মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৪৭- অসম্পূর্ণ সত্ত্বা

লিখা :- অর্থহীন অমিত

[ ১ ]

হাসপাতালের করিডোর বেয়ে ১৭ নাম্বার কেবিনটা দাড়িয়ে। অন্যসব সব কেবিনের মতই এর রংটা সম্পূর্ণ সাদা অর্থ্যৎ কেবিনের দেয়াল,চাদর,জানালার পর্দা এমনকি ফুলদানিটাও সাদা রঙের। তবে পার্থক্য হচ্ছে এই কেবিনে শুয়ে থাকা মানুষটার গায়ের রং ফ্যাকাসে আর চোখের নিচটা কালো বর্ণের। পৃথিবীর সাথে পার্থক্যটা অনেক আগেই ধরা পড়লেও আজকাল এই খুব পরিচিত কেবিনটার সাথেও মনোমালিন্য হচ্ছে তুহিনের। কেনো জানি মনে হয়, এই কেবিনটাও তাকে আর চায় না। সারা দিন শুয়ে কাটে। নেবুলাইজারটা পাশেই পড়ে থাকে আর এর পাশে অক্সিজেনের বড় বড় বেশ কয়েকটা সিলিন্ডার, দেখে মনে হয় তাকে পাহারা দিচ্ছে। মাথার পাশে ছোট একটা টেবিল তার উপর ফুলদানিটা রাখা, ফুল গুলো প্লাস্টিকের। তবে ঐ সব ছাপিয়ে টেবিলের উপরের গ্লুকোজের প্যাকেট আর ইঞ্জেকশন গুলো নিজেদের দাম্ভিকতা প্রকাশ করছে বেশ শক্ত ভাবেই। সচরাচরের মতো আজো প্রায় নির্ঘুম রাত কেটেছে তুহিনের। একলাই পরে থাকে সে, বাবার ছোট সরকারী চাকরি তাই চাইলেও প্রতিদিন সেই রশিদপুর থেকে রাগীব আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে পারেন না। মাঝে মাঝে বাবার জন্য তুহিনের ভীষন কষ্ট হয়। তাদের সহায় সম্পত্তি যা ছিলো সব শেষ হয়ে গেছে তার এই মরনব্যাধির পিছনে আর এখন ঋণের জন্য দৌড়াচ্ছেন এখান থেকে ওখানে।

তুহিনের কেমোথেরাপি চলছে। কেমোর রেডিয়েশনে মুখ ঝাঝরা, শরীরে একটাও লোম নেই। বিছানায় পড়ে পড়ে ভেইন দিয়ে স্যালাইন গিলে সে। মাত্র ২ টা দেয়া হয়েছে, বাকী গুলোর জন্য ডাক্তার তাড়া দিচ্ছেন কিন্তু করানো এখনো সম্ভব হয়নি কারণ হচ্ছে টাকা। এই কেবিনটার প্রতিদিনের ভাড়া মেটাতে তার বাবার হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবশ্য কেবিনে রাখা ছাড়া আর উপায়ও নেই কারন কেমোথেরাপির রোগীকে বাড়িতে রাখা যায়না, সবসময় নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখতে হয়।

[ ২ ]

আজকাল পুরনো স্মৃতিরা বেশ তাড়িয়ে বেড়ায় তুহিনকে। বিশেষ করে কলেজ লাইফের কথা বেশ মনে পরে তার। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, খুনশুটি এগুলোতে একসময় বুদ হয়ে থাকা ছেলেটা আজ বড্ড নি:সঙ্গ আর নিশ্চুপ। বন্ধুদের সাথে যে এখন কথা হয় না তা নয় তবে এর পরিমাণ খুব অল্প। সবাই যার যার ব্যস্ততা নিয়ে ভীষন ব্যস্ত। মায়ের সাথে স্মৃতি বলতে শুধু উনার একটা ছঁবি। তার জন্মের সাথে সাথেই মা মারা যান। এতে একটা লাভ হয়েছে তুহিনের, মা বেঁচে থাকলে হয়তো মায়ের সাথে স্মৃতির ভান্ডার বড় হতো আর সেগুলো বড্ড যন্ত্রণা দিতো। মায়ের গায়ের গন্ধটা কেমন ছিলো, প্রায় সে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সে, কিন্তু সান্ত্বনা পাও না।

আরেকটা স্মৃতি আজকাল তাকে বড্ড পোড়াচ্ছে। একটা মেয়ে, মেয়েটা তার পাড়ার স্কুলে পড়তো। কলেজ থেকে ফেরার সময় প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে উপস্থিত হতো তুহিন। কোন কোন দিন আড় চোখে অজস্র কথাও হতো তাদের। তার পর হঠাৎ একদিন,

-- আপনি প্রতিদিন এই জায়গায় দাড়িয়ে থাকেন কেনো??

তুহিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

- না মানে এমনেই

-- হুম

- আসলে আমি আপনাকেই খুঁজি।

-- কেনো??!!

- জানি না, তবে এই প্রবলেমটা হচ্ছে এইবার পহেলা ফাগুন থেকে। আপনার কন্ঠে কবি গুরুর গান মুগ্ধ করেছিলো সেই দিন।

-- হুম

ব্যাস এতোটুকুই, সেইদিন আর কোন কথা হয়নি, মেয়েটা চলে গিয়েছিলো। তুহিন প্রতিদিন স্কুলের সামনে দাড়িয়ে থাকতো, মেয়েটা তাকে দেখে হাসতো। হঠাৎ এক দিন একটা চিঠি। সারা রাত বুক পকেটেই ছিলো চিঠিটা তুহিনের। পরেরদিন একটা গোলাপ নিয়ে দাড়িয়ে সে।মেয়েটা আসতেই সে বললো,

- হৃদিকা, আসলে প্রথম প্রেমের চিঠিতে দু-চারটে বানান ভুল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

-- আমি কি করবো বলো, এতো বকা খাই কিন্তু বানান ঠিক হয়না। কয়টা বানান ভুল??

- দুটো।

-- তাও কম

পকেটে রাখা গোলাপটা এগিয়ে দিয়ে তুহিন বললো,

- এই গোলাপটা তোমার জন্য।

ভীষন লজ্জা পেলো হৃদিকা, তার খাতার ভাঁজে রাখা গোলাপটাও ঠিক তার মতোই লজ্জা পাচ্ছিলো। সেদিন দুটো মানুষ তাদের বিশুদ্ধ ভালোবাসা দিয়ে নিজেদের পৃথিবী গড়ে নিবে, সেই বিশ্বাসের অস্তিত্ব দু-জোড়া চোখে জানান দিচ্ছিলো দৃঢ় ভাবেই।

অসুখটা জানার পর নিজে থেকেই সরে আসে তুহিন। জেনে শুনে কারো জীবন অন্ধকারে ঢেলে দেয়া ভীষন পাপ। হাত ধরে অনেক কেঁদেছিলো হৃদিকা সেই দিন, তুহিন নির্বাক ছিলো। প্রথম প্রেমের সেই বানান ভুল করা চিঠিটা আজো আছে তুহিনের কাছে, দুটো বানান আজো ভুল রয়ে গেছে আর সেই গোলাপটা হয়তো খাতার ভাজে শুকিয়ে চ্যাপ্টা।

[ ৩ ]

বৃহঃস্পতিবার রাতে বাবা আসেন শুক্রবার থেকে শনিবারে রাতে বাড়িতে চলে যান। এই সপ্তাহে তুহিনের বাবা এলেন শুক্রবার বিকেলে। ভীষন বিমর্ষ দেখাচ্ছিলো উনাকে। লাস্ট কয়েকটা মাসে আজই প্রথম কিছু একটার ভয় দেখতে পেয়েছে তুহিন তার বাবার চোখে।

- কি হয়েছে বাবা??

-- কই!!!!

- তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?

-- গাধা, আমি ডাক্তারের রুমে গেলাম।

তুহিন ঠিকই বুঝতে পারে তার বাবার অস্পষ্টতা। টাকা যোগাড় হয়নি, তাই বাকী কেমোথেরাপি গুলো এখন দেয়া হবেনা। সারা রাত দুশ্চিন্তা করে করে এক অসুস্থ সন্তানের পিতার চেহারা খারাপ হয়ে যাওয়াটা খুব অদ্ভুত কিছুনা। বাবা ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। ডাঃ মাসুদ আহমেদ। তুহিন সেই প্রথম থেকেই উনার তত্ত্বাবধানে আছে। এখন পর্যন্ত বেঁচে থাকার পিছনে উনি পুরোটাই দায়ী। এই মানুষটার একটা গুণ তুহিনকে মুগ্ধ করে, আর সেটা উনার হাসি মুখ। খুব মিষ্টি শাসন দিয়ে ভুলিয়ে দেন প্রশ্নবোধক জীবনের আর মাত্র কয়েকটা দিন। তুহিনের খুব শখ এই হাসিটা মুখস্থ করার কিন্তু হয় না। ডাক্তার আংকেল রিপোর্ট নিয়ে কিছু সময় ঘাটাঘাটি করেন আর পাশে স্থীর হয়ে দাড়িয়ে বাবা সময় গুনেন। যদি ডাক্তারের মুখ থেকে আচ্ছা শব্দটা বের হয় সে আশায় অপলক তাকিয়ে থাকেন উনার মুখের দিকে।
ডাক্তার আংকেলকে প্রায় বেঁচে থাকার প্রশ্ন করে সে।

- আংকেল

-- হ্যাঁ বাবা

- বাঁচবো?

তখন মাসুদ আংকেল আবারো তুহিনের বায়োপসি বনম্যরো টেস্ট কিংবা ফাইন নিডল এসপিরেশনের রিপোর্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি।করেন। তার পর একটা হাসি দিয়ে বলেন,

-- সবই ঠিক তোমার, তবে এই বোকার মতো কথা কেনো??

তুহিন এতো কিছু বুঝেনা, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার আংকেল হাসেন, হয়তো এই হাসির আড়ালে চাপা কষ্ট লুকান।

[ ৪ ]

বাবা পাশে থাকলে রাতে, মৃত্যু ভয়টা ঝাপটে ধরেনা তুহিনকে। আজো প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ করেই কান্নার শব্দে চোখ খুলে তুহিন। বাবা, পাশে বসে অঝোরে কাঁদছেন। বড্ড অসহায় লাগে তার তখন, নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট একজন মনে হয়। তুহিন কিছু বলেনা, সে অশ্রু শূন্য। হয়তো ডাক্তারের কাছ থেকে নেগেটিভ কোন কিছু জানতে পেয়েছেন, হয়তো উনার বংশের নিভু নিভু প্রদিপটার আবারো নিভে যাবার আশংকা দেখা দিয়েছে। বাবা এভাবেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েন শুধু জেগে থাকে তুহিন। এক সময় আযান দেয়, আলো ফুটে চারিদিকে। বেঁচে থাকার পেন্ডুলামে আরেকটা দিনের শুরু। ছোট্ট কেবিনটার জানালা দিয়ে এক চিলতে যে আকাশটা দেখা যায় তা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয় তুহিনের চোখে। মাঝে মাঝে এইসব কিছু তুহিনের অহেতুক মনে হয়, এই চিকিৎসা, ডাক্তার আংকেলের সান্ত্বনা অথবা এই মিথ্যে কথার শহর।

তুহিন তবুও স্বপ্ন বুনে, একদিন এই মিথ্যের পুরোটা আবয় জুড়ে বৃষ্টি হবে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাবে খুব ব্যস্ত এই শহরটার রাস্তা, কোথায় মৃদু বাতাসে দোলা খাওয়া কয়েকটা বর্ষার প্রথম কদম, ঘুলঘুলিতে আশ্রয় নেয়া চড়ুইজোড়া আর হয়তোবা সেই মেয়েটিও। তখন সে থাকবে কিনা জানে না তবে সে খুব করে চায়, সেদিন তার সত্ত্বাটার স্নান হবে। কারো নিউরণে হয়তো তার স্মৃতিরা আন্দোলন করবে। কেউ হয়তো তার কথা ভেবে খুব গোপনে ফেলবে কয়েকফোঁটা অশ্রু। সেই কেউ হয়তোটা হয়তোবা তার ঋণের চাপে ভেঙ্গে পড়া নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা, হয়তো ডাক্তার আংকেল, আর না হয় প্রথম প্রেমের বানান ভুল করে লিখা চিঠির সেই মেয়েটা।