একটি অভিশাপ । (একটু ধৈর্য
ধরে পড়ুন আশা করি ভাল
লাগবে)
.
[১]
হ্যাপিহোম নামের
বৃদ্ধাশ্রমটি শহর থেকে একটু
দুরে । এই বৃদ্ধাশ্রমেরই
একটি ঘরে থাকেন রহিমা বেগম,
চৌধুরী সাহেবের মা ।
বেশ কিছুদিন যাবত অসুস্থ ।
আজ হঠাৎ একটু বেশি অসুস্থ
হয়ে পড়েছেন ।
আদরের একমাত্র মানিক কে
দেখতে খুব ইচ্ছে করছে ওনার ।
পরিচালিকাকে বললেন
ছেলের কাছে ফোন করতে....
.
(ক্রিং...ক্রিং....) ফোনের
আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল
রবি চৌধুরীর । ফোন হাতে
নিয়ে
-হ্যালো রবি চৌধুরী
স্পিকিং...
.
অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন
মহিলা কন্ঠের আওয়াজ ভেসে
আসল।
-হ্যা.. হ্যালো স্যার ।
হ্যাপি হোম থেকে বলছি । আজ
একবার এখানে আসতে হবে ।
গৃন্নি মায়ের অসুস্থতা
বেড়ে গেছে ।"
.
মহিলাটি "হ্যাপিহোম"
বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালিকা ।
রবি চৌধুরীর অনুদানেই গড়ে
উঠেছে এই বৃদ্ধাশ্রমটি ।
অবহেলিত বৃদ্ধদের প্রতি
গভীর ভালবাসার স্বরূপে
তিনি বৃদ্ধাশ্রমটি
প্রতিষ্ঠিত করেন ।
ওনার ৫০ উর্ধ্ব বৃদ্ধা
মাকেও রেখেছেন এই
বৃদ্ধাশ্রমে ।
"মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে
খুবই বিরক্ত হলেন চৌধুরী
সাহেব।
-(ধমকের সুরে) আমি কি
ডাক্তার যে আমাকে বলছো?
ভাল কোন ডাক্তার ডেকে
চিকিৎসা করে নাও । আমার
সেক্রেটারির হাতে টাকার
চেক পাঠিয়ে দিব ।
অপর পাশের মহিলাটি কিছু
বলতে চেয়েও চুপ হয়ে গেলেন ।
-জ্বি আচ্ছা । বলেই ফোন
কেটে দিলেন.....!
.
[২]
রবি চৌধুরী শহরের নামকরা
ধনীদের মধ্যে একজন । রাস্তার
পাশের বিশাল এই
অট্টলিকাটি সবারই নজর কাড়ে
। সুবিশাল এই বাড়িটির
সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধকরে ।
সুন্দর এই অট্টলিকাটি রবি
চৌধুরীর বাসা । বাসার
ভিতরের কারুকাজও চোখ
ধাঁধিয়ে দেয় । স্ত্রী
পূত্র ও দুই কণ্যা সন্তান কে
নিয়ে চৌধুরী সাহেবের
সুখী পরিবার ।
>> ক্রিং ক্রিং... আবারো
বেজে উঠল ফোনটি । রাগের
মাথায় কলটি রিসিভ করলেন,
অপর পাশ থেকে
-স্যার একটি সুখবর । আমাদের
ডিলটা একসেপ্ট হয়েছে ।
কামাল সাহেব আজকে মিটিং
অ্যারেন্জ করতে বলছেন । এখন
শুধু আপনার অনুমতির
প্রয়োজন ।
রবি চৌধুরীর ঠোটের কোনায়
হাসির ছাপ । আনেক টাকা আয়
হবে এই ডিলটিতে ।
.
-হ্যা আজই মিটিং ফিক্সড
করো । আমি একটু পরেই অফিসে
আসছি ।
বাড়ির কাজের মেয়েটি চা
দিয় গেল । দ্রুত ব্রেকফাষ্ট
সেরে রেডি হয়ে নিজের
গাড়িতেই রওনা দিলেন
আফিসে ।
.
[৩]
গভীর আগ্রহে দরজার দিকে
তাকিয়ে আছে রহিমা বেগম ।
পরিচালিকা ঘরে প্রবেশ
করলে জানতে চাইলেন
-খোকা কখন আসবে?? (বুকের
মানিককে একটি পলক দেখার
জন্য মনটা তার আজ খুব বেশি
ছটফট করছে) ।
পরিচারিকাকে চুপ থাকতে
দেখে বুঝলেন যে ওনার ছেলে
আজও আসবেনা । উদাস মনে
জানালা দিয়ে বাইরে
তাকালেন । আকাশে মেঘ,
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ।
আকাশের বৃষ্টি সবারই নজরে
আসে সহজেই কিন্তু ওনার
মনের আকাশে যে মেঘের
ঘনাঘটা তা হয়তো উপর ওয়ালা
ছাড়া আর কেউ দেখতে
পাচ্ছেনা ।
ব্যাথিত মনে স্মৃতির পাতে
গুলো উল্টাতে লাগলেন
রহিমা বেগম ।
.
"খুব অল্প বয়সে রহিমা বেগমের
বিয়ে হয়েছিল এক স্কুল
শিক্ষকের সাথে । স্বামীর
আর্থিক অবস্থা ভাল না হলেও
মানুষটি ছিল খুবভাল। কথায়
বলে অভাগা যেদিকে চায়
সাগরও নাকি শুকিয়ে যায় । ১
বছরের সন্তান কে রেখে
স্বামী মারা যান ।
বিধবা হন রহিমা বেগম ।
স্বামীর শোকে প্রায় পাগল
হয়ে যান তিনি । বুকের
মানিককে স্বামীর স্মৃতি
হিসেবে নিয়ে বেঁচে
থাকেন তিনি । নিজের রূপ,
যৌবনকে বিসর্জন দেন রবির
কথা ভেবে । নিজের হাতে
তুলেনেন পরিবারের
দায়িত্ব ।নিজের সুখ আহলাদ
কে বিসর্জন দিয়ে, বাড়ি
বাড়ি কাজ করে লালন-পালন
করতে থাকে তার সোনা
মানিককে ।
দিনের পর দিন অত্যাচার,
অপবাদ, লালসার শিকার হয়েও
সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেন
তিনি । চাইলেই তখন বিয়ে করে
নিজের সুখের সংসার
সাজাতে পারতেন কিন্তু
বুকের মানিকের কথা ভেবে
নিজের সুখকে বিসর্জন
দিয়েছেন ।সময় বদলে গেছে,
ভাগ্যও বদলে গেছে । রবি আর
আগের সেই ছোট্ট রবি সোনা
নেই । এখন রবি চৌধুরি হয়েছেন
। স্বামী ওনাকে ছেড়ে
গেছেন সেই কবে ।
একমাত্র বুকের মানিক রবি
চৌধুরিও তাকে রেখে
গেছেন বৃদ্ধাশ্রমে । সবাই এই
অভাগীকে ছেড়ে চলে গেলেও
দুঃখ কষ্ট আজও পিছু
ছাড়েনি তার ।
অতীতের দিনগুলির কথা
ভাবতেই চোখ বেয়ে নেমে
এলো অশ্রু ধারা । বৃষ্টি
থেমে গেছে । হয়তো এই
অভাগীর চোখের জল দেখে
বৃষ্টিও লজ্জা পেয়ে
পালিয়ে গেছে.. ।
.
মূমূর্ষ অবস্থায় বিছানাতে
শুয়ে আছে রহিমা বেগম ।
বেলা যত বাড়তে লাগলো
রহিমা বেগমের অসুস্থতাও
বাড়তে থাকলো ।
ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়ে
বললেন: -আল্লাহই শেষ ভরসা ।
পরিচালিকা ভাবগতিক বুঝে
গেলেন । রবি চৌধরীকে
ফোনে সবকিছুই খুলে বলিলেন
। শুনিয়া রবি চৌধুরী বললেন:
-জরুরি মিটিং চলছে । এখন
আসতে পারবেননা । মিটিং
শেষ করে এসে দেখে যাবেন ।
পরিচালিকা কানের কাছে
মুখ এনে বলে গেলেন চৌধুরি
সাহেবকে আনার জন্য লোক
পাঠানো হয়েছে ।
রহিমা বেগম কিছুই বললেননা
শুধু গভীর আগ্রহে দরজার
দিকে ফ্যালফ্যাল করে
তাকিয়া রইলেন । সময়ের
সাপেক্ষে মৃত্যুর সঙ্গে
পাল্লা দিয়ে চলছেন তিনি।
কে যেন "মা" "মা" বলে ডাকলো
তাকে ।
-তুই এসেছিস খোকা, আয় আমার
বুকে আয় সোনা" দরজার দিকে
মুখ ফিরালেন তিনি। কিন্তু
কোথায় তার খোকা?
তবে কি তিনি ভূল শুনেছেন?
চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়ে
পড়ছে ওনার ।
তারপর কয়েকবার ক্ষীণ কন্ঠে
খোকা, খোকা বলে ডেকে
চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লো
রহিমা বেগম ।
রহিমা বেগমের মৃত্যুর প্রায়
আধা ঘন্টা পরে ঘরে প্রবেশ
করলো চৌধুরী সাহেব । একটু
দেরি করে ফেলেছেন তিনি....
.
[৪]
১৫ বছর পরে.......
"মৃত্যুর আগে মায়ের মুখটি
দেখার ভাগ্যও হয়নি চৌধুরী
সাহেবের । অর্থ নামের
আলেয়ার আলোর পিছনেই
ছুটেছেন সারাটি জীবন ।
হ্যাপি হোমের ঐ ঘরে বসেই
আজ মায়ের মৃত্যুর সেই
দিনটির কথা ভাবছেন বৃদ্ধ
রবি চৌধুরী ...আজ তিনিও এই
বৃদ্ধাশ্রমেরই বাসিন্দা....
॥
॥
লেখা: রক্ত ভিখারী