লেখাঃ প্রদীপ্ত চৌধুরী
- সরে বসেন।
: কেন?
- বসব।
: এটা তো মহিলা সিট না।
- তবে আপনারটা কি পুরুষ সিট?
: না, তবে আপনাদের জন্যে তো সামনের সিটগুলো।
- কচু, পাবলিক বাসে সব সিট সবার।
: আচ্ছা, ঠিক আছে আমি উঠছি।
- কেন? উঠবেন কেন? আমার কি বসতে দুইটা সিট লাগে?
: না, তবে...
- কোনো কথা নেই, চুপ করে বসেন।
ছেলেটা আর কোনো কথা বলে না। কেন যে কথা বলে না তা সে জানে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মেয়ে, তারপরো তার শাসন মেনে নেয়। হয়তো, কেউ কেউ এত মিষ্টি করে শাসন করতে পারে যে, ‘যাহ্ দুষ্টু' কিংবা ‘মাইর দিবো' শব্দগুলো শুনতে দ্বিতীয়বার দুষ্টুমি করার ইচ্ছাটা দমিয়ে রাখা যায় না।
ওটা ছিল তৃতীয় দিনের ঘটনা। প্রাপ্তি ছেলেটাকে প্রথম দেখে এই বাসস্টপেজে আরো দুদিন আগে। বাবু-বাবু চেহারার ছেলেটা, কিন্তু চোখে-মুখে চিন্তার ইয়া-বড়ো একটা সাগর তার। এতো চিন্তা-চিন্তা ভাব এইরকম বাবু চেহারার সাথে ঠিক যায় না। বরং, এসব বাবু চেহারার ছেলেদের গাল দুটো টিপে দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে,‘এই বাবু ক্যাডবেরি নেবে?' কিন্তু, কেন যানি এই বাবুগুলাই ক্যাডবেরির কথা শুনলে লাফিয়ে উঠে। এমন ভাবে লাফ দেয় যেন মনে হয় ছোটবেলার ক্যাডবেরি খাওয়া পোকা ধরা দাঁতের ব্যথাটা এইমাত্র শির-শির করে উঠলো।
- এই আপনি বসে আছেন কেন?
: মানে?
- আমি দাঁড়িয়ে আছি।
: তো? বাসের মামা তো আপনাকে বলেছিল সিট নেই।
- মিথ্যা বলেছিল।
: মানে?
- সিট আছে, কিন্তু খালি নেই। এখন তাড়াতাড়ি করে উঠে বসতে দেন তো।
: মানে?
- এতো মানে মানে করেন কেনো? এটাতো স্বাভাবিক ভদ্রতা। একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে সিট ছেড়ে দিতে হয়। উঠুন বলছি।
ছেলেটা আর কথা বাড়ায় না। সিট ছেড়ে দেয়। মেয়েটা বসে। এমনিতেই সিট খালি দেখে মেয়েরা বাসে ওঠে। তারপরো আজ প্রাপ্তির প্রথম বারের মতো সিটে বসার আনন্দ হয়। কেমন যেন জয় করার আনন্দ। আরো ভালো লাগে বাবু-বাবু মুখটা কাচু-মাচুতে ভরে যেতে দেখে। ছোট মানুষগুলোর মুখটা শুকিয়ে গেলে কেমন যেন তাতে একটা মায়া পড়ে। আর সেই মায়ায় বারবার যেন একটা আদরের ছায়া থাকে।
- আপনি প্রতিদিনই কেন বাসে যান?
: হুমম?
- রিকশা, সি.এন.জি. নিয়ে যান না কেনো?
: এমনি।
- এমনি কিছু হয় না কি? আপনি আমাকে দেখার জন্য বাসে আসেন।
: কী! কী সব বলেন?
- তাইলে আজ রিকশায় চলেন।
: আপনি এত অসংগত কথা বলেন কেন? আপনার ইচ্ছা হলে আপনি যান।
প্রাপ্তির ভীষণ রাগ হয় ছেলেটার উপর। কত ইচ্ছা ছিলো শুধু একটু পাশাপাশি বসে যাবে। নাহ্ লোকদেখানো জড়াজড়ি জিনিসটা প্রাপ্তির ঠিক পছন্দের না, শুধু পাশাপাশি বসবে, অল্প একটু দূরত্ব রেখে। হুডটা খোলা থাকবে, নামাবে না। ডাস্টবিনগুলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অজান্তে ছেলেটা প্রাপ্তির ওড়নার কোনা তুলে নাকে ধরবে। যেদিন খুব বৃষ্টি হবে সেদিন আইসক্রিম খেতে খেতে হুড উঠানো রিকশায় ভিজবে। ধুর, এটা তো বোকারা ও বোঝে। ছেলেটা আসলে বোকা না, ও একটা ভেড়া। প্রাপ্তি হেসে ফেলে। ছেলেটার দিকে আরেকবার তাকায়, আর চোখ নামিয়ে আরেকবার হাসে। প্রাপ্তির হাসির শব্দে এবার ছেলেটা তাকায়। কেমন যানি ভেড়ার মত চাহনি, শুধু গায়ে সাদা সাদা লোম নেই। থাকলে ভালোই হতো প্রাপ্তির, সকল বিকাল নিয়ম করে আঁচড়ে দিতে পারতো।
আরেকদিন।ক্যালেন্ডারের হিসাবে, ফেব্রুয়ারির ৯। মোটামুটিরকম ফাঁকা বাসস্টপেজ। বাসের জন্য অপেক্ষা। হঠাৎ প্রাপ্তি প্রশ্ন করে,
- চকলেট খাবেন?
ছেলেটা চমকে উঠে বলে,
: মানে?
- আজকে চকলেট ডে। জানেন না?
: নাহ্।
ছেলেটা তো দেখছি একটা গাধা। এটাও জানে না। তারপরো, মনে মনে একটু খুশি হয়ে প্রাপ্তি বলে,
- ওহ্, আচ্ছা, তার মানে নেই।
: নেই মানে?
- ও সব আপনি বুঝবেন না। নেন, চকলেট খান।
: না, আমি চকলেট খাই না।
- কেন?
: ওটা, বাচ্চাদের জন্য।
- আপনি তো বাচ্চাই। বড় হলেন কবে?
: মানে?
- তাহলে, আপনাকে সিগারেট কিনে দেই। সিগারেট চলে তো আপনার?
: সিগারেট?
- হুমম, টানেন কি না বলেন।
: নাহ্।
- ভালো। আর কোনোদিন ও টানার চেষ্টা করবেন না। কারণ সিগারেট টানলে ঠোঁট কালো হয়ে যায়। আর কাল ঠোঁট দেখলে আমার বুড়িগঙ্গার পানির কথা মনে পড়ে। বুড়িগঙ্গার পানি এত্তোগুলো পচা। আপনি ওতো গুলো পচা হতে পারেন না। আর হ্যাঁ, আমার ভাড়াটা আজ দিয়ে দেবেন। আপনার জন্য চকলেট কিনতে গিয়ে টাকা শেষ হয়ে গেছে।
‘এই মেয়েটা আসলেই কি একটু-আধটু পাগলী নাকি? নাহ্, মেয়েটা অনেকটা পাগলী, যাকে বলে একেবারে গাছপাগলী। আর এই গাছপাগলীরা ভূতের থেকেও অদ্ভূত হয়।', ছেলেটা ভাবে আর অবাক দৃষ্টিতে পাগলীটার দিকে তাকায়।
প্রাপ্তির হাসি পায়, কাছের মানুষের কাছ থেকে জোর করে আবদার মেটানোর আনন্দের হাসি, তারপরো প্রাপ্তি হাসে না। আচ্ছা, ছেলেটাকে কেনো তার কাছের মানুষ মনে হয়? ছেলেটা কী ভাবে? আদৌ কি ভেড়াটা কিছু ভাবে? প্রাপ্তি এবার আর হাসি চাপতে পারে না। হাসির শব্দে বাসভর্তি লোক ওদের দিকে তাকায়। ছেলেটা এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো, এখন আর চোখ ধরে রাখতে পারে না, নামিয়ে নেয়। ছেলেটা মনে হয় কিছু বুঝতে পারে। 'পারলে পারুক। তাও যদি বুদ্ধুটা একবারের জন্য ও বুঝতে পারে।’, মনে মনে ভাবে প্রাপ্তি।
- আপনি প্রেম করেন না?
: হুমম্ করি।
এতদিন পরে এবার প্রাপ্তি অবাক হয়।
- তাহলে হলুদ শার্ট পরেন নি যে?
: কেন হলুদ শার্ট পরবো কেনো?
- আজ তো পহেলা ফাল্গুন। আজ বসন্তের রঙে সাজতে হয়।
: ওহ্, আমার প্রেমিকা তো পরতে বলে নি। তুমি কেনো হলুদ শাড়ি পরেছো?
- আমার প্রেমিককে দেখানোর জন্য। কেমন লাগছে আমাকে?
: সেটা তোমার প্রেমিককেই জিজ্ঞাসা কোরো।
- আপনি বলেন না।
: কেনো আমি কি তোমার প্রেমিক?
- না, তারপরো বলেন।
: পচা লাগছে।
- কেনো, পচা লাগবে কেনো?
: চুলগুলো বেধে এসেছো কেনো? একেবারেই পচা লাগছে। তারচেয়ে বরং ওদের ছেড়ে দাও। ছাড়া চুলে তোমাকে পরীর মত লাগে।
প্রাপ্তি আরো অবাক হয়। আজ ছেলেটা প্রথম এতো কথা বলেছে। এতো পরিবর্তন কী করে হলো? আসলেই কী ও প্রেমে পড়েছে? তাহলে, কার প্রেমে পড়েছে? এইসব বাবু-বাবু চেহারা ভিতর কোথায় জানি একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে থাকে। আর সে রহস্যের তল সবসময় পাওয়া যায় না। প্রাপ্তির বুকটা কেপে ওঠে, হয়তো অজানা সন্দেহে নয়ত কিছু পাওয়ার আনন্দে। সেদিন আর কথা হয় না। ছেলেটা বাস থেকে নেমে যায়।
আজ শুক্রবার। প্রাপ্তির কলেজ বন্ধ, ছেলেটার ও মনে হয় বন্ধ। কিন্তু তারপরো প্রাপ্তি আজ বাসস্টপেজে যাবে। ঠিক সাড়ে আটটা বাজতেই যাবে। প্রাপ্তি জানে সে নিজেও আর দশটা মেয়ের মত সাধারণ না। কত-কত প্রপোজ করা ছেলেদের ভিড়ে তার কিনা পছন্দ হয়েছে একটা বাবু টাইপ ছেলেকে। এতো এতো ড্যাশিং ছেলের মধ্যে তার কি না মনে ধরেছে একট ভেড়া। নামটা পর্যন্ত জানে না, ফোন নাম্বার তো অনেকদূরের জিনিস। বাসের বাইরে বলতে গেলে কথাই হয় নি। কোনোকিছুই তার হিসাবে মিলে নি। তারপরো তার মনে হয়, ছেলেটা আজ আসবে। কেন যে মনে হয় তা প্রাপ্তি জানে না, তবে ছেলেটা না আসলে প্রাপ্তি অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে। আর কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেলে কাজল পরে ছবি তুলবে। ফোলা চোখের ছবি নাকি দেখতে বেশ লাগে। প্রাপ্তির কোনোকিছুই নিয়ম মেনে হয় নি তাই এবারো হয়তো বেমানান মনের কথা শুনেই সে সামনে এগোবে। সময় হয়ে যাচ্ছে, প্রাপ্তি বেরোবে এখনি, খোলা চুলেই বেরোবে, পরী হয়ে। নাহ্ ও লাল শাড়ি পরবে না, লালপরীকে ওর ছোটবেলা থেকেই বুড়ি-বুড়ি লাগে। ও পরবে নীল শাড়ি কারণ, নীল পরীদের আকাশটা অনেক বড়। আর সে আকাশে কষ্টের মেঘ জমলে তা যেমন একসময় বৃষ্টি হয়ে ঝরে যায়, ঠিক তেমনি ওই আকাশটাতে সূর্য উঠলে তাকে আরো বড়ো, আরো বেশি নীল লাগে।