-ঐ রাফি শোন,
মিলে টাকা জমা দে, না হয়
দুপুর থেকে তোর মিল অফ ।
মেসের মিলের ম্যানেজারের
দায়িত্বে থাকা সুমন ভাই রাফিকে
ডেকে কথাগুলো শুনিয়ে দিলেন ।
অসহায়ের মত একটা চাহনি দিয়ে সুমন
ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল রাফি ।
চোখের কোণে শিশির বিন্দুর মত অশ্রু
জমে আসছে,
তারপর মাথাটা নুয়ে নিজের রুমে
চলে আসল ।
বিছানায় শুয়ে নিরবে কাঁদতে লাগল ।
কিছুই বুজে উঠতে পারতেছেনা কি
করবে ?
সামনে পরীক্ষা, তাই মেসে
থাকাটাও জরুরি । কিন্তু বাড়ি থেকে
তো গতকাল এসেছে মাত্র !
টাকার কথা বাবার কাছে বলেছিল,
কিন্তু এই দুর্দিনে তিনি নিজের
সংসারটা ভাল করে চালিয়ে যেতে
পারতেছেন না, আর এখন টাকা দিবেন
কোথা থেকে ?
মা-বাবা তিনভাই আর দুই বোনকে
নিয়ে রাফিদের পরিবার । মা-বাবার
স্বপ্ন ছিল সন্তানদের পড়ালেখা
শিখিয়ে মানুষ হিসাবে গড়ে
তোলবেন, কিন্তু জীবনের মাঝ পথে
এসে দারিদ্রতা তাদের স্বপ্নটাকে
গলাটিপে হত্যা করে দিল ।
তাদের মধ্যে ছোট ছেলে রাফি ,
বড় দুটি গার্মেন্টস কোম্পানি অত্যান্ত
নূন্যতম বেতনে কাজ করে । মাস শেষে
তাদেরই টানা-পোড়নে জীবন চলে,
বাড়িতে দিবে কোথা থেকে ?
আর ছোট দুইটা বোন । একজন সমাজের
চোখে বোঝা হয়ে আছে, তা নিয়ে
মা-বাবার চোখে ঘুম নেই ।
গরিব পরিবারের হওয়াই তা আরেকটু
সমস্যায় ফেলেছে তাদেরকে ।
আর একজন সবেমাত্র কিশোরীতে পা
দিল । ক্লাস থ্রীতে পড়াশোনা করে ।
সরকার থেকে কিছুটা উপবৃত্তির খরচ
পায় বলে পড়াটা এখনও চালু আছে !
রাফি গ্রামের একটা স্কুল থেকে
অভাবের মধ্যে কোন রকম করে এস
এস.সি.টা পাশ করেছিল বলে আজ
বাবা শহরে পড়তে পাঠাল, কিন্তু
ছেলেকে মেসে চলার মত টাকা
দিতে গেলে অনেক কষ্টে
নিজেদেরকে চলতে হত ।
আজ তার অবস্থা আরো খারাপ ,
মোটকথা তার পক্ষে আর রাফির
ব্যায়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছেনা ।
-দুপুর গেল, না খেয়ে, রাতটাও
খাটিয়ে দিল অনাহারে ।
পড়ালেখাতো দূরের কথা চিন্তায়
রাতে ঘুমাতেও পারলোনা । পেটের
খিদেয় ছট-ফট করেই ভোর হল । রাতে
পাশের রুমের নিশাদ ভাই ডেকেছিল
খাওয়ানোর জন্য, কিন্তু রাফি না শুনার
ভান ধরে শুয়ে রইল ।
মেসের বড় ভাইয়েরা অনেক আদর করেন,
কিন্তু যখন নিয়মিত খরচটা দিতে
পারেনা তখন রাগের মাথায় উলট-
পালট কিছু বলে ফেলেন, পরবর্তীতে
যদিও তারা অনুতপ্ত হন ।
তার প্রতি এতটা সদয়ও হতে পারেন না,
কারণ এখানে যারা থাকে সকলেই
মধ্যবিত্ত । আর পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন
বাস্তবতার মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত দেরকে
চলাফেরা করতে হয় । পরিবার থেকে
তাদেরকে অনেক কষ্টে খরচ আনতে হয় ।
কিন্তু রাফির পরিবারটা আরোও
নিন্মমানের ।
সকালে উঠে কাপড়-চোপড়গুলো ব্যাগে
গুচালো রাফি, একজন বড় ভাই বলল,
কিরে রাফি কই যাবি ?
কিন্তু রাফির কোন উত্তর নেই !
বড় ভাই আর দ্বিতীয় বার জিজ্ঞাসা
করলেন না ।
ব্যাগটা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল কাউকে
কিছু না বলেই ! গন্তব্য ঠিক নেই,
যেদিকে চোখ যায় আজ সেদিকেই
হারিয়ে যাবে ।
পেটের ক্ষুধার জ্বালায় পা দুটো যেন
পেটটাকে অনুরোধ করে বসল, আমাকে
কিছু শক্তি দে, আর পেটটা যেন মুখের
কাছে আবদার করতে থাকল আমায়
খাবার দে । কিন্তু তার কাছে
দেওয়ার মত কিছুই নেই ।
একটু করে পথ এগুতে লাগল ।
চোখ দুটো যেন পাথর হয়ে তাকিয়ে
থাকতে চায় সামনের রেস্টুরেন্টগুলোর
দিকে ।
কিন্তু কিছু করার নেই এইভাবের চলতে
থাকল ।
সামনে ট্রেনের রাস্তা দেখতে
পেলে, এবার সেই রাস্তা ধরেই
হাটতে থাকল । পেটের খিদের
জ্বালায় পা যেন আর চলেনা, অতি
কষ্টে চালিয়ে যায় ।
আজ রোদটাও ভীষন কড়া, যেন শরীরের
চামড়াটা পুড়ে যাবে ।
রোদের মাঝে মানুষগুলোর
আনাগোনাও তেমন চোখে পড়ছেনা ।
ভীষন প্রয়োজনের লোকগুলো ছাতা
হাতে ছুটে চলে ।
রাস্তা ধরে এগুতে থাকে রাফি...
সামনে একটা বিশাল ব্রিজ মুলত
ট্রেনের রাস্তার জন্যই ব্রিজটা
বানানো হয়েছে...
ব্রিজটা ধরে এগুতে থাকে রাফি ..
শরীরে যেন অবশিষ্ট আর শক্তি নেই ।
শরীরটাকে আর নাড়াতে
পারতেছেনা । মুহুর্তের মধ্যে মাথাটা
একটা চক্কর দিয়ে ব্রিজের উপর পড়ে
যায় রাফি ।
প্রায় ১০ মিনিট পর একটা ট্রেনকে ঐ
রাস্তা ধরে চলতে দেখা যায় ।
মানুষগুলো অবাক হয়ে ট্রেনটার দিকে
তাকিয়ে থাকে !
সেটার চাকার মাঝে লোহিত রঙের
কিছুটা আঁচর লেগে থাকতে দেখা
গেল ।
লোকগুলো কৌতুহলি হয়ে পথটা ধরে
কিছুটা এগোয় !
রঙটা আরো ঘন আকার হতে থাকে ।
হঠাত্ সামনের দিকে তাকাতেই
মানুষগুলো শিউরে উঠে !
চোখগুলো বড় হয়ে যায়,
পশমগুলো খাড়া হয়ে উঠে ।
একটা ছিন্ন-বিন্ন শরীর, টুকরোগুলো
ছড়িয়ে আছে পাঁচ-ছয় ফুট জায়গা জুড়ে ।
অনেকটা দূরেও কিছু টুকরো পাওয়া
গেল ।
হয়তো তার বাবা-মাও জানতে
পারেনি রাফির খবর ।
হারিয়ে ফেলে রাফি নামক
সন্তানটিকে ।
এভাবেই সমাপ্তি হল একটা রাফি এবং
একটা স্বপ্নের ।
হয়ত প্রতিদিন এই দারিদ্রতার বোঝা
কাধে না নিতে পেরে কত রাফিকে
এভাবে হারিয়ে যায় আমাদের সমাজ
থেকে ।
লিখা : Nz Bhuiyan Zaman