১। সারারাত প্রচন্ড রকম উৎকণ্ঠা নিয়ে জেগে থাকবার মত কঠিন কাজ পৃথিবীতে বোধ হয় আর নেই । যদিও রাতের শেষদিকে এসে আমার চোখে একটু আধটু তন্দ্রা ভাব চেপেছিল , কিন্তু পাশে বসে থাকা মাঝবয়সী লোকটার নাক ডাকার তীব্রতায় সেই ঘুম আর বেশিক্ষন টেকেনি । বসে বসে এমনিতেই ঘুমানো যায়না , কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম আমার পাশের লোকটা রীতিমত নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে গভীর ঘুমে ডুব দিয়েছেন । কিছু মানুষের অতিপ্রাকৃতিক দক্ষতা দেখে আসলেই অবাক না হয়ে পারিনা । কিন্তু পরক্ষনেই সামলে নিই নিজেকে ; কি জানি এমনটা হয়ত হয় – হাসপাতালের এই মাঝারি করিডোরে অনেকখানি উৎকণ্ঠা যেমন আমার চোখদুটোকে নিদ্রাহীন করে রেখেছে , সেই উৎকণ্ঠাই হয়ত এই লোকটির চোখে ঘুম নামিয়েছে । সকাল হলেই হয়ত আবার তাকে অবিরত ছুটতে হবে , নিজেকে বিশ্রাম দেবার সময়টুকু আর পেয়ে ওঠা হবেনা । সাতপাঁচ ভেবে উঠে দাঁড়াই আমি , মাথার দুপাশটায় রাত জাগবার জন্য টিমটিমে ব্যাথা ।
ভোরের আঁধারে ভাবটা কাটিয়ে ঢাকার আকাশে এখন সকালের ছোঁয়া । বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিয়েই কেবিনের দিকে এগিয়ে আসলাম আমি । যতটা সম্ভব কম আওয়াজ করে দরজাটা খুলে একবার তাকালাম – কেবিনের এক পাশে শুভ্র বিছানাটিতে চাদর গায়ে দিয়ে আমার রাজকন্যাটি চারদিকে অবারিত মায়া ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে । আমি একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে যাই । আরেকটু হলেই আমি হয়ত অনেকখানি অন্ধকারের মাঝে আমার রাজকন্যাটিকে হারিয়ে ফেলতাম । জানেন পাঠক, নিজেকে রাজপুত্র ভাবতে বরাবরই প্রচন্ড অনিশ্চয়তায় ভুগি আমি – যুদ্ধে দাঁড়ানোর মত সাহসী হয়ত আমি নই । কিন্তু তবুও আমি আমার এই সামান্যতা নিয়েই এই অভিমানী রাজকন্যার কাছে বারবার ছুটে এসেছি । সে হয়ত একদিন বুঝবে আমার এই ছুটে আসবার কারন , হোক একটু দেরি – আমার যে খুব তাড়া আছে এই কথাটি আমি তো কখনই তাকে বলিনি ।
ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কেবিনের সবচেয়ে কর্নারের জানালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি । বাহিরে প্রচন্ড শীতে কাঁপছে আমার এই এক টুকরো পরিচিত শহর । এমন সকাল আর কয়দিন দেখেছি তা মনে করাটা বেশ কষ্টকর । ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম , তখন আমার বেরসিক ফাইনাল এক্সামগুলো সকাল সাড়ে সাতটা আটটার দিকে হয়ে যেত । আম্মার হুংকার শুনে আমাকে তখন ঘুমঘুম চোখ নিয়েই উঠতে হত আগের রাতের আধা ভাঙ্গা পড়াগুলোতে চোখ বুলানোর জন্য । ক্লাস ফাইভে উঠবার পরেই ছেলে হবার সার্থকতায় আমার স্কুলের ক্লাস গিয়ে গড়ালো দুপুর ১২টায় । তাই কিচ্ছু না বোঝার বয়সেই সকালের সাথে আমার কোনরকম সম্পর্ক হবার আগেই বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল অবলীলায় ।
প্যান্টের পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটাকে সারারাত ঘুম পাড়িয়ে রেখে খানিকক্ষণ আগেই ডেকে তুলেছি । বাসায় কাউকে কিচ্ছু না বলে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়াটা আমার উপর কেমন প্রভাব ফেলবে এই মুহূর্তে সেটা ভাবতে পারছিনা । আর কাউকে নিয়ে ভয় না হলেও আম্মার উপর আমার কোন বিশ্বাস নেই । আমার ডিয়ার ফাদার আম্মার পরিচয়ের সামারাইজ করবার জন্য তাকে একটা উপাধি দিয়েছিলেন । " নারী আগ্নেয়গিরি" নামক সেই উপাধি শুনবার পর আম্মাকে চেনেনা এমন কারোই আর তার কার্যক্রমের ব্যাপারে কোনরকম সন্দেহ জেগে ওঠেনা । আম্মার চেহারাটা মনেমনে ভাবতে ভাবতেই আমি টের পেলাম আমার মোবাইলটা থরথর করে কাঁপছে । মোবাইল একটা যন্ত্র - একটা যন্ত্রের কখনো কোন ভয়ভীতি থাকেনা ; কিন্তু ভয়ে কাঁপবার কথাটা পরোক্ষভাবে হলেও সত্যি , কেননা আম্মার কলেই ভাইব্রেশন হচ্ছে । আমি তিনবার বুকে ফুঁ দিয়ে কল রিসিভ করতেই আম্মার গর্জন শুনতে পেলাম , " এই গাধার বাচ্চা রামগাধা , এই মুহূর্তে তুই কোথায় আছিস ?"
আমি কোন রকম ভনিতা না করে বললাম , " আম্মা , তুমি অবশ্যই জানো আমি কই আছি । তুমি কনফার্ম হয়েই আমাকে ফোন দিয়েছ , ভুল বললাম ? "
এখানে উল্লেখ্য যে , এই হসপিটালের একজন ডাক্তার সম্পর্কে আমার চাচাত ভাই হয় ।
কিন্তু আম্মা আরেকটা হুংকার দিয়ে বলল , " তুই আগে আমাকে বল, মেয়েটা ২০টা ঘুমের ট্যাবলেট কেন খাইল ? আবিদ, বল আমাকে মেয়েটা এই কাজ কেন করল ? চুপ করে থাকলে থাবড়া দিয়ে দাঁত ফেলে দিব !"
- "আমি চুপ করে থাকব না । কিন্তু তুমি বলার স্পেস তো দিবা আমাকে !"
- "অসভ্য ছেলে, তুমি স্পেস চাও ? আমি এতদিন পর মেয়েটার কথা কেন শুনলাম ? মেয়েটা তোর জন্যেই মরতে যাচ্ছিলো, তাইনা ?"
আম্মার কথা শুনে আমি আস্তে করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম । আমি এখন তাকে কেমন করে বোঝাই তার এই প্রশ্নের উত্তর আমি এক কথায় দিতে পারব না । আমি তাকে কেমন করে বোঝাই যে কাল রাত থেকে আমার উপর দিয়ে কি চলে গেছে । আমি তাকে কেমন করে বলি যে তার ছেলেটা এমন কোন রসগোল্লার টুকরা হয়ে উঠতে পারেনাই যে তার জন্যে একটা মেয়ে মরতে যাবে । তারপরও হয়ত আমি কোনকিছুর দায় এড়াতে পারিনা , তাই আড়চোখে ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম , " হ্যা আম্মা । সাবা আমার জন্যেই এই কাজটা করেছে । আমিই দায়ী , শুধুমাত্র আমি ।"
টের পেলাম, আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই আম্মা ফোনটা কেটে দিল । আমি জানি , আম্মা এখন হাসপাতালে আসার প্রস্তুতি নেবে । চোখ খোলা রেখেই আমি দেখতে পেলাম , আম্মা ফোন হাতে নিয়ে বসে থেকেই সিতারা খালাকে বলছে , " সিতারা , ফ্রিজ থেকে বাচ্চা মুরগিটা বাইর কর , আমি স্যুপ রান্না করব । সিতারা , ঐ সিতারা , মুরগি বাইর করছিস ?"
২। সাবার সাথে আমার প্রথম দেখাটা হয়েছিল ভার্সিটির প্রথম দিনে ক্যাম্পাসের টঙ্গে চা খেতে গিয়ে । টঙ্গে বসে একা একটা মেয়ে চা খাচ্ছে ব্যাপারটিতে বিস্ময়কর কিছু না থাকলেও কেন যেন আমার বেশ মজা লেগেছিল দেখে । যদিও ওই সময়টিতে শীতের প্রকোপ কমে গিয়েছিল অনেকটাই , তবুও মেয়েটির সোয়েটার, কানটুপি আর মাফলারের সমারোহ দেখে মনে হচ্ছিল, সে বুঝি সাইবেরিয়াতে বেড়াতে এসেছে । একটু পরপর সে তার চায়ের কাপে হাত ঘষে উত্তাপ নেবার চেষ্টা চালাচ্ছিল – ক্লাসে যাবার কোন তাড়াও দেখতে পাচ্ছিলাম না তার মাঝে । শুধু দেখেছিলাম , তার বাদামী রঙের চশমার মোটা কাঁচের ওপাশটায় কেমন যেন কুয়াশার ভিড় । বুঝতেই পারছেন পাঠক, প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে বেশ অন্যরকমভাবে চোখে পড়েছিল আমার ।
সেদিন টং থেকে বেরিয়ে ক্লাসে যাবার পর আমি আবিষ্কার করেছিলাম , টঙ্গে দেখা সেই মেয়েটি আমারই ক্লাসেমেট । দেখেছিলাম , ক্লাসের শেষ বেঞ্চটিতে সেই কার্টুন কার্টুন মেয়েটি গুটিসুটি মেরে বসে আছে । ভার্সিটিতে সচরাচর দেখা যায় , মেয়েরা প্রথমদিকের বেঞ্চগুলিতেই জায়গা করে নেয় – কিন্তু আমি বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করার পর বুঝতে পেরেছিলাম , এই মেয়েটি আসলে ব্যাকবেঞ্চার । প্রথমদিনই মেয়েটির উপর ইন্টারেস্ট জন্মাবার কারনে কেমন যেন বেখেয়ালেই তার দিকে আমার দৃষ্টি চলে যেত । একই ক্লাসে পড়বার সুবাদে কথা বলাটা হয়ত কোন ব্যাপার ছিল না কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম , মেয়েটা একদমই অদ্ভুত রকমের আজব । সে কারো সাথে মেশেনা – ছেলেরা তো দূরেই থাক , উৎসুক কয়েকটা মেয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলেও তার নির্বাক স্বভাব দেখে পিছু হটে গেছে । সে সবসময় একা একা থাকত – প্রতিদিন প্রথম ক্লাস শুরুর পাঁচ ছ মিনিট পরে পৌঁছে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকত । একা একা ক্লাসনোট তুলত । ক্লাস শেষে মাঝেমাঝে আমি অবশ্য তাকে ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরতে দেখতাম । তারপর একদিন কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে আমি তার সাথে পরিচিত হতে গেলাম ।
-“ এই কেমন আছো ? আমি আবিদ , তুমি ?”
মেয়েটি তখন চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে করতে আমার দিকে না তাকিয়েই বলেছিল ,
“ সাবা ।”
স্কুল কলেজ ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছিলাম আর শুধুমাত্র উত্তরটাই পাচ্ছিলাম । হাল ছেড়ে দেবার টাইম এসে গেছে এটা ভেবে শেষে বললাম , “ আমি কি বিরক্ত করছি তোমাকে ?”
আমাকে ভীষণ রকম টাশকি খাইয়ে সেই মেয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলেছিল ,
“হ্যা করছোতো ! আমি একটুও ফ্রেন্ডলি না, বুঝতে পারোনি ? আমি কারো সাথে মিশতে পারিনা । আমার একাই ভাল লাগে ।”
আমি বুঝতে পেরেছিলাম । তাই কানে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম , তার উপর আর আগ্রহ দেখাব না । কিন্তু কপালে খারাপি থাকলে বুঝি এমনটাই হয় – বেহায়ার মতই আমি তাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়ে বসলাম । তারপর যা হবার তা ই হল , তাজরিয়া সাবা নামের এই অহংকারী মেয়েটা আমাকে ফেসবুকেও ইগনোর করল ।
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতূহল বোধ হয় পূর্বপুরুষ হতে প্রাপ্ত । তাই সাবার মাথার উপর নিষেধাজ্ঞার রেড সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও আমাকে নিয়মিত তার থেকে নিরাপদ দূরত্বে ঘুরঘুর করতে দেখা গেল । ভার্সিটির বিভিন্ন নোটিস জানানোর উদ্দেশ্য নিয়ে আমি প্রায় ই তার বেঞ্চে যেতাম । হাস্যকর ক্লাউনের মত বলতাম , “ এই সাবা , ক্যাম্পাসে কনসার্ট জানো ?”
“ ডিপার্টমেন্টে ফেস্ট আসছে শুনেছো ?” ইত্যাদি ইত্যাদি ।
আর সাবা বরাবর ই কোন দিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলত , “ ও আচ্ছা , জানতাম না ।”
আমি বলবার মত দ্বিতীয় কোন বাক্য পেতাম না , ঘুরে চলে আসতাম । একসময় সাবা বাদে ক্লাস সুদ্ধু সবাই - এমন কি আমি নিজেও টের পেয়ে গেলাম , আমার কপাল পুড়তে চলেছে ।
ক্লাসের সবাই বুঝতে পেরেছিল , সাবাকে কখনো ঘাটানো যাবেনা । সেটা আমিও বুঝতে পেরেছিলাম , কিন্তু কি এক টানে আমি যেন তাকে এড়িয়ে যেতে পারতাম না । হয়তবা আমি তার কুয়াশা ঢাকা চোখের মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম , হয়তবা আমি তার বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলে বাঁধা পড়েছিলাম । অথবা এটাও হতে পারে – আমি হয়ত কখনোই আনন্দ স্পর্শ না করা এই শেষ বিকেলের মেয়েটির গোপন বিষাদের মায়ায় পড়ে গিয়েছিলাম ।
ফেস্টের দিন বিকেলে কোন দিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল আমি ঠিক বলতে পারিনা , কিন্তু আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম সাবা ক্যাম্পাসে এসেছে । নিজের চেহারার প্রতি কখনোই যত্ন না নেওয়া মেয়েটি সেদিন নিজেকে একটু গুছিয়ে আনতেই যেন একরাশ স্নিগ্ধতায় ঝলমল করে উঠছিল । আমি কিছুতেই সেই স্নিগ্ধতা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না ।
সেদিন ছবি তুলতে তুলতে সাবা যখন আমার দিকে এগিয়ে আসছিল ,আমি তখন নিজের হাতের ওপর চিমটি কেটে দেখেছিলাম , ঘটনা আসলেই ঘটছে কিনা । কিন্তু সাবা সত্যিই এসেছিল; আমার পাশে বসতে বসতে বলেছিল ,
“ দেখ আবিদ , আমি কিছু কথা বলব তোমাকে – তারপর চলে যাব ।”
আমি ওর কথার ধরন শুনে হাসি আটকাতে পারিনি , বলেছিলাম , “ আচ্ছা বল কি বলবা ! আই অ্যাম হিয়ার ফর ইয়ু !”
মেয়েটা কয়েকবার চেষ্টা করে বলতে লাগল , “ আসলে আবিদ – আমি জানি , আমাকে ক্লাসের সবাই , তুমি , তোমরা আমাকে অনেক অসামাজিক ভাব – আমি কারো সাথে কথা বলিনা , মিশি না । একা আসি যাই , নোবডি ইভেন নো’জ মাই নেইম । তুমি অনেক মিশুক , তাই হয়ত আমার এমন বিহেভের পরেও কথা বল আমার সাথে । কিন্তু আমি আসলে এটুকুই বলতে চাচ্ছি যে , আমি এরকম ই ।”
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে ওর কথাগুলো শুনছিলাম । একসাথে এতগুলো কথা বলার পরে থেমে গেল ও । আমি চোখ নাচিয়ে বললাম , “ হুম , আমি বুঝেছি তুমি ওইরকম না , যে টা ক্লাসে আমি ভাবতাম – তুমি আসলে এইরকম যে টা এখন আমি দেখছি ! ”
- “ আমি আসলে বলতে চাচ্ছি যে, আমি খুব আনফ্রেইন্ডলি , খুব বোরিং – তাই সবখান থেকে দূরে থাকি । তুমিই একমাত্র কথা বলতে আসো , আমি তোমার সাথেও বাজে বিহেভ করি । তুমি হয়ত মাইন্ড করতে পারো, তাই তোমাকে এটা বললাম । ”
- “ হুম , এখন তোমার কথার পয়েন্ট কি ? আমি এসব মেনে নিয়ে কি তোমার সাথে মিশতে পারি ?”
- “ কেউ পারেনাই , তুমি কিভাবে পারবে ?”
আমার খুব ইচ্ছে করল , প্রচন্ড মায়াবী এই মেয়েটার চুলগুলো ছুঁয়ে দিয়ে বলি – সাবা , তোমার মায়ায় আমি যে বাঁধা পড়ে গেছি , আমি এখন সব পারি । কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না , শুধু একটু হেসে বললাম , “ তুমি একটুও আনফ্রেইন্ডলি না – ওসব বাজে কথা । ”
সাবা আর কথা বাড়ায়নি । আপনমনে কি যেন ভাবতে ভাবতে উঠে চলে গিয়েছিল । শুধুমাত্র রাতে ফেসবুক চেক করতে গিয়ে আমি দেখতে পেয়েছিলাম , আমি তার ছোট্ট জগতটায় একটা জায়গা পেয়ে গেছি ।
সাবা নিজের স্বভাব বদলাতে পারেনি , কিন্তু আমিই ওর সাথে মানিয়ে গিয়েছিলাম । ফলাফল হিসেবে , ওর মনের সাথে আমার দূরত্ব অনেকটাই কমে গিয়েছিল । কথা অনেক কম হলেও আমাকে বেশিরভাগ সময়টাতেই ওর সাথে বসে থাকতে দেখা যেত । আমরা একসাথে হাঁটতাম , ওর বাসা ভার্সিটি থেকে খুব একটা দূরে না হওয়ায় কখনো কখনো ওকে বাসা পর্যন্তও পৌঁছে দিতাম । আমাদের মাঝে দেয়ালটা ভেঙ্গে যাওয়ার একটা সুবিধা এটাই ছিল যে , আমি যা ই বলতাম না কেন, ও সেগুলো শুনত – শোনার পর ছোট্ট করে কিছু একটা বলত ; আমার এতেই যে কি পরিমান শান্তি লাগত আমি সেটা বোঝাতে পারব না কিছুতেই ।
মাঝেমাঝে সাবা খুব দূরে হারিয়ে যাবার কথা বলত । বলত , “ যেতে চাই পাহাড়ের কাছাকাছি , পাশ ঘেঁষে চলে যাবে ছোট্ট একটা নদী । খুঁজেপেতে একটা গাছের ওপর কাঠের পাটাতন বসিয়ে আমি বানিয়ে নেব আমার ছোট্ট ট্রি-হোম । তারপর কাঁদিয়ে ছাড়বে এমন কিছু বই নিয়ে আমি হারিয়ে যাব এই দুনিয়া থেকে , যাকে তোমরা জীবন বলো । মাঝেমাঝে আমার যে কি ভীষণ আয়োজন করে একলা হবার ইচ্ছে জাগে ,আমি যদি সেটা তোমাকে বোঝাতে পারতাম !” ওর কথা শুনে আমি শুন্য চোখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতাম । আমার খুব বলতে ইচ্ছে করত , আমি তোমায় একটা পাহাড় কিনে দেবো । ভালবাসি বলে ফ্রি অফার হিসেবে নদীটা বয়ে যাবে পাশ ঘেঁষে । আর গাছের ওপর পাটাতন বসানোর কাজটাও আমিই করব , বিনিময়ে আমি শুধু গাছের নীচে বসে থাকতে চাই । তুমি যখন বই পড়ে কাঁদতে থাকবে , আমি শুধু তখন নিচ থেকে জিজ্ঞেস করব, “ তোমার কি একটা রুমাল লাগবে ?” আমি কিছুই বলতে পারিনি – প্রিয় পাঠক , সাহসী কেমন করে হতে হয় , বলতে পারেন ?
আমি যেদিন জানতে পেরেছিলাম , সাবা কাউকে ভালবাসে এবং কারো সাথে ওর সম্পর্ক রয়েছে – খুব চমকে গিয়েছিলাম । প্রথমটায় বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করছিলনা , কিন্তু মিথ্যে অথবা গাঁজাখুরি গল্প শোনাবার মেয়ে যে সাবা নয় সেটা আমার চেয়ে ভাল আর কে ই বা জানে । জেনেছিলাম , রাফিন নামের সেই ছেলেটির সাথে সাবার মোবাইলে পরিচয় । টিপিকাল লাভস্টোরি – সাবা কখনো দেখেনি ওর ভালবাসার মানুষটিকে , শুধুমাত্র কথা শুনেই ভালবেসেছে । মেয়েটা হয়ত জানেনা বাইরের দুনিয়াটা কিরকম , ওর হয়ত ধারণা নেই , কিন্তু তারপরেও কেন যেন ওকে এই ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারলাম না । আমিও বিশ্বাস করতে চাইলাম , এরকম একটা মেয়ের সাথে কখনোই খারাপ কিছু হতে পারেনা ।
সব ই ঠিকঠাক ছিল , কিন্তু সাবার ভালবাসার কথা শুনে আমি ভেতরে ভেতরে প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে যেতে লাগলাম । সবসময় হাস্যোজ্জল এই আমি শুকনো মুখ নিয়ে ওর সাথে বসে থাকতাম । একদিন সাবা ই জানতে চাইল , “ আবিদ , ইয়ু আর নট ওকে । তাইনা ?”
আমি জানি , আমি নিজে থেকে কিছু না বললে সাবা কখনোই ফোরস করে কিছু জানতে চাইবেনা , এটা ওর স্বভাবে নেই । কিন্তু সেদিন আমার ভীষণ ইচ্ছে করল ও যেন আমার কাছ থেকে জানতে চায় আমার কি হয়েছে । আমি তাহলে চিৎকার করতে করতে ওকে বলে দিতাম , আমি ওকে কতটা চাই !
সাবা আমার কাছে কিছু জানতে চায়নি । এই মেয়েটার উপর আমার কোন অভিমান করা মানায় না জেনেও সেদিন কেন যেন আমার প্রচন্ড অভিমান হয়ে গেল । আমি ক্লাসে আসলাম না – এক সপ্তাহ , দুই সপ্তাহ ।
পৃথিবীর সবচাইতে শক্ত দেয়ালটি কিন্তু কখনো কোন সিমেন্ট অথবা কংক্রীট দিয়ে তৈরি হয় না । পাশাপাশি চলতে থাকা দুটি মানুষের মাঝে তৈরি হওয়া এই দেয়ালে দরকার হয়না কোন নাম্বার ওয়ান ব্রিকও । মাঝেমাঝে এই দেয়ালটিকে হাজার চেষ্টা করেও ভাঙ্গা যায়না - পাশাপাশি চলা মানুষ দুটো তখন দেয়ালের উপর থেকে উঁকি মেরে একজন আরেকজনকে দেখে । এই বিচ্ছিরি রকমের শক্ত দেয়াল টা কেন ভুল একটা জায়গায় বাজে ভাবে এঁটে বসে থাকে - এর উত্তর আমার জানা নেই । আমি কেবল এটাই জানি , " সে কেন বুঝে নেয়না ?" নামক বিচ্ছিরি অভিমানের ইট অথবা কংক্রীট দিয়ে বানানো এই দেয়ালের মত বাজে জিনিস এই পৃথিবীতে আর দুইটা নেই ।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠবার পর আমার মনে পড়ল , আজ সাবার জন্মদিন । দীর্ঘ দুই সপ্তাহ ধরে জমানো অভিমান এবং তার চৌদ্দগুষ্টির বারোটা বাজিয়ে আমি ক্যাম্পাসের দিকে ছুটে গেলাম । নিজের উপর রাগ হতে লাগল খুব , এই আমার অনুভূতির নমুনা ? আমি তো জানতাম ই ও কিরকম , আমি তো শীতল এই মেয়েটাকেই ভালবাসতাম , তারপরেও কেন এতদিন ধরে আমি ওর থেকে দূরে থাকলাম ? ও কাউকে ভালবাসে এইজন্যে ? নিজের সাথে অনবরত যুদ্ধ করতে করতে আমি যখন ক্যাম্পাসে পৌঁছালাম, দেখতে পেলাম , সাবা ক্লাসে নেই । অন্যদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম, এই দুই সপ্তাহের প্রতিদিনই সে ক্লাসে এসেছে , অথচ আজ আসে নি । ফোন করলাম , কিন্তু সেটাও ছিল অফ । মিনিট পাঁচেক মনের সাথে যুদ্ধ করবার পর ঠিক করলাম , ওর বাসায় চলে যাব ।
সাবাকে মাঝেমাঝে বাসা পর্যন্ত ছেড়ে আসার কারনে ওর বাড়ির রাস্তাটা আমার বেশ ভালই মনে ছিল । নীল রঙ্গা ছিমছাম বাড়িটা সাবাদের নিজেদেরই বাড়ি । মেয়েটা ওর বাবা মা কে নিয়ে কখনোই কিছু বলেনি , তাই বুঝতে পারছিলাম না দিনের বেলায় দুজনেই বাসায় থাকবেন কিনা । তবে আমরা যেহেতু একসাথেই পড়াশুনা করি , তাই জন্মদিনে ওর মিসিঙের ব্যাপারে খোঁজ নিতে আসাটা তাদের কাছে খুব একটা অদ্ভুত লাগবেনা বলেই আশা করেছিলাম ।
দারোয়ান মামাকে পরিচয় দিতেই সে দরজা খুলে দিল , আমাকে বেশ কয়েকদিন সাবার সাথে দেখেছে বলেই হয়ত ঝামেলা করেনি । বাড়ির ভেতর পা রাখবার আগে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ভেতরে আংকেল আন্টি দুজনেই আছেন কিনা । উত্তরে তিনি মাথা নাড়িয়ে বুঝালেন , “ দুজনেই বের হয়ে গেছেন ।”
বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা ছিমছাম , ভেতরেও ঠিক ততটাই শান্ত – আমার পায়ের আওয়াজটাও যেন গাঢ় হয়ে শোনা যাচ্ছিল । আমি এদিক ওদিক কোনখানেই সাবাকে দেখতে না পেয়ে ওর নাম ধরে ডাকলাম , একবার ডাকলাম, দুইবার ডাকলাম । কিছুক্ষন পর ভেতর থেকে সাবা ধীর পায়ে বের হয়ে আসল । সেই শান্ত স্নিগ্ধ মায়াবী মুখ , কিন্তু ও যখন একটু একটু করে আমার কাছে এসে দাঁড়াল , আমি ওর গালে জলের রেখা দেখতে পেলাম । খুব স্পষ্টভাবে । খুব তীক্ষ্ণভাবে ।
আমি বুঝতে পারছিলাম সাবা ভাল নেই । কখনই মিথ্যে করে হাসেনা ও, তাই সেদিনটিতেও সে মিথ্যে করে হাসবার মিথ্যে চেষ্টাটি আর করতে যায়নি । আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একসময় বলল ,
“ বসছো না কেন ? বসো ।”
মেয়েটার বিষাদ স্রোতের উৎসটিকে আমি যেন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না । তবুও নিজের অস্থিরতাকে থামিয়ে বলেছিলাম , “ শুভ জন্মদিন, মেয়ে । ”
সাবা চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন , মনে হচ্ছিল ও যেন আমার দিকে তাকিয়ে নিজের সাথেই কোন কথা বলছে ।
- “ আমার সত্যিই খেয়াল ছিল না আবিদ । একদম ই না । ”
- “ তোমার কি হয়েছে সাবা ? আমাকে বলা যায় ?”
- “ কই কিছু হয়নি তো । নতুন করে কিছু হয়নি । আগের মতই সব ।”
- “ আচ্ছা ঠিক আছে , নতুন করে কিচ্ছু হয়নি । আগে থেকেই কি হয়েছে ? সামথিং ইজ ভেরি রং । কাউকে তো বলবা ? আংকেল আন্টির সাথে শেয়ার কর বলেও তো মনে হয় না আমার । বাড্ডে তে ঘরে বসে কাঁদতেছো । কেন সাবা ? নিজে কাউকে কেয়ার কর না ইটজ ওকে । আমি কেয়ার করি তোমাকে , এইটা একটু বুঝো ?”
- “ আংকেল আন্টি- মানে আমার আব্বু আম্মু ?”
- “হ্যা ।”
সাবা অন্য দিকে তাকিয়ে বলল , “ আবিদ , তুমি কখনো ওপেন রিলেশনশীপের নাম শুনেছ ?”
- “ শুনেছি , কি হয়েছে এর ?”
চুপ করে থাকল মেয়েটা । নিজের সাথে কি যেন বোঝাপড়া চলছিল ওর – খানিক বাদে হাত দিয়ে মুখ ঘষে টলমল করা চোখে ও আমার দিকে তাকাল , “ কোথায় শুনেছ ফেসবুকে ? আবিদ, আমি আমার পাঁচ বছর বয়স থেকে এই অদ্ভুত রিলেশনটিকে নিজের চোখের সামনে দেখে আসছি । আমার আব্বু আর আমার আম্মু , তাদের সম্পর্ক টিকে আদৌ বিয়ের ধাপে ফেলা যায় কিনা আমি জানিনা । খুব ছোট থেকেই দেখছি , তাদের আসলে নিজের নিজের জীবন আছে – দুজন মিলে একটা জীবন তারা লিড করেনি । আমার বাবার গার্লফ্রেন্ড , মা’র বয়ফ্রেন্ড – আমি এসব দেখতে দেখতে বড় হয়েছি । আমার কখনো কোন বন্ধু ছিলনা , তুমিই বলনা কোন প্যারেন্টস কি তাদের বাচ্চাকে এরকম একটা ফ্যামিলির মেয়ের সাথে মিশতে দেবে ? আমার খুব একা লাগত জানো , মোস্ট অব দ্যা টাইম , রাতে না আসত আব্বু , না আম্মু । আমার জন্য মিস্ট্রেস রাখা হত , টাকার অভাব নেই তো তাই । এন্ড নাও দে থিংক দে হ্যাভ ডান এভ্রিথিং । ফাইনালি কাল রাতে তারা ডিভোর্সের ডিসিশান নিয়েছে , আমি যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি – তাই আর কি । এই বাড়ি আমার , ব্যাঙ্কে আমার নামে একটা একাউন্ট আছে । মাই লাইফ ইজ বিউটিফুল – তোমার কি তাই মনে হয় না আবিদ ? ”
আমি কোন ভাষা পেলাম না বলবার মত । এই মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেবার সময়তো অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে, এখন আমি আর কি বলতে পারি ? আমি শুধু বিস্ফারিত চোখে দেখতে লাগলাম , সাবার চোখ ছাপিয়ে ফোয়ারার মত পানি পড়ছে অথচ তার মুখে কিনা যন্ত্রণার কোন ছাপ নেই । খানিকক্ষণ থামার পর সে আবার বলল ,
“ রাফিনের সাথে আমার পরিচয় এস এস সি’র পরে । আমি ওকে পেয়ে সবকিছু থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছিলাম । আমার কোন বন্ধুর দরকার নেই , কোন আনন্দের দরকার নেই । আমি ওর সাথে কথা বলি – ও চুপ করে শোনে , আমাকে খুব ভালবাসে ও । কিন্তু কেন জানি ইদানিং মনে হচ্ছে , আমার বোধ হয় রাফিনের সাথে দেখা করা দরকার ।”
- “ সাবা , আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছ ?”
- “ তুমিই তো সরে গেলে ।”
- “এই দুই সপ্তাহে একবার ও মনে হয়নি আমাকে ?”
সাবা থমকে গিয়ে বলল, “হয়েছে তো , অনেকবার মনে হয়েছে ।”
- “ মনে হলে তো ফোন দিতে ?”
- “ আবিদ , আমার সাথে কেউ মিশতে পারেনা , আমি যে এটা জানি । তাই ভেবেছিলাম , তুমিও আর পারছ না । সরে গেছ আমার থেকে । ”
সামলাতে পারছিলাম না নিজেকে , মনে হচ্ছিল সব কিছু বলে দেই । কিন্তু তাতে কি লাভ আমার ? এই মেয়েটা সারাটা জীবন কষ্ট পেয়েছে – ও যদি কাউকে মন থেকে ভালবাসে , আমি কেমন করে সেই ভালবাসাটুকু কেড়ে নিতে পারি ? এতটা অধিকার আমার কেমন করে হতে পারে ?
শুধু বলেছিলাম , আমি রাফিনের সাথে কথা বলতে চাই । কারন সাবার কথা শুনে মনে হচ্ছিল ছেলেটা এই মুহূর্তে দেখা করতে চায় না । আমি রাফিন কে রাজি করাব কেবল এই একটা শর্তেই সাবা রাজি হল আমাকে কথা বলতে দিতে । নিজের মোবাইলটা আমাকে দিয়ে বলল ,
“ রিসেন্ট কল লিস্টে নাম্বার আছে । আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি , কিছুই খাইনি এখনো ।”
জানেন পাঠক, সেদিন অনেক কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল । আমি বুঝতে পেরেছিলাম , রাফিন নামে আসলে কেউ নেই – রাফিন বসবাস করে সাবার অবচেতন মনে । সেদিন সাবার রিসেন্ট কল লিস্টে রাফিনের কোন ফোন নাম্বার ছিল না । শুধু তাইনা , ওর ছোট্ট কন্ট্যাক্ট লিস্টেও R দিয়ে কোন নাম ছিল না । আমি যখন সাবাকে এটা বলেছিলাম , ও আমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে রাফিনকে কল করেছিল । তারপর যখন আমার দিকে মোবাইলটা এগিয়ে দিল , ফোনের অন্যপাশে রাফিন তো দূরে থাক - কেউই ছিল না ।
আমি সেদিন পারিনি রাফিনের জন্য সাবার এতখানি অনুভূতিকে মিথ্যে প্রমান করে আসতে । আমার কেবলই মনে হচ্ছিল , মেয়েটা ভাল থাকুক , মিথ্যে কোন একটা অবয়বকে কেন্দ্র করেই না হয় বেঁচে থাকুক । ভালবাসার অভাবটা নাহয় আমার দিক থেকেই পুষিয়ে দেব - তবু ও ভাল থাকুক ।
কিন্তু সব কিছু এতটা সহজ হয়নি । সাবা রাফিনের সাথে দেখা করতে চাচ্ছিল , আর তাতেই হয়ে গেল সমস্যা । যেদিন ওদের দেখা হবার কথা , সেদিন সকালে সাবা বলেছিল, ও নাকি সন্ধ্যায় রেইলস্টেশন থেকে রাফিনকে রিসিভ করবে । কারন সাবার কল্পনায় রাফিনের বসবাস ঢাকা থেকে অনেক দূরে – এজন্যেই ওদের নাকি এতদিন দেখা হয়নি । আমি ওকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, আমিই রাফিনকে নিয়ে আসব ; মেয়েটা রাজি হয়নি – হবেনা সেটাই স্বাভাবিক । এতদিন অপেক্ষার পর নিজের ভালবাসার মানুষটিকে দেখবার লোভ কি কেউ সামলাতে পারে ?
আমি অপেক্ষা করছিলাম কোন মির্যাকলের জন্য । কিন্তু রাত আটটারর দিকে আমার মোবাইলে সাবার কল আসলো ।
- “আবিদ , রাফিন আসেনি ।”
- “ ঠিক আছে , সাবা । তুমি এখন কোথায় আমাকে সেটা বল ।”
- “ তোমার কি মনে হয় ও কেন আসেনি ?”
- “ আমি বলব তোমাকে , আমি আসি ?”
- “ওর ফোন কেন বন্ধ ? ইজ হি আ লায়ার ?”
- “না , সাবা । ”
- “ তাহলে কি ? আমাকে জানতে হবে ।”
- “ সাবা , রাফিন বলে কেউ নেই ।”
সাবা আর কিছু শুনতে চায়নি । দু সেকেন্ডের মত চুপ থেকে নীরবেই ফোনটা রেখে দিয়েছিল ।
মনের অস্থিরতাকে সামলাতে না পেরে সেদিন রাতে যখন সাবার বাসায় চলে গেলাম , দেখি অচেতন মেয়েটার হাতে অনেক কয়টা ওষুধের পাতা । জীবনের প্রতি ওর বিতৃষ্ণাটা বোধ হয় সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছিল ।
৩। দুইদিন ধরেই হাসপাতালে যাওয়া আসা চলছে আমার । যখনই কেবিনে যাই , দেখি আম্মা সাবাকে ধরে তার স্পেশাল বাচ্চা মুরগির স্যুপ খাওয়াচ্ছে । “ না না করবি না , মাথাও নাড়বি না , না খেয়ে ভাল হবি বাবা ?” এরকম ডায়লগ শুনে সাবাও কেমন যেন গোলগোল চোখে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকে । আম্মা বাসায় চলে গেলে ও আমার দিকে তাকিয়ে বলে ,
“ আমার কপাল দেখ – আমার কোনদিন বড় কোন অসুখ হয়নি । অসুখ হলেও তো মা দূরে থাকতে পারত না , তাইনা আবিদ ?”
আমি সেই উত্তর দিই না , ধমকের মত করে বলি , “ নো মন খারাপ । নেভার এভার ।”
সাবা হাসে । এবং আমি জানি , ও মিথ্যে করে কখনোই হাসেনা ।
ডাক্তার বলে দিয়েছিল , রাফিনের অস্তিত্বহীনতার কথা মেনে নিতে ওর সময় লাগবে । এতটা বছর ধরে যাকে ঘিরে ও বেঁচে থেকেছে এত সহজে তাকে ভুলতে পারবেনা । ভুল বলেনি , কোন অস্তিত্ব ছাড়াই রাফিন যে এতটাদিন ধরে মেয়েটাকে ভালবাসা দিয়ে রেখেছে , তাতে আমিই কৃতজ্ঞ অনেকখানি । রাফিনের কথা বলতে বলতে সাবার চোখে যখন শুন্য দৃষ্টি নেমে আসত , আমার ইচ্ছে হত সারা পৃথিবী খুঁজে রাফিনের অস্তিত্বকে আবিষ্কার করি।
সাবার আব্বু আম্মু ও এসেছিলেন , তবে একসাথে নয় । দুইজন ই অসুস্থ মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারেননি , শুধু ওর হাতটা ধরে চুপচাপ বেডের পাশে বসেছিলেন অনেকক্ষণ । কিন্তু আমার বিশ্বাস , এরপর যখন তারা সাবাকে দেখতে আসবেন , তখন আর আলাদা করে নয় – অনেকগুলো কিটক্যাটের প্যাকেট নিয়ে একসাথেই আসবেন । কিটক্যাট সাবার ভীষণ প্রিয় ।
সাবা আর আমি এখনো চুপচাপ সময় কাটাই , উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটাহাঁটি করি । মাঝেমাঝে ও ক্লান্ত হয়ে আমার হাত চেপে ধরে , আর আমি এই মুহূর্তটির জন্য সারাটি দিন ধরে অপেক্ষা করি । প্রিয় পাঠক, আমি এখনো অপেক্ষায় থাকি , একদিন হয়ত সাবা তার রাফিনের অস্তিত্ব আমার মাঝে আবিষ্কার করবে ।
ভালবাসার মানেটাই যে খ্যাপাটে , ভীষণ রকম বিচ্ছিরি ।