লেখাঃ তানজিম আহমেদ রুশো
...এক...
তুমি অনুরোধ করেছিলে গল্পটা যেন এখন না লিখি। বেশ অনেক দিন... না... অনেক অনেক দিন পরে যেন লিখি। কিছু কিছু গল্প নাতি-নাতনীদের শোনানোর জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এটা তেমনই একটা গল্প। কী ? গল্পের নামটা দেখে কী কিছু একটা মনে পড়ছে তোমার ? ঐ যে একটা বিজ্ঞাপন দেখাতো না টেলিভিশানে... পন্ডস কোল্ড ক্রিমের ? একজন মানুষের কোমল মুখ আরেকজন মানুষকে সোহাগভরে বলে - "গুগলি উগলি উশ"... আর সাথে সাথে সেই মানুষটার দুই গাল ধরে দুইদিকে টেনে দিতে হয় ? তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম তখন আমার কী ইচ্ছে করছিলো জানো ? তোমার দুই গাল দুই দিকে টেনে দিয়ে বলি - "গুগলি উগলি উশ"।
আচ্ছা গল্পটা তাহলে লিখেই ফেলি। কী বললে ? এখন গল্প লিখতে বসলে আমাকে আর তোমার গাল ধরে গুগলি উগলি উশ করতে দিবে না ? আচ্ছা তাহলে গল্পটা আর লিখবো না কেমন ? তুমি ঘুমোও।
আমি গল্প লেখার খাতাটা গুটিয়ে নিলাম। চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম। আমি জানি আমার গল্পটা এখন মনে মনে লেখা হতে শুরু করবে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র...
...দুই...
আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তৃতীয় বর্ষের শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে কিছুদিন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। প্রায় এক মাসের বন্ধ পেয়েছি। প্রতিদিনই মাথায় পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে নতুন কী করা যায়। কিছুদিন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নিলাম। একদিন গাড়ি চালানোর সময় ব্রেকের বদলে এ্যাক্সিলেরেটরে চাপ দিয়ে ফেলায় গাছের সাথে গাড়ি ধাক্কা খেলো। এ্যাক্সিডেন্ট করে নাকের হাড্ডি ভাঙলাম। আমার পাশে বসা প্রশিক্ষক নাজমুল ভাইয়ের হাত ভাঙলো। অতঃপর গাড়ি চালানো শিকেয় উঠলো। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সাঁতার শিখতে চাইলাম। বরুণদা'র সাথে পুকুরে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেলাম। পশ্চাৎদেশে এমন ব্যথা পেলাম যে টানা তিনদিন উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাতে যেতে হলো। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতেই মাথায় ঢুকলো একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা কিনতে হবে। বন্ধুবান্ধবরা তখন ডিএসএলআর দিয়ে সুন্দর সুন্দর রমণীদের প্রোফাইল পিকচার তুলে ব্যাপক হারে ফেইসবুকে লাইক কামিয়ে চলেছিলো। আমি পেলে বড়জোড় পৃথুকেই হয়তো পাবো আমার ক্যামেরায় ছবি তোলানোর জন্য। তখন আমার একমাত্র বান্ধবী ছিলো পৃথু। কোনো এক বিচিত্র কারণে কোনো রমণীই আমাকে দীর্ঘদিন সহ্য করতে পারতো না। পৃথু পারতো। এজন্য আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো পৃথু আদৌ মেয়ে কী না। চেহারার কাটবাট তো মেয়েদের মতোই। কিন্তু আমাকে যেহেতু সহ্য করে, সুতরাং সন্দেহ থেকেই গিয়েছিলো।
পৃথুই আমাকে একদিন বাসার কাছের বসুন্ধরা সিটিতে নিয়ে গেলো ডিএসএলআর ক্যামেরা দেখানোর জন্য। সেদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিলো। আমার আইসক্রিমের ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিলো। পৃথু বলছিলো সে কোল্ড কফি খাবে। আইসক্রিম নাকি কোল্ড কফি - এই নিয়ে দুইজন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, ঠিক তখন দেখলাম ইমন দুই হাতে দুই স্যুপের কাপ নিয়ে আমাদের দিকেই আসছে। এই গরমের মধ্যে স্যুপ ? তার চেয়ে বড় কথা এই গরমের মধ্যে ইমন ? ইমনকে তখন আমি দুই চোখে সহ্য করতে পারছিলাম না কারণ যখনই আমি পৃথুর সাথে আরাম করে ঘুরে বেড়াই কোথা থেকে যেন ব্যাটা এসে উদয় হয়। আমাদের দুইজনের মাঝে বার্গারের কাবাব হয়ে বসে পড়ে।
আমাদের দেখেই ইমন হাসতে হাসতে বললো - সারপ্রাইজ...
পৃথু হকচকিয়ে যাওয়ার সুন্দর অভিনয় করে বললো - রিয়ালি সারপ্রাইজড। তুই এখানে ? তোর প্রাক্তন প্রেমিকা কোথায় ?
ইমন তখন ফেইসবুকে "প্রাক্তন প্রেমিকা" নামক কাল্পনিক এক চরিত্রকে নিয়ে তুলকালাম সব স্ট্যাটাস লিখে গণ্ডা গণ্ডা লাইক-পাপ অর্জন করে চলছিলো। পৃথুর প্রশ্নে শিয়ালের মতো হেসে সে বললো - সুন্দরী... তোমার সামনে প্রাক্তন-বর্তমান সব প্রেমিকাই ম্লান। আমার এই অঞ্জলিভরা স্যুপসুধা তুমি পান করিলে এই কামার্ত... সরি... প্রেমার্ত হৃদয় বশীভূত হয়। - খুব ঢং করে পৃথুর হাতে স্যুপের কাপ তুলে দিয়ে সে নিজে আরেকটা কাপে সলাৎ সলাৎ শব্দ করে চুমুক দিতে থাকে।
পৃথু ইমনের হিউমারে মুগ্ধ হয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপর বলে - কী রে ? রুশোর জন্য স্যুপ আনলি না ?
ইমন শুনতে পায় নি এমন ভাব করে পৃথুকে বললো - থ্রি হান্ড্রেড সেকেন্ড মুভিটা দেখেছিস ? জোস বানিয়েছে না ?
পৃথুও থ্রি হান্ড্রেড নিয়ে কথা বলতে মগ্ন হয়ে গেলো। আমি যে দৃশ্যপটে আছি তা দুইজনই বেমালুম ভুলে গেলো। আমি ওদের দুইজনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিক করলাম নিজেই এক কাপ স্যুপ কিনে খাবো। যদিও এই গরমে স্যুপ খেতে মোটেও ইচ্ছে করছিলো না কিন্তু মেজাজ এতটাই খারাপ লাগছিলো যেন বিপরীত দিক থেকে এক সত্তা আমাকে চিৎকার করে বলছে - নিজেকে কষ্ট দাও। নিজেকে কষ্ট দিতে শীতল আইসক্রিমের বদলে উষ্ণ স্যুপ পান করো।
সেদিন ভাগ্যিস ইমন আমাদের সাথে দেখা করতে এসেছিলো। ভাগ্যিস আমাকে সে স্যুপ দেয় নি। ভাগ্যিস আমার নিজেকে কষ্ট দেওয়ার জন্য এক কাপ স্যুপ খেতে ইচ্ছে করছিলো।
আমি স্যুপের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। একজন ছেলে এবং একজন মেয়ে স্যুপের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে। জনে জনে স্যুপ বিলিয়ে যাচ্ছে। আমি মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ছেলেটার হাতে দিয়ে বললাম - হ্যালো ভাইয়া... থাই স্যুপ একটা।
ছেলেটা তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটাকে বললো - আমার হাত আটকা। তুমি দিতে পারবে ?
মেয়েটা মাথা নাড়লো। গামলা থেকে বড় চামচে করে স্যুপ দিতে লাগলো। আমি আড়চোখে একবার মেয়েটার দিকে তাকালাম। পাশ থেকে মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে। গোলগাল মুখ। উজ্জ্বল শ্যাম গায়ের রং। গায়ে শেফদের মতো পোশাক, মাথায় শেফদের টুপি। খুব ধীরে ধীরে সে স্যুপ ঢালছে। কিন্তু দেখতে দেখতে স্যুপের কাপ ভরে গেলো। খুব ধীরে ধীরে সে কাপের সাথে টিস্যু পেপার জড়াচ্ছে। কিন্তু কাপটা খুব দ্রুত আবরণ পেয়ে গেলো। খুব ধীরে ধীরে মেয়েটা আমার হাতে স্যুপের কাপটা তুলে দিলো। কিন্তু এত দ্রুত কেন সেটা আমার হাতে চলে এলো ? আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম - গুগলি উগলি উশ...
মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বললো - সরি ?
আমি বললাম - নানান্না নান্না নান্না গুগলি উগলি উশ...
মেয়েটা মনে হয় বুঝতে পারলো আমি কী বলছি। মিষ্টি করে হাসলো। তারপর পাশে রাখা একটা চেয়ারে টুপ করে বসে পড়লো। একটা রুলটানা খাতা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগে সেটার উপর চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলো। আমি স্যুপের কাপটা হাতে নিয়ে ইমন আর পৃথুকে খুঁজতে লাগলাম। ওদেরকে খুঁজতে খুঁজতেই আমার মনে হলো একটা ভুল হয়ে গেছে। "গুগলি উগলি উশ" বলার সাথে সাথে মেয়েটার ফুলা ফুলা গাল দু'টো টেনে দেওয়া দরকার ছিলো। ধুর... এসব কী ভাবছি ? আমি হাসি মুখে ইমন আর পৃথুর দিকে এগিয়ে গেলাম।
...তিন...
- বার বার ওদিকে কী দেখছিস ? - পৃথু আমাকে জিজ্ঞেস করে।
ইমন আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বললো - কী আর দেখবে ? নিশ্চয়ই কোনো পক্ষীর দিকে নজর গেছে...
- আরে ধুর... রুশো ইদানীং মেয়েদের দিকে তাকায় না। আমি খেয়াল করেছি... - পৃথু ইমনকে বলে।
ইমন হাত দিয়ে নিজেকে ঢাকতে ঢাকতে বলে - ওরে সর্বনাশ... রুচির পরিবর্তন হয়ে গেছে নাকি ?
ইমনের নোংরা রসিকতায় কান না দিয়ে আমি পৃথুকে জিজ্ঞেস করি - আরেক কাপ স্যুপ খাবি ?
- আরেক কাপ স্যুপ ? - পৃথু বলে - না রে। একটাই যথেষ্ট... ইমন খাবি ?
আমি ইমনের দিকে আশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। প্লিজ ইমন... হ্যাঁ বল তুই। এই প্রথম আমার আজকের দিনে ইমনকে একটু ভালো লাগে যখন ও বলে - আন তাহলে। খাই...
আমি দ্রুত পায়ে স্যুপের দোকানটার দিকে হেঁটে যাই। ছেলেটাকে দোকানে দেখছি না। মেয়েটা একা বসে আছে চেয়ারে। চেয়ারে বসে রুলটানা খাতাটা মন দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কলম দিয়ে কী যেন লিখছে তাতে।
- আপু... আরেক কাপ স্যুপ। - আমি মেয়েটাকে বলি।
মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। একটু যেন চোখ কুঁচকে ওঠে ওর। পরক্ষণেই মিষ্টি হেসে বলে - বুবলি বুবলি ওয়াশ ?
আমি সংশোধন করে দিই - উহুম... গুগলি উগলি উশ... - "উশ" বলার সময় আমার জিভ দিয়ে শিসের মতো ধ্বনি বের হয়।
মেয়েটা আগের মতোই ধীরে ধীরে স্যুপ ঢালছে। ধীরে ধীরে স্যুপের কাপে টিস্যু পেপার জড়াচ্ছে। আমি হালকা গলায় বললাম - ঐ খাতাটার মধ্যে কী লেখা ?
মেয়েটা ওর খাতার দিকে একবার তাকায়। তারপর টেনে টেনে বলে - আমার স্টুডেন্টের হোমওয়ার্ক।
- ও আপনি পড়ান ?মানে টিচার ?
- হুম... টিউশানি করি।
মেয়েটার গলার স্বর একটু রুক্ষ্ম। আমার স্বস্তি লাগে। মেয়েটার একটা খুঁত বের করতে পেরে নিজেকে উদ্ধারের বাসনা আরও তীব্র হয়।
- আচ্ছা যাই ?আপনি কী আবারও চেয়ারটায় টুপ করে বসে পড়ে রুলটানা খাতাটায় ডুবে যাবেন ? - আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করি।
মেয়েটা উত্তর দিতে পারে না। হই হই করে তিন-চারটা ছেলে দোকানের সামনে এসে চিৎকার করতে থাকে - আপু... স্যুপ স্যুপ স্যুপ...
মেয়েটা তাড়াতাড়ি স্যুপের গামলার কাছে চলে যায়। খুব দ্রুত হাতে গামলা থেকে স্যুপ ঢেলে দিতে শুরু করে। আমার দেখতে ভালো লাগে না। আমার বেলায় কী সুন্দর ধীরে ধীরে ঢালছিলো। সুন্দর লাগছিলো ব্যাপারটা... আর এখন ?
আমি ফিরে আসি ইমন আর পৃথুর কাছে। হুট করে একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাসের আইডিয়া আমার মাথায় চলে আসে। আমার মুখে মনে হয় একটা ফিঁচেল হাসি চলে এসেছিলো কারণ পৃথু আমাকে দেখে বলে ওঠে - এরকম দাঁতের ড্রয়ার খুলে রেখেছিস কেন ?
আমি আমার নিজের দুই গাল টানতে টানতে বলি - গুগলি উগলি উশ...
ইমন আর পৃথু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
...চার...
- এসব কী স্ট্যাটাস দিয়েছিস তুই ? - পৃথু আমাকে চ্যাটিংয়ে নক করে বলে।
- ভালোই তো... দেখছিস না কত লাইক পাচ্ছি ? - আমি পৃথুকে বলি।
- হুম... তাই দেখছি। এমনিতে তোর স্ট্যাটাসের লাইকে তো ভাটার টান থাকে।
- তোর কী মনে হয় ?মেয়েটা আমার স্ট্যাটাসটা পড়বে ?
- পাবলিক করে রেখেছিস তাই না স্ট্যাটাসটা ?যাই হোক... মেয়েটার যদি তোর সাথে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকে কয়েকজন তাহলে হয়তো ওর নিউজফিডে চলে যেতে পারে স্ট্যাটাসটা। কিন্তু সেটা কী খুব স্মল প্রোবাবালিটি না ?
- হুম... দেখি কালকে একবার যাবো বসুন্ধরা সিটিতে...
- মেয়েটাকে দেখতে ?
- হুম... মেয়েটাকে মোবাইলে স্ট্যাটাসটা দেখাবো।
- রুশো... তুই কী সত্যিই সিরিয়াস ?নাকি ফান করছিস বল তো ?
- ফান করছি আসলে...
- আই উইশ ইট উড বি ফান। তোকে আমি সত্যিই বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে।
- আমিও আমার নিজেকে বুঝতে পারি না।
- তবে যাই হোক... তোর স্ট্যাটাসটা পড়ে মেয়েটাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে...
- আমারও মেয়েটাকে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
...পাঁচ...
ইমন আমাকে গভীর রাতে ফোন দেয়। চিৎকার করে বলে - ***র পোলা। তোর স্ট্যাটাসে ২৫২ টা শেয়ার পড়েছে। হোয়াট দা হেল...
- ২৫৪ টা এখন। - আমি ইমনকে বলি।
- দোস্ত... মেয়েটা তো নিশ্চয়ই এতক্ষণে স্ট্যাটাসটা দেখে ফেলেছে।
- কী জানি।
- কালকে চল মেয়েটাকে দেখতে যাই।
- হুম... যাবো।
- খুব ইমব্যারেসিং কিছু করিস না। নরমাল কথাবার্তা বলিস ঠিক আছে মেয়েটার সাথে ?
- তোর কী মনে হয় ইমন ?মেয়েটা খুব রেগে যাবে না তো স্ট্যাটাসটা পড়লে ?
- রাগার তো কথা না... খুশিই হবে মনে হয়। একটা কথা বল দোস্ত নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কয়টা পেলি ?ফলোয়ার বাড়লো কয়জন বল তো ?
আমি উত্তর না দিয়ে হাসতে থাকি।
...ছয়...
বসুন্ধরা সিটির লেভেল এইটে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার সাথে ইমন, পৃথু, আমার কাজিনদের বেশ কয়েকজন। আমার আরও কয়েকজন বন্ধুও আছে।
প্রচণ্ড ভিড় এখানে। দুই-একটা টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও দেখতে পাচ্ছি। আরও অনেক মানুষে জায়গাটা বোঝাই। আমাকে দেখে কয়েকজন বলে ওঠে - ঐ যে রুশো নবজাতক শিশু। কয়েকজনকে "ঐ যে চান্দিছিলা" - ও বলতে শুনলাম।
আমি সত্যিই ভাবি নি এরকম একটা কাণ্ড হয়ে যেতে পারে। ফেইসবুকে আমার স্ট্যাটাসটা খুব সাধারণ ছিলো। কিন্তু ফেইসবুক এমন একটা জায়গা যেটা তিলকে তাল করতে পারে। অসংখ্য মানুষ স্ট্যাটাসটা শেয়ার করেছে। সবার একটাই প্রশ্ন ছিল - মেয়েটা কে ? তাদের চাওয়া ছিলো মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে এই স্ট্যাটাসটা পড়াতে হবে। মেয়েটা স্ট্যাটাসটা পড়েছে কী না সেটাও আমি জানি না। তবে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা সে জেনে গেছে। মেয়েটা বিপদে না পড়লেই হয়। ভিড়ের মধ্যে আমাকে জায়গা করে দেওয়া হয়। আমি এগিয়ে যেতে থাকি। এখানে এত মানুষ ছুটে এসেছে মেয়েটাকে দেখার জন্য। তারা হয়তো প্রতীক্ষায় ছিলো আমিও এখানে চলে আসবো।
মেয়েটা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে উৎসুক চোখ অনেকগুলো। কেউ একজন বলে ওঠে - ওদেরকে নিরিবিলি কথা বলার সুযোগ দেওয়া উচিত। ভাইবোন, আপনারা সবাই নিজ নিজ কাজে যান। কিন্তু কেউ জায়গা ছেড়ে নড়তে চায় না। সবাই মজা দেখতে উদ্গ্রীব।
আমি মেয়েটার সামনে গিয়ে বলি - আমি মনে হয় আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছি তাই না ?
মেয়েটা আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে ফেলে। তারপর বলে - আজকে আমি মানুষকে স্যুপ দিয়ে দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারি নি। দেখেছেন কত মানুষ আমার কাছে স্যুপ খেতে এসেছে ?
- হুম... আমি আসলে ভাবি নি এত মানুষ আমার স্ট্যাটাসটা শেয়ার দিবে।
- আপনি জানেন আজকে কত মানুষ আমার গাল ধরে বুগলিবুগলি ওয়াশ করতে চেয়েছে ?
- গুগলি উগলি উশ...
- ও সরি... গুগলি উগলি উশ - মেয়েটা আবার মিষ্টি করে হাসে।
- আপনি এত হাসছেন কী করে ?দেখেন কত মানুষ আপনার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আপনার অস্বস্তি লাগছে না ?
- আমার তো মজাই লাগছে। কই ?আজকে তো স্যুপ খেতে চাচ্ছেন না ?
- ও তাই তো... দিন স্যুপ দিন...
- স্যুপ শেষ হয়ে গেছে। দেখেন গামলা খালি... স্যুপ আনতে পাঠানো হয়েছে।
- ও... ঠিক আছে আপু...
- আমার মত একটা পিচ্চি মেয়েকে আপনি আপু ডাকলেন কী করে ?
- আমিও পিচ্চি। আমি রুশো নবজাতক শিশু... আপনি ?
- আমি অহনা... আমার ফেইসবুক প্রোফাইল নেইম পিচ্চি অহনা...
আমি অহনার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। আমার স্ট্যাটাসটির প্রতিটি বাক্য আমার মাথায় আরেকবার খেলা করতে শুরু করে -
"আজকে বসুন্ধরা সিটির লেভেল এইটে স্যুপের দোকানে এক আপুকে দেখে এত কিউট লেগেছে যে পর পর চারবার (চাপা ছিলো... আসলে দুইবার) তার দোকানে গিয়ে তার কাছ থেকে স্যুপ নিয়ে খেলাম। আপুটার ফুলা ফুলা গাল ধরে GooglyWooglyWooshকরতে এত ইচ্ছে করছিলো। আপুটা এত মিষ্টি করে হাসছিলো যে ঝুপ করে তার প্রেমে পড়ে যেতে মন চাইছিলো। জানি না... আমার এই স্ট্যাটাসটা সে দেখবে কি না... তবে তাকে আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে - আপনি আমাকে আপনার ফুলা ফুলা গাল দু'টো ধরে গুগলি উগলি উশ করতে দিবেন প্লিজ ?মাত্র একবার... প্লিইইইইজ ?"
আশেপাশে থেকে মানুষজন চিৎকার করতে থাকে। বেশিরভাগই অর্থহীন চিৎকার। দুই-একটা বুঝতে পারলাম। তারা বলছে - অনেক কথা হয়েছে। এখন মেয়েটার গাল ধরে গুগলি উগলি উশ করো।
আমরা দুইজনই এই কথাগুলো শুনে লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হতে শুরু করলাম। আমাদের ঐ মুহুর্তের অনেকগুলো ছবি পরে অনেকেই আমাদেরকে ট্যাগ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন আমাদের প্রোফাইলে ঐ ছবিগুলো প্রোফাইল পিকচার এবং কাভার ফটো হিসেবে ছিলো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে আমি আর অহনা যদি নাও চাইতাম, আশেপাশের মানুষ জোর করে আমাদের দুইজনকে ধরে এক করে দিতো। কিন্তু আমরা দুইজনই চেয়েছিলাম এক হতে। হ্যাঁ... আসলেই চেয়েছিলাম। পিচ্চিকে ছাড়া শিশু কোথায় যাবে ? শিশুকে ছেড়ে পিচ্চি থাকতে পারবে ?
সেই পিচ্চি অহনা মেয়েটা এখন আমার পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। হালকা হালকা নাকও ডাকছে। মেয়েটা আমাকে গল্পটা লিখতে দিতে চাইছে না।
আচ্ছা না লিখি... গল্পটা তো সবাই জানে তাই না ?