মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ৩২৫- বেগুনি আকাশ ও সোনালি ডানার শঙ্খচিল

লেখা-ইব্রাহিম খলিল

হ্যাপী বার্থডে আপুনি... পিনাকে
জড়িয়ে ধরে রিনরিনে গলায় বলে ওর
ছয় বছরের ছোট বোন ফাবিহা। পিনা
শক্ত করে ফাবিহাকে জড়িয়ে ধরে ওর
গালে একটা চুমু দিয়ে বলে- আমার
জন্মদিনের গিফট কই? ফাবিহা তার
জামার ভেতর থেকে ছোট্ট একটা ভাঁজ
করা কাগজ এনে পিনার হাতে গুঁজে
দেয়। পিনা কাগজটা খুলে দেখে
তাতে একটা লাল রঙের ফ্রক পড়া, দুই
বেণী করা পিচ্চি মেয়ে আর নীল
রঙের টি-শার্ট পড়া, ঝাঁকড়া চুলের
পিচ্চি ছেলে হাত ধরাধরি করে
দাড়িয়ে আছে, আর নিচে লেখা-
হ্যাপী বার্থডে। পিনা ছবিটা
দেখেই ফিক করে হেসে ফেলে।
ফাবিহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে
আগের মত রিনরিনে গলায় বলল- ছবি
ভাল হয় নাই আপুনি? পিনা চোখ মটকে
বলল- অসাম ছবি হইসে রে কিন্তু একটা
কথা বলতো ছেলেটার মাথায় যে
ঝাঁকড়া চুলই হবে তা তুই জানিস
কিভাবে? ফাবিহা এই প্রশ্ন শুনে ফ্যাল
ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। পিনা
আপনমনেই হাসতে হাসতে ফাবিহার
আঁকা ছবিটা ওর পড়ার টেবিলের
সামনের দেয়ালে আটকে দেয়। তার
বোকা সোকা এই বোনটা তাকে
আসলেই অনেক ভালবাসে।
*
*
রাত সাড়ে ১২টার মধ্যে পিনাকে
তার বেশ অনেকগুলো বন্ধুবান্ধব ফোন
করে উইশ করে ফেললো। পিনা জানে
ফেসবুকের ওয়াল এতক্ষণে উইশে ভরে
গিয়েছে। পিনা এর মাঝে বেশ কিছু
সময় টেলিভিশন দেখলো। আম্মুর সাথে
গল্প করলো তারপর একসময় বিরক্ত হয়ে
সেলফোন হাতে নিয়ে বসে থাকলো।
নাহ, আসাদের কোনোই ফোন বা
ম্যাসেজ নেই এখনো। অথচ গত ক’দিন
থেকেই আসাদকে ইনিয়ে বিনিয়ে
নানা কথার ফাঁকে পিনা অসংখ্যবার
বুঝিয়ে দিয়েছে আজ তার জন্মদিন। এত
কিছুর পরেও যদি সেই মানুষটি
জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানায়
তাহলে বুঝতে হবে প্রতিবারের মত
এবারো পিনাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।
পিনা সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুরুদুরু
বুকে- নিজে থেকেই আসাদের
নাম্বারে ফোন করে বসে।
-হ্যালো।
-কেমন আছেন?
- হু ভালো। কী ব্যাপার এত রাতে ফোন
করেছো যে?
-আজকে আমার জন্মদিন আমাকে উইশ
করেন।
-তোমাকে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ উইশ
করেছে, আমি না করলেও তো হয়,
নাকি? এছাড়া জন্মদিন নিয়ে এত
মাতামাতি করাও আমার একদম পছন্দ না,
পিনা।
- আমার মাতামাতি করা পছন্দ,আমাকে
উইশ করেন। একগুঁয়ের মত বলল পিনা।
-ছেলেমানুষি করো না। কখনো ভেবে
দেখেছ রাস্তার পথশিশুগুলো, বস্তির
ছেলে মেয়েগুলো কখনো জন্মদিনের
উৎসব করে কি না? করে না, পিনা।
ওদের জীবনের অভাব, আর কষ্টের
কারণে নিজেদের জন্মদিনটাকেই
অভিশপ্ত মনে হয় তাদের। ওরা তো
জানেও না ওদের জন্ম কবে হয়েছিল।
কিছুটা আনমনা হয়ে বলে আসাদ।
- অ্যাই এম স্যরি। আমি আপনার পয়েন্ট
অফ ভিউ বুঝতে পেরেছি আসাদ ভাই।
আমাকে উইশ করতে হবে না।
ছেলেমানুষী করার জন্যে দুঃখিত।
পিনা আর কোন কথা না বলেই লাইন
কেটে দিয়ে সেলফোনটা বন্ধ করে
দেয়। গলার কাছে কেমন যেন একটা
কষ্টের পিণ্ড জমে আছে । সে নিজেও
জানে আসাদ যেখুব ভুল কিছু বলে নি
তাকে, তবু মনের কোথায় যেন একটা
ব্যথা টনটন করছে। কথাগুলো কি তাকে
আরও একটু নম্রভাবে বলা যেতো না।
আসাদের কথাগুলো শুনে মনে হচ্ছে
জন্মদিন নিয়ে কথা বলাই একটা বিরাট
অন্যায়। পিনার চোখ থেকে ঝরঝর করে
অশ্রু ঝরছে। মনে হচ্ছে তার এবারের
জন্মদিনটা খুব খারাপ যাবে।
*
*
আসাদের সাথে পিনার পরিচয়টা বছর
তিনেক আগে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হওয়া এই মেয়েটি কালচারাল
ক্লাবের যোগ দিতে কথা বলতে
এসেছিলো আসাদের সাথে। মাত্র
পাঁচ ফুট কিংবা আরো কম হাইটের
ফর্সা ও ছিপছিপে মেয়েটার দিকে
তাকিয়ে আসাদ প্রথমে কিছুটা
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলো। মনে
হচ্ছিলো কোনো স্কুল-ছাত্রী তার
সাথে মজা করতে এসেছে! সে বার
কয়েক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো-
তুমি কি এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী?
প্রতিবারই রিনরিনে গলায় মেয়েটি
উত্তর দিলো- জ্বি ভাইয়া।
-কোন ডিপার্টমেন্ট?
-মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজম। ঢোক
গিলে বলল মেয়েটি।
-তোমাকে তো দেখে অনেক পিচ্চি
মনে হয়। আমি ভাবিই নি তুমি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। আসাদ
ভালোমানুষের মত হাসে।
-আমাকে সবাই এমনই ভাবে ভাইয়া। নতুন
কিছু ভাবলে বলবেন, কেমন? ফট করে
বলে বসে পিনা।
আসাদ সাথে সাথেই তার স্বভাবসুলভ
গাম্ভীর্যে ফিরে যেয়ে বলে-ওই যে
লাল ফতুয়া পড়া আপুটাকে দেখছো না?
ও হচ্ছে মৌ। তুমি মৌ এর সাথে কথা
বলো, নতুন মেম্বারদের সাথে ও-ই
যোগাযোগ করছে। ঠিক আছে?
-জ্বি আচ্ছা। ধইন্না পাতা ভাইয়া।
পিনা অল্প একটু হেসে দাঁত দেখায়।
আসাদ সরু চোখে পিনার দিকে এক নজর
তাকিয়েই আগের চেয়েও বেশি
গম্ভীর হয়ে যায়। কলেজ পেরিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য পা রাখা
বেশির ভাগ ছেলে -মেয়েই আসলে
একটা ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে যায়।
এদের সাথে আন্তরিকতা দেখানোও
অনেক সময় ভয়াবহ ব্যাপার।
এরপর থেকেই আসাদ প্রায়ই লক্ষ্য
করেছে, ভার্সিটি বা ভার্সিটির
বাইরের যে কোনো কিছু জানতে হলে
অথবা যে কোন ব্যাপারে সাহায্য
লাগলে মেয়েটি বারবার আসাদের
কাছে আসছে। আসাদ পিনাকে প্রায়ই
পিচ্চি বলে ডাকে। পিনা তার এই
সম্বোধন বেশ সাদরেই গ্রহণ করেছে।
আসাদ সংস্কৃতিকর্মী। সুতরাং
স্বভাবতই সে বেশ আগ্রহের সাথে
পিনাকে নাটক, বই, ইতিহাস, মিউজিক
নিয়ে বিভিন্ন কথা বলতো। পিনা
বরাবরই আসাদের সব কথার খুব
মনোযোগী শ্রোতা, গোগ্রাসে
গিলতো আসাদের সব কথাই। একটা
সময়ে পিনা আসাদকে ফোন করা শুরু
করলো। আসাদ তখনই ভেতরে ভেতরে
সতর্ক হয়ে গিয়েছে। ওর মনে হয়েছে
ব্যাপারটা অন্যদিকে যাচ্ছে। প্রেম-
ভালোবাসা নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে
কিছুটা এলার্জি আছে আসাদের।
কলেজে পড়ার সময় একটা মেয়েকে পছন্দ
করতো আসাদ, ব্যাপারটা
ভালোবাসার কাছাকাছি । একতরফা
ভালোবাসা।। সেই মেয়েটিকে
ভালোবাসার কথা জানাবার আগেই
ইতালি প্রবাসী এক লোকের সাথে
মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দিয়ে
দেয় মেয়েটির বাবা-মা। সতেরো,
আঠারো বছর বয়সের একজন বাচ্চা
মেয়ের পাশে প্রায় তেত্রিশ-
চৌত্রিশ বছরের একজন ভারিক্কী
চেহারার লোককে দেখে আসাদ
এতটাই আহত হয়েছিল যে ঘটনার
অনেকদিন পর পর্যন্ত সে রাতে ঘুমাতে
পারেনি। ব্যস, তার জীবনের
ভালোবাসার গল্পের সেখানেই
সমাপ্তি। এ যুগের প্রেমিক হবার লম্বা
লিস্টে তাকে কোনোমতেই আঁটানো
যাবে না তা সে জানে। এসব নিয়ে
ভাবনা নেই তার। তবে সময়ের সাথে
সাথে তার জীবনবোধ বদলে যাচ্ছে এই
নিয়েই মূলত মগ্ন আছে সে। আশেপাশের
মানুষকে দেখতে, তাদের নিয়ে
ভাবতে ভালো লাগে আসাদের।
কখনো কখনো তার মনে হয় তার জীবনটা
কোন উপন্যাসের মত লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
যেই উপন্যাসে আছে অজস্র ছোট ছোট
গল্প, নাম না জানা সব বেদনা, হাজার
হাজার চরিত্র, গূঢ় বাস্তবতা আর
সেইসাথে অসীম শূন্যতা। এসব
অবসেশনের একটা পর্যায়ে মাঝে
মাঝে মনে হয় যে প্রকৃত বয়সের চাইতেও
বড় হয়ে গিয়েছে সে। দলছুট মনে হয়
নিজেকে, যেন কোন এক অদ্ভুত পথের
পথিক হয়ে গিয়েছে সে। সে পথ সে
একান্তই একা......
*
*
পিনাকে নিয়ে আসাদের মৌয়ের
সাথে বেশ ক’বার কথা হয়েছে।
প্রতিবারই মৌ ওকে বলেছে পিনার
আবেগের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে।
আসাদ প্রথম প্রথম বলতো,
বিশ্ববিদ্যালয়ের আসার পর এমন করে
অনেককেই ভালো লাগে। এই
ভালোলাগার দৈর্ঘ্য দিয়াশলাই এর
কাঠির মত। একবার বারুদে আগুন লেগে
গেলেই ঠুস করে জ্বলে মিলিয়ে
যাবে। কিংবা একসময় নিজে থেকেই
বারুদ খসে যাবে কাঠি থেকে। কিন্তু
আসাদকে মিথ্যে প্রমাণ করে পিনা
তার এক রত্তি আবেগ দিয়াশলাই এর
কাঠির মত বুকের কাছে সযত্নে ঠিকই
ধরে রেখেছে, প্রায় আড়াইটি বছর
ধরে। মৌ আগে আসাদকে পিনার
ব্যাপার নিয়ে খ্যাপাতো আর মিটমিট
করে হাসতো। এখন তাও করেনা, শুধু
মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে- তোর
মত বাউন্ডুলে কে কেউ এতদিন ধরে পছন্দ
করতে পারে তা দেখেও তুই অবাক
হোস না? কিংবা কিছু অনুভব করিস না?
গণ্ডারের চাইতেও অধম হয়ে গেছিস
রে তুই। খারাপ লাগে মাঝে মাঝে
আমার পিচ্চি মেয়েটার কথা ভেবে।
আসাদ এসব কথা শুনে চুপ করে থাকে। খুব
অল্প অল্প করে হলেও পিনা তার
ছেলেমানুষি আচরন দিয়ে, আবেগের
প্রকাশ দেখিয়ে তার মনে একটা ছোট্ট
জায়গা করে নিয়েছে আসাদ আজকাল
তা অনুভব করে। তবুও কেমন যেন একটা
বাঁধা আসে বারবার মন থেকে। কেন
যেন মনে হয় পিনা হয়ত তার চেয়েও
অনেক অন্যরকম, অনেক গোছালো
কাউকে পাওয়ার যোগ্য। এইসব কিছু
ভেবে প্রায়ই আসাদ খুব বিষণ্ণ হয়ে যায়।
*
*
রাত বারোটার পর পিনাকে
জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ইচ্ছে
করেই ফোন করেনি আসাদ। পিনা
নিজে থেকে ফোন করার পরেও
হালকা কথা বার্তা বলে ফোন রেখে
দিয়েছে। আসাদ জানে পিচ্চি
পিনার এখন মন খারাপ। জন্মদিন নিয়ে
বেশ ক’দিন ধরেই পিনাকে উল্লসিত
হতে দেখে এসেছে সে। আসাদের
সাথে টুকটাক কথা হলে আকারে
ইঙ্গিতে পিনা তা বুঝিয়েও
দিয়েছে। আসাদ সব বুঝে আপনমনেই
হেসেছে। কখনোই সে পিনাকে
কোনো কিছু উপহার দেয়নি.। তবে
এবার তাকে জন্মদিনের উপহার দিতে
চায়। কিংবা হাতে গোনা কিছু
চেনামুখকে নিয়ে এবার পিনার
জন্মদিন উদযাপন করলেও মন্দ হয় না তাই
ভাবছে সে। একটা কেক আর কিছু ফুল
কিনে ফেলা যায়। কিংবা পিনাকে
একটা ব্যাগ গিফট করা যায়। পিনার
প্রিয় বাদামী ব্যাগটা বেশ পুরনো হয়ে
গিয়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে
মৌকে ফোন করে আসাদ। পিনার
জন্মদিন উপলক্ষে কী করা যায় তা
নিয়ে মৌয়ের সাথে কথা বলা দরকার।
এই পৃথিবীতে যে কোনো ব্যাপারে
সাহায্য পাওয়ার জন্যে, কিংবা
দরকারের মুহুর্তে তার পাশে পাওয়ার
জন্যে এই বন্ধুটিই শুধু আছে তার।
*
*
খুব ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে পিনা
দীর্ঘ সময় নিয়ে স্নান করলো। জন্মদিন
উপলক্ষে সে ঠিক করে রেখেছিলো
বেগুনী একটা ড্রেস পড়বে। বেগুনী
আসাদের প্রিয় রঙ। কিন্তু এখন আর
বেগুনী রঙের কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে
না। পিনা ওর বেশ পুরনো একটা সাদা-
সোনালি রঙের একটা ফতুয়া পড়লো,
গলায় দিলো একটা সোনালি স্কার্ফ।
কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো চুলগুলো খুব উঁচু করে
বেঁধে ফেললো। তারপর ছোট্ট একটা
নিঃশ্বাস ফেলে তার বাদামী
ব্যাগটা নিয়ে ক্লাসের দিকে
রওয়ানা হল।
মানিক মিয়া এভিনিউ এর পাশ দিয়ে
যাওয়ার সময় প্রতিদিন পিনার চোখ
পড়ে অজস্র জারুল গাছের দিকে।
বেগুনী রঙের থোকা থোকা ফুলে গাছ
ভরে থাকে। পিনার জারুল ফুল দেখে
মন ভালো হয়ে যায়। বেগুনী রঙের যে
আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে আসাদের
কাছ থেকে না জানলে হয়ত ও কখনো
বুঝতেও পারতো না। আসাদের সাথে
গল্প করতে কী ভীষণ ভালো লাগে
পিনার। অথচ আসাদের এসবে কোনোই
ভ্রূক্ষেপ নেই। মাঝে মধ্যে রাত দশটার
পর ফোন করলেই আসাদ গম্ভীর গলায়
বলবে-পিচ্চি, আমার সেলফোনটা হল
মাইক্রোম্যাক্স এর, রাত দশটার পর
ফোনে কথা বললে বা ফোনে বেশি
কথা বললে সেলফোনটা গরম হয়ে যায়
বুঝলে? কমদামী চাইনিজ ফোন তো...আর
ফোন গরম হলে আমার কানও গরম হয়ে
যায়, আর কান গরম হলে মাথা গরম হয়ে
যায়। তাই আমাকে রাতে ফোন দিও
না প্লিজ। এই ধরণের কথা শোনার পর
আর কী বলার থাকতে পারে? পিনা
তাই আবারো অ্যাই এম স্যরি বলে ফোন
রেখে দেয়। সে জানে আসাদের
টাইপের মেয়ে হয়ত সে না, আসাদ তার
আবেগের ধারে কাছ দিয়েও যেতে
চায় না। তবুও কেন যেন আসাদের জন্যে
পিনার ভালোলাগা দিন দিন বাড়ছে
বৈ কমছে না। ছোটোবেলায় বলা
ধাঁধার কথা মনে হল তার; নদীকে
কাটলে নদী আরও লম্বা হয়ে বেড়ে
যায়, পিনার আবেগগুলো মনে হয় নাম
না জানা ছোট্ট কোন নদীর মত হয়ে
গিয়েছে, যতই সে আসাদের প্রতি
আবেগকে কেটে ফেলতে চাক না
কেন নদী আরো লম্বা হয়ে বয়েই
চলবে...পিনা আপনমনেই দীর্ঘ
নিঃশ্বাস গোপন করে।
*
*
ক্লাসে ঢোকামাত্র একগাদা বন্ধু
পিনাকে হৈ হৈ করে উইশ করলো।
এতগুলো মানুষের হাস্যেজ্জল মুখ দেখে
পিনার মন একটু একটু করে ভালো হতে
থাকে। ক্লাসের সবার পক্ষ থেকে
পিনা বিশাল একটা বার্থডে কার্ড
পেয়েছে। সেই কার্ডের উপরে লেখা-
আজ বিচ্ছিরি পিনার বাড্ডে”
কার্ডের উপরে নানা রঙের কালি
দিয়ে ক্লাসের সবাই মন্তব্য করেছে।
পিনা আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে
কার্ডটার ভেতরের লেখা পড়তে শুরু
করলো। তাতে লেখা-
তোর নাকি একা একা খালি বসে
বসে স্বপ্ন দেখেই কাটে দিন
কোনমতে।
তোর নাকি নেই কোন কাজের ছিরি
সাড়া পাড়া জেনে গেছে, তুই
বিচ্ছিরি।।
তোর নাকি ঘরদোর চুলোয় গেছে
দিনরাত একাকার আজ তোর কাছে
খেয়ালের হাতে হাত এই বাড়াবাড়ি
সবাই তো বুঝে গেছে এ-ও বিচ্ছিরি।।
তুই নাকি খুব খুব খুব ভালোবেসে
ভালোবাসা পেতে আরও দূরে যাস
শেষে
ভালোবাসা মানে না তো
হিসেবের কড়ি
বেহিসেবী তাই তুই খুব বিচ্ছিরি।।
তুই নাকি সবকিছু আগুনের মত
পোড়াতে চেয়েছিস জঞ্জাল যত
সে আগুনে আমিও তো জ্বলেপুড়ে মরি
আমরা তো বলবোই, তুই বিচ্ছিরি।।
কার্ডের লেখাগুলো পড়ে আনন্দে
পিনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পাশ
থেকে কেউ যেন হেঁড়ে গলায় বলে
উঠলো- বিচ্ছিরি পিনা এখন আমাদের
ভালোবাসায় কাঁদবে, ওরে কেউ
গামলা এনে দে। পিনা চোখে জল
নিয়ে হাসছে, তার মনে হচ্ছে এই
পৃথিবীতে না আসলে সে জানতোই
না জীবনটা কত সুন্দর হতে পারে!!
*
*
আসাদ শূন্য দৃষ্টিতে মৌয়ের দিকে
তাকিয়ে বলল- কেকের উপর কী
লিখতে বলবো? প্রিয় পিচ্চি পিনা,
তোমার জন্মদিনে তোমাকে জানাই
নিরন্তর শুভেচ্ছা। কি ঠিক আছে?
-তুই কী পিনার শিক্ষক নাকি? এত
ভাবের কথা লিখবি ক্যান? মুখ
বাঁকিয়ে বলে মৌ।
-প্রিয় পিনা, শুভ জন্মদিন, অনেক সফল হও
জীবনে। এইটা ঠিক আছে?
-উফফ কী সব বলছিস। মনে হচ্ছে কোন এক
কুখ্যাত আঁতেলের বানী শুনছি।
আরেকটা বল-
-শুভ জন্মদিন পিনা। ব্যস। আর কিছুই
লিখতে হবে না। আসাদ বিমর্ষ মুখে
বলে।
-স্টুপিড, মজাদার কিছু লেখ। উমম...
লিখতে পারিস-
“প্রিয় পিনা
তোমারে বিনা
মুশকিল হবে জিনা
তাই থাকতে চাই না তুমিহীনা”
আসাদ কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে হাসতে
থাকে তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে
বলে-লিখতে পারিস তবে পিচ্চি
বুঝে ফেলবে এই লাইনগুলো আমি
লিখিনি।
-বুঝুক, কিন্তু খুশি তো হবে। কম তো পেইন
দিসনি মেয়েটাকে। সারপ্রাইজ যখন
দিবি ভাল মতই দে। যাকে বলে একদম
'ছিনেমাটিক ছারফ্রাইজ'। নাটকীয়
ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলে মৌ।
কেকের দোকানীও ওদের কথা শুনে
একগাল হেসে বলল- স্যার এই
কবিতাটিই কি লিখে দিবো? আসাদ
আগের মত কিছুটা বিব্রত হয়ে বলল- দিন,
তবে হলুদ বা গোলাপি ক্রিম দিয়ে
লিখবেন না প্লিজ, সাদা রঙের যেন
হয় লেখাগুলো... দোকানী মহা
উৎসাহে সাদা রঙের ক্রিম দিয়ে
কেকের উপর কবিতা লেখা শুরু করে
দিয়েছে, তার উৎসাহ দেখে আসাদের
ভালো লাগছে।
আসাদ আর মৌ পিনার জন্যে অনেক
ঘোরাঘুরি করে একটা বড়সড় হ্যান্ডব্যাগ
কিনলো। মৌ কিনলো দোলনচাঁপা ফুল,
সাদা পাথরের ছোটোখাটো কিছু
কানের দুল, আসাদ কিনলো হলুদ-সাদা
গোলাপ, পূর্ণেন্দু পত্রী আর জীবনানন্দ
দাশের কবিতার বই, মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সমগ্র...
ইত্যাদি। সে পিনার খুব কাছের কিছু
বন্ধুকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে তাদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনের একটা
ফাস্টফুডের দোকানে পিনাকে নিয়ে
চলে আসতে বলেছে। আসাদের আজ খুব
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে, মনে হচ্ছে হয়
সে আজ অনেক বাচ্চাদের মত কাজ কর্ম
করছে নয়তো পিচ্চি পিনা অনেক বড়
হয়ে গিয়েছে।
*
*
ছোট্ট ফাস্টফুডের দোকানটা বিকেল
পাঁচটার পর থেকেই উৎসব মুখর হয়ে
গিয়েছে। আজকের এই উৎসবে দুজন
বিশেষ অতিথিও এনেছে আসাদ,
তারা হল- আকবর আর সম্রাট। ওদের
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে বয়ের
কাজ করা দুই ভাই। পিনার দুইপাশে এরা
দুজন চকচকে চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
আর অপেক্ষা করছে কখন কেক কাটা
হবে। কেকের বাক্স খোলা মাত্রই সবাই
কেকের উপরের লেখাটা পড়ার জন্যে
হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। পিনা কেকের
লেখা পড়ে বিস্ময়ে মাছের মত খাবি
খাচ্ছে। কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে
গিয়েছে ওর বাচ্চা বাচ্চা
চেহারাটা। আসাদ টেবিলের
একপাশে বসে একেকজন ছেলেমেয়ের
আচরন দেখছে আর কথা বার্তা শুনছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পিনার
চাইতেও আকবর, সম্রাট এবং পিনার
বন্ধুবান্ধবের আনন্দ বেশি। পিনা একটু পর
পর কাঁদো কাঁদো মুখ করে ফেলছে
আবার হাসছে। টেবিলের এক কোণে
রাখা দোলনচাঁপা ফুলগুলোর ঘ্রাণে
চারপাশ মৌ মৌ করছে। আসাদ
আপনমনেই ভাবতে থাকে তার মন এখন
ভালো... বড্ড ভালো...
-আসাদ ভাই... কেকের উপরের
অণুকাব্যটা কে লিখেছে? মৌ আপু?
-হুমম...
-অসাধারণ সুন্দর হয়েছে অণুকাব্যটা,
আচ্ছা, তাহলে কবিতার বইয়ে লেখা
লাইনগুলো কে লিখেছে?
-কোন লাইনগুলো বলতো? আসাদ না
বোঝার ভান করে বলে।
-“নেমে গেছে বৃষ্টি অনেকক্ষণ
ভাসছে আমার ঢাকা এখন
আমি একা-একা ময়দানে ভিজবো
অনেকক্ষণ
পিনা আমি আর ধরবো না তোমার
ফোন
আমি একা-একা ঘুরে যাবো ছবির হাট
আর আশুলিয়া
একা-একা ফুচকা, একা লেবুচা
তুমি একা-একা ঘরে বসে করে যাও-
তোমার অভিমান
সামনে আমার স্বপ্ন হবে বিশাল আকাশ
সমান”…!!
-এই লাইনগুলো আমি লিখেছি। নরম
গলায় বলল আসাদ। অঞ্জন দত্তের গানের
লাইনের কিছু শব্দ বদলে লিখে
দিয়েছি। তোমার ভালো লেগেছে?
- পিনা আমি আর ধরবো না তোমার
ফোন লাইনটা বদলে যদি ধরবো তোমার
ফোন হত তাহলে অনেক ভাল লাগতো।
গম্ভীর হতে গিয়েও হাসতে হাসতে
বলে পিনা।
-ঠিক আছে তবে তাই হবে।
-আমি ভেবেছিলাম আজকে বেগুনী
রঙের পোষাক পড়বো, কিন্তু…বলতে
গিয়েও থেমে যায় পিনা।
-হা হা… আমার উপর রাগ করে পড়নি
তাই তো…অবশ্য তোমার সোনালি
স্কার্ফ দেখেও কবিতার একটা লাইন
মাথার ঘুরছে আমার…
-পিনা একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল-
কোন লাইন?
- আমরা দুজনে বেগুনি আকাশে,
সোনালি ডানার শঙ্খচিল ।
আসাদের কথা শুনে পিনার চোখ
ভিজে আসছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে
বাইরের আকাশ হয়ত আজ তার জন্যে
বেগুনী রঙ ধারন করেছে... লালচে
বাতির এই ছোট্ট ফাস্টফুডের দোকান
পেরুলেই তার জন্যে অপেক্ষা করছে
অদ্ভুত আনন্দময় কোনো জগৎ। বারবার তার
মনে হচ্ছে জীবন অনেক অদ্ভুত, এই
জীবনটাকে সে অনেক ভালোবাসে।
যেমন মানুষ ভালোবাসে মানুষকে।