মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২১৭- মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ

লেখাঃ নীল অধর

=আচ্ছা বলুনতো তেলাপোকার
ক'টি পা?
=স্যার আমি জানতাম
চাকরিটা মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ
পদের।
=বলুন্তো এক আকাশে সর্বোচ্চ
কতটি তারা থাকতে পারে?
=স্যার
আমি মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ
পদের জন্য আবেদন করেছি।
=ঠিক আছে এবার বলুন
ঢাকা শহরে কতটি ট্রাফিক সিগন্যাল
পয়েন্ট আছে?
=স্যার আমি.....
=হ্যাঁ,আমরা জানি আপনি মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ
পদের জন্য আবেদন করেছেন।কিন্তু
আপনি তো কোনো উত্তরই
দিতে পারছেন না।
=স্যার আমি....
=আচ্ছা ঠিক আছে আপনি আসুন।
=স্যার চাকরিটা আমার খুব দরকার।
Next......
চাকরিটা আর হলোও না।জীননের প্রথম
যুদ্ধে হেরে গেলাম।আবার নতুন
করে প্রস্তুতি শুরু করলাম।
আমি জানি মার্কেটিং কাকে বলে?
শপিং কাকে বলে?মার্কেট
সেগ্মেন্টেশন কি?মার্কেটিং এর জনক
কে?এসব আমার জানা।কিন্তু ওসব বাদ
দিয়ে মুখস্ত করতে শুরু করলাম
তেলাপোকার ক'টি পা।গরু,ছাগল,হাস
,মুরগির ক'টি পা সব মুখস্ত করে ফেললাম।
কিন্তু
আকাশে কয়টি তারা থাকতে পারে তার
কোনো উত্তর কোথাও খুঁজে পেলাম না।
আমি গ্রামের ছেলে।বাবা-
মা আমাকে অনেক কষ্ট
করে পড়িয়েছেন।আমি মার্কেটিং এর
ছাত্র।ছাত্র হিসেবে মোটামুটি।প্রতিদ
িন পত্রিকা দেখি আর দরখাস্ত করি।
এইতো কদিন
আগে সরকারি চাকরি করার বয়স তাও
পেরিয়ে গেলো।আমার
বাবা কৃষক,মা গৃহিনী।
'আরতো পারছিনা বাবা,তুই
কবে চাকরি করবি,তোর বাবার বুকের
বেথাটাতো দিন দিন
বাড়িতেছে,ভালো ডাক্তার
দেখানো দরকার।পাড়ার
ছেলেরা পরীকে বড্ড বিরক্ত করছে।
ওরে বিয়ে দেওয়া দরকার আর সুমনের
মাস্টার বাড়ীতে এসে বলে গেছে,নয়
মাসের বেতন বাকী পড়েছে.
কবে চাকরি করবি বাবা?'
মায়ের পাঠানো এমন
চিঠি প্রতি মাসেই
আমি পাই।এখন খাম না খুলেই
বলে দিতে পারি ভেতরে কি লিখা আছে।
প্রতিবারী মাকে লিখে পাঠাই-
'এইতো মা আর কটা দিন পরেই
আমি চাকুরিতে যোগদান করবো।আমার
পদের নাম মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।
অনেক টাকা বেতন পাব।বাবাকে ভাল
ডাক্তার দেখাবো।
পরীরে ভালো ঘরে বিয়ে দেবো।
কটা দিন পরেই সুমনের বেতন
দিয়ে দেবো।'
এবারে মায়ের চিঠির
সাথে একটা ইন্টারভিউ কার্ড পেলাম।
মা'র চিঠি না খুলে রেখে দিলাম।
ইন্টারভিউ কার্ড এ পরীক্ষার
সময়,স্থান,তারিখ দেখলাম।সেই
সাথে মনে করার চেষ্টা করলাম
তেলাপোকা কটি পা?
=আপনি কতো দিন আগে মাস্টার্স পাশ
করেছেন?
=স্যার দু'বছর আগে।
=এর আগে কোথাও চাকরি করেছেন?
=না।
=এতোদিন চাকরি করণ নিই কেন?
=স্যার চাকরি পাইনি।
=বলেন কি!আপনি চাকরি চাকরি পান
নি।আমাদের এখানে আপনার
চাকরি পাকা।জানেন তো আপনার
পদের নাম মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।
=স্যার আমার চাকরি হয়ে গেছে?
=হ্যাঁ হয়ে গেছে।আপনার মত
উদ্যমী,কঠোর
পরিশ্রমী ছেলে আমরা খুঁজছি।
=স্যার কবে জয়েন্ট করতে হবে?
=আপনি চাইলে কাল থেকে জয়েন্ট
করতে পারেন।কাল ঠিক ন'টায়
অফিসে চলে আসবেন।প্রথম অবস্থায়
বেতন ১২০০০/= টাকা পাবেন।
=স্যার আমি কাল ই জয়েন্ট করবো।
=তাহলে টাকাটা নিশ্চয় কাল
নিয়ে আসছেন?
=টাকা!কিসের টাকা!
=কেন আপনি সার্কুলার
ভালো করে পরেন নি?
=সার্কুলার তো...
=এইজে সার্কুলার।এখানে
লেখা আছে জামানত প্রযোজ্য।
আপনাকে জামানত হিসেবে ২০০০০/=
টাকা জমা দিতে হবে।
=স্যার
আমিতো টাকা আনিনি তা ছাড়া লেখাটা এতো ছোট
করে লেখা
যে লক্ষই করিনি।আমি একটু
ভেবে দেখি।
=আচ্ছা ভাবুন।ভেবে জানাবেন।
=আচ্ছা.... .
ভেবেছিলাম প্রশ্নকর্তা তেলাপোকার
ক'পা জিজ্ঞেস না করলেও হাতীর
ক'পা তা জিজ্ঞেস করবেন।আর
জিজ্ঞেস করলেই এক হাত
নিয়ে নিতাম।গড়গড় করে বলে দিতাম
হাতির চারটি পা।কিন্তু হাত পায়ের
কথা না বলেই চাকরি দিল।
এভাবে দরখাস্ত করতে আর ইন্টারভিউ
দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।
এখনো মার চিঠি আসে কিন্তু খুলিনা।
খোলার প্রয়োজন পড়েনা।প্রতি লাইন
মুখস্ত।মেসে থাকি।মেসেও বেশ কয়েক
মাসের টাকা বাকি পড়ে গেছে।মেস
মালিক বলেছে,সামনের
মাসে টাকা না দিতে পারলে ঘাড়
ধরে বের করে দেবে।
lএকদিন গভীর রাতে খুব মনোযোগ
দিয়ে পেপারে সার্কুলার পড়ছি।
দরখাস্ত লিখব এমন
পিঠে একটা ছোয়া পেয়ে চমকে উঠি।
মেসের বড় ভাই।
মেসের সবাই তাকে বড় ভাই
বলে ডাকে।আমিও
ডাকি।
=ভায়া,ওসব দরখাস্ত টরখাস্ত করে লাভ
নেই।
চাকুরির চিন্তা তুমি বাদ দাও।
=কিন্তু আমার তো চাকরি দরকার।
বাবার বুকের
ব্যাথা,বোনের বিয়ে,ছোটো ভাইয়ের
স্কুলের বেতন....
=আমিও এক সময় একটা চাকুরির জন্য
কি না করেছি।
মাইলের পর মাইল হেতেছি,অফিস
থেকে অফিসে গিয়েছি,অনুরোধ
থেকে চোখের জল পর্যন্ত
ফেলেছি,কোন লাভ হয়নি।এই শহরের নাম
ঢাকা।
এখানে সবার মায়া,মমতা,ভালবা
সা ঢাকা থাকে। তুমি স্বার্থ
রক্ষা করলেই
তবে তারা হৃদয়ের ঢাকনা খোলেন।
=তাহলে আমি এখন কি করবো?
=শোনো,ঢাকা শহরের মানুষ
কখনো পিছনে তাকায়
না,খানিকটা দাঁড়ায় ও না।কারণ
কারো হাতে সময় নেই,সবাই ছুটছে।
কোথায় ছুটছে?
কেউ ছুটছে উদ্দেশ্য নিয়ে,কেউ
উদ্দেশহীন ভাবে।আর
এই ছোটাছুটির মাঝেই বেচে থাকা।
=কিন্তু বড় ভাই আমার তো চাকরি....
=খুব দরকার তাইনা?এসো,আমার
সাথে এসো।
=কোথায়?
=আমার ঘরে এসো।
আমি তার পেছন পেছন তার ঘরে যাই।
ঘরের ভেতর
কালো কালো কি যেনো দেখতে পেলাম।
জিজ্ঞাসা করলাম,এগুলো কি?
=কয়লা।
=কয়লা!
=অবাক হয়ে লাভ নেই।এই
কয়লাগুলো পাঁটায়
গড়ো করে তার সাথে একটু
সুগন্ধি মিশিয়ে শিশিতে ভরে তৈরী করি দাঁতের
মাজনঁআম দিয়েছি'বড় ভাইয়ের দাতের
মাজন'...শিশি বিক্রি করছি ১৫
থেকে ২০ টাকায়।
অথচ এটা তৈরী করতে আমার খরচ হয় ২
থেকে ৩
টাকা।প্রতিদিন আমার প্রায় ১০০
থেকে ১৫০
শিশি বিক্রি হয়....আমার আসছে ১৫০০
থেকে ৩০০০
টাকা।দিন দিন
চাহিদা বেড়ে জাওয়ায়
আমি একা পারছি না।যদি তুমি চাও
তাহলে আমার
সাথে কাজ করতে পারো।
=শুধু কয়লা বিক্রি করে....
=ঢাকা শহরের মানুষ চলন্ত অবস্থায়
থাকে।এদের
যাচাই বাছাই করার মত সময় বা সুযোগ
কোনোটাই
থাকেনা।আর লেকচার টা একটু
গুছিয়ে বলতে পারলেই ব্যাস।লেকচার
অবশ্য
আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব.....গলায়
কোম্পানির
পরিচয় পত্র থাকবে। তোমার পদ
হবে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।
এখন আমি মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।
গলায় ছবি সহ
পরিচয়
পত্র,ঘাড়ে একটা ব্যাগ,ব্যাগে বড়
ভাইয়ের
কালো মাজন।আমি মাস্টার্স পাশ।
লেকচার ও দেই
খুব আকর্ষনীয় ভাবে।হুঢ়ুড় করে কয়েক
শিশি বিক্রি হয়ে যায়।
হাতে কাঁচা টাকা আসতে লাগলো।
একদিন
সন্ধ্যা বেলা সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকগুলো গাড়ির
মধ্যে একটা গাড়ীতে উঠে যথারীতি লেকচার
দিলাম।অনেকেই আগ্রহী হয়ে মাজন
কিনল।এসময়
বেশীর ভাগ যাত্রী অফিস
থেকে বাসায় ফেরেন।
লক্ষ করি সিটে বসে থাকা একজন
যাত্রী খুব
মনোযোগ সহকারে আমার
দিকে তাকিয়ে আছেন।এক
পর্যায়ে আমাকে কাছে দাকেন...কাছে জাই...গলায়
পরিচয় পত্র ঝুলছে।লেখা আছে--
মো: রফিকুল ইসলাম,
পরিচালক,বাংলাদেশ ব্যাংক
মতিঝিল,ঢাকা।
আমি খুব সহজেই তাকে চিনলাম।
প্রাইমারি স্কুলে একসাথে পড়তাম।ও
সেকেন্ড বয়
ছিল,আমি থার্ড।
ইচ্ছে হচ্ছিলো ওকে জড়িয়ে ধরি।কিন্তু
কি এক বাস্তবতা আমাকে টেনে ধরলো।

আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
=এই তোমার নাম সুজন না?তুমি সুবর্ণপুর
গ্রামের
প্রাইমারী স্কুলে পড়তে না?
আমি না চেনার ভান করে বলি--
=না।সুবর্ণপুর নামে কোন
গ্রামতো আমি চিনি ই না।
আমাকে আপনি কিভাবে চিনবেন।
মাজন নিবেন নাকি তাই বলেন?
=না মাজন দরকার নেই।কিন্তু তুমি.....
আস্তে আস্তে গাড়ী থেকে নেমে গেলাম।
চোখের সামনে শুধু রফিকের
চেহারা টাই ভেসে উঠছে।কিছুতেই
ভুলতে পারছিনা ....আজ আর
বিক্রি করবোনা ।মেসে চলে এলাম।
এখন আমার হাতে প্রচুর কাঁচা টাকা।
এবার বাড়ী যেতে হবে।
বাবাকে ডাক্তার
দেখাতে হবে,বোনকে একটা ভাল
ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হবে,আর
ভাইয়ের স্কুলের বেতনটাও দিতে হবে।
সেইসাথে ঘরটাও ঠিক করতে হবে।এবার
বাবা মাকে সাথে করে নিয়ে আসবো।
সুমনকে ঢাকার
একটা স্কুলে ভর্তি করে দেব।এখন
ইচ্ছে করলেই দুই থেকে তিন রুমের
একটা বাসা ভাড়া আমি নিতেই
পারি।
ভোরবেলা বাড়ির
উদ্দেশ্যে রওনা দেবো ।এখন বেশ রাত।
মনের ভেতর বাড়ি যাবার
একটা উত্তেজনা কাজ করছে।সময়
কাটানোর জন্য এতদিনের
না খোলা মুরে চিঠিগুলো খুলে পড়তে থাকি।
প্রায় সব চিঠিতে এক ই
বক্তব্ব...একটা চিঠি পেলাম একটু
আলাদা।চিঠিটা এ রকম--
এলাহি ভরসা
বাবা সুজন
আমার দোয়া নিয়ো।অনেকদিন যাবৎ
তোমাকে লিখছি কিন্তু কোন সাড়াশব্দ
পাচ্ছিনা। তুমিকি আমার
পাঠানো চিঠি পাচ্ছোনা?
নাকি তুমি ঠিকানা বদলেছ?
তোমাকে আর টাকা পাঠাতে হবেনা।
তোমার বাবার বুকে আর ব্যাথা নাই।
আর কখনো ব্যাথা হবেও না। তিনি গত
সপ্তাহের প্রথম দিন ইন্তেকাল করেছেন।
তার কিছু গোপন সঞ্চয় ছিল,ইন্তেকালের
সময় সেগুলি তোমাকে দিতে বলেছেন।
সম্ভব
হলে তুমি এসে টাকাগুলি নিয়ে যেও।
এবার তোমার বোনের কথা বলি।
চেহারা মাশা আল্লাহ
ভালো ছিলো। সে একটা ছেলের
সাথে পালিয়ে গেছে।কোথায়
আছে,কেমন আছে কিচ্ছু জানিনা। আর
সুমন জেল খাটিতেছে।
কি কারণে পুলিশ ধরেছে তাও
জানিনা।
আর আমার কথা কি বলবো?
বেচে আছি এখনো। তোমার বাবার
সঞ্চয়গুলা তোমাকে দিয়ে দায়িত্ব
টা শেষ করতে চাই।পত্রটা সুমনের
মাস্টারকে দিয়ে লিখিয়েছি।
ইতি
তোমার মা।
চিঠি হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে চোখের
জল পড়লো ঠিক 'মা' শব্দ টার উপর।
আচমকা চিৎকার করে উঠি,মা...
মা আমি আসছি মা।আমি আসছি।আমার
এখন অনেক টাকা।বাবার
মতো আমি তোমার
বুকে ব্যাথা হতে দেবনা।আমি আসছি।
আমি এখন চাকরি করি মা।আমি এখন
মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ
মা,মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ।