লেখক-Incomplete Sakib
দুপুর ২:১৫।
সাকিব তার মোটা ফ্রেমের
চশমাটা মুছে আবার
চোখে পরে নিলো। পকেট
থেকে একটা রুমাল বের
করে ঘামে ভিজে যাওয়া গোলগাল
ফর্শা মুখটা মুছে আবার
রুমালটা পকেটে রেখে দিলো। আজ
সে লাল রঙের একটা টি শার্ট আর নীল
একটা জিন্সের প্যান্ট পরেছে। বার বার
ঘড়ি দেখছে সাকিব। বাসটা সে মিস
করল কিনা বুঝতে পারছে না। কারণ বাস
প্রতিদিন ২:১০ এর ভেতরই চলে আসে।
প্রতিদিন সে এখান থেকেই
বাসে ওঠে। আজকে অবশ্য সে একটু
দেরি করে ফেলেছে আসতে।
গাড়ির হর্ন আর রিকশার বেল এর শব্দ
ছাপিয়ে হঠাৎ একটা চিকন কণ্ঠ
শুনতে পেলো সাকিব "এই
ছেলে এদিকে আসো।" সাকিব দেখল
কলেজ ড্রেস পরা মেয়ে রাস্তার
অন্যপাশ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে হাত
নাড়ছে। সে ডানে-
বামে তাকিয়ে দেখল
যে আসলে মেয়েটি অন্য
কাউকে ডাকছে কিনা। না,
মেয়েটি ওকেই ডাকছে। কিন্তু সাকিব
মেয়েটিকে চিনতে পারলনা। যখন তার
মস্তিস্কের নিউরন গুলো মেয়েটির
মুখবয়ব খোঁজার বৃথা চেষ্টায় ব্যাস্ত,
ততক্ষনে মেয়েটি রাস্তা পার
হয়ে সাকিবের
সামনে এসে দাড়িয়েছে।
সাকিব দেখল দুপুরের নির্দয় সূর্য তার
অসহনীয় রোদের
ঝলকানি দিয়ে মেয়েটির সৌন্দর্যের
প্রখরতাকে ম্লান করার চেষ্টা করছে।
যার ফলশ্রুতিতে মেয়েটির শুভ্র-সতেজ
মুখটি ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছে।
ঘামে ভিজে তার মুখের বাম
পাশটিতে কিছু অবাধ্য চুল
লেপ্টে আছে। তার
ললাটে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম
সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। ধূসর
রংয়ের চোখদুটি চশমার ফ্রেমের ফাঁক
দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। এই অনিন্দ সুন্দরীর
মায়াকাড়া চোখদুটো সাকিবকে যেন
সম্মোহিত করে ফেলছিল। তার চিন্তার
সূতা কাটল কথার ঝঙ্কারে।
মেয়ে- এই, তুমি কি আমার
কথা শুনতে পাচ্ছ না?
সাকিব- ওহ!! সরি।
আমি আসলে শুনতে পাইনি। কি যেন
বলছিলেন।
“এগুলো ধরো" বলে মেয়েটি সাকিবের
হাতে কিছু নোট ধরিয়ে দিলো।
সাকিব জিগ্যাসূ দৃষ্টিতে বলল
"এগুলো কি করব?"
মেয়ে- উফফ!! এগুলো তোমার
আপুকে দিবা। আর বলবা যেন কালকের
ভেতরই কপি করে নেয়। কারণ আমার
কালেকেই এগুলো লাগবে। আর
তুমি এগুলো নিয়ে এক্ষুনি বাসায় যাও।
সাকিব- কিন্তু.........
মেয়ে- ওহহ হ্যা। আরেকটা কথা। বিগত
সালের কিছু প্রশ্নও আমি এড
করে দিয়েছি। এজন্য নতুন কিছু আর
লাগবেনা। শুধু এগুলো পড়লেই হবে।
রিকশা দাড় করিয়ে রেখেছি অনেক্ষন।
আচ্ছা আমি আসি।
সাকিব- আমার কথাটা তো শুনেন।
ততক্ষনে মেয়েটি রাস্তা পার
হয়ে রিকশা এর কাছে পৌঁছে গেছে।
মেয়েটি রিকশাতে ওঠার প্রায়
সাথে সাথেই রিকশা চলতে শুরু করলো।
সাকিব নোটগুলো হাতে নিয়ে বোকার
মত কিছুক্ষণ চলন্ত রিকশাটির
দিকে তাকিয়ে রইল। রিকশাটি দৃষ্টির
আড়াল হলে সে নোটগুলোর এর
দিকে তাকালো।
মৃদু শব্দে প্রথম
নোটটিতে লেখা অধ্যায়ের নাম পড়ল
সে "ভেক্টর"। মেয়েটি সাইন্সের
স্টুডেন্ট। গাড়ির হর্নের শব্দ শুনে মুখ
তুলে তাকালো সাকিব।
গাড়ি চলে এসেছে। নোটগুলো ব্যাগের
মধ্যে রেখে দিয়ে সে গাড়িতে উঠে পড়ল।
রুমে পৌঁছেই প্রতিদিনের
মতো তাড়াতাড়ি করে খেয়ে দেয়ে প্রাইভেট
পড়ানোর
উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সাকিব। ২
টা প্রাইভেট পড়িয়ে গ্রুপ
স্টাডি করে রাত ৮ টার
দিকে রুমে আসলো। সে তার
টেবিলটির দিকে তাকাতেই
দেখলো সেই নোটগুলো অন্য কিছু বইয়ের
সাথে ওগোছালো ভাবে পড়ে রয়েছে।
সে চেয়ার টেনে বসল।
নোটগুলো হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলো আর
চিন্তা করতে লাগলো যে কি করা যায়।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা নোটের
শেষের পাতায়
গিয়ে হাল্কা গোলাপি রঙের
লেখাতে তার চোখ আটকে গেলো।
ওখানে লেখা ছিলো
" নুসরাত জাহান তনিমা
মোবাইল নম্বরঃ 01740........."
সাকিব নম্বরটিতে ফোন দিলো। ৩-৪
বার রিং বাজার পর ওপাশ
থেকে একটা মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো।
"হ্যালো"
সাকিব মোলায়েম কন্ঠে বলল
আমি "নুসরাত জাহান তনিমা"
কে চাচ্ছিলাম?
"জী আমিই তনিমা। আপনি কে বলছেন
প্লিস?"
সাকিব- "আমাকে আপনি চিনবেন না।
কিন্তু আমার কাছে আপনার
যে নোটগুলো আছে ওগুলো অবশ্যই
চিনবেন।" smile emoticon
তনিমা- ওহহ হ্যা ভাইয়া।
চিনতে পেরেছি। আসলে আমি আপনার
ফোনেরই অপেক্ষা করছিলাম। আমার এক
বান্ধবীর ছোট ভাইয়ের ঐ সময়
ওখানে দাড়ানোর কথা ছিলো। এজন্য
একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।
আমি সত্যি সরি। frown emoticon
সাকিব- এটা কোন ব্যাপার না। ভুল
বোঝাবুঝি তো এখন ঠিক
হয়ে গেলো তাইনা। আর আপনি কিন্তু
অনেক তাড়াতাড়ি কথা বলছেন, একটু
ইজি হয়ে কথা বলেন।
তনিমা- আমি তো তনিমা, তাই
তনিমা হয়ে কথা বলতে পারবো।
ইজি হয়ে কথা বলতে পারবো না।
হা হা হা। grin emoticon
সাকিব- আপনি তো অনেক
মজা করে কথা বলেন।
তনিমা- হুম বলি।
আপনি মজা করে কথা বলতে পারেন না?
সাকিব- নাহ, পারিনা।
তনিমা-আচ্ছা না পারলেও কোন
সমস্যা নেই। কিন্তু কাল ঐ
নোটগুলো কি নিয়ে আসতে পারবেন?
আমার কালকে ওগুলো লাগবে।
সাকিব- অবশ্যই পারবো।
এভাবেই সাকিবের সাথে তনিমার
পরিচয়। তনিমা যখন কলেজ
থেকে বাসায় যেতো সেই
সময়টাতে সাকিবও বাসের জন্য
অপেক্ষা করতো। এভাবেই দু
জোড়া চোখের দৃষ্টি বিনিময়
এবং মুঠোফোনে ভাবের আদান-প্রদান
এর
মাধ্যমে ধীরে ধীরে তারা ভালো বন্ধুতে পরিণত
হলো। তাদের
সম্পর্কটা আপনি থেকে তুমিতে চলে যায়।
দেখতে দেখতে ৫-৬ মাস
কেটে গেলো। তাদের
মাঝে ভালোলাগার
পরিমাণটা বাড়তে বাড়তে ভালোবাসায়
রুপান্তরিত হচ্ছিলো, দু জনই
এটা বুঝতে পারতো। কিন্তু কেউ মুখ
ফুটে বলতো না।
এমন সময় একদিন দুপুরে সাকিব
প্রতিদিনের বাস আশার ৩০ মিনিট
আগে থেকে দাঁড়িয়ে ছিলো তনিমার
জন্য। কিন্তু ৫ মিনিট, ১০ মিনিট করে ৩০
মিনিট পার হয়ে ২
টা বেজে গেলো তাও কোন
রিকশা এলো না তনিমা কে নিয়ে।
২.১০ এর দিকে সাকিব এর ক্যাম্পাসের
বাস চলে আসলে ঐদিন
সে বাসে উঠে চলে গেলো। ফোন নম্বর
এ চেষ্টা করেও দেখল ফোনটি বন্ধ
রয়েছে। সাকিবের মনের ভেতর
বিভিন্ন চিন্তা উঁকি দিতে লাগলো।
ঐদিন কোনভাবে পার হলো তার।
কিন্তু পরেরদিন ও তনিমার রিকশা আর
এলো না। সাকিব অনেকবার ওর
ফোনে চেষ্টা করল, কিন্তু ফোন বন্ধ
পেলো। বাস চলে যাওয়ার পরও অনেক্ষন
অপেক্ষা করে থাকলো। কিন্তু তারপরও
রিকশা এলোনা। সাকিবের
কাছে তনিমার বাসার কোন নম্বর
ছিলোনা। আর সাকিব তনিমার বাসাও
চিনতো না। সাকিবের ঐ দিনটাও
অনেক খারাপ কাটলো। অনেক
চিন্তা করল যে কি করা যায়, কিন্তু কূল-
কিনারা কিছুই খুঁজে পেলোনা। এর
পরেরদিনও রিকশা এলোনা। সাকিবের
অস্থিরতা চরম পর্যায়ে উঠলো। কিন্তু
কিছুই করার ছিলো না।
কিন্তু সামনে সাকিবের জন্য বড় চমক
অপেক্ষা করে ছিলো। সেদিন সাকিব
প্রাইভেট পড়াতে গেলে তাঁর ছাত্রীর
মুখে তনিমার নাম শুনে চমকে উঠল।
সাকিব অবাক কন্ঠে জিগ্যেস
করলো "তুমি তনিমাকে চেনো কিভাবে?"
সেই ছাত্রী তখন
পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। বলল
যে তনিমা ওরই বান্ধবী। সাকিব ও
তনিমার পরিচয়েরও প্রায় ৮-৯ মাস
আগে থেকেইও তনিমা সাকিব কে পছন্দ
করত কিন্তু বলতে পারতো না। এজন্য
সে তনিমাকে বুদ্ধি দিয়েছিলো কিভাবে নোটের
ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে পরিচিত
হওয়া যায়। সে আরো বলল
যে তনিমা ওকে অনেক ভালোবাসে।
কিন্তু কখনও বলতে পারেনি। তনিমার
সামনে বিয়ে। আর তনিমা তার বাবা-
মার পালক সন্তান। কিন্তু তার বাবা-
মা তাকে কখনো এটা বুঝতেও দেয়নি।
আর নিজের সন্তানের থেকেও বড়
করে দেখতো তারা তনিমাকে। এজন্য
সে তার বাবা-মাকে তার পছন্দের
কথাটি বলতে পারছেনা। বাবা-মা কষ্ট
পাবে এই ভয়ে সে নিজের
ভালোবাসাকে নিজের মাঝেই
হত্যা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর
সেজন্যই আপনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ
করে দিয়েছে। আর ওর বাবা এলাকার
একজন বড় রাজনৈতিক নেতা।
সাকিব কথাগুলো শুনে সেদিন আর
পড়াতে পারলো না। তনিমার বাসার
ঠিকানা টা নিয়ে বের হয়ে এলো।
কিন্তু তনিমার বাসায় যাওয়ার সাহস
করতে পারলো না। কারণ খোঁজ
নিয়ে জানতে পারলো ঐ এলাকায়
তনিমার বাবার নামে সবাই কাঁপে।
সাকিব সেদিন
রাতে ঘুমাতে পারলো না। সারা রাত
তনিমার চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক
খেতে লাগলো। আর একটু ঘোর
লাগা ভাব আসলেই তনিমার সেই
নিষ্পাপ-কোমল
মুখটা চোখে ভাসছিলো। সাকিব এই
অস্থির নির্ঘুম রাতটি পার
করে বুঝতে পারলো যে তনিমা তার
কাছে কি। শুধুমাত্র ভয়ের জন্য সে তার
তনিমাকে হারাতে পারে না। এজন্য
সিধ্যান্ত নিলো যে সে তনিমাদের
বাসায় যাবে।
পরদিন সকালে সে তনিমাদের বাসায়
গেলো।
কলিং বেল টিপ দেয়ার পর সাকিব
একটা ভারী শক্ত কন্ঠ
শুনতে পেলো "খুলছি।"
তার প্রায় সাথে সাথেই একজন
লম্বা শ্যামবর্ণের পুরুষ
দরজা টা খুলে দিলো। দেখে সাকিব
বুঝতে পারলো যে ইনিই তনিমার বাবা।
তাকে দেখে সাকিবের বুকের ভেতর
ঢিপ-ঢিপ শুরু করল। সাকিব কোন রকমে বলল
যে "আমি তনিমার বাবার
সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।"
লোকটি শক্ত কন্ঠে বলল যে "আমিই
তনিমার বাবা। কি বলবে বলো?"
কথা শুনে সাকিবের মুখ শুকিয়ে গেলো।
কি বলবে মাথায় কাজ করছিলো না।
ঠিক সেই মুহূর্তে সাকিব
দেখলো দরজা থেকে একটু
দূরে তনিমা এসে দাড়িয়েছে। তার
চোখেমুখে চিন্তিত আর জিজ্ঞ্যাসু
চাহুনি। কিন্তু তার ঐ নির্মল সুন্দর মুখটির
দিকে তাকিয়ে সাকিবের সব ভয়
ভীতি কোথায় হারিয়ে গেলো। ঐ
মুখটি সারাজীবন দেখার জন্য
যা করতে হয় সে আজ তাই করবে। সাকিব
দৃঢ় কন্ঠে বলল
যে "আমি তনিমাকে অনেক
ভালোবাসি।
আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।"
তনিমার বাবা সাকিবের
কথা শুনে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। ডান
হাত তুলতে গেলেন সাকিবকে চড়
মারার জন্য। সেই সময় তনিমা দৌড়
দিয়ে এসে তার বাবার বাম
হাতটি ধরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। আর
টলমল চোখে বলতে লাগলো "আব্বু।
মারলে আমাকে মারো। কারণ আমিও
ওকে ভালোবাসি। "
তনিমার বাবা অবাক দৃষ্টিতে মেয়ের
মুখের দিকে তাকালেন। তারপর দু হাত
ধরে মেয়েকে উঠিয়ে বললেন
যে "তনিমা। তুই আগে আমাদের কেন
বলিসনি যে তোর পছন্দ আছে!!"
তনিমা কান্না কান্না চোখে বলল "
আব্বু। তোমরা কষ্ট
পাবে মনে করে আমি তোমাদের
কাছে কিছুই বলিনি। "
তনিমার বাবা হাসিমুখে বলল "
আরে পাগলী তুই
যেখানে সুখী হবি সেখানেই
তো আমাদের সুখ।"
তনিমা এই কথাটা শুনে তার
বাবা কে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।
তনিমার কান্না দেখে সাকিবও তার
কান্না আটকাতে পারলো না। সেও
তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের
কোণা দিয়ে বেয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু
অশ্রুকণা মুছতে লাগলো।
তবে এ কান্না দুঃখের কান্না নয়। এ এক
বিশাল প্রাপ্তির কান্না। এ
কান্না সুখের কান্না।