মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৯০- অমন মানুষ হয়

ঝাল দিয়ে দু প্লেট ফুচকার অর্ডার করে
ছোট্র টুলটায় বসে আছে তিথী । ও
বোধহয় আমার অপেক্ষাই করছে । প্রায় দশ
মিনিট আগে বলেছিলাম , __ ‘আমি বের
হয়েছি তুমি ওখানটাতেই থাকো’ ।
যদিও তখন আমি ওর থেকে তিন
মিনিটের হাটা পথের দূরত্বে দাড়িয়ে
ছিলাম ।
ও জানে আজকেও আমি আগের মতো
সামনে নাও যেতে পারি । আজকেও
ওকে আরো কিছুক্ষন বসে থেকে চলে
যেতে হতে পারে ।
তবে ও জানেনা আমি ওর পিছনের
উল্টোপাশের ঝাউ ঝোপের কাছের
বেঞ্চিটায় বসে আছি । তিথি
ভাবলেশহীন ভাবে ওখানেই বসে আছে
। ওর মধ্য উঠবার কিংবা কিছু করার লক্ষন
দেখা যাচ্ছেনা মোটেও ।
আমি এবারেও তিথীর সামনে যাবোনা

উঠে দাড়িয়ে পাঞ্জাবীর পকেটে
হাত দিয়ে হাটা দিলাম ।
পাঞ্জাবীটার দুটো পকেটের একটা
ছেড়া । কীভাবে ছিড়েছে মনে নেই ।
ছেড়া ছিলো কিনা তাও মনে পড়ছেনা

ছেড়া স্থানটা দিয়ে হাতে দিব্যি
বাতাস লাগছে । আমি মকেটে হাত
রেখেই হাত দুলিয়ে দুলিয়ে হাটছি ।
আমি জানি তিথী কিছুক্ষন পর ছলছল
চোখে উঠে দাড়াবে । তারপর বাসায়
যেয়ে কানে হেডফোন গুজে দিয়ে
শুয়ে থাকবে । ওর চোখ তখনো ছলছল করবে
। চোখের কোন বেয়ে এক-দু ফোটা জল
গড়িয়েও পড়বে । তিথী ওটা মুছে
সংকল্প করবে এরপর আর আমার সামনে না
আসার । কিন্তু কিছুক্ষন পরেই যদি আমি
আবার বলি নীলক্ষেত মোড়ে চলে এসো
, তাহলে ও কিছুক্ষন আগের কথা বেমালুম
ভুলে যাবে । ছুটে আসবে মোড়ে ।
ওখানেও আমি থাকবোনা । কিছুক্ষন
থেকে বিষন্ন হয়ে ফিরে যাবে ।
এবারে ওর চোখ ছলছল করবে না । কারন
বারবার এক কাজ করতে হয়না । তিথী
ওটা জানে ।
তবে আমি জানিনা । কারণ আমি
বারবার ওকে আসতে বলেও আমি যাইনা

আমার তিথীর ছলছল চোখের কথা
ভাবতে খুব ভালো লাগে । তবে সামনে
দাড়িয়ে দেখার সাহস করিনি কখনো ।
আমার আপাতত কোথাও যেতে ইচ্ছে
হচ্ছে । পকেটে আছে মাত্র সাত টাকা ।
পকেটে সাত টাকা রাখার কারণ আছে ।
সাত হচ্ছে লাকী নাম্বার । লাকী
সেভেন ।
আমি পকেটে সাত টাকা নিয়ে এ
কারণেই ঘুরি । অবশ্য পেছনে একটা কারণ
ও আছে ।
একবার আমি ভার্সিটি থেকে বাসায়
ফিরছিলাম । আমার পকেটে ছিলো সাত
টাকা । কারণ পকেটে থাকা একটা দশ
টাকার নোট থেকে তিন টাকা আমি
তিনটা লজেন্সের পেছনে ব্যায়
করেছিলাম । তিনটা ছেলে এসে
লজেন্স খেতে চেয়েছিলো । আমি
বাকী সাত টাকা পকেটে রেখে কিছুদূর
যেতে না যেতেই এক-গাদা ছেলে
মেয়ে এসে ঘিরে ধরলো লজেন্স
পাবার আশায় । আমি মহা ফ্যাসাদের
ভেতর পড়ে গেলাম । পকেটে আছে মাত্র
সাত টাকা । অথছো ছেলে মেয়ে সব
মিলিয়ে আছে চৌদ্দজন ।
উদ্ধার করলো মেয়েটা । মেয়েটা
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছিলো কোথাও ।
আমি হুট করে ডাক দিয়ে থামিয়ে
দিলাম ।
“আপনার কাছে সাতটা টাকা হবে ?”
মেয়েটা চোখ গোল করে আমার দিকে
তাকিয়ে রইলো ।
“না , আমার কাছে সাত টাকা ভাঙতি
নেই” মেয়েটা মিনমিনে গলায় জবাব
দিলো ।
আমি বললাম “ভাঙতি আমি দিচ্ছি”
মেয়েটা বললো “ভাঙতি দিতে হবেনা
, এই নিন” বলে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে দশ
টাকার নোটটা একরকম গুজে দিয়ে কিছু
বলার সুজোগ না দিয়ে দৌড়ে একরকম
ছুটেই পালাল ।
আমি লজেন্স কিনে বিলিয়ে দিয়ে
বাকী তিন টাকা ফিরিয়ে দিতে
মেয়েটাকে খুঁজতে থাকলাম ।
পেয়েও গেলাম কিছুক্ষন পর । রাস্তার
ধারের বেঞ্চিতে বসে পা দিয়ে
মাটি খোঁচাচ্ছে ।
“এই নিন আপনার বাকী তিন টাকা” আমি
হাতের টাকাটা সামনে বাড়িয়ে
দিলাম ।
মেয়েটা এবারেও চোখ গোল করে
তাকিয়ে রইলো ।
“আপনি এসেছেন তিনটাকা ফেরত
দিতে !” মেয়েটার চোয়ালের মধ্যকার
ফাক বৃদ্ধি হয় ।
“জ্বী । আমার সাত টাকার প্রয়োজন
ছিলো” আমি সাদামাটা জবাব দিলাম

“সাত টাকারই কেনো দরকার হলো ? কম
বেশী হলে আপত্তি হলোনা কেনো !”
“কারণ আমার কাছে সাত টাকা ছিলো
আর টাকা লাগতো চৌদ্দ টাকা”
“আপনি কি সবসময় সাত টাকা নিয়ে
ঘোরেন ?” ভ্রু কুচকে জানতে চাইলো
মেয়েটা ।
“জ্বী না । আজকেই সাতটাকা হয়ে
গিয়েছে । নইলে আমার পকেটে
জীবনেও চৌদ্দটাকার প্রয়োজনে সাত
টাকা ছিলো কিনা মনে নেই । আর
চৌদ্দ টাকার প্রয়োজনও কখনো পড়েছে
কিনা ঠিক মনে করতে পারছিনা” আমি
নিরাসক্ত ভঙ্গীতে জবাব দিলাম ।
মেয়েটা কিছুক্ষন আমার দিকে
তাকিয়ে রইলো তারপর ফিক করে হেসে
দিলো ।
আমি এবারে মেয়েটার দিকে
তাকালাম । মানুষ অমনো হয় !
*
“আজকে আমার ভালো লাগায় নেই
মানা
ভালোবাশার দ্বারেতে আজ মনচায় দিই
হানা”
চিরকুটটা দলা পাকিয়ে ফেলে দিলাম
। অহেতুক চীজ পকেটে রাখার মানে
হয়না । আমি হাত উল্টে আঙুলের ডগা
দিয়ে নাকের ঘাম মুছে নিলাম । এখন
পরিবেশটা খুব একটা ঠান্ডা না হলেও
শুধু-শুধু গাছের ছায়ার তলায় বসে থেকে
ঘাম আসার মতো মোটেও না । তাও আমি
ঘামছি । চিরকুটটা আমাকে শঙ্কার ভেতর
ফেলে দিয়েছে । মেয়েটা চিরকুট
কেনো দেবে !
আমি ঝিম মেরে বসে রইলাম । কাছে-
পিঠে কোথাও দোকান নেই । ধোয়ার
তৃষ্ঞা জেগেছে খুব । আমি যদিও ধূম্রখোর
নই তাও আমার আপাতত ধোয়ার পিপাসা
পাচ্ছে । বোধহয় ভেতর থেকে উড়ন্ত
ধোয়াটাকেও এটার সাথে মিশিয়ে
দিয়ে এটার ধোয়া বলে চালিয়ে
দেবার ছলটুকু করার জন্যই । পকেটে সাত
টাকা আছে । সাতাশ টাকা ছিলো ।
বিশ টাকা একটা টোকাইকে পেয়ে
দিয়ে দিয়েছি । মোটামুটি খিদের
টের পাচ্ছি । যখন সাতাশ টাকা ছিলো
তখন ক্ষিধে ছিলোনা । এখন টাকা নেই ,
তাই ক্ষিধে পাচ্ছে । এখন তিথীর
কাছে ফোন দেয়া চলে । ফোনটা বের
করে ফোন দিলাম । তিথী ধরলোনা ।
কারণ ওর কাছে ফোনটা যায়নি , আর না
যাবার কারণ হচ্ছে ফোনে টাকা নেই ।
একটা যান্ত্রিক কন্ঠ কিছুক্ষন শুদ্ধ ভাষায়
কথা বললো । আমি আবারো ফোন দিলাম
। শুদ্ধ ভাষাটা পছন্দ হয়েছে । আবারো
ফোন দিলাম , ‘এই কলটি সম্পূর্ণ করার জন্য
যথেস্ট পরিমান টাকা আপনার একাউন্টে
নেই’ বলার পর এবারে কেটে দিলাম ।
এখানে একাউন্ট আসবে কোথেকে ! বেশ
বড় রকমের ভুল । তিথী সাথে থাকলে
বলা যেতো , তিথী অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকতো । আর নয়তো এই
ব্যাপারে আমার মাথা ব্যাথা দেখে
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকতো , তারপর
ফিক করে হেসে দিতো । আর আমি
দেখতাম । লুকিয়ে একরাশ মায়া নিয়ে
দেখতাম । ধরাও হয়তো খেতাম । কে
জানে ! ধরা কি খেতাম ?
আচ্ছা , আমি মেয়েটার দিকে
তাকিয়ে থাকি কেনো ! আমার কি
কিছু হয়েছে ?
মেয়েটা কি আমার কেউ ? তবে আমি
বোধহয় মেয়েটার কেউ । হতাশায় কুকড়ে
এলাম । এই বাউন্ডুলে জীবনে ওর মতো
একজন কেনো যে এলো ! আমার কিছু
একটা করতে হবে । অন্তত কিছু না করেও
কিছু করতে হবে ।
*
এ সময়টাতে তিথীর বারান্দায় আসার
কথা না । তাও তিথী এসেছে । কারণ
আমি বলেছি আমি আসবো । তিথী সাফ
মানা করে দিয়েছে । বলেছে আমাকে
বাড়ীর ত্রি-সীমানায় যেনো না
দেখে । আমি হু-হা করে কলটা কেটে
দিয়েছি । তিথী ভেজা চুলে দাড়িয়ে
আছে । আমি নিচে দাড়িয়ে আছি ।
ঝোপটা না থাকলে তিথী আমাকে
দেখতে পেতো । পেলে ছুটে নিচে
নেমে আসতো । আসার সময় হয়তো হোচট
খেয়ে নখ উল্টাতো । আর ওখান থেকে
চুইয়ে রক্ত গড়াতো , তিথীর সেদিকে
কোন ভ্রুক্ষেপ থাকতোনা ।
তিথী আমাকে না দেখলেও আমি ওকে
দেখেছি । এক গাছি চুল ওর চোখে-মুখে
এসে পড়ছে , আর ও আলতো হাতে
সারিয়ে দিচ্ছে । কাজ নেই , তাও
বারান্দায় বসে থাকবে । জানে আমি
আসবোনা , তাও বসে থাকবে । একটা
দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আমার , নাহ্ ..
এই মেয়েটার থেকে দূরে থাকতে হবে
আমার । যতোটা দূরে থাকলে মেয়েটা
আমার মুখটা কল্পনাও করতে পারবেনা ।
আমি আবার তিথীর দিকে তাকালাম ।
মেয়েটা দূরে দৃষ্টি মেলে দিয়েছে ,
আকাশ পানে । পাতার ফাক দিয়ে
আলোরা তিথীর মুখে এসে পড়ে
খেলছে । তিথী বিষন্ন হয়ে আকাশ
দেখছে । আর আমি তিথীকে । মানুষ অমনও
হয় !
*
বারো টাকার বাস ভাড়া দশ টাকা
দিয়েছি বলে বাসের হেল্পার ব্যাটা
খুব ত্যাক্ত করছে । পকেটে আর টাকা নেই

পকেটে পনেরো টাকায় কেনা একটা
গোলাপ । আমি কিনিনি । রুমমেট কিনে
দিয়েছে । কিনে এনে জোড় করে
হাতে দিয়ে পাঠিয়েছে । তিথীর
কাছে পাঠিয়েছে । আমি গোলাপটা
বাসের হেল্পারের হাতে দিয়ে
দিলাম । হেল্পার ব্যাটা হা করে আমার
দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর তার
মনে কি আসলো কে জানে , বাকী দশ
টাকাও ফিরিয়ে দিলো ।
সাথে দশ টাকার নোটটাও , ‘ভাইজান
আপনের পয়সা দেওন লাগবোনা’ । আমি
হাতে টাকা আর ফুল নিয়ে বসে রইলাম ।
নামার সময় হেল্পারের হাতে ফুলটা
গুজে দিয়ে এলাম , ‘এটা আপনার কাছেই
থাকুক ভাই’ ।
হেল্পার অবাক চোখে আমার দিকে
তাকিয়ে থাকলো । বোধহয় পড়তে
চাইছে কিছু একটা । আমার চোখ পড়তে
চাইছে । আমি সরে এলাম ।
তিথী জানেনা আমি এখন ওর বাড়ীর
সামনে যাবো । কারণ আজ বলিনি আমি
আসছি । আমি যেয়ে দাড়িয়ে থাকলাম ।
তিথী বারান্দায় এলোনা ।
কিছুক্ষন পর সোজা নিচে নেমে এলো ।
এসে নিরাসক্ত ভাবে দাড়িয়ে রইলো ।
আমার মনে হলো কিছু একটা বলা দরকার ।
আমি উল্টো ঘুরে হাটা দিলাম । আমার
আসলে কিছুই বলার নেই । হেটে
অনেকটা দূর গেলাম । তারপর আবার
ফিরে এলাম । মেয়েটা ওখানেই ঠায়
দাড়িয়ে আছে । গালে জলের দাগ
লেগেছে । গরম নোনা জল কিনা ! খুব
দ্রুতই শুকিয়ে গিয়েছে ।
আমি মেয়েটার চোখের দিকে
তাকালাম । একরাশ ক্রোধ ছাপিয়ে
কিছু একটা প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে ।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে
কাঁদছে । আমি দেখছি ।
মানুষ অমনও হয় !