[ ১ ]
হাইয়ার ম্যাথের অংক নিয়ে সেই
বিকেল থেকে ভীষন প্যারায় আছে রুমু,
কিছুতেই হোমওয়ার্ক গুলো সলভ করতে
পারছেনা। এই কার্টেশীয়
স্থানাংকের অংক গুলো কেনো
জানি রুমুর মাথায় ঢুকে না অথছ তার
বন্ধুরা ফরফর করে স্যারকে অংক গুলো
করে দেয়।
" হিউম্যান বিকাম এ গ্রেট স্যাডিস্ট
ওয়েন হি ফিল জেলাস উইথ হিজ ক্লোজ
পারসন " কথাটার সত্যতা রুমু জানে তবুও
সে হিংসে করে আর তার হিংসে অপুর
উপর। এর সুস্পষ্ট কারণ আছে, একটা মানুষ
ম্যাথম্যাটিক্সে এত ভালো হয় কি করে
সেটা রুমুর মাথায় ঢুকে না। অবশ্য এই
হিংসেটা অপুর সামনেই করে সে, অপু
তখন ভ্যাবলার মতো শুধু হাসে। রুমুর
অংকের ভাবনায় ছেদ পড়ে তার ফোন
কলে, স্ক্রীণে নামটা দেখেই গা শির
শির করে উঠে রুমুর। বেশ কয়েকবার রিং
হয় কিন্তু সে ফোন ধরে না আসলে
ধরতে সাহস পায় না। পড়ার টেবিল
থেকে উঠে বেলকনিতে যায় রুমু, চোখ
বুলায় চার পাশে, উঠনের কোনে
গন্ধরাজ ফুলের গাছটা দাড়িয়ে। এখন
অবশ্য ফুলে নেই তবে ফুলের সময়ে এর
গন্ধে সারাটা বাড়ি মৌ মৌ করে।
আকাশে পাংশু মেঘের আনাগোনা।
ইদানীং শেষ রাত্রে বৃষ্টি হয়, আর এ
জন্য প্রতিদিন সকালে মন খারাপ হয়ে
যায় রুমুর। জানালা খুলে ঘুমানোটা
অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার কিন্তু যে
কারণে ইদানীং জানালা খুলে
ঘুমানো সেই বৃষ্টি এলে কেনো জানি
মরার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না।
" কিরে এই সন্ধ্যে বেলায় বেলকনিতে
কি করিছ?"
মায়ের ডাকে ঘুমের সাথে
অভিমানের ছেদ পরে তার।
" কিছু না মা, এমনেই দাড়িয়ে আছি "
" তোর ছোট মামা এসে গেছে "
হঠাৎ করেই মনটা প্রচন্ড ভালো হয়ে
যায় রুমুর। তার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে
সুখি মানুষ হচ্ছেন ছোট মামা। এটা রুমুর
শুধু বিশ্বাস নয় পরীক্ষালব্ধ ফল। কয়েক
সপ্তাহের জন্য ছুটিতে দেশে এসেছেন
তিনি, থাকেন আমেরিকায়। সে এক
দৌড়ে নিচে ড্রয়িংরুমে আসে।
" কিরে কই ছিলি তুই? "
" আমার রুমেইতো "
" কতো দিন পর!!! তাই না? "
" মামা তুমি, মোটা হয়ে গেছো "
" আর তুই শুটকি"
বলেই মামা হাসলেন, সেই প্রানবন্ত
হাসি। উনি আবার প্রশ্ন করলেন,
" কলেজে যাওয়া হয় ঠিক মতো "
" হ্যাঁ মামা, এখন জেরা বন্ধ করো।
ভালো আছো তুমি?"
" আমি খারাপ থাকি নাকি!!"
" এবারো একা আসছো "
" না না, একটা টেডি বিয়ার সাথে
আছে। তোর জন্য "
" চলো, তোমার রুম দেখিয়ে দেই।
জানো ছোট মামা, আমি নিজের
হাতে গুছিয়েছি রুমটা।"
" তাই!!! আপা কই গেলি, আমার
আম্মাজান দেখি সত্যি সত্যি বড় হয়ে
গেছেরে "
তারা দুজন রুমের দিকে হাটতে
লাগলেন।
[ ২ ]
" কিরে ভ্যাবলা, আজ দেরী করলি যে "
রুমুর কথায় উত্তর দিলোনা অপু শুধু একটু
হাসলো। অবশ্য অপু ছেলেটা এমনি
ক্লাসে খুব একটা কথা বলেনা কারো
সাথেই। এর ফলে সবার কাছে তার
কারেক্টারটা একটা একগুয়ে টাইপ
ছেলে। ক্লাসের পিছনে বসতে
ভালোবাসে ও। সবার থেকে আলাদা
থাকতেই যেনো সর্ব সুখ তার।
পড়ালেখা শেষে যতটুকু সময় পায়,
পুরোটাই ঢেলে দেয় গিটারের তারে।
এর তার গুলোর সাথে তার দারুণ সখ্যতা।
বাবা মা দেশের বাইরে থাকেন,
মাঝে মাঝে এসে দেখে যান অপুকে।
সিলেট শহরে মেজরটিলায় মস্ত বড়
একটা বাড়িতে সে একাই থাকে। তার
দেখা শুনার জন্য একজন বৃদ্ধ চাচা আছেন।
রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় সব
তিনিই সামলান আর আছে একজন
দারোয়ান। অপুর গুটি কয়েজন বন্ধু তবে
এদের মধ্যে রুমুর সাথে সবচেয়ে বেশি
কথা হয় ইদানীং। রুমু আবার জিজ্ঞেস
করলো,
" কিরে দেরী করলি কেনো? "
" কই দেরী করলাম!!, ক্যাম্পাসের
বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম "
" কেনো? বাইরে আমাদের কোন ক্লাস
আছে নাকি!!?!
রুমু হাসলো আর তার হাসির সাথে
যোগ দিলো রাজু আর মিনারের হাসি।
" কি করছিলি অপু বাইরে? হুম, স্পেশাল
কেউ নাকি? "
রাজু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অপুর দিকে, অপু
উত্তর দেয়ার আগেই " ট্রিট চাই ট্রিট
চাই " বলে লাফিয়ে উঠলো মিনার।
অপুকে আর বেশি পঁচানো গেলো না,
ম্যাথের স্যার ক্লাস রুমে ঢুকলেন। জনাব
আবুল হোসেন, এই কলেজে আছেন প্রায়
৭-৮ বছর। ভালোই পড়ান তবে চরিত্রে
কিছু ঝামেলা আছে। আসলে পঞ্চাশ
পেড়িয়ে যাওয়া পুরুষা চুকচুক প্রজাতির
হয়। ঘরে বুড়িয়ে যাওয়া স্ত্রীতে আর মন
ভেজে না, আশে পাশে এতো রঙ, এই
রংধনুতে মন আটকে যাওয়া খুব
অস্বাভাবিক কিছু নয় তাদের জন্য। স্যার
এই তালিকায় পড়েন, কিছুটা ছেছড়া
টাইপ। তাছাড়া ক্লাসের পড়া থেকে
তিনি প্রাইভেট পড়াতেই বেশি
ভালোবাসেন।
[ ৩ ]
যেদিন ইলেক্ট্রিসিটি থাকেনা
সেদিন যেনো সন্ধ্যেটা ঝুপ করে
নামে শহরটার বুকে। চারিদিকে খুব
গাঢ় একটা অন্ধকার ঝেঁকে বসে। রুমু তার
বিছানায় শুয়ে, মাথা ব্যথায় টনটন
করছে। স্যারের বলা আজকের কথা গুলো
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না
কিছুতেই কিন্তু কেউ যেনো মগজে সে
কথা গুলো প্রচন্ড শব্দ করে শুনাচ্ছে। মা
একবার ডেকে গেলেন, ঐ দিকে
ভ্রুক্ষেপ নেই রুমুর। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার,
বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু
কাউকে কিছু বলতে পারছেনা।
" কিরে ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস
কেনো"
ছোট মামা রুমুর ঘরের লাইট অন করে
দেখলেন সে বিছানায় শোয়া।
জিজ্ঞেস করলেন," কিরে, মাথার
ব্যথা কমেনি? "
ছোট মামার কন্ঠ শুনেই কেঁদে দিলো
সে। মামা পুরো অবাক, তিনি বললেন,"
আরে আমি আবার আসছিতো সামনের
সামারে, আর এবার আসার সময় তোর
জন্য একটা লাল টুকটুক মামী নিয়ে
আসবো। "
রুমু থামলো না, কেঁদেই চলেছে,
থামবার কোন লক্ষণ না দেখে ছোট
মামা তার রুম থেকে বেড়িয়ে
গেলেন পাছে উনার অশ্রু যদি রুমু দেখে
ফেলে। রুমুর পৃথিবী যেনো থমকে আছে
আজ সকাল থেকে।
মামা আবার রুমে এলেন, " কান্না শেষ
তোর? আমার ফ্লাইট ৮ টায়। চল
এয়ারপোর্টে।" রুমু গেলোনা,
বিছানায় পড়ে রইলো সে। আজ স্যার
তাকে শারিরীক কিছুর ইঙ্গিত
দিয়েছেন,যা বজ্রপাতের মতো
পড়েছে রুমুর উপর। রাতে অপুর ফোন,
-- তোকে স্যার কি বলছে??
- মানে!!
-- ন্যাকামি করবিনা।
- কিচ্ছুনা।
-- আমাকে জেরিন সব বলেছে।
- তবে জিজ্ঞেস করছিস কেনো।
-- তুই আর স্যারের বাসায় যাবি না
এটাই ফাইনাল।
রুমু কিছু বললো না, ঐ পাশে অপু প্রচন্ড
রাগ নিয়ে একটানা কথা বলে যাচ্ছে।
অপু নিরব প্রকৃতির তবে এই টাইপ মানুষ
ভীষন রাগী হয়ে থাকে। লাস্ট ৬ -৭
মাসে অপু সম্পর্কে এই ধারণাটা স্পষ্ট
হয়েছে রুমুর।
[ ৪ ]
- কি করিস বাবা
-- কিছুনা।
- চুলের এই অবস্থা কেনো তোর!!!
-- এমনেই।
- দুপুরে খাইছিস??
-- হুম
- আব্দুল ভাই কোথায়??
-- নিচে।
- তোর বাবার একটা ঝামেলা হয়ে
গেছে। এই মাসের আসার কথা ছিলো
আমাদের কিন্তু হয়তো আসা হবে না।
-- এ আর নতুন কি??
- রাগ করিসনা বাবা
অপু স্কাইপের লাইন ডিসকানেক্ট করে
দিলো। ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার। তাকে
কেউই বুঝতে চায় না। তার অনুভূতির
কোন দাম নেই কারো কাছে।
গিটারটা হাতে নেয় সে, এপিটাফ
গানের সুরটা মন খারাপ থাকলে বড্ড
শান্তি দেয়। একটু পর আবার ফোন বেজে
উঠে, না তার মা নয় রুমুর ফোন। বেশ
কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরে সে
- কিরে কই ছিলি, ব্যস্ত নাকি??
-- বেলকনিতে ছিলাম, বল কি?
- কাল স্যারের বাসা আছে, স্যার ফোন
দিয়েছিলেন। পরশু স্যার সিলেটের
বাইরে যাবেন তাই।
-- এর পরেও তুই স্যারের ফোন রিসিভ
করেছিস কেনো?
ফোনের ঐ পাশ নিশ্চুপ আর এই পাশে
ক্রোধ।
-- তোর বুঝা উচিত রুমু, ঐ বেটা মানুষ নয়।
আল্লা না করুক যদি কোন দিন তোর
কোন ক্ষতি করে??
রুমু নির্বাক, সে যে কাঁদছে সেটা স্পষ্ট
হয়ে ধরা দিচ্ছে অপুর কানে। রুমু স্যার
সম্পর্কে আরো অনেক কিছু বলতে চায়
অপুকে কিন্তু পারেনা। কথা গুলো সুঁই
হয়ে বিঁধে হৃদয়ে কিন্তু মুখে আসেনা।
[ ৫ ]
" অংকগুলো বুঝছো তো?? " স্যারের
কথাটা এড়িয়ে যায় রুমু। শুনেও না শুনার
ভান করে সে। স্যার আবার জিজ্ঞেস
করেন,"রুমু অংক গুলো বুঝতে পারছো? "
" জ্বী স্যার "
" বাসায় যখন নিজে নিজে করবে তখন
না বুঝলে আমাকে ফোন দিও, কেমন। "
উত্তরে কিছু বলেনা,মাটির দিকে
তাকিয়ে থাকে সে। আর অপু স্যারের
দিকে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে তাকায়।
স্যার প্রায় রুমুকে ফোন দেন। এটা শুধু অপু
জানে, রুমু আর কাউকে বলেনি। স্যার
উনার নিজের পারিবারিক ঝামেলা
গুলো শেয়ার করতে চান রুমুর সাথে।
প্রথম প্রথম স্যারের কথা গুলো গুরত্ব
দিলেও এখন স্যারের ফোন খুব কম ধরে।
স্যারের ইনটেনশন অন্য কিছু তা স্পষ্ট রুমুর
কাছে। তার পরেও স্যার নানা ভাবে
তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। রুমু
এড়িয়ে যায় কিন্তু স্যার ক্লাস রুমেও
বিভিন্ন কথা বলেন। প্রাইভেট শেষে
বেড়িয়ে পড়ে অপু, নিঃশব্দে হেটে
চলে সে, রুমু তাকে ডাক দিয়ে
দাড়াতে বলে। একটু পর রুমুর বন্ধুরা সবাই
একা সাথে জড়ো হয়।
" তোমাদের সবার সাথে আমি একটা
কথা শেয়ার করতে চাই।"
সবাই উৎসুক হয়ে তাকায় রুমুর দিকে।
সবার চোখে মুখে ভীষন আগ্রহ।
" কি হয়েছে রুমু ?"
মিনার প্রশ্ন করার সাথে সাথেই রুমু
কেঁদে উঠে। সবাই আশ্চর্য হয়ে যায় শুধু
অবাক হয়না অপু কারন সে জানে
সবকিছু। দিন দিন স্যারের এই প্যারা
বাড়তে লাগলো। রুমু প্রাইভেট ছেড়ে
দিলো কিন্তু এখন স্যার ক্লাসরুমেও
রুমুকে নানা ভাবে নানা কথা বলেন।
[ ৬ ]
মাস দুই-এক পর,
সবাই কেবিন থেকে এক এক করে
বেড়িয়ে এলো শুধু বসে থাকলো অপু,
সে একটু পরে যাবে।
"এই পাগলামোটা কেনো করলি রুমু?"
রুমু কিছু বলেনা, ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে আছে। গতকাল রাতে তাকে
ইবনেসীনায় ভর্তি করানো হয়েছে আর
এর কারন হলো অনেকগুলো স্লিপিং
পিল।
"কয়টা খেয়েছিলি "
" ১০ টা "
" পুরো এক পাতা!! "
রুমু কিছু বলেনা,
" মরলিনা কেনো? মরে যাওয়া উচিত
ছিলো তোর "
" স্যার উনার বাসায় যেতে বলেছেন "
কথাটা অপু ঠিক বুঝলো না, সে আবার
জিজ্ঞেস করলো,
" কি বলেছেন? "
" বলেছেন উনার স্ত্রী বাসায় নেই।
আমাকে যাওয়ার জন্য। একটা শাড়ী
পড়ে যেতে।"
কথাটা বজ্রপাতের মতো পড়লো অপুর
উপর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট
হচ্ছে তার। তার পর বেশ কিছু সময়
নিরবতা।
" কোন দিন যাওয়ার কথা বলেছেন "
" আগামী কাল "
অপু আর কিছু বলেনা, খুব নিঃশব্দে
বেড়িয়ে আসে কেবিন থেকে।
পরের দিন,
রাত ৮ টার দিকে অপুকে দেখে স্যার
অবাক হয়ে বললেন, " কি ব্যাপার অপু,
তুমি এই সময়ে?"
" গত পরশুর একটা ম্যাথমেটিকাল প্রবলেম
ছিলো, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম,
ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে
যাই। "
" কাল সকালে পড়া, কাল আসলে
পাড়তে। আচ্ছা কিসে প্রবলেম বের
করো আমি আসছি "
" ম্যাডাম কোথায় স্যার "
" মেয়েটাকে নিয়ে তার এক আপার
বাসাত গেছে ও। আজ সেখানেই
থাকবে। তুমি প্রবলেমটা বের করো,
আমাকে আবার বেরুতে হবে।"
শোলডার ব্যাগের ভিতর আনা খুব প্রিয়
নাইফটা আরেকবার চেক করে নিলো
সে। তারপর খুব নিঃশব্দে কয়েকটা
স্টেপ, স্যারের পিছে পিছে সে
পৌছালো উনার বেড রুমে।
বরাবর বুকের বা পাশেই বসিয়েছে
ছুরিটা। একটু পর পর কেঁপে উঠছে একটা
মানুষরুপী জানোয়ারের শরীর। এখনো
বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা মেঝেতে পড়ে
থাকা লোকটার।
এই টাইপ মানুষ ও মানসীকতার ঘৃণিত
পশুকে দ্বিতীয় কোন চান্স দিতে নেই।
সরাসরি খুন করে ফেলতে হয়। এতো দিন
যাকে শুধু দেখলে খুন করতে ইচ্ছে করতো
আজ অবশেষে সেটাই হলো। সব কাজ
শেষ আপাদত খুব সাবধানে এই বাসা
বেড়িয়ে যেতে হবে। অপু নাইফটা
বাথরুমের বেসিনের পানিতে ধুয়ে
ব্যাগে পুরে নেয় তার পর খুব
স্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে আসে
সে।
হাইয়ার ম্যাথের অংক নিয়ে সেই
বিকেল থেকে ভীষন প্যারায় আছে রুমু,
কিছুতেই হোমওয়ার্ক গুলো সলভ করতে
পারছেনা। এই কার্টেশীয়
স্থানাংকের অংক গুলো কেনো
জানি রুমুর মাথায় ঢুকে না অথছ তার
বন্ধুরা ফরফর করে স্যারকে অংক গুলো
করে দেয়।
" হিউম্যান বিকাম এ গ্রেট স্যাডিস্ট
ওয়েন হি ফিল জেলাস উইথ হিজ ক্লোজ
পারসন " কথাটার সত্যতা রুমু জানে তবুও
সে হিংসে করে আর তার হিংসে অপুর
উপর। এর সুস্পষ্ট কারণ আছে, একটা মানুষ
ম্যাথম্যাটিক্সে এত ভালো হয় কি করে
সেটা রুমুর মাথায় ঢুকে না। অবশ্য এই
হিংসেটা অপুর সামনেই করে সে, অপু
তখন ভ্যাবলার মতো শুধু হাসে। রুমুর
অংকের ভাবনায় ছেদ পড়ে তার ফোন
কলে, স্ক্রীণে নামটা দেখেই গা শির
শির করে উঠে রুমুর। বেশ কয়েকবার রিং
হয় কিন্তু সে ফোন ধরে না আসলে
ধরতে সাহস পায় না। পড়ার টেবিল
থেকে উঠে বেলকনিতে যায় রুমু, চোখ
বুলায় চার পাশে, উঠনের কোনে
গন্ধরাজ ফুলের গাছটা দাড়িয়ে। এখন
অবশ্য ফুলে নেই তবে ফুলের সময়ে এর
গন্ধে সারাটা বাড়ি মৌ মৌ করে।
আকাশে পাংশু মেঘের আনাগোনা।
ইদানীং শেষ রাত্রে বৃষ্টি হয়, আর এ
জন্য প্রতিদিন সকালে মন খারাপ হয়ে
যায় রুমুর। জানালা খুলে ঘুমানোটা
অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তার কিন্তু যে
কারণে ইদানীং জানালা খুলে
ঘুমানো সেই বৃষ্টি এলে কেনো জানি
মরার ঘুম ভাঙ্গতে চায় না।
" কিরে এই সন্ধ্যে বেলায় বেলকনিতে
কি করিছ?"
মায়ের ডাকে ঘুমের সাথে
অভিমানের ছেদ পরে তার।
" কিছু না মা, এমনেই দাড়িয়ে আছি "
" তোর ছোট মামা এসে গেছে "
হঠাৎ করেই মনটা প্রচন্ড ভালো হয়ে
যায় রুমুর। তার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে
সুখি মানুষ হচ্ছেন ছোট মামা। এটা রুমুর
শুধু বিশ্বাস নয় পরীক্ষালব্ধ ফল। কয়েক
সপ্তাহের জন্য ছুটিতে দেশে এসেছেন
তিনি, থাকেন আমেরিকায়। সে এক
দৌড়ে নিচে ড্রয়িংরুমে আসে।
" কিরে কই ছিলি তুই? "
" আমার রুমেইতো "
" কতো দিন পর!!! তাই না? "
" মামা তুমি, মোটা হয়ে গেছো "
" আর তুই শুটকি"
বলেই মামা হাসলেন, সেই প্রানবন্ত
হাসি। উনি আবার প্রশ্ন করলেন,
" কলেজে যাওয়া হয় ঠিক মতো "
" হ্যাঁ মামা, এখন জেরা বন্ধ করো।
ভালো আছো তুমি?"
" আমি খারাপ থাকি নাকি!!"
" এবারো একা আসছো "
" না না, একটা টেডি বিয়ার সাথে
আছে। তোর জন্য "
" চলো, তোমার রুম দেখিয়ে দেই।
জানো ছোট মামা, আমি নিজের
হাতে গুছিয়েছি রুমটা।"
" তাই!!! আপা কই গেলি, আমার
আম্মাজান দেখি সত্যি সত্যি বড় হয়ে
গেছেরে "
তারা দুজন রুমের দিকে হাটতে
লাগলেন।
[ ২ ]
" কিরে ভ্যাবলা, আজ দেরী করলি যে "
রুমুর কথায় উত্তর দিলোনা অপু শুধু একটু
হাসলো। অবশ্য অপু ছেলেটা এমনি
ক্লাসে খুব একটা কথা বলেনা কারো
সাথেই। এর ফলে সবার কাছে তার
কারেক্টারটা একটা একগুয়ে টাইপ
ছেলে। ক্লাসের পিছনে বসতে
ভালোবাসে ও। সবার থেকে আলাদা
থাকতেই যেনো সর্ব সুখ তার।
পড়ালেখা শেষে যতটুকু সময় পায়,
পুরোটাই ঢেলে দেয় গিটারের তারে।
এর তার গুলোর সাথে তার দারুণ সখ্যতা।
বাবা মা দেশের বাইরে থাকেন,
মাঝে মাঝে এসে দেখে যান অপুকে।
সিলেট শহরে মেজরটিলায় মস্ত বড়
একটা বাড়িতে সে একাই থাকে। তার
দেখা শুনার জন্য একজন বৃদ্ধ চাচা আছেন।
রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় সব
তিনিই সামলান আর আছে একজন
দারোয়ান। অপুর গুটি কয়েজন বন্ধু তবে
এদের মধ্যে রুমুর সাথে সবচেয়ে বেশি
কথা হয় ইদানীং। রুমু আবার জিজ্ঞেস
করলো,
" কিরে দেরী করলি কেনো? "
" কই দেরী করলাম!!, ক্যাম্পাসের
বাইরে দাড়িয়ে ছিলাম "
" কেনো? বাইরে আমাদের কোন ক্লাস
আছে নাকি!!?!
রুমু হাসলো আর তার হাসির সাথে
যোগ দিলো রাজু আর মিনারের হাসি।
" কি করছিলি অপু বাইরে? হুম, স্পেশাল
কেউ নাকি? "
রাজু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো অপুর দিকে, অপু
উত্তর দেয়ার আগেই " ট্রিট চাই ট্রিট
চাই " বলে লাফিয়ে উঠলো মিনার।
অপুকে আর বেশি পঁচানো গেলো না,
ম্যাথের স্যার ক্লাস রুমে ঢুকলেন। জনাব
আবুল হোসেন, এই কলেজে আছেন প্রায়
৭-৮ বছর। ভালোই পড়ান তবে চরিত্রে
কিছু ঝামেলা আছে। আসলে পঞ্চাশ
পেড়িয়ে যাওয়া পুরুষা চুকচুক প্রজাতির
হয়। ঘরে বুড়িয়ে যাওয়া স্ত্রীতে আর মন
ভেজে না, আশে পাশে এতো রঙ, এই
রংধনুতে মন আটকে যাওয়া খুব
অস্বাভাবিক কিছু নয় তাদের জন্য। স্যার
এই তালিকায় পড়েন, কিছুটা ছেছড়া
টাইপ। তাছাড়া ক্লাসের পড়া থেকে
তিনি প্রাইভেট পড়াতেই বেশি
ভালোবাসেন।
[ ৩ ]
যেদিন ইলেক্ট্রিসিটি থাকেনা
সেদিন যেনো সন্ধ্যেটা ঝুপ করে
নামে শহরটার বুকে। চারিদিকে খুব
গাঢ় একটা অন্ধকার ঝেঁকে বসে। রুমু তার
বিছানায় শুয়ে, মাথা ব্যথায় টনটন
করছে। স্যারের বলা আজকের কথা গুলো
বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না
কিছুতেই কিন্তু কেউ যেনো মগজে সে
কথা গুলো প্রচন্ড শব্দ করে শুনাচ্ছে। মা
একবার ডেকে গেলেন, ঐ দিকে
ভ্রুক্ষেপ নেই রুমুর। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার,
বুক ফেটে কান্না আসছে কিন্তু
কাউকে কিছু বলতে পারছেনা।
" কিরে ঘর অন্ধকার করে রেখেছিস
কেনো"
ছোট মামা রুমুর ঘরের লাইট অন করে
দেখলেন সে বিছানায় শোয়া।
জিজ্ঞেস করলেন," কিরে, মাথার
ব্যথা কমেনি? "
ছোট মামার কন্ঠ শুনেই কেঁদে দিলো
সে। মামা পুরো অবাক, তিনি বললেন,"
আরে আমি আবার আসছিতো সামনের
সামারে, আর এবার আসার সময় তোর
জন্য একটা লাল টুকটুক মামী নিয়ে
আসবো। "
রুমু থামলো না, কেঁদেই চলেছে,
থামবার কোন লক্ষণ না দেখে ছোট
মামা তার রুম থেকে বেড়িয়ে
গেলেন পাছে উনার অশ্রু যদি রুমু দেখে
ফেলে। রুমুর পৃথিবী যেনো থমকে আছে
আজ সকাল থেকে।
মামা আবার রুমে এলেন, " কান্না শেষ
তোর? আমার ফ্লাইট ৮ টায়। চল
এয়ারপোর্টে।" রুমু গেলোনা,
বিছানায় পড়ে রইলো সে। আজ স্যার
তাকে শারিরীক কিছুর ইঙ্গিত
দিয়েছেন,যা বজ্রপাতের মতো
পড়েছে রুমুর উপর। রাতে অপুর ফোন,
-- তোকে স্যার কি বলছে??
- মানে!!
-- ন্যাকামি করবিনা।
- কিচ্ছুনা।
-- আমাকে জেরিন সব বলেছে।
- তবে জিজ্ঞেস করছিস কেনো।
-- তুই আর স্যারের বাসায় যাবি না
এটাই ফাইনাল।
রুমু কিছু বললো না, ঐ পাশে অপু প্রচন্ড
রাগ নিয়ে একটানা কথা বলে যাচ্ছে।
অপু নিরব প্রকৃতির তবে এই টাইপ মানুষ
ভীষন রাগী হয়ে থাকে। লাস্ট ৬ -৭
মাসে অপু সম্পর্কে এই ধারণাটা স্পষ্ট
হয়েছে রুমুর।
[ ৪ ]
- কি করিস বাবা
-- কিছুনা।
- চুলের এই অবস্থা কেনো তোর!!!
-- এমনেই।
- দুপুরে খাইছিস??
-- হুম
- আব্দুল ভাই কোথায়??
-- নিচে।
- তোর বাবার একটা ঝামেলা হয়ে
গেছে। এই মাসের আসার কথা ছিলো
আমাদের কিন্তু হয়তো আসা হবে না।
-- এ আর নতুন কি??
- রাগ করিসনা বাবা
অপু স্কাইপের লাইন ডিসকানেক্ট করে
দিলো। ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার। তাকে
কেউই বুঝতে চায় না। তার অনুভূতির
কোন দাম নেই কারো কাছে।
গিটারটা হাতে নেয় সে, এপিটাফ
গানের সুরটা মন খারাপ থাকলে বড্ড
শান্তি দেয়। একটু পর আবার ফোন বেজে
উঠে, না তার মা নয় রুমুর ফোন। বেশ
কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরে সে
- কিরে কই ছিলি, ব্যস্ত নাকি??
-- বেলকনিতে ছিলাম, বল কি?
- কাল স্যারের বাসা আছে, স্যার ফোন
দিয়েছিলেন। পরশু স্যার সিলেটের
বাইরে যাবেন তাই।
-- এর পরেও তুই স্যারের ফোন রিসিভ
করেছিস কেনো?
ফোনের ঐ পাশ নিশ্চুপ আর এই পাশে
ক্রোধ।
-- তোর বুঝা উচিত রুমু, ঐ বেটা মানুষ নয়।
আল্লা না করুক যদি কোন দিন তোর
কোন ক্ষতি করে??
রুমু নির্বাক, সে যে কাঁদছে সেটা স্পষ্ট
হয়ে ধরা দিচ্ছে অপুর কানে। রুমু স্যার
সম্পর্কে আরো অনেক কিছু বলতে চায়
অপুকে কিন্তু পারেনা। কথা গুলো সুঁই
হয়ে বিঁধে হৃদয়ে কিন্তু মুখে আসেনা।
[ ৫ ]
" অংকগুলো বুঝছো তো?? " স্যারের
কথাটা এড়িয়ে যায় রুমু। শুনেও না শুনার
ভান করে সে। স্যার আবার জিজ্ঞেস
করেন,"রুমু অংক গুলো বুঝতে পারছো? "
" জ্বী স্যার "
" বাসায় যখন নিজে নিজে করবে তখন
না বুঝলে আমাকে ফোন দিও, কেমন। "
উত্তরে কিছু বলেনা,মাটির দিকে
তাকিয়ে থাকে সে। আর অপু স্যারের
দিকে প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে তাকায়।
স্যার প্রায় রুমুকে ফোন দেন। এটা শুধু অপু
জানে, রুমু আর কাউকে বলেনি। স্যার
উনার নিজের পারিবারিক ঝামেলা
গুলো শেয়ার করতে চান রুমুর সাথে।
প্রথম প্রথম স্যারের কথা গুলো গুরত্ব
দিলেও এখন স্যারের ফোন খুব কম ধরে।
স্যারের ইনটেনশন অন্য কিছু তা স্পষ্ট রুমুর
কাছে। তার পরেও স্যার নানা ভাবে
তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। রুমু
এড়িয়ে যায় কিন্তু স্যার ক্লাস রুমেও
বিভিন্ন কথা বলেন। প্রাইভেট শেষে
বেড়িয়ে পড়ে অপু, নিঃশব্দে হেটে
চলে সে, রুমু তাকে ডাক দিয়ে
দাড়াতে বলে। একটু পর রুমুর বন্ধুরা সবাই
একা সাথে জড়ো হয়।
" তোমাদের সবার সাথে আমি একটা
কথা শেয়ার করতে চাই।"
সবাই উৎসুক হয়ে তাকায় রুমুর দিকে।
সবার চোখে মুখে ভীষন আগ্রহ।
" কি হয়েছে রুমু ?"
মিনার প্রশ্ন করার সাথে সাথেই রুমু
কেঁদে উঠে। সবাই আশ্চর্য হয়ে যায় শুধু
অবাক হয়না অপু কারন সে জানে
সবকিছু। দিন দিন স্যারের এই প্যারা
বাড়তে লাগলো। রুমু প্রাইভেট ছেড়ে
দিলো কিন্তু এখন স্যার ক্লাসরুমেও
রুমুকে নানা ভাবে নানা কথা বলেন।
[ ৬ ]
মাস দুই-এক পর,
সবাই কেবিন থেকে এক এক করে
বেড়িয়ে এলো শুধু বসে থাকলো অপু,
সে একটু পরে যাবে।
"এই পাগলামোটা কেনো করলি রুমু?"
রুমু কিছু বলেনা, ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়ে আছে। গতকাল রাতে তাকে
ইবনেসীনায় ভর্তি করানো হয়েছে আর
এর কারন হলো অনেকগুলো স্লিপিং
পিল।
"কয়টা খেয়েছিলি "
" ১০ টা "
" পুরো এক পাতা!! "
রুমু কিছু বলেনা,
" মরলিনা কেনো? মরে যাওয়া উচিত
ছিলো তোর "
" স্যার উনার বাসায় যেতে বলেছেন "
কথাটা অপু ঠিক বুঝলো না, সে আবার
জিজ্ঞেস করলো,
" কি বলেছেন? "
" বলেছেন উনার স্ত্রী বাসায় নেই।
আমাকে যাওয়ার জন্য। একটা শাড়ী
পড়ে যেতে।"
কথাটা বজ্রপাতের মতো পড়লো অপুর
উপর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট
হচ্ছে তার। তার পর বেশ কিছু সময়
নিরবতা।
" কোন দিন যাওয়ার কথা বলেছেন "
" আগামী কাল "
অপু আর কিছু বলেনা, খুব নিঃশব্দে
বেড়িয়ে আসে কেবিন থেকে।
পরের দিন,
রাত ৮ টার দিকে অপুকে দেখে স্যার
অবাক হয়ে বললেন, " কি ব্যাপার অপু,
তুমি এই সময়ে?"
" গত পরশুর একটা ম্যাথমেটিকাল প্রবলেম
ছিলো, এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম,
ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে
যাই। "
" কাল সকালে পড়া, কাল আসলে
পাড়তে। আচ্ছা কিসে প্রবলেম বের
করো আমি আসছি "
" ম্যাডাম কোথায় স্যার "
" মেয়েটাকে নিয়ে তার এক আপার
বাসাত গেছে ও। আজ সেখানেই
থাকবে। তুমি প্রবলেমটা বের করো,
আমাকে আবার বেরুতে হবে।"
শোলডার ব্যাগের ভিতর আনা খুব প্রিয়
নাইফটা আরেকবার চেক করে নিলো
সে। তারপর খুব নিঃশব্দে কয়েকটা
স্টেপ, স্যারের পিছে পিছে সে
পৌছালো উনার বেড রুমে।
বরাবর বুকের বা পাশেই বসিয়েছে
ছুরিটা। একটু পর পর কেঁপে উঠছে একটা
মানুষরুপী জানোয়ারের শরীর। এখনো
বাঁচার প্রাণপণ চেষ্টা মেঝেতে পড়ে
থাকা লোকটার।
এই টাইপ মানুষ ও মানসীকতার ঘৃণিত
পশুকে দ্বিতীয় কোন চান্স দিতে নেই।
সরাসরি খুন করে ফেলতে হয়। এতো দিন
যাকে শুধু দেখলে খুন করতে ইচ্ছে করতো
আজ অবশেষে সেটাই হলো। সব কাজ
শেষ আপাদত খুব সাবধানে এই বাসা
বেড়িয়ে যেতে হবে। অপু নাইফটা
বাথরুমের বেসিনের পানিতে ধুয়ে
ব্যাগে পুরে নেয় তার পর খুব
স্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে আসে
সে।