নিপুণ (ফরহাদ আহমেদ)
তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে বাম পা টা মচকে যায়। তবু সবুজ
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই চলতে থাকে। দেরী হয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা পেরোনো বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। আজ
দেরী হয়ে গেল। কী করা যাবে?
অফিসের ছোট পদের চাকরী। নিজেরটা তো করতে হয়ই, বড়
অফিসারদের ফাইলপত্র প্রায়ই দেখে দিতে হয়। আজ
তো অফিস থেকে সবুজই শেষ বেরোলো। তারপর বাসের জন্য
অপেক্ষা, দৌড়াতে দৌড়াতে বাস ধরা, আর বাস
থেকে নামতে গিয়ে আচ্চমকা পা টা মচকে যাওয়া।
মাঘমাসেও ওর শার্টের বুকের কাছটা ভেজা।
আলীবাবা রেস্টুরেন্ট থেকে একপ্লেট ভাত আর দুইজনের
সমান মুরগীর অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রহমান
চাচা আর চাচী সাতদিন থেকে হাসপাতালে আছেন। চাচীর
নাকি পেশাবে কী সমস্যা হচ্ছিলো। এলাকার
ডাক্তারকে দেখিয়ে পনেরদিনের ওষুধ খেয়েও কাজ হয়নি,
তাই ঢাকায় এসেছিলেন পিজিতে দেখাবেন বলে। সবুজের
আব্বাই ফোন করেছিলেন,
"- রহমান ভাই আর ভাবী যাচ্ছে, বুঝলি? তুই একটু দেখিস
তো বাবা, অতো বড় শহরে তোর চাচা-চাচী কিছু
বুঝতে পারবে না।"
আপন কেউ না, তবুও এড়িয়ে যেতে পারেনি। ওদের
ক্ষেতে তিনের ভাগে কাজ করতো,
ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। কলেজে পড়বার জন্য গ্রাম
ছেড়ে দেবার পর আর তেমন দেখা হয়নি, ছেলেদের চাপে সব
সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।
অভাবে পড়ে ভাগে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন, অন্য
গ্রামে গিয়ে নাকি মজুরীর কাজ করতেন।
সায়েদাবাদে যখন দেখা হয়, সবুজ খুব অবাক হয়েছিল। চাচা-
চাচী এতো বৃদ্ধ হয়ে গেছেন !
সবুজকে জড়িয়ে ধরে চাচী কেঁদে ফেলেন। আব্দুর রহমান
স্ত্রীকে বকা দেন,
"- কী করো হাসুর মা ? বাপজানের জামাটাই
নুংরা কইরা দিলা, ছাড়ো তো। ... তুমি কিছু
মনে কইরো না বাপ, তুমার চাচী বুঝে নাই।"
ডাক্তার দেখিয়ে সন্ধ্যার বাসে তুলে দিয়ে বাড়ী ফিরেই
টিভিতে স্ক্রল দেখে, "নারায়নগঞ্জে বাসে পেট্রলবোমা,
এগারো জন যাত্রী দগ্ধ..."
স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই আবার বের হয়ে যায়। বুড়া মানুষ
দুইটাকে আজকে ছাড়তেই চায়নি, কিন্তু রহমান
চাচা কিছুতেই শুনেন নাই। ঐ বাসটাতেই আগুন
লেগেছে কিনা জানেনা, কিন্তু তবুও বার্ন
ইউনিটে ছুটে যায়।
বাসটা নাকি দাঁড়িয়ে ছিল, তখনই ঘটনা ঘটে। আব্দুর
রহমান পানি খেতে নীচে নেমেছিলেন। বুড়ী মহিলাটার
হাত আর মুখের পুরোটাই ঝলসে যায়।
সেই থেকে সবুজ নিজের সাধ্যমতো করছে।
সকালে পাউরুটি আর দুইটা ডিম কিনে দিয়ে আসে, দুপুরের
জন্য চাচার হাতে টাকা গুঁজে দেয়, সন্ধ্যায় আবার নিজেই
খাবার কিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার
বেশি বেশি করে আমিষ খাওয়াতে বলেছে; সবুজের
সাধ্যে অতো হয়না।
নিজের জন্য কখনো নিজের অভাবের উপর খারাপ লাগেনি,
বুড়া মানুষ দুইটার জন্য কিছু করতে পারছে না বলেই
ভাগ্যকে অভিশাপ দিচ্ছে বারবার।
******************************
*********************
এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হচ্ছিলেন, কেউ
দেখে ফেলছে কিনা। কেউ বলতে সবুজ, ছেলেটার আসার সময়
হয়ে গেছে, দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। দোকানীর কথায়
সচকিত হন,
"- আপেল কয়টা দিবো?
- এই ট্যাকায় যা হয়, দ্যাও... (পকেট থেকে দুইটা নোট
দোকানীর দিকে এগিয়ে দিলেন)
- আপেল দুইটা হবে, দিবো?
- একখান কমলা হইতো না?
- তাহলে একটা একটা করে নিতে হবে...
- দ্যাও..."
আবার পিছনের দিকে তাকালেন, আজকের দুপুরের
খোরাকি খরচ হয়ে গেল। সবুজ জানলে খুব লজ্জায়
পড়ে যেতে হবে। বিকালেই কিনতে আসতে চেয়েছিলেন,
কিন্তু বুড়ীর ড্রেসিং হতেই সন্ধ্যা লেগে গেল।
"- ন্যাও তো, ফল দুইটা জলদি কইরা খাইয়া ন্যাও। বাপজান
আসার আগেই শ্যাষ কইরা দ্যাও।
- এইসব করতে গ্যাসেন ক্যান ?
- ফল না খাইলে জুত পাইবা ক্যামনে ?
- ট্যাকা পাইলেন কই ?
- আমি কই পাবো ? বাপজান দিসিলো খাওনের লিগা,
ওইটা আইজ খরচা করি নাই।
- তাইলে ফল একখান আপনি খান, খিদা প্যাটে কতোক্ষন
থাকবেন ?
- পুরুষ মানুষ একবেলা না খাইলে কিছু হয়না, তুমি খাও। আর
দেরী কইরো নাতো, বাপজান দ্যাখলে দুঃখ পাইবো।"
আব্দুর রহমান ছোট ছোট টুকরা করে বউয়ের
মুখে তুলে দিতে লাগলেন, বউয়ের হাতে ব্যান্ডেজ। কপাল
আর মুখও সাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে ঢাকা,
টুকরাগুলা মুখে তুলে নেয়ার সময় মাথা নীচু
করে নেয়া দেখে বুঝা যাচ্ছে, স্বামীর
কাছে খাইয়ে নিতে মহিলার খুবই লজ্জা লাগছে। কী যেন
একটা কথা বলে মাথাটাকে আরো নীচু করে ফেলেন মহিলা,
সেই দেখে আব্দুর রহমানের বলিরেখা পড়া গালটাও
চওড়া হলো। এক্সিডেন্টের পর এই প্রথম বুড়োবুড়ি হাসলো।
"আমিষটা বেশি দরকার, আপেল-বেদানা খাইয়ে লাভের
চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি..." ডাক্তারের
কথাটা সবুজের কানে এখনো বাজছে। বৃদ্ধ
বয়সে একবেলা না খেয়ে থাকাটাও ঠিক না, সেটাও ওর
মনে আছে। কিন্তু, এই শুকনা হাসির কাছে ওসবকিছুই ম্লান
হয়ে গেছে সবুজের কাছে। আজ ওর
বাড়ী ফিরতে আরো দেরী হবে, হোক; কিন্তু আরো কিছুক্ষণ
এই দৃশ্য দেখার লোভ সামলাতে পারেনা।
দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মচকে যাওয়া বাম
পায়ে একফোঁটা উষ্ণ পানির অস্তিত্ব টের পায়;
চেখে না দেখলেও ও জানে, স্বাদটা নোনতাই হবে।