার কিছু সম্পর্কের পুরোটা সময় জুরেই সুখের সুধা বইতে থাকে কিন্তু হঠাৎ ছোট্ট একটা ভুলের জন্য দুজনের মাঝে হয় পাহাড়সম ভাঙনের সৃষ্টি"।
.
(৫)
বিন্তির বাবা প্রথম থেকেই নিরব কে পছন্দ করতোনা। তবুও শুধু মাত্র বিন্তির জন্যই বিয়ে টা হয়েছিলো। এখন বিন্তির না আসার খবর শুনে চিন্তা আর এতো দিন এর খোব মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলে নিরব কে ঝাচ্ছেতাই বলছে -" এই ছেলে! পেয়েছো টা কি আমার মেয়েটা কে? সেই শুরু থেকেই কষ্ট দিয়েছ, ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েটাকে পাগল ও করেছ, আর এখন নিজেই গুম করে রেখে বলছো বিন্তি রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছে না? দাড়াও আমি তোমার শেষ দেখে ছারবো!"
.
পুরো ঘরের অবস্থাই থমথমে। একদিন পর ঈদ অথচ এখন ও বিন্তির কোনো খোজ নেই। নিরব দের পরিবার ও এ বাসায় চলে এসেছে। থানা- পুলিশ পর্যন্ত জিডিও হয়েছে। ঠিক তখন বিন্তির ছোট খালার ছেলে সাইফ এসে নিরব কে ডেকে নেয় "ভাইয়া, কিছু কথা ছিলো!"
.
(৬)
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। হোটেল রুম এর জানালার ধারে বসে সাগর পাড়ে চেয়ে থেকে বিন্তি কাঁদছে। শাওয়ার ছেরে ভিজতে ভিজতে খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে বিন্তির।
হঠাৎ রুম এর ডোর এ খট খট আওয়াজ শুনতে পায়। বিন্তি আসতে বলে, দেখে সেই আন্টি টা এসেছে।
"মা তোমার ফেস টা কেমন দেখাচ্ছে যে?"
"কেমন আন্টি? ঠিক ই তো আছি"
"কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে তুমি কেঁদেছ?"
"না! আমি ঠিক আছি, কিছু বলবেন আন্টি?"
"না, তেমন কিছুনা, আকাশে আজ নতুন চাঁদ উঠলো যে, কাল তো ঈদ, তাই তোমার খোজ নিতে এলাম"
"তাই নাকি? ঈদ মোবারক আন্টি"
"ঈদ মোবারক! তা মা তুমি কি আরো কদিন থাকবে এখানে?"
"উম্ম এইতো দু/একদিন থাকবো, তো আপনাদের পঞ্চাশতম ম্যারেজ ডে কেমন লাগলো? ঈদ কোথায় করবেন?
"এইতো মা! ছেলেরা আনন্দ করে পাঠিয়েছে, আমরাও আনন্দ পেলাম, বুড়ো বয়সের আনন্দ, আর আমরা তো আজ রাতের গাড়িতেই চলে যাচ্ছি মা"
"ও! মিস করবো আপনাদের"
"আমরাও করবো মা, তবে যাওয়ার আগে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই যদি কিছু মনে না করো"
"নিশ্চই,বলুন আন্টি"
"তুমি কি ম্যারিড?"
"জি"
"হাসব্যান্ড এর সাথে ঝামেলা হয়েছে?"
"(!)"
"শোনো মা, কিছু মনে করোনা,সেই প্রথম থেকেই তোমার মন টা কেমন যেনো লাগছিলো তাই জিজ্ঞেশ করলাম, তবে একটা কথা কি, জীবনে চলার পথে নিজেদের মাঝে অনেক ঝামেলা হবে, অনেক খারাপ কিছু হবে, তাই বলে আলাদা হয়ে থেকোনা, হয়তো রাগের মধ্যে এখন কিছু করছো, কিন্তু একটা সময় ঠিক বুজতে পারবে। এই দেখোনা আমরা এখন ও এক সাথে আছি? তোমাদের মতো সময়ের হাজার ঝামেলা পেরিয়েই তো এখন ও এক সাথে আছি, হা হা হা"
"(-)"
"মন খারাপ করোনা, বুজলে মা? আমাদের জন্য দোয়া করো, যাই, তোমার আংকেল বসে আছে একা, ভাল থেকো"
.
(৭)
রাত এর ডিনার করে হোটেল রুম ছেরে বাহিরে এসে খোলা জায়গাটায় বসে থাকে বিন্তি। কাল ঈদ, অথচ যার সাথে বসে থেকে ঈদের দিনের প্ল্যান করার কথা সেই পাসে নেই। বুকের মধ্যে সূক্ষ্ম চিন চিন ব্যাথা অনুভব করে বিন্তি। পাচ সাত ভাবতে ভাবতে আনমনা ভাবেই ফোন টা অন করে নিরব কে কল দেয় বিন্তি, হঠাৎ বিন্তি হতচকিয়ে যায়! নিরব এর ফোন এর রিংটোনের সেইম রিংটোন স্পষ্ট ভাবে বিন্তির পিছনে বাজছে।
পিছনে ঘুরে দাড়াতেই বিন্তি দেখতে পায় নিরব দাড়িয়ে এক মনে বিন্তির দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হওয়া ভাব না কাটতেই নিরব বিন্তির হাত টা ধরে এক ঝটকা তে বুকের সাথে চেপে ধরে।
দুজনেই কাঁদতে থাকে। একজন কাঁদছে প্রিয় মানুষ টিকে খুজে পাওয়ার আনন্দে আর অন্য জন কাঁদছে প্রিয় মানুষ টির রাগ ভাঙানোর সুখে।
.
রাতের নরম প্রকৃতি তে বাস এর জানালার পাশে বিন্তি বসে আছে, কিন্তু এবার একা নয়, সাথে আছে নিজের জীবনে সবচাইতে আপন মানুষ টা।
নিরবতা ভেঙে নিরব বলে উঠে-
"এই শুনো, সাইফ যে একটা মেয়ের সাথে লুকিয়ে প্রেম করে এটা কিন্তু কাউকে বলবেনা, ও যদি তোমার লুকানো আস্তানার কথা না বলতো তাহলে আজ রাতেই আমি ডেড হয়ে যেতাম"
"উহহহ, ন্যাকা, ওইদিন এত্তো গুলো কথা বলে এখন সুফী সাজতে এসেছে। আর কোনো দিন ওসব বললে আর খুজে পাবেনা, কাউকে না জানিয়েই চলে যাবো"
"সেই সুযোগ টা আপনাকে আর দেয়া হবেনা মহা রানী, এখন থেকে আপনাকে আমার মধ্যেই বেধে রাখবো, আর কষ্ট দিবোনা"
"হুহ, মনে থাকে যেনো"
"থাকবে"
.
গাড়িতে থাকা সবাই ঘুমিয়ে গিয়েছে, বিন্তিও নিরব এর কাধে মাথা রেখে শুয়ে আছে, আস্তে করে ওদের সিটের জানালা টা খুলে দেয় নিরব। সাথে সাথেই এক ঝটকা বাতাসে বিন্তির চুল গুলো উড়ে এসে নিরব এর মুখ ঢেকে দেয়, গভীর আবেশে তলিয়ে যায় দুজন। নিরব ও নিজের মনে চোখ বুজেই শপথ করে ফেলে, " এই পথচলার হয়তো শেষ আছে, কিন্তু কখনো যেনো নিজেদের এক সাথে চলার পথ টি শেষ না হয়"।
বা হাত টা দিয়ে বিন্তির বাহু চেপে ধরে নিরব। দু-জনেই চোখ বুজে অনুভব করতে থাকে পবিত্র কিছু মুহুর্ত কে।
.
"সত্য ভালবাসা গুলো এমন ই। এর কোনো সমাপ্তি নেই। কেননা পবিত্র ভালবাসার প্রতিটি মুহুর্তই একেকটি নতুন অধ্যায়ের জম্ম দেয়"।
.
Written By : অদৃশ্য ইকারাস