১।
বান্দরবান পাকুরপারা পাহাড় এলাকা।
তারমাঝ দিয়ে বয়ে চলছে একটা প্রশস্ত
কিন্তু শান্ত স্রোতধারা। পাহাড়ের বুক
চিড়ে একেবেকে নেমে যাচ্ছে
নিচের দিকে। তার আসম্ভব সুন্দর স্বচ্ছ
জলগুলো যেন দিনের সমস্ত আলোকে
প্রতিফলিত করে দেবে তার বুক থেকে।
কিছু কিছু যায়গায় নিচের চকচকে বালি
চকমকি পাথরের মত আলোর ঝলকানি
দিচ্ছে। খুব কাছ থেকে একটু দাড়িয়ে
লক্ষ্য করলে কিছু সামুদ্রিক ছোট মাছকে
খেলা করতে দেখা যায়। চারপাশে
অসংখ্য গাছপালায় ঘেরা। হাজারো
রকম পাখির ডাকে পুরো এলাকা মুখরিত,
মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতির সন্তানেরা
প্রকৃতিকে জাগিয়ে রাখছে এভাবে।
মাঝে মাঝে দেখা মেলে কিছু বন্য
প্রানির। প্রকৃতি এখানে তার রুপ
প্রকাশে কার্পন্য করেনি একেবারেই,
বরং একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছে। এমন
সৌন্দর্যকে দেখতে দেখতে এগিয়ে
চলছে দুজন। পরষ্পরের হাত ধরে, পরম
নির্ভরতায় আর অনাবিল মানষিক
প্রশান্তিতে। মাঝে মাঝে গাছের
ফাঁক থেকে বেড়িয়ে আসা বানর মুখ
খিচিয়ে যাচ্ছে এই দুই অনাকাঙ্খিত
অনুপ্রবেশকারিকে। কিন্তু সেদিকে
খেয়াল নেই দুজনের কারুরই। আমরা
এগিয়ে চলছি আমাদের লক্ষে। আর মন
ভড়িয়ে নিচ্ছি চারপাশ থেকে।
আমি আর প্রিমা। আমরাই সেই দুজন
পথযাত্রি। উদ্দেশ্য- এই সুন্দর নদির জন্মদাতৃ
অসম্ভব সুন্দর “ঝরণা”। ইচ্ছা- ঝরণার সাথে
সাথে নিজেদের জীবন আর প্রকৃতির
অপার সৌন্দর্যকে খুব কাছ থেকে
দেখার, উপভোগ করার। নিজেদের মধ্যে
ভাগাভাগি করে নেয়া অনেক “স্বপ্ন”
গুলোর মাঝে একটাকে পূর্ণতা দেয়ার।
যে স্বপ্নের বীজ বপন হয়ে গেছিলো
দুজনের মনে অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে।
২।
দুজনের পরিচয় ঠিক গল্প করার মত, অনেক
ফিকশান রাইটারের রসদ যোগাতে
পারবে সে গল্প।
ফেসবুকের দুই নিয়মিত সার্ফার ছিলাম
আমরা। সেখানেই প্রথম পরিচয়। দুই
নিঃসঙ্গ মানুষের পছন্দ অপছন্দ আর চিন্তা
ভাবনার স্টাইল অনেকটাই মিলে যায়।
সেই থেকে নিজেদের স্বপ্নের আদান
প্রদান শুরু হয়ে আর থেমে থাকেনি
কখনও। সে স্বপ্নগুলোতে একটার পর একটা
রঙ্গিন পালক যুক্ত হয়েছে শুধু। একজন একটা
স্বপ্নের কথা বললে সেটাকে অন্যজন রঙ
তুলির আচরে রাঙ্গিয়েছে, দিয়েছে
পুর্ণতা। আর নিয়েছি একসাথে সে স্বপ্ন
গুলো পুরনের শপথ। পাহাড়ের এই গহীন
কোনের ঝরণার দিকে হেটে যাওয়া
আমরা, সেই স্বপ্ন গুলোর একটা পুরোনেই
ব্যাস্ত।
৩।
দুজনের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে
বাস স্টান্ডে আসা যেখানে অপেক্ষা
করছিলো চট্টগ্রামের বাস। দুজন উঠে
পড়েছিলাম তারাতারিই। বুকে
উত্তেজনা স্বপ্ন পুরনের, আর পাশেই
নির্ভরতার একজন। সব মিলিয়ে দারুন
এক্সাইটেড। জার্নিটাও ভালোই
কাটিয়েছি দুজন, গল্পে গল্পে আর পরম
মমতায় একে অপরকে আকড়ে ধরে। চট্টগ্রাম
পৌছেই সেখান থেকে “বান্দরবান”।
সেখানে টুরিষ্ট অফিসে যোগাযোগ
করে সাথে একজন গাইড নিয়ে সারা
এলাকা সম্পর্কে জেনে নেই আমরা।
যদিও আগেই সব খবর নিয়েই বের
হয়েছিলাম, তবুও বাড়তি সতর্কতা
হিসেবে এই আয়োজন। কেউ ই চাই না,
একটু অসাবধনতায় কারো একটু ক্ষতি হয়ে
যাক। যেখানে যাবার জন্য, যে স্বপ্ন
পুরণের জন্য এত আয়োজন তার মাঝে কোন
খুত রাখা চলবে না যে। ঝরণার যে
যায়গাটা আমাদের লক্ষ ওদিকটায়
হিংস্র বণ্য প্রানীরা আসে না তবে
কিছু সাপ আর কিট পতঙ্গ থাকে। তারপরও
একটা দুনলা বন্দুক আর একটা সনিক বিপার
(যেটা শব্দ তৈরি করে কীট পতঙ্গকে
দূরে রাখবে) আর এক বোতল কার্বলিক
এসিড নিয়ে নিলাম সাথে। সাথে
আছে আরো কিছু প্রোয়োজনীয় জিনিস,
যেমন- একটা চাকু, অল্প দড়ি, তাবু,
ক্যামেরা, পানি, খাবার, ফার্স্ট এইড
কিট ইত্যাদি। তারপর গাইডের কাছ
থেকে আরেকবার পুরো পথের বিবরন
শুনে নিয়ে যাত্রা শুরু হল আমাদের।
অনেকটা পথ এগিয়ে দেয় গাইড, তারপর
তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাত্রা শুরু করি
আমরা। সব জিনিসগুলো ভাগ করে বয়ে
নিয়ে যাচ্ছি দুজনে। একজনের হাতে
অন্যজন হাত দিয়ে চলছি লক্ষ্যে।
৪।
প্রিমা- একটু রেষ্ট নেই? আর হাটতে
পারছি না তো।
আমি- আচ্ছা চল একটু বসি।
দুজন একটা উচু যায়গা দেখে বসে পড়ি।
প্রিমা মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে
চারপাশ। আর আমি দেখি ওর মুগ্ধ হওয়া
চোখ। অল্প কিছু নাস্তা করে নেই
ওখানেই, তারপর আবার চলার শুরু। সূর্য
ততক্ষনে মাথার উপর উঠে গেছে।
গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে পড়ে কোথাও
কোথাও সার্চলাইটের আলোর মত আলোর
বৃত্ত তৈরি করছে আর পরিবেশকে একটা
মায়া দিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশিদুর নেই
আর। তবে চড়াই উতরাই ভেঙ্গে উপরের
দিকে উঠতে কষ্ট হচ্ছে একটু।
প্রিমা- আর কতটুকু উঠতে হবে?
আমি- এইত আর একটু, খুব বেশি না। খুব
বেশি কষ্ট হচ্ছে?
প্রিমা- হুম, পা ওঠাতে ইচ্ছা করছে না
যে আর।
আমি- খুব বেশিদুর নাই আর, চল এক কাজ
করি ব্যাকপ্যাকগুলো এখানে রেখে
যাই,
তারপর তোকে উপরে রেখে এসে, আমি
এগুলো নিয়ে যাবো আবার।
প্রিমা- থাক তোর কষ্ট হবে, আবার পরে
আসতে।
কন্ঠে ঝড়ে পড়লো আমার জন্য একরাশ
মায়া। কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে এটাও
বুঝতে পারছিলাম হাটতে পারবে না ও
আর।
আমি- অল্প একটুতো, আমার কষ্ট হবে না।
ওখানে ব্যাকপ্যাক রেখে শুধু তাবু আর
বন্দুকটা নিলাম ঘাড়ে। তারপর
প্রিমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার
কাধে ওর হাত রেখে দিলাম। আমাকে
ধরে হাটছে আর চারপাশ দেখছে ও।
আনন্দে ঝলমল করছে চেহারা। আমার
সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে
গেলো ওর ওই চেহাড়া দেখে। তখন
ঝরণার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মন ভালো
করে দেয়া একটা শব্দ। অল্প কিছুক্ষনের
মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম ঝরণার
পাশে।ও বাচ্চা মেয়ের মত দৌড়ে
ঝরণার কাছে চলে গেলো। জোড়ে
চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো “এত সুন্দর
কেনো এই ঝরণা”। ও মুগ্ধ চোখে ঝরণার
পানিকে আছড়ে পড়তে দেখছে। আর
আমি মুগ্ধ চোখে ওর মুগ্ধতাকে দেখছি।
তখন আমার মনে হল ওর এই মুগ্ধ চোখ আর
প্রানোচ্ছল হাসির জন্য আমি সব করতে
পারি, সব। সারাজীবন যাযাবর হয়ে ঘুরে
বেড়াতে পারি পথে পথে, বনে
বাদারে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা
করছিলো “আমি তোর এই মুগ্ধ হয়ে যাওয়া
চোখ আর এই হাসিকে অনেক
ভালোবাসি”। বলতে পারি নি, কারন
আমি ওকে দেখছিলাম দুচোখ ভরে, কি
বাচ্চা মেয়ের মত মজা করছিলো ও।
হটাত এসে শক্ত করে জড়ালো আমায়, বলল
তোকে “অনেক ভালোবাসি”। চোখে
পানি চলে এলো আমার। লুকানোর
চেষ্টাও করলাম না, দেখে ও হেসে
ফেলে বলল “পাগল”।
আমি তাবু খাটানোর জায়গা খুজলাম।
ঝরণাটা ছিলো দুই স্তরের। মানে উপর
থেকে পানি পড়ে এক জায়গায় জমা
হচ্ছে, আবার সেখান থেকে নিচে
আছড়ে পড়ে নদি হয়ে চলে যাচ্ছে।
প্রথমে যেখানে পানিটা জমা হচ্ছে
তার পাশে সমতল জায়গা আছে
অনেকখানি। একটু পরিষ্কার করে নিয়ে
তাবু টাঙ্গিয়ে নিলাম।
আমি- তুই এখানে একটু রেষ্ট নে, আমি
ব্যাকপ্যাক দুটো নিয়ে আসি।
প্রিমা- আমার একা ভয় করবে, চল আমিও
যাবো তোর সাথে।
আমি- তুই যেতে পারবি না। তুই থাক
এখানে, দিনের বেলা কিছু হবে না,
আমি যাব
আর আসবো।
ওকে বন্দুকটা হাতে ধড়িয়ে দিয়ে আমি
ফিরে এলাম ব্যাকপ্যাকের কাছে।
ব্যাকপ্যাক নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি
যেখেনে বসিয়ে রেখে গেছিলাম
সেখানেই বসে আছে ও। কাছে গেলাম,
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার অনেক
ভয় করছিলো তোকে ছাড়া। আমি ওকে
শক্ত করে চেপে রইলাম। মনে মনে বললাম
“তোকে এক মুহুর্তের জন্যও ছেড়ে যাবো
না কোনদিন”।
তারপর খেয়ে নিলাম দুজনে। আসলে
খাওয়ালাম একজন আরেকজনকে, পরম
মমতায়। তারপর চারপাশটা দেখতে বেড়
হলাম।
ঝরণাটার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে।
উপর থেকে পরে একটা যায়গায়
পানিগুলো জমা হয় প্রথমে, তারপর
সেখান থাকে আছড়ে পরে তৈরি
করেছে নদিটাকে। যেখানে পানিটা
প্রথমে জমছে সেখানে স্রোত কম, পানি
অনেক বেশি স্বচ্ছ। পানির আলোরন না
থাকলে হয়ত মনে হত কাচের তৈরি কোন
কিছু, যার উপর দিয়ে অনায়েসে হেটে
যাওয়া যাবে। এক ধারে অল্প কিছু সবুজ
শ্যাওলা জমে আছে। একপাশে পাহাড়
উচু হয়ে উঠে গেছে, অন্য পাশে একটু
সমতল হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে।
সমতল জায়গার কিছুদুর উত্তরে গেলেই
পাহাড়রের একটা কার্নিশ আছে, যার
নিচে পড়ে গেলেই সব শেষ।
আমরা দুজনেই চারপাশটা মনোযোগ
দিয়ে দেখছিলাম আর ঝরণার শব্দ
শুনছিলাম।
হঠাৎ প্রিমা আমার দিকে তাকালো,
আমি ওর চোখ দেখেই বুঝে গেলাম ও কি
চাচ্ছে। দুজনেই নেমে গেলাম ঝরণার
উচ্ছল সেই ঝকঝকে জলে। ও আমাকে
পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো আর
আমি ওকে। বেশ কিছুক্ষন আমরা মজা
করলাম পানিতেই।
আমি- প্রিমা, চল অনেক হইছে, নয়ত শরীর
খারাপ করবে।
প্রিমা- আরেকটু থাকি না।
আমি- না আর থাকা যাবে না, শরীর
খারাপ করলে তখন কি হবে, তোকে
ফেলে আমি
কিন্তু চলে যাবো।
ছোট বাচ্চাদের মত গাল ফুলায়ে উঠে
আসলো পানি থেকে। আমি জড়ায়ে
নিলাম ওকে, কোলে তুলে নিয়ে
আসলাম তাবুতে। লজ্জা পেয়ে মাথা
নিচু করে যে হাসিটা ও দিয়েছিলো,
সেটা দেখে রবিন্দ্রনাথের মত বলতে
ইচ্ছা হয় “বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা”।
শুকনো কাপড় পড়ে ভেজা কাপড়গুলো
মেলে দিলাম বাতাসে। তারপর খাবার
পালা। সাথে থাকা ঝাল ঝাল করে
মসলা দেয়া পাখির মাংশ আর রুটি
দিয়েই খাবার পর্ব সেরে ফেললাম,
ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে আসছে।
তাবুর চারপাশে একটু কার্বলিক এসিড
ছড়িয়ে, সনিক বিপারটা চালু করে তাবুর
পাশে রেখে দিলাম।
আমরা একটু উচু জায়গায় বসে অপেক্ষা
করছিলাম রাত নামার। চাঁদনি রাত। হ্যা,
আমরা সময়টা সেভাবেই বেছে
নিয়েছিলাম, সেদিন পুর্ণিমা ছিলো
না, তবে চাঁদ ছিলো পুর্ণ। রাতের জন্য
অপেক্ষার সময়টুকু ও পাখির ডাক কমে
আসা চারপাশ দেখে আর আমি ওকে
দেখেই কাটিয়ে দিলাম।
একটা সময় রাত নেমে এলো, বহু
প্রতিক্ষিত সেই রাত। যার স্বপ্ন
বুনেছিলাম আমরা এতদিন। যাকে পুরণের
জন্য একজন অন্যজনে মিশে গেছি, যার
জন্য চলে এসেছি এখানে।
আমি প্রিমার দিকে তাকালাম, ও
তাবুতে ঢুকে গেলো। আমি অপেক্ষা
করছিলাম ওর জন্য,বাইরে বসে।
ও যখন তাবু থেকে আস্তে আস্তে বেরুলো,
আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
পুরো শরীর সাদা রঙে মোড়ানো। সাদা
ড্রেস পড়েছে মেয়েটা, সাথে সাদা
ওরণা। পিঠে এলিয়ে থাকা খোলা চুল,
যার অল্প কিছু ঘার বেয়ে সামনে চলে
এসেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো
আকাশের কোন পরী ভুলে এখানে ঢুকে
পড়েছে, আর তার ডানা খুলে রেখে
আমার দিকে হেটে আসছে। আমার মনে
হচ্ছিলো চিৎকার দিয়ে বলি “তুই এত
সুন্দর কেনো?”। কিন্তু বলতে ভয়
পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো এটা কোন
স্বপ্ন দৃশ্য, একটু শব্দ করলেই ঘুম ভেঙ্গে
যাবে, দেখবো সামনে তুই নেই। তাই
সাহস পাচ্ছিলাম না কোন কথা বলার, শুধু
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছিলাম তোকে।
আমার সামনে এসে বসে পরল ও।
তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। আমিও
চোখ ফেরাতে পারছি না।
শুনেছিলাম প্রকৃতি পারফেক্ট কোন
জিনিস তৈরি করে না। শুদ্ধ সৌন্দর্য
মানুষ সহ্য করতে পারে না তাই প্রকৃতি
তাকে সেটা দেয় না। ঐ সময় আমার সে
বিশ্বাসের গোড়া টালমাটাল হয়ে
গেলো। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কিছু
ব্যাতিক্রম ঘটায়, মাঝে মাঝে তার
খেয়াল বসে মানুষের সামনে কিছু
বিশুদ্ধ সৌন্দর্য এনে দেয়। সেটা তেমনই
একটা মুহুর্ত ছিলো।
আকাশে চাঁদের আলো। সামনে একঝাক
পরীদের থেকে আমার কাছে চলে আসা
এক সাদা পরী, পাশে ঝরণার প্রবাহমান
পানি আর মৃদু শব্দ, বাকি প্রকৃতি নিশ্চুপ।
চাঁদ তার জোসনার আলো দিয়ে
চারপাশের পরিবেশটা মায়াময় করে
দিয়েছিলো। ওর গায়ে চাদের আলো
পড়ছে, সাদা জামায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
মনে হচ্ছিলো যেন ওর গা থেকে কোন
স্বর্গীয় আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে
চারদিকে। মনে হচ্ছে আমাকে মুগ্ধ করে
দিয়ে এখনই ও ডানা মেলবে আকাশে।
ঝরণার মৃদু শব্দ ছাড়া সব শব্দ থেমে গেছে।
আমি দেখছিলাম পৃথিবীর বিশুদ্ধতম
সৌন্দর্য আর পৃথিবীর শুদ্ধতম মেয়েটিকে।
আমার পুরো শরীরে আর লোম কুপে নেষা
ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। শুধু মনে হচ্ছিলো সময়
এখানেই আটকে যাক। ঘড়ির কাটা
থেমে যাক, পৃথিবীর সমস্ত কাজ থেমে
যাক, শুধু এই মুহুর্তটি যেন আনন্তকাল ধরে
চলতে থাকে।
আমার অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেড়
হয়ে গেলো “অনেক বেশি
ভালোবাসিরে তোকে, এই চাঁদ আর
প্রকৃতি সাক্ষ্যি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে
গেলেও আমি তোকে ছেড়ে কোথাও
যাবো না”। ও আমাকে মিষ্টি হেসে
আমার পাশে এসে বসল। আমি মনে মনে
বললাম “এই হাসির জন্য আমি আমার জীবন
বাজি রেখে দিতে পারি”। আমার মনে
হল প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর কেন? এই সময়টা এক
সময় শেষ হয়ে যাবে। আমার পুরো
পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছা
করছিলো।
ও গান ধরল “ভালোবাসি ভালোবাসি,
এই............”। মনে হচ্ছিলো আমি কোথাও
একটা ডুবে যাচ্ছি ধিরে ধিরে, যার
কোন শেষ নেই, শুরু নেই, প্রচন্ড গভীর সে
অনুভূতি। তলিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
গান শেষে ও আমার দিকে এগিয়ে এল।
চোখটা আস্তে আস্তে বন্ধ করে ফেলল,
ঠোট দুটো খুলে যাচ্ছে ধিরে ধিরে,
চাঁদের আলোয় মুক্তোর মত দাত গুলো
জ্বলছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত কোন এক
আকর্ষনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, নেমে
আসছিলো আমার রুক্ষ খসখসে ঠোট, কোন
এক মোলায়েম পড়শে..........................
..............................................
৫।
হটাৎ শব্দে চমকে উঠলাম।
মামা- কি ব্যাপার আজ কি কলেজ যাবা
না, উঠবা কখন? খাবা কখন আর যাবা কখন?
আমি শুধু তাকিয়ে আছি, মনে হচ্ছে কোন
কথাই শুনতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি
না। আস্তে আস্তে মনে পড়ল আমি এই স্বপ্ন
গুলো দেখেছিলাম কোন এক “তুই” এর
সাথে, নিয়েছিলাম স্বপ্ন পুরনের শপথ,
কিন্তু মাঝ পথে সে আমার উপর বিশ্বাস
হারিয়ে ফেলেছে। আমাকে বন্দি করে
রেখে গেছে স্বপ্নের বৃত্তে। বেরুতে
পারছি না আমি। প্রতি রাতে আমি এমন
অনেক স্বপ্ন পুরন করি ওকে নিয়ে। কিন্তু
নতুন কোন স্বপ্ন দেখি না, দেখবো
কিভাবে, ওতে রং তুলির আচর দিয়ে
সৌন্দর্য দেবার মানুষটা যে আর নেই।
আবার মনে একটা আশা নিয়ে আরেকটি
দিন শুরু হয়, সে হয়ত কোন একদিন ফিরবে
আমার কাছে, এসে বলবে, ওই চলনা
আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো হাত ধরে
একসাথে পুরন করি.........
বান্দরবান পাকুরপারা পাহাড় এলাকা।
তারমাঝ দিয়ে বয়ে চলছে একটা প্রশস্ত
কিন্তু শান্ত স্রোতধারা। পাহাড়ের বুক
চিড়ে একেবেকে নেমে যাচ্ছে
নিচের দিকে। তার আসম্ভব সুন্দর স্বচ্ছ
জলগুলো যেন দিনের সমস্ত আলোকে
প্রতিফলিত করে দেবে তার বুক থেকে।
কিছু কিছু যায়গায় নিচের চকচকে বালি
চকমকি পাথরের মত আলোর ঝলকানি
দিচ্ছে। খুব কাছ থেকে একটু দাড়িয়ে
লক্ষ্য করলে কিছু সামুদ্রিক ছোট মাছকে
খেলা করতে দেখা যায়। চারপাশে
অসংখ্য গাছপালায় ঘেরা। হাজারো
রকম পাখির ডাকে পুরো এলাকা মুখরিত,
মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতির সন্তানেরা
প্রকৃতিকে জাগিয়ে রাখছে এভাবে।
মাঝে মাঝে দেখা মেলে কিছু বন্য
প্রানির। প্রকৃতি এখানে তার রুপ
প্রকাশে কার্পন্য করেনি একেবারেই,
বরং একটু বেশিই দিয়ে ফেলেছে। এমন
সৌন্দর্যকে দেখতে দেখতে এগিয়ে
চলছে দুজন। পরষ্পরের হাত ধরে, পরম
নির্ভরতায় আর অনাবিল মানষিক
প্রশান্তিতে। মাঝে মাঝে গাছের
ফাঁক থেকে বেড়িয়ে আসা বানর মুখ
খিচিয়ে যাচ্ছে এই দুই অনাকাঙ্খিত
অনুপ্রবেশকারিকে। কিন্তু সেদিকে
খেয়াল নেই দুজনের কারুরই। আমরা
এগিয়ে চলছি আমাদের লক্ষে। আর মন
ভড়িয়ে নিচ্ছি চারপাশ থেকে।
আমি আর প্রিমা। আমরাই সেই দুজন
পথযাত্রি। উদ্দেশ্য- এই সুন্দর নদির জন্মদাতৃ
অসম্ভব সুন্দর “ঝরণা”। ইচ্ছা- ঝরণার সাথে
সাথে নিজেদের জীবন আর প্রকৃতির
অপার সৌন্দর্যকে খুব কাছ থেকে
দেখার, উপভোগ করার। নিজেদের মধ্যে
ভাগাভাগি করে নেয়া অনেক “স্বপ্ন”
গুলোর মাঝে একটাকে পূর্ণতা দেয়ার।
যে স্বপ্নের বীজ বপন হয়ে গেছিলো
দুজনের মনে অল্প কিছুদিনের পরিচয়ে।
২।
দুজনের পরিচয় ঠিক গল্প করার মত, অনেক
ফিকশান রাইটারের রসদ যোগাতে
পারবে সে গল্প।
ফেসবুকের দুই নিয়মিত সার্ফার ছিলাম
আমরা। সেখানেই প্রথম পরিচয়। দুই
নিঃসঙ্গ মানুষের পছন্দ অপছন্দ আর চিন্তা
ভাবনার স্টাইল অনেকটাই মিলে যায়।
সেই থেকে নিজেদের স্বপ্নের আদান
প্রদান শুরু হয়ে আর থেমে থাকেনি
কখনও। সে স্বপ্নগুলোতে একটার পর একটা
রঙ্গিন পালক যুক্ত হয়েছে শুধু। একজন একটা
স্বপ্নের কথা বললে সেটাকে অন্যজন রঙ
তুলির আচরে রাঙ্গিয়েছে, দিয়েছে
পুর্ণতা। আর নিয়েছি একসাথে সে স্বপ্ন
গুলো পুরনের শপথ। পাহাড়ের এই গহীন
কোনের ঝরণার দিকে হেটে যাওয়া
আমরা, সেই স্বপ্ন গুলোর একটা পুরোনেই
ব্যাস্ত।
৩।
দুজনের বাসা থেকে বের হয়ে প্রথমে
বাস স্টান্ডে আসা যেখানে অপেক্ষা
করছিলো চট্টগ্রামের বাস। দুজন উঠে
পড়েছিলাম তারাতারিই। বুকে
উত্তেজনা স্বপ্ন পুরনের, আর পাশেই
নির্ভরতার একজন। সব মিলিয়ে দারুন
এক্সাইটেড। জার্নিটাও ভালোই
কাটিয়েছি দুজন, গল্পে গল্পে আর পরম
মমতায় একে অপরকে আকড়ে ধরে। চট্টগ্রাম
পৌছেই সেখান থেকে “বান্দরবান”।
সেখানে টুরিষ্ট অফিসে যোগাযোগ
করে সাথে একজন গাইড নিয়ে সারা
এলাকা সম্পর্কে জেনে নেই আমরা।
যদিও আগেই সব খবর নিয়েই বের
হয়েছিলাম, তবুও বাড়তি সতর্কতা
হিসেবে এই আয়োজন। কেউ ই চাই না,
একটু অসাবধনতায় কারো একটু ক্ষতি হয়ে
যাক। যেখানে যাবার জন্য, যে স্বপ্ন
পুরণের জন্য এত আয়োজন তার মাঝে কোন
খুত রাখা চলবে না যে। ঝরণার যে
যায়গাটা আমাদের লক্ষ ওদিকটায়
হিংস্র বণ্য প্রানীরা আসে না তবে
কিছু সাপ আর কিট পতঙ্গ থাকে। তারপরও
একটা দুনলা বন্দুক আর একটা সনিক বিপার
(যেটা শব্দ তৈরি করে কীট পতঙ্গকে
দূরে রাখবে) আর এক বোতল কার্বলিক
এসিড নিয়ে নিলাম সাথে। সাথে
আছে আরো কিছু প্রোয়োজনীয় জিনিস,
যেমন- একটা চাকু, অল্প দড়ি, তাবু,
ক্যামেরা, পানি, খাবার, ফার্স্ট এইড
কিট ইত্যাদি। তারপর গাইডের কাছ
থেকে আরেকবার পুরো পথের বিবরন
শুনে নিয়ে যাত্রা শুরু হল আমাদের।
অনেকটা পথ এগিয়ে দেয় গাইড, তারপর
তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাত্রা শুরু করি
আমরা। সব জিনিসগুলো ভাগ করে বয়ে
নিয়ে যাচ্ছি দুজনে। একজনের হাতে
অন্যজন হাত দিয়ে চলছি লক্ষ্যে।
৪।
প্রিমা- একটু রেষ্ট নেই? আর হাটতে
পারছি না তো।
আমি- আচ্ছা চল একটু বসি।
দুজন একটা উচু যায়গা দেখে বসে পড়ি।
প্রিমা মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকে
চারপাশ। আর আমি দেখি ওর মুগ্ধ হওয়া
চোখ। অল্প কিছু নাস্তা করে নেই
ওখানেই, তারপর আবার চলার শুরু। সূর্য
ততক্ষনে মাথার উপর উঠে গেছে।
গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে পড়ে কোথাও
কোথাও সার্চলাইটের আলোর মত আলোর
বৃত্ত তৈরি করছে আর পরিবেশকে একটা
মায়া দিয়ে যাচ্ছে। খুব বেশিদুর নেই
আর। তবে চড়াই উতরাই ভেঙ্গে উপরের
দিকে উঠতে কষ্ট হচ্ছে একটু।
প্রিমা- আর কতটুকু উঠতে হবে?
আমি- এইত আর একটু, খুব বেশি না। খুব
বেশি কষ্ট হচ্ছে?
প্রিমা- হুম, পা ওঠাতে ইচ্ছা করছে না
যে আর।
আমি- খুব বেশিদুর নাই আর, চল এক কাজ
করি ব্যাকপ্যাকগুলো এখানে রেখে
যাই,
তারপর তোকে উপরে রেখে এসে, আমি
এগুলো নিয়ে যাবো আবার।
প্রিমা- থাক তোর কষ্ট হবে, আবার পরে
আসতে।
কন্ঠে ঝড়ে পড়লো আমার জন্য একরাশ
মায়া। কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে এটাও
বুঝতে পারছিলাম হাটতে পারবে না ও
আর।
আমি- অল্প একটুতো, আমার কষ্ট হবে না।
ওখানে ব্যাকপ্যাক রেখে শুধু তাবু আর
বন্দুকটা নিলাম ঘাড়ে। তারপর
প্রিমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার
কাধে ওর হাত রেখে দিলাম। আমাকে
ধরে হাটছে আর চারপাশ দেখছে ও।
আনন্দে ঝলমল করছে চেহারা। আমার
সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষেই দূর হয়ে
গেলো ওর ওই চেহাড়া দেখে। তখন
ঝরণার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। মন ভালো
করে দেয়া একটা শব্দ। অল্প কিছুক্ষনের
মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম ঝরণার
পাশে।ও বাচ্চা মেয়ের মত দৌড়ে
ঝরণার কাছে চলে গেলো। জোড়ে
চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো “এত সুন্দর
কেনো এই ঝরণা”। ও মুগ্ধ চোখে ঝরণার
পানিকে আছড়ে পড়তে দেখছে। আর
আমি মুগ্ধ চোখে ওর মুগ্ধতাকে দেখছি।
তখন আমার মনে হল ওর এই মুগ্ধ চোখ আর
প্রানোচ্ছল হাসির জন্য আমি সব করতে
পারি, সব। সারাজীবন যাযাবর হয়ে ঘুরে
বেড়াতে পারি পথে পথে, বনে
বাদারে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা
করছিলো “আমি তোর এই মুগ্ধ হয়ে যাওয়া
চোখ আর এই হাসিকে অনেক
ভালোবাসি”। বলতে পারি নি, কারন
আমি ওকে দেখছিলাম দুচোখ ভরে, কি
বাচ্চা মেয়ের মত মজা করছিলো ও।
হটাত এসে শক্ত করে জড়ালো আমায়, বলল
তোকে “অনেক ভালোবাসি”। চোখে
পানি চলে এলো আমার। লুকানোর
চেষ্টাও করলাম না, দেখে ও হেসে
ফেলে বলল “পাগল”।
আমি তাবু খাটানোর জায়গা খুজলাম।
ঝরণাটা ছিলো দুই স্তরের। মানে উপর
থেকে পানি পড়ে এক জায়গায় জমা
হচ্ছে, আবার সেখান থেকে নিচে
আছড়ে পড়ে নদি হয়ে চলে যাচ্ছে।
প্রথমে যেখানে পানিটা জমা হচ্ছে
তার পাশে সমতল জায়গা আছে
অনেকখানি। একটু পরিষ্কার করে নিয়ে
তাবু টাঙ্গিয়ে নিলাম।
আমি- তুই এখানে একটু রেষ্ট নে, আমি
ব্যাকপ্যাক দুটো নিয়ে আসি।
প্রিমা- আমার একা ভয় করবে, চল আমিও
যাবো তোর সাথে।
আমি- তুই যেতে পারবি না। তুই থাক
এখানে, দিনের বেলা কিছু হবে না,
আমি যাব
আর আসবো।
ওকে বন্দুকটা হাতে ধড়িয়ে দিয়ে আমি
ফিরে এলাম ব্যাকপ্যাকের কাছে।
ব্যাকপ্যাক নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি
যেখেনে বসিয়ে রেখে গেছিলাম
সেখানেই বসে আছে ও। কাছে গেলাম,
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার অনেক
ভয় করছিলো তোকে ছাড়া। আমি ওকে
শক্ত করে চেপে রইলাম। মনে মনে বললাম
“তোকে এক মুহুর্তের জন্যও ছেড়ে যাবো
না কোনদিন”।
তারপর খেয়ে নিলাম দুজনে। আসলে
খাওয়ালাম একজন আরেকজনকে, পরম
মমতায়। তারপর চারপাশটা দেখতে বেড়
হলাম।
ঝরণাটার আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে।
উপর থেকে পরে একটা যায়গায়
পানিগুলো জমা হয় প্রথমে, তারপর
সেখান থাকে আছড়ে পরে তৈরি
করেছে নদিটাকে। যেখানে পানিটা
প্রথমে জমছে সেখানে স্রোত কম, পানি
অনেক বেশি স্বচ্ছ। পানির আলোরন না
থাকলে হয়ত মনে হত কাচের তৈরি কোন
কিছু, যার উপর দিয়ে অনায়েসে হেটে
যাওয়া যাবে। এক ধারে অল্প কিছু সবুজ
শ্যাওলা জমে আছে। একপাশে পাহাড়
উচু হয়ে উঠে গেছে, অন্য পাশে একটু
সমতল হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে।
সমতল জায়গার কিছুদুর উত্তরে গেলেই
পাহাড়রের একটা কার্নিশ আছে, যার
নিচে পড়ে গেলেই সব শেষ।
আমরা দুজনেই চারপাশটা মনোযোগ
দিয়ে দেখছিলাম আর ঝরণার শব্দ
শুনছিলাম।
হঠাৎ প্রিমা আমার দিকে তাকালো,
আমি ওর চোখ দেখেই বুঝে গেলাম ও কি
চাচ্ছে। দুজনেই নেমে গেলাম ঝরণার
উচ্ছল সেই ঝকঝকে জলে। ও আমাকে
পানিতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো আর
আমি ওকে। বেশ কিছুক্ষন আমরা মজা
করলাম পানিতেই।
আমি- প্রিমা, চল অনেক হইছে, নয়ত শরীর
খারাপ করবে।
প্রিমা- আরেকটু থাকি না।
আমি- না আর থাকা যাবে না, শরীর
খারাপ করলে তখন কি হবে, তোকে
ফেলে আমি
কিন্তু চলে যাবো।
ছোট বাচ্চাদের মত গাল ফুলায়ে উঠে
আসলো পানি থেকে। আমি জড়ায়ে
নিলাম ওকে, কোলে তুলে নিয়ে
আসলাম তাবুতে। লজ্জা পেয়ে মাথা
নিচু করে যে হাসিটা ও দিয়েছিলো,
সেটা দেখে রবিন্দ্রনাথের মত বলতে
ইচ্ছা হয় “বাজিল বুকে সুখের মত ব্যাথা”।
শুকনো কাপড় পড়ে ভেজা কাপড়গুলো
মেলে দিলাম বাতাসে। তারপর খাবার
পালা। সাথে থাকা ঝাল ঝাল করে
মসলা দেয়া পাখির মাংশ আর রুটি
দিয়েই খাবার পর্ব সেরে ফেললাম,
ততক্ষনে সন্ধ্যা নেমে আসছে।
তাবুর চারপাশে একটু কার্বলিক এসিড
ছড়িয়ে, সনিক বিপারটা চালু করে তাবুর
পাশে রেখে দিলাম।
আমরা একটু উচু জায়গায় বসে অপেক্ষা
করছিলাম রাত নামার। চাঁদনি রাত। হ্যা,
আমরা সময়টা সেভাবেই বেছে
নিয়েছিলাম, সেদিন পুর্ণিমা ছিলো
না, তবে চাঁদ ছিলো পুর্ণ। রাতের জন্য
অপেক্ষার সময়টুকু ও পাখির ডাক কমে
আসা চারপাশ দেখে আর আমি ওকে
দেখেই কাটিয়ে দিলাম।
একটা সময় রাত নেমে এলো, বহু
প্রতিক্ষিত সেই রাত। যার স্বপ্ন
বুনেছিলাম আমরা এতদিন। যাকে পুরণের
জন্য একজন অন্যজনে মিশে গেছি, যার
জন্য চলে এসেছি এখানে।
আমি প্রিমার দিকে তাকালাম, ও
তাবুতে ঢুকে গেলো। আমি অপেক্ষা
করছিলাম ওর জন্য,বাইরে বসে।
ও যখন তাবু থেকে আস্তে আস্তে বেরুলো,
আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
পুরো শরীর সাদা রঙে মোড়ানো। সাদা
ড্রেস পড়েছে মেয়েটা, সাথে সাদা
ওরণা। পিঠে এলিয়ে থাকা খোলা চুল,
যার অল্প কিছু ঘার বেয়ে সামনে চলে
এসেছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো
আকাশের কোন পরী ভুলে এখানে ঢুকে
পড়েছে, আর তার ডানা খুলে রেখে
আমার দিকে হেটে আসছে। আমার মনে
হচ্ছিলো চিৎকার দিয়ে বলি “তুই এত
সুন্দর কেনো?”। কিন্তু বলতে ভয়
পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিলো এটা কোন
স্বপ্ন দৃশ্য, একটু শব্দ করলেই ঘুম ভেঙ্গে
যাবে, দেখবো সামনে তুই নেই। তাই
সাহস পাচ্ছিলাম না কোন কথা বলার, শুধু
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখছিলাম তোকে।
আমার সামনে এসে বসে পরল ও।
তাকিয়ে আছে আমার দিকেই। আমিও
চোখ ফেরাতে পারছি না।
শুনেছিলাম প্রকৃতি পারফেক্ট কোন
জিনিস তৈরি করে না। শুদ্ধ সৌন্দর্য
মানুষ সহ্য করতে পারে না তাই প্রকৃতি
তাকে সেটা দেয় না। ঐ সময় আমার সে
বিশ্বাসের গোড়া টালমাটাল হয়ে
গেলো। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কিছু
ব্যাতিক্রম ঘটায়, মাঝে মাঝে তার
খেয়াল বসে মানুষের সামনে কিছু
বিশুদ্ধ সৌন্দর্য এনে দেয়। সেটা তেমনই
একটা মুহুর্ত ছিলো।
আকাশে চাঁদের আলো। সামনে একঝাক
পরীদের থেকে আমার কাছে চলে আসা
এক সাদা পরী, পাশে ঝরণার প্রবাহমান
পানি আর মৃদু শব্দ, বাকি প্রকৃতি নিশ্চুপ।
চাঁদ তার জোসনার আলো দিয়ে
চারপাশের পরিবেশটা মায়াময় করে
দিয়েছিলো। ওর গায়ে চাদের আলো
পড়ছে, সাদা জামায় প্রতিফলিত হচ্ছে।
মনে হচ্ছিলো যেন ওর গা থেকে কোন
স্বর্গীয় আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে
চারদিকে। মনে হচ্ছে আমাকে মুগ্ধ করে
দিয়ে এখনই ও ডানা মেলবে আকাশে।
ঝরণার মৃদু শব্দ ছাড়া সব শব্দ থেমে গেছে।
আমি দেখছিলাম পৃথিবীর বিশুদ্ধতম
সৌন্দর্য আর পৃথিবীর শুদ্ধতম মেয়েটিকে।
আমার পুরো শরীরে আর লোম কুপে নেষা
ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। শুধু মনে হচ্ছিলো সময়
এখানেই আটকে যাক। ঘড়ির কাটা
থেমে যাক, পৃথিবীর সমস্ত কাজ থেমে
যাক, শুধু এই মুহুর্তটি যেন আনন্তকাল ধরে
চলতে থাকে।
আমার অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেড়
হয়ে গেলো “অনেক বেশি
ভালোবাসিরে তোকে, এই চাঁদ আর
প্রকৃতি সাক্ষ্যি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে
গেলেও আমি তোকে ছেড়ে কোথাও
যাবো না”। ও আমাকে মিষ্টি হেসে
আমার পাশে এসে বসল। আমি মনে মনে
বললাম “এই হাসির জন্য আমি আমার জীবন
বাজি রেখে দিতে পারি”। আমার মনে
হল প্রকৃতি এত নিষ্ঠুর কেন? এই সময়টা এক
সময় শেষ হয়ে যাবে। আমার পুরো
পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছা
করছিলো।
ও গান ধরল “ভালোবাসি ভালোবাসি,
এই............”। মনে হচ্ছিলো আমি কোথাও
একটা ডুবে যাচ্ছি ধিরে ধিরে, যার
কোন শেষ নেই, শুরু নেই, প্রচন্ড গভীর সে
অনুভূতি। তলিয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
গান শেষে ও আমার দিকে এগিয়ে এল।
চোখটা আস্তে আস্তে বন্ধ করে ফেলল,
ঠোট দুটো খুলে যাচ্ছে ধিরে ধিরে,
চাঁদের আলোয় মুক্তোর মত দাত গুলো
জ্বলছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত কোন এক
আকর্ষনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, নেমে
আসছিলো আমার রুক্ষ খসখসে ঠোট, কোন
এক মোলায়েম পড়শে..........................
..............................................
৫।
হটাৎ শব্দে চমকে উঠলাম।
মামা- কি ব্যাপার আজ কি কলেজ যাবা
না, উঠবা কখন? খাবা কখন আর যাবা কখন?
আমি শুধু তাকিয়ে আছি, মনে হচ্ছে কোন
কথাই শুনতে পাচ্ছি না, বুঝতে পারছি
না। আস্তে আস্তে মনে পড়ল আমি এই স্বপ্ন
গুলো দেখেছিলাম কোন এক “তুই” এর
সাথে, নিয়েছিলাম স্বপ্ন পুরনের শপথ,
কিন্তু মাঝ পথে সে আমার উপর বিশ্বাস
হারিয়ে ফেলেছে। আমাকে বন্দি করে
রেখে গেছে স্বপ্নের বৃত্তে। বেরুতে
পারছি না আমি। প্রতি রাতে আমি এমন
অনেক স্বপ্ন পুরন করি ওকে নিয়ে। কিন্তু
নতুন কোন স্বপ্ন দেখি না, দেখবো
কিভাবে, ওতে রং তুলির আচর দিয়ে
সৌন্দর্য দেবার মানুষটা যে আর নেই।
আবার মনে একটা আশা নিয়ে আরেকটি
দিন শুরু হয়, সে হয়ত কোন একদিন ফিরবে
আমার কাছে, এসে বলবে, ওই চলনা
আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো হাত ধরে
একসাথে পুরন করি.........