মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২৬৯- শুধুই মায়ের দীর্ঘশ্বাস

এই রোহান! রোহান! উঠবি?, নাকি দিব
পানি ঢেলে?” মায়ের
মুখে পানি ঢালার কথা শুনে লাফ
দিয়ে উঠে বসে রোহান।
সে ভাল করেই জানে যে আর এক মুহূর্ত
দেরি করলে সকালের
গোসলটা তাকে বিছানাতে সারতে হবে।
” আম্মু, আর একটু
ঘুমাই না?” রিহানের গলায় আহ্লাদি সুর।
” হুম , অনেক
ঘুমিয়েছো হয়তো এভাবেই কষ্ট আর
ক্লান্তহীন পরিশ্রমে ছোট
থেকেই বড় করেছে ছেলেটাকে।
ছেলেটার
বাবা মারা গেছে অনেক আগেই মা ই
ওর সব।
.
কিন্তু, পরিস্থিতির
দমকা ঝড়ে যে কি হয়ে গেলো, কিছু
বুঝে উঠার আগেই সব
ভেঙে পড়েছে দুমড়ে-মুচড়ে।
.
একা থাকাটা এখন আর কোনো ব্যাপার
না রমা বেগমের
কাছে। মোটামুটি অভ্যেস হয়ে গেছে।
কেউ এ
নিয়ে আফসোস করলে রমা ছোট্ট
করে হাসে। আমার
কিন্তু কিছুই মনে হয় না।_ বলেন কি? এতবড়
বাড়িটাতে সারাটা দিন একা.. কেমন
যেন মনঃক্ষুণ্ন
আপনজন। করুণার দৃষ্টি পড়ে রমার মুখের
ওপর।
.
রমা একদম সহ্য করতে পারে না এই করুণা।
অথচ এজন্য
কারো সঙ্গে রূঢ় ব্যবহারও
করতে পারে না।
সে স্বাভাবিকভাবেই বলে_
সংসারের কত কাজ
আছে না...একা থাকলামতো কি?
.
আমাকে তো করে খেতে হয়। আর আমার
পড়াশোনা...দেখ
না কত বই পড়ে আছে।
পড়া হয়নি বলে শেলফে ওঠাতে পারছি না।
_ এখনো এসব
করতে পারেন। আহারে! এ বয়সে কোথায়
একটু সুখ
করবেন...বউর হাতের
রান্না...তা কপালে না থাকলে কিছুই
হয় না..আবার সেই
করুণা।
কি আর করা যায়।রমা হালকাভাবেই
নেয় সব।
মানুষের কথায় এত দোষ ধরে লাভ কি?
মিছেমিছি কষ্ট
পাওয়া। মানুষতো বলবেই।
যেখানে যে কথাটা বলার
তা বলে যদি কেউ স্বস্তি পায়তো পাক।
রমার
বদহজম হয় না। কথা হজমের শক্তিটা বয়স
বাড়ার
সঙ্গে বেড়েই চলেছে।
.
ক'দিন হলো ছোটভাই # অভ্র
এসেছে বউবাচ্চা নিয়ে। থাকে পূর্ব
আমেরিকায় বাঙালি অধ্যুষিত
এলাকায়।
প্রতিবছর একবার আসে। দেশের টান খুব
ভাইটার।
তাছাড়া বাচ্চাদের দেশ
চেনাতে হবেতো। বিদেশ
বিভূঁইয়ে জন্ম,
বেড়ে উঠলোতো কি তাদের
শেকড়তো বাংলাদেশ।
মনে মনে হাসে রমা।
.
ভাইটার জন্য তার দুঃখ হয়।
বউবাচ্চাকে দেশ চেনাবার
কি ব্যর্থ প্রচেষ্টা তার।
বউটাতো আধা ইংরেজ।
সিটিজেনশিপ মেয়ে। তার তিন পুরুষ
লন্ডনেই আছে।
বাচ্চাদেরও সেরকম করে তৈরি করছে।
এর মাঝে কি যেন
একটা গর্ব অনুভব করে। কী সেটা।
খোলাসা করে কখনো অবশ্য বলে না।
তবে তার
হাবভাবে সেটাই প্রকাশ পায়। মা-
মেয়েরা সারাক্ষণ
ফটফট ইংলিশ বলে, সারাক্ষণ
শোঁ শোঁ করছে। পরিষ্কার
কিছু বোঝাও যায় না। বলবিতো একটু
পরিষ্কার করেই বল।
মনে মনে বলে রমা। ওখানকার লোকাল
ইংলিশ। এরকমই
নাকি। ওরা নিজেরা বুঝলেই হলো।
.
খাবারের বেলায়ও
সেই একই অবস্থা। কত রকম মেনু করে রমা।
ভাইপোকে তবু
কেএফসিতে দৌড়াতে হয়। পিজা,
বারগার, ড্রাই চিকেন এসবেই
আসক্তি তাদের।
.
ক্যান্ডির বিরিয়ানি অবশ্য সবারই প্রিয়।
ভাইটা প্রায়ই লাইন ধরেছে জি.ই.সি র
রেস্তোরাঁয়।
না ধরে উপায় কি?রমা একা মানুষ।
সবদিকতো সামাল দিতে পারে না।
তিন
বাচ্চা নিয়ে ওরা পাঁচজন।রমার ব্যস্ত
সময়
কাটছে। সারাক্ষণ
চলে এটা ওটা খাবারের আয়োজন।
ওরা চেখে দেখুক বা না দেখুক
রমাতো মন
বোঝে না। আর ভাইটাও তো তার
ভোজনরসিক।
ছোটবেলা সে কি পছন্দ
করতো না করতো সেসবই
রমার মনে ওঠে সারাক্ষণ। যত
দেশি খাবারে ভাইটার দুর্বলতা রমার
মতো ভালো তা আর কে জানে। এই
ক'দিনে সবই
সে খাইয়ে দিতে চায় তার ভাইকে।
বোনের
হাতে তৈরি সব মুখরোচক খাবার
পেয়ে সেও উৎফুল্ল।
বলে কেউ না খাক। কিচ্ছু নষ্ট করো না।
সব তুলে রাখ।
.
আমি খাব। কত রকম মন্তব্য তার খাবার
নিয়ে। _এত কষ্ট
করেছ তুমি। এত সুন্দর ভাপা পিঠা। এত
সফট হয় কি করে।
তোমার ওই ফিরনির স্বাদই আলাদা। অন্য
বোনরা তো এমন
রাঁধতে পারে না। আর আলু ভাজি।
তোমারটা খাওয়ার পর
আর কারো তা খেতে ইচ্ছে হয়? এত
ঝরঝরে হয় কি করে?
রান্নার ফাঁকে, খাবারের
ফাঁকে গল্পেও মশগুল হয়ে যায়
ভাইবোন। ছোটবেলার কত কথা...মার
কথা, বাবার কথা,
অন্য ভাইবোনদের কথা...সব...।রমার সেই
ভাইটা বউটাও তার জন্য
দুঃখ করছে।
রমার কাছে সেটা করুণাই মনে হচ্ছে।
আবার
অন্যভাবেও ভাবতে চেষ্টা করছে সে।
তার চেয়ে কম
করেও চৌদ্দ/পনের বছরের ছোটভাইটা।
.
সেইতো কোলে কাকে নিয়ে বড়
করেছে। মা সব সময়
বলতেন_ রমার ঋণ কোনোদিন শোধ
করতে পারবি না। তোর জন্মের
পরতো আমার
শুধু রোগ আর রোগ। ওর কোলে কোলে তুই
বড় হয়েছিস।
তোকে খাওয়ানো, গোসল, ঘুম
পাড়ানো সবই ও করেছে।
কে জানে মার এসব কথা থেকেই
ভাইটা তার
কথা বেশি ভাবে কিনা। তারপরও
নিজের বর্তমান
নিয়ে কিছুই বলতে রাজি নয় রমা।
সে চেপে যেতেই
ভালোবাসে। একা থাকাটা এখন আর
তার
কাছে কোনো ব্যাপার নয়। সে এটাই
ভাবতে চায়।
.
চায়ের কাপটা হাসিমুখে ছোটভাইয়ের
বউর
দিকে এগিয়ে দেয় রমা। আরে রাখেন
আপা।
আমি তুলে নেব। আপনাকে আর কষ্ট
করতে হবে না।_
আরে কষ্ট কি।
তোমরা আসছো...কী যে ভালো লাগছে...।
নেও, ধর। এই কফির মগটা কিন্তু তোমার
দুলাভাইয়ের
একেবারে শেষ সময়ে কেনা। ক'দিন
পরইতো চলে যায়।
কথাটা বলে খানিকটা চুপ
করে থাকে রমা।
_যত্নে রেখে দেবেন দুলাভাইয়ের
হাতের জিনিস।
_ কি লাভ বল। আমি যতদিন আছি...তারপর
কোথায়
কি যাবে...কে এসব দেখে রাখবে।
দীর্ঘশ্বাস চেপে যায়
রমা।
.
ছোটভাই আসা অবধি একটা কথাই
বলছে...ভালো দেখে একটা লোক রাখ।
এভাবে একেবারে একা থাকা ঠিক
না। তাছাড়া তোমার
এখন আরাম-আয়েশের দরকার। এত
কাজইবা করবে কেন?
_আরাম-আয়েশের কথা বাদ দে।
তবে লোক একটা খুঁজছি।
একটা ভালো লোক। পেলেই
রেখে দেব।
হাটবাজারে যেতেও কেউ
সঙ্গে থাকলে মন্দ হয় না।
_হাটবাজারও করো বুঝি?
_না করে উপায় কি? অভ্যাসটাই
তো খারাপ হয়ে আছে।
সারাজীবন
ভালো জিনিসটা খেয়েছি।
ছেলেওতো দেখে আনতে পারতো না।
নিজে না গেলে টাকাটাই মাটি।
ভাইটার মুখ বিবর্ণ হয়। রমার আবার হাসে।
_এই,
আমাকে নিয়ে এত কি ভাবিস।
আমারতো বেশ
চলে যাচ্ছে।
_চলেতো যাচ্ছে। কিন্তু
পড়ে গেলে কে দেখবে। হতাশার
সুর ভাইয়ের।
_আরে, দূর পড়ব না। দেখিস আমি চলার
মধ্যেই যাব। তোর
দুলাভাইয়ের মতো।
মন খুলে হাসতে চায় রমা। কোনো কষ্ট
বুকে চেপে রাখতে চায় না সে।
সে চায় না, তার স্ট্রোক
করুক। অসময়ে চলে যাক।
কিংবা প্যারালাইজড
হয়ে বিছানায় পড়ে থাকুক।
পড়ে থাকলে সত্যিইতো তাকে দেখবে কে?
.
মনের জোর আছে রমা।
ভাইটা কেনইবা এত
হাহুতাশ করছে। সবেতো তার বয়স ষাট।
সেদিন কোথায়
যেন পড়ল। বিদেশে কোথায় এক
জরিপে দেখা গেছে,
পঞ্চান্ন থেকে ষাট এই
সময়টাকে বেশিরভাগ মানুষ
মধ্যবয়স বলে মনে করে, বৃদ্ধ নয়। তবে আর
কি?
রমাতো এখনো মধ্যবয়সেই আছে। তার জন্য
এত
চিন্তা কি। ছোট ভাইটা খামোকাই
ভাবছে এত। যত
ভাবছে রমার জন্য করুণার পাত্রটাও তত
ভারী হয়ে উঠছে।
.
ছেলের ওপরও কম ত্যক্ত-বিরক্ত হয়নি রমার।
মার
সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছিল ছেলে।
একটা বছর বউ
বাপের বাড়ি পড়েছিল। আসবে না সে।
তার
আলাদা সংসার চাই। শাশুড়ির
সঙ্গে থাকতে তার
ভালো লাগে না। গোঁ ধরেছিল
ছেলেও_মা বেঁচে থাকতে কখনো আলাদা সংসারে যাব
না আমি।
এখানেই ফিরে আসতে হবে তোমাকে।
কিন্তু তার
অঙ্কে ভুল ছিল।
.
যতটা শক্তভাবে সে বউকে কথাটা বলেছিল
ততটা শক্ত
সে থাকতে পারেনি।
সে বউকে শ্বশুরবাড়িতে ঠিক
টাকা পাঠিয়েছে। বউ ফোন
করলে ফোন ধরে ঘণ্টার পর
ঘণ্টা কথা বলেছে। যেন কোনো কিছুই
হয়নি। তবে আর মার
জন্য মায়া দেখানো কেন? কেন এ করুণা।
ছেলের
রাতজাগা, অবেলায় ঘুমানো, ছুটির
দিনে বাইরে গিয়ে বউর
সঙ্গে দেখা করা...সবই
বুঝতে পারতো রমার। খারাপ
লেগেছে তার।
সে তো ছেলের ওপর নির্ভরশীল না।
তবে কেন তার জন্য
বউ-ছেলের এ লুকোচুরি খেলা। ছেলের
এমন
ভালোবাসা তার
কাছে করুণা ছাড়া কিছুই না।
একটা বিষফোঁড়া তার
শরীরে বাসা বেঁধেছিল। বড় কষ্ট
পেয়েছে সে। শেষ পর্যন্ত শক্ত
হাতে সেটাকে উপড়ে ফেলেছে।
রমার চোখ
দুটো ছলছল করে। একা থাকার কষ্টে নয়।
মৃত স্বামীর
প্রতি কৃতজ্ঞতায়। মানুষের
মতো বেঁচে থাকার
সংস্থানটুকু তার জন্য সে রেখে গেছে।
না হলে কি হতো।
ঠিক উল্টোটি হতো। ছেলের
সংসারে সে বিষকাঁটা হতো। আর
সে কাঁটাকে ওপরে ফেলতে ছেলেই
তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতো।
বোনের চোখের ছলছল দৃষ্টি ভাইটার
কাছে কোনো অর্থ
করে কে জানে। বোনের কাছে আর
একটা আবদার
করে সে...আপা, তুমি আমার সাথে চল।
আমার ডুপ্লেক্স
বাড়িটাতো খালিই পড়ে আছে।
ওখানে চেনা পরিচিত
সবাই। তোমাকে দেখাশোনার লোক
ঠিক করে দেব। এই
শহরে তোমার একমাত্র ছেলে তোমার
থেকে দূরে সরে থাকবে এটা কেমন
দেখায়।
.
লোকেইবা কি বলবে। হাসে রমা, তার
সেই সরল
হাসি। এ হাসির
অর্থটা কখনো খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় তার
ছোট্ট ভাইটির।
রমা তাকে বোঝায়...দিন
বদলে গেছে। এটাই এখন বাস্তব।
আমাকে আমার
মতো থাকতে দে। কোথাও যেতে বলিস
না। এখানেই
আমি ভালো আছি। মায়েরা এখন
এভাবেই ভালো থাকে। শুধুই
ফেলে যায় দীর্ঘশ্বাস আর সুখী থাকার
মিথ্যে নাটক..........
.
--------
লেখা -
অন্ধকার আকাশ্