মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৩২৪- ছায়ামানবী

লেখা - মাহমুদ অনিক

আজ আমার মন ভালো নেই। যখন আমার মন
খারাপ থাকে তখন আমি যেকোনো
একটা বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন
থাকি। এই পদ্ধতিটা আমাকে বাবা
শিখিয়েছেন। বাবার ধারনা এটা
করলে নাকি মন আর খারাপ থাকেনা।
মন খারাপের কারনটা একসময় হারিয়ে
যায়। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই
বাবার শেখানো এই পদ্ধতিটা অবলম্বন
করি। কখনো সত্যি সত্যিই এটা কাজে
দেয়। আবার কখনো মন খারাপের আরও
কয়েকটা কারন যুক্ত হয়।
আজ আমার মন খারাপ, তাই আমি
বিছানায় শুয়ে শুয়ে যুক্তরাষ্ট্রের
ক্যামব্রিজের রাস্তাঘাট, ওখানকার
লোকেদের চাল-চলন, কথাবার্তা আর
ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস গুলো কেমন
হতে পারে এসব নিয়ে একটা কল্পনার
জগতে ডুবে আছি। আমি কল্পনার জগতে
'ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব
টেকনোলজির' ক্লাসরুমে বসে একজন
বুড়ো বয়সী প্রফেসরের ফিজিক্স
লেকচার শুনছি। হঠাৎ কোথা থেকে
যেন গুণগুণ শব্দে রবীন্দ্র সংগীতের
আওয়াজ ভেসে আসলো। আমি
ক্লাসরুমের এপাশ-ওপাশ পুরোটাতে
চোখ বুলালাম। নাহ! এখানে কেউ
রবীন্দ্র সংগীত গাইছে না। তাছাড়া
এদের কন্ঠে এমন সুন্দর রবীন্দ্র সংগীত
শোনার আশাও করা যায়না।
বাঙালীদের মতো এতো আবেগ আর
ভালবাসা নিয়ে আর কেউ রবীন্দ্র
সংগীত গাইতে পারেনা। ক্লাসে
আমি ছাড়াও আর একজন বাঙালী
ছেলে আছে। কিন্তু সেও যে এই গান
গাইছে না সে ব্যাপারে আমি শতভাগ
নিশ্চিত। কারন এ গান নারীকন্ঠে
গাওয়া হচ্ছে।
কল্পনার জগতে গানের শব্দের উৎপত্তির
গোয়েন্দাগিরি করে ব্যর্থ হয়ে আমি
বাস্তব জগতে ফিরলাম। এখন গানটা
আরও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আরও বেশী
মায়ায় আকর্ষণ করছে গানটা। এখন আমি
নিশ্চিত যে, আপাই গান গাইছে। আপা
যখন গান গায় তখন যতোই গুরুত্বপূর্ণ কাজ
থাকুক তাতে আর মনোনিবেশ করা যায়
না। আপার সুর আর কন্ঠের জাদুতে আমার
পুরো পৃথিবীটাই যেন স্থির হয়ে
থাকে। আমি আপার ঘরে গিয়ে, আপার
কোলে মাথা রেখে তন্ময় গান শুনছি।
আপা গাইছে- " আমি তোমারো
বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব
বাস। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ
মাস..............."
আপার কোলে মাথা রেখে গান শুনলে
আমার সমস্ত দুঃখ, চিন্তা, মন খারাপ
দুরে পালিয়ে যায়। অন্যরকম একটা
ভালবাসা আমাকে ঘিরে থাকে
চারপাশ থেকে। এই পৃথিবীতে আমি
সবচাইতে বেশী ভালবাসি আমার
আপাকে। সেই ছোটবেলা থেকেই
আপার স্নেহ- মমতা আর ভালবাসায়
আমি বেড়ে উঠেছি। আপা কখনোই
আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি।
আমি, আপা আর বাবা এই তিনজন
নিয়েই আমাদের পরিবার। আমার বয়স
যখন ৫ বছর তখন আমার মা মারা যান।
মায়ের চেহারা, মায়ের স্নেহও আমার
তেমন মনে নেই। আপাই আমাকে মায়ের
মতো স্নেহ ভালবাসা দিয়ে বড়
করেছে। আপা আমার চাইতে সাত
বছরের বড়। তিন মাস আগে আপার বিয়ে
হয়ে গেছে। দুলাভাই অফিসের কাজে
বিদেশে ছিলেন বলে আপা এতদিন
শ্বশুরবাড়ী যায়নি। কিন্তু আজ দুলাভাই
আপাকে নিতে আসবেন। তাই আজ
আমার মনটা খুবই খারাপ।
জুম্মার নামাজের পর পরই দুলাভাই
এসেছেন। ছোট খালা, খালু আর রিমি
এসেছে অনেক আগেই। তিনজন মানুষের
এই বিশাল বাড়ীটায় আজ অনেক
প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে। পুরো
বাড়ীটা মাতিয়ে রেখেছে রিমি
একাই। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে
বাড়ির সব দায়িত্ব ওর ওপরই ন্যস্ত
হয়েছে।
আমরা সবাইমিলে একসাথে খাওয়া-
দাওয়া করলাম। তারপর অনেকক্ষণ
গল্পগুজব চললো। খুব আনন্দে কেটে
যাচ্ছে মন খারাপের দিনের সময় গুলো।
আমার দুলাভাই এমনিতেই খুব মিশুক আর
হাসি খুশী স্বভাবের মানুষ, তার
সাথে যদি কথার গোডাউন রিমি যুক্ত
হয় তাহলে আর আড্ডা না জমে যায়
কোথায়। আমি নিজেও আড্ডাবাজ
স্বভাবের, কিন্তু আজকের এই আড্ডায়
আমার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নেই।
দুলাভাই আর রিমির কথা শুনে আমার
হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা হয়ে
যায়। আবার হঠাৎ করে আপার ছলছল
বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকাতেই
আমার মনটা বিষাদে ভরে উঠে। যে
আপা সেই ছোটবেলা থেকে আমাকে
মায়ের স্নেহে লালনপালন করেছে,
প্রতিরাতে আমাকে গল্প শুনিয়েছে,
সে আপার যেন আজ সব কথা হারিয়ে
গেছে। আপা বোধহয় আজ সব গল্প ভুলে
গেছে। মুখে হাসি ধরে রেখেছে
ঠিকই, কিন্তু আমার আর বাবার কথা
ভেবে যে ওর ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে
সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।
দুলাভাই আপাকে যাওয়ার জন্য তাগিদ
দিচ্ছেন। এখন আপা চলে যাবে। গত এক
সপ্তাহ যাবৎ আপা রাজুর মা'কে ঘরের
সব কাজ বুঝিয়ে দিয়েছে। তবুও যাবার
আগে আবারও রাজুর মা'কে সব বুঝিয়ে
দিয়ে ছুটি দিয়ে দিলেন। এবার শুরু
হলো সেই আবেগী মুহূর্ত। আমি, আপা
কিংবা বাবা কেউই চোখে অশ্রু
ঝরিয়ে কাঁদছিনা। কিন্তু আমাদের
সবার ভেতরটা যে পুড়ে যাচ্ছে সেটা
আমরা তিনজনই বুঝতে পারছি। বাবা
আপাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন।
বাবার চোখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে
যে ওনার মনে আপাকে বলার জন্য
অনেক কথা জমে আছে। কিন্তু বাবা
আপাকে কিছুই বলছেন না। কন্যাদানের
সময় সব বাবারাই মেয়েদেরকে নানান
ধরনের উপদেশ দেন। কিন্তু বাবা
জানেন, আপাকে উপদেশ দেয়ার
মতো কিছুই নেই। গত ১২ টা বছর আপা
এই সংসার সামলেছেন। আপা নিজের
অজান্তেই বাবা আর আমার মা হয়ে
উঠেছে এই অল্প বয়সেই। বাবা আপার
কপালে একটা চুমু দিলেন। তারপর
দুলাভাইকে বললেন- 'বাবা আমার
কলিজাটা দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।
সবাই তো মেয়ের কন্যাদান করে, আমি
মায়ের কন্যাদান করলাম। ওকে দেখে
রেখো, ওর যাতে কোন কষ্ট না হয়।'
বাবা আপনি শুধু শুধুই চিন্তা করছেন।
সোমা কি আপনাদের ছেড়ে খুব দুরে
কোথাও চলে যাচ্ছে? মাত্র তো
ঘন্টাখানেকের পথ, আপনাদের যখন
ইচ্ছা হবে ওকে দেখতে চলে যাবেন।
তাছাড়া আমরা তো প্রতি সপ্তাহে
আসবোই।'
দুলাভাই যখন বাবার সাথে কথা বলছেন
তখন আমি আপার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে
কাঁদছি। আমি যে কাঁদছি সেটা
আপাকে বুঝতে দিচ্ছিনা, কিন্তু আপা
যে কাঁদছে সেটা আমি ঠিকই অনুভব
করছি। আমার এখন ইচ্ছা করছে হাউমাউ
করে কাঁদতে। আমি অনেক কষ্টে
কান্নাটাকে চেপে রেখেছি। আপা
চলে যাওয়াতে আজ আমার যতোটা কষ্ট
লাগছে, মায়ের কথা ভেবেও আমার
কখনো এতোটা কষ্ট লাগেনি।
চোখের জলহীন কান্নায় নিঃশব্দে
কেঁদে আর আমাদেরকেও কাঁদিয়ে
আপা চলে গেলো শ্বশুর বাড়ীতে।
আমি আপা আর দুলাভাইকে গাড়ীতে
তুলে দিয়ে ঘরে ফিরে এসেছি। ঘরে
ঢুকতেই দেখলাম বাবা উদাস দৃষ্টিতে
দেয়ালের দিকে তাকিয়ে
সিগারেটে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছেন।
বাবা সাধারণত এ সময়ে সিগারেট
খান না; আর আমার কিংবা আপার
সামনে তো কখনোই না। কিন্তু আজ
আমি ঘরে ঢুকেছি দেখেও বাবা
সিগারেট ফেলছেন না। আমি আমার
রুমে ঢুকে চুপচাপ বসে রইলাম। একটু পরেই
বাবা আমার রুমে এসে বসলেন।
-কি রে তোর কি সোমার জন্য খুব কষ্ট
হচ্ছে?
-তোমার হচ্ছেনা?
-তা তো কিছুটা হচ্ছেই। কিন্তু কি
করবি বল, বোনকে খুব বেশী ভালবাসিস
বলে তো আর সারাজীবন ওকে
নিজেদের কাছে রেখে দেয়া
চলেনা। ওর ও তো একটা জীবন আছে
তাই না।"
-হুমম
-তোর মামা কী কয়েকদিনের মধ্যে
ফোন- টোন করেছিলো?
-গত সপ্তাহেই করেছিলো।
-ভিসা প্রসেসিং, এডমিশনের কাজ
কতদূর এগোল?
- সবই প্রায় কমপ্লিট হয়ে গেছে। হয়তো
দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই ফ্লাইট। আচ্ছা
বাবা, আমার বিদেশ না গেলে কি
হয়না? এখানেই কত ভালো ভালো
ইউনিভার্সিটি আছে। কত ভালো
ভালো ফ্যাকাল্টি আছে।
- কিন্তু তোকে যে এরোনেটিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। তাছাড়া
তোর মামা কত আশা নিয়ে সবকিছুর
এরেঞ্জ করেছে। তুই না গেলে ওরাও
তো খুব কষ্ট পাবে।
- আর আমি চলে গেলে তোমাদের কষ্ট
হবে না?
- কিছুটা কষ্ট তো হবেই। বাবা রে এই
পৃথিবীতে কারো জন্য কোন কিছু
আটকে থাকেনা। এই যে দেখ, তোর মা
আজ বারো বছর ধরে নেই, তার জন্য
আমাদের সংসার কী থেমেছিলো?
সোমা সবটা সামলে নিয়েছে এতদিন।
আবার আজ সোমাও ওর ঘর-সংসার
গোছাতে চলে গেলো। কয়েকটা দিন
আমাদের খুব কষ্ট লাগবে। তারপর আস্তে
আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
- তা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু তুমি একা
থাকবে কিভাবে?
- আমি বরাবরই একা রে সুমিত।
তাছাড়া তুই কি একেবারেই চলে
যাচ্ছিস নাকি? মাত্র তো পাঁচ-ছয়টা
বছর; তারপর তুই দেশে ফিরে আসবি,
বিয়ে করবি। আবার আমাদের একটা
সুন্দর পরিবার হয়ে যাবে।
- বাদ দাও তো ওসব। তোমাকে একা
রেখে আমার একদমই যেতে ইচ্ছা
করছেনা।
- তুই আর আপত্তি করিসনা। এখন থেকেই
আস্তে আস্তে সবকিছু গোছগাছ শুরু করে
দে।
- বাবা তোমাকে বন্ধু ভেবে একটা
কথা বলবো?
- হুমম বল।
- বাবা তুমি একটা বিয়ে কর। আপা
নেই, আমিও যদি চলে যাই তাহলে এ
ঘরে তোমাকে দেখার আর কেউই
থাকবে না।
- বিয়ে! বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে
তো আমি আরও অনেক আগেই করতাম।
আমার একা থেকেই অভ্যেস, একা
থাকতেই ভাললাগে।
শোন, তোকে একটা উপদেশ দেই-
জীবনে কখনোই খুব বেশী মায়ায়
জড়াবি না। মায়া মানুষকে দ্বিধায়
ফেলে দেয়, আর এতে করে ধ্যান নষ্ট হয়।
জীবনে খুব বেশিদূর এগোন যায়না।
আমার শরীরটা ভালো লাগছে না রে,
শুয়ে পড়ি গিয়ে। তুইও বেশী রাত
জাগিস না।
- বাবা আমি কি তোমার মাথায় একটু
হাত বুলিয়ে দেবো?
- দিবি? দে তাহলে।
বাবা আমার বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
বাবা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমি বাবাকে অপলকে দেখছি। বাচ্চা
ছেলেদের মতো কোলবালিশ নিয়ে
কাত হয়ে একটা একা নির্লিপ্ত মানুষ
ঘুমাচ্ছেন। মানুষটা আসলেই ছোটকাল
থেকে একা এবং নিজকেন্দ্রিক। বাবা
ছোট থাকতেই আমার দাদা-দাদী
মারা যান। বড় চাচার কাছেই ছিলেন
বাবা। তারপর ভার্সিটিতে ভর্তি
হতে এলেন ঢাকায়। পড়ালেখা শেষ
করে ব্যাংকে চাকরী নিলেন। আমার
নানাজান ও ব্যাংকে চাকরী করতেন।
সৎ, পরিশ্রমী আর আদর্শবান ছেলে
হিসেবে নানাজান বাবাকে খুব পছন্দ
করতেন। এই পছন্দ থেকেই বাবা-মা'র
বিয়ে হল। আপা জন্ম নিলেন, তার ৭ বছর
পর আমার জন্ম হল। আমার বয়স যখন সাড়ে
চার বছর তখন মা'র হার্টের সমস্যা দেখা
দিলো। বিভিন্ন ডাক্তার, চেকাপ, ওষুধ,
চিকিৎসা, সবকিছু চলা সত্ত্বেও একদিন
হঠাৎ করে মা মারা গেলেন। সেই
থেকে বাবা একা। নানী, মামা,
খালা সবাই অনেক চেষ্টা করেছিলেন
বাবাকে বিয়ে করাতে, কিন্তু বাবা
আর বিয়ে করেননি। এসব গল্প আমি আপা
আর খালার কাছ থেকে শুনেছি।
আপা চলে যাবার পর থেকে আমার
মনটা ভালো নেই। আগের মতো ঘরে
মন টেকে না, পড়াশোনায় ও মন
বসেনা। আপা প্রতিদিনই দু-তিনবার
করে ফোনে খোঁজখবর নেয়। আর রিমি
তো ফোন করলে ছাড়তেই চায় না। ওর
কলেজের কোন স্যারের মাথায়
প্রবলেম আছে, কোন বান্ধবী কার
সাথে প্রেম করে, কোন ছেলে ওকে
দেখলেই ড্যাপ ড্যাপ করে তাকিয়ে
থাকে, ওর ফেসবুকের ইনবক্সে কি কি
ম্যাসেজ আসে, ইত্যাদি ইত্যাদি সব
হাবিজাবি কথা। মাঝেমাঝে
কাজের বাহানা দিয়ে ওর কল রিসিভ
করিনা। আর লাগাতার কয়েকদিন কল
রিসিভ না করলে, বাবার ফোনে কল
করে ঝগড়া শুরু করে দেয়।
একঘেয়েমি কাটাতে আমি এখন
প্রতিদিনই আমার চেনা ও পছন্দের
জায়গা গুলোতে ঘুরি আর বন্ধুদের
সাথে আড্ডা দেই। কে জানে, আবার
কবে দেখা হবে এ শহরের সাথে, আমার
চেনা মানুষ গুলোর সাথে।
আমার আমেরিকা যাওয়ার ডেট
ফিক্সড হয়ে গেছে। আর তিনদিন পরেই
আমার ফ্লাইট। আপা গতকাল থেকে
আমাদের বাসায় এসেছে। আমার জন্য
এটা-ওটা তৈরি করে দিচ্ছে। মামা-
মামীর জন্য আচার, পিঠা আরও কত কি
তৈরি করছে। বাবা অনেকগুলো
জামাকাপড় কিনে এনেছেন আমার
জন্য। আর রিমি তো কলেজ থেকে
সোজা আমাদের বাসায় চলে আসে,
তারপর সন্ধ্যাবেলা খালা এসে ওকে
নিয়ে যায়।
আপা, দুলাভাই, বাবা, খালা আর
রিমি আমাকে এয়ারপোর্টে পর্যন্ত
পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। আপা আর
বাবার কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
"কথার গোডাউন" আর ছটফট স্বভাবের
রিমির নিস্তব্ধতা আর উদাসীনতাও
আমার কষ্ট বাড়াচ্ছে। সবাইকে ছেড়ে
যেতে আমার খুব কষ্ট লাগছে। তবুও
বাবার স্বপ্নের কথা ভেবেই যাচ্ছি।
জীবনের দৌড়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার
জন্যই সবাইকে ছেড়ে দূরদেশে যাচ্ছি।
সব মায়া ফেলে রেখে যাচ্ছি।
বাবার ভাষ্যমতে - "মায়া মানুষকে
দ্বিধায় ফেলে দেয়, আর তাতে
কাজের ধ্যান নষ্ট হয়। জীবনে খুব দ্রুত
এগোনো যায়না। "
বাবাকে খুব বলতে ইচ্ছে করছে- বাবা,
শুধু এগিয়ে চলার নামই কি জীবন? আজ
আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। মা
আমার কাছে শুধুই আধোআধো মনে পড়া
কিছু স্মৃতি, এলবামে দেখা কিছু ছবি,
আর সবার কাছ থেকে শোনা গল্পের
মতো এক ছায়ামানবী। সবার কথা বাদ
দিয়ে ঠিক এ মুহূর্তে আমার সেই
ছায়ামানবীর কথা খুব মনে পড়ছে।
আমার নিজের প্রয়োজনে আর বাবা
আর আপার জন্য এমুহূর্তে সেই
ছায়ামানবীকে খুব দরকার। যে আজ
থাকলে, হয়তো আমি দূরদেশে বসে
সারাক্ষণ আপা আর বাবার কথা
ভাবতাম না। আপাও নিজের ঘর সংসার
ছেড়ে আমাদের জন্য এতোটা ব্যাকুল
হয়ে থাকত না। আর বাবাও এমন
ছন্নছাড়া জীবন যাপন করতেন না।
আমরা সবাই আমাদের দুশ্চিন্তা আর
মায়াগুলোকে ঐ ছায়ামানবীর কাছে
জমা রেখে নিজেদের মতো এগিয়ে
যেতাম। আর ঐ ছায়ামানবী আমাদের
সবাইকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে নিজে
স্থির থেকে আমাদের এগিয়ে যাওয়া
দেখত।
জীবনে এই প্রথমবার আজ আমার মাকে
এতোটা মনে পড়ছে। তার শূণ্যতা এই প্রথম
আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি। আমার
নিজেকে আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অসহায়
মানুষ বলে মনে হচ্ছে। হাজারো
মানুষের এই কোলাহলে আমার চিৎকার
করে বলতে ইচ্ছে করছে- "মা আমি
তোমায় সত্যিই খুব ভালবাসি। আমি
তোমার একটু স্পর্শ পাবার জন্য ব্যাকুল
হয়ে আছি। তুমি ফিরে এসো মা, তুমি
আমার ছায়া হয়ে থাকো।