লেখাঃ মোঃ নাহিদুল ইসলাম
ফোর্থ ইয়ারে এসে স্টাডি ট্যুর দিতে চায়নায় আসা । মহাপ্রাচীর নামক আশ্চর্য জিনিস দেখতে গেলাম একদিন। ওইখানেই হাতের নাইকনটা দিয়ে দূরের পাহাড়গুলা কেমন দেখায় সেটাই দেখার চেষ্টা করছিলাম। তখনই কেউ একজন সুরেলা গলায় বলল “তুমি কি আমাদের একটা ছবি তুলে দেবে?”। ফিরে দেখি এক বিদেশিনী, সম্ভবত ল্যাটিন তার আরও দুজন বন্ধু নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি মাথা নাড়তেই সে তার হাতের ক্যামেরাটা এগিয়ে দিতে গেল, কিন্তু বিধিবাম ফিতায় টান খেয়ে কিভাবে জানি ক্যামেরাটা পপাত ধরণীতল। মেয়েটা একটা হাহাকারের মত শব্দ করে ক্যামেরাটা তুলে দেখে জিনিসটা আপাতত আউট অফ অর্ডার । বেচারীর চেহারাটা হলো দেখার মত। আমার কেন জানি মায়া লাগল খুব। বললাম যে তোমরা দাড়াও, আমি আমার ক্যামেরাটা দিয়ে তুলে দিচ্ছি। সে মন খারাপের হাসি দিয়ে দাড়িয়ে গেল অবশ্য । আমি বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। বেশ ফটোজনিক চেহারা মেয়েটার, সুন্দর ছবি উঠল কয়েকটা। আমি ছবিগুলো তাকে দেখাতে গেলামঃ
-সুন্দর ছবি উঠেছে তোমার
-হুম । কিন্তু ছবিগুলো তো পাচ্ছি না ।
-তুমি চাইলে আমি শহরের কোন কফিশপে এসে তোমাকে দিয়ে যেতে পারি
-আমরা আজকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি । সময় হবে না ।
-ও আচ্ছা, তাহলে তোমার ফেসবুক আইডি কিংবা ইমেইল এড্রেস দিলে আমি পাঠিয়ে দিতে পারি ।
এই বুদ্ধিটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে সেটা আমি তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম । গুডবাই বলে ওরা অন্যদিকে চলে গেল তারপর । আর এভাবেই আমার লিয়ানার সাথে পরিচয় ।
বিদেশিনীর ফেসবুক আইডিটা খুজে বের করলাম দেশে ফিরে এসে । ছবিগুলা পাঠিয়ে দিলাম তারপর । ওর প্রোফাইল ঘুরে দেখলাম নানা জায়গায় তোলা তার অনেক ছবি । তখন ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম মেয়েটা দেখতে ভালই । বিশেষ করে তার চুল, পানির রং কালো হলে সম্ভবত এমনই দেখাতো । এটা অবশ্য আমার কথা না, এক লেখকের কথা । তবে লিয়ানার চুল দেখে বুঝলাম ভদ্রলোক মোটেও বানিয়ে বানিয়ে বলেন নি । কোন ভিনদেশী মেয়ের চুল এত চমৎকার হতে পারে সেটা আমি ভাবিনি । ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম সেদিন । পরদিন দেখলাম সে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়েছে । মনে মনে নিজেকে একটা গাল দিলাম, কেন আমার মাথায় এটা আসলো না । রাজি হতে আপত্তি ছিল না আমার । সেদিনই পরে দেখেছিলাম যে সে একটা মেসেজ দিয়েছে । লিয়ানার সাথে গল্পের শুরুটা হলো তখন থেকে।
-ধন্যবাদ
-এ আর এমন কি
-তোমার ছবি তোলার হাত ভাল
-ধন্যবাদ । তোমার চেহারাও খুব ফটোজনিক । ক্যামেরার চোখেও সুন্দর দেখায় খুব
-ক্যামেরার চোখ মানে লেন্স আর কি
-সেটাই । কিন্তু আমি চোখ বলি
-ভাল ফটোগ্রাফাররা এমনই বলে
-আমি ভাল ফটোগ্রাফার না । তবে চেষ্টা করি শেখাতে
-মানে?
-মানে আমার ধারণা সৌন্দর্য্য বোঝার মত ক্ষমতা মানুষের চোখের চেয়ে বেশী কিছুর হতে পারে না । সেই সৌন্দর্য্য খুঁজে নিতে হয় কিভাবে সেটাই আমরা ক্যামেরাকে শেখানোর চেষ্টা করি ।
-ইমপ্রেসিভ । তুমি কি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার?
- না না, আমি এমনি শখের ফটোগ্রাফার । এদিক ওদিক বেড়াতে গেলে ছবি তুলি । তুলতে ভাল লাগে
-তুমি তাহলে অনেক বেড়াও?
-বেড়াতে কার না ভাল লাগে? আমিও চেষ্টা করি বেড়ানোর । এই যা
-আমারও খুব ঘুরতে ভাল লাগে । আমি কয়দিন পরপরই এখানে ওখানে ঘুরে আসি
-ভাল তো
এভাবে কথা বাড়তে থাকে । জানলাম যে লিয়ানা স্প্যানিশ । স্পেনের ভ্যালেন্সিয়ায় থাকে । পড়াশোনা করছে ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এ । ঘুরে বেড়ানোটা তার শখ, প্যাশন যাই বলি না কেন । ওর সাথে কথা হতো নানা বিষয়ে । ও বলত ভ্যালেন্সিয়ার ক্যাথিড্রাল, মিউজিয়াম, পার্ক, স্টেডিয়ামের কথা । আমি বলতাম আমার দেশের মেজবান, পুরান ঢাকার ইফতার কিংবা শীতের পিঠার কথা । সে কোথা থেকে বেড়িয়ে আসলেই আমাকে বলা শুরু করত নতুন দেখা নদীটির কথা, কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় নানা রঙে রঙিন বরফের কথা । আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । এইসব জায়গায় বেড়ানো নিয়ে গল্প বলার ক্ষমতা ছিল তার অসাধারণ । নতুন নতুন জায়গা দেখার ব্যাপারে ওর আগ্রহ সীমাহীন । আমি বলতাম যে একটা দেশের প্রকৃতি অবশ্যই সুন্দর, অতুলনীয় । তবে দেশের সৌন্দর্য্য সত্যিকার ভাবে বোঝা যায় সেই দেশের মানুষ আর কালচারে । ও মানতে চাইতো না সবসময় । বলতো প্রকৃতি বানিয়েছে সৃষ্টিকর্তা, সেই রূপের সাথে কোন কিছুর তুলনা হতে পারে না । আমি বলতাম নদী, পাহাড় এসব দুটো দেশে যতটুকু আলাদা, যতটা ভিন্ন সাজে সজ্জিত, তার চেয়ে দুটো দেশের মানুষ আরও অনেক বেশী রঙ ধরে রাখে । এইসব নিয়ে তর্কাতর্কি আমি কম করি নি । ও আমাকে বলত স্পেনে বেড়াতে যেতে । ও নাকি আমাকে স্যান সেবাস্তিয়ান, মাদ্রিদ, গ্রানাডা, কাতালোনিয়া, ক্যাথিড্রালগুলো সব দেখিয়ে আনবে । জায়গাগুলো নাকি এত সুন্দর যে আমার মনে হবে আমি কল্পনার রাজ্যে চলে গেছি । ওর বলার ঢং দেখে আমি হেসে ফেলতাম, আমি বলতাম যে স্পেনে গেলে আমি দেখব তোমাদের খাবারের দোকান, বুলফাইট, ফেরিয়া ডি অ্যাবিল এইসব । তার চেহারা তো আর দেখতাম না কিন্তু আমি জানতাম সে শুনে ঠোঁট উল্টাতো । আমি ওকে বলতাম কখনো যদি এই বাংলাদেশে আসো তো তোমাকে আমি পাহাড়, সাগর তো দেখাবই । আরও দেখাবো মানুষ । তখন তুমি বুঝবে যে মানুষের সৌন্দর্য্যটা কোথায় । আমার কথা শুনে সে খুব সিরিয়াস হয়ে যেত । বলত একদিন সে আসবে এই দেশে ।
এভাবেই সময়গুলো কেটে যায় । থ্রেডের মেসেজ সংখ্যাও বাড়তে থাকে । প্রেমে পড়া বলতে কি বোঝায় সেটা আমি জানতাম না কিন্তু সাত সমুদ্রের ওই তীরের এই বিদেশিনী অল্প সময়েই আমার মনের একটা বড় অংশ দখল করে নিল । ওর সাথে কথা বলার জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম । ইচ্ছে হত একটা জাহাজ ভাসিয়ে চলে যাই স্পেনে । অবশ্য আমি বাস্তববাদী । ওই বিদেশিনী যে আমার সাথে গল্প করছে তার আরও আট দশটা বন্ধুর মত সেটা আমি জানতাম, সে যে আমার চেয়ে এক বছরের বড় সেটাও আমি জানতাম, আমি জানতাম যে এই দেশের কোন মেয়ের সাথে আমার কখনো এত ভাল সম্পর্ক হয়নি তাই লিয়ানাকে আমি অনুভব করি । আমি জানতাম যে হুয়ান নামের অন্য এক স্প্যানিয়ার্ড লিয়ানার রাজপুত্র । আমার তারপরও কোন দুঃখ ছিল না, ছোট্ট এই গরীব দেশের এক তরুণের জন্য ঐতিহ্যবাহী স্পেন দেশের এক তরুণী সব ছেড়েছুড়ে চলে আসবে না এটা আমি সহজেই মেনে নিয়েছিলাম ।
মাঝখানে লিয়ানার কথা বার্তা কমে গিয়েছিল । জানতে চাইলে সে বলে হুয়ানের সাথে নাকি তার ঝামেলা হচ্ছে কিছু ব্যাপারে । আমি আর বেশী কিছু জানতে চাইনি । তারপরই হঠাৎ করে একদিন ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল । আমি ওকে অনলাইনে পাচ্ছিলাম না, মেইল করেও পাচ্ছিলাম না । কখনো ফোনে কথা হয়নি আমাদের, তাই ফোন নাম্বারও জানতাম না । লিয়ানাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখিনি কিন্তু ওর সাথে কথা না হওয়া একেকটা দিন আমার কাছে একেকটা বছর মনে হয় । প্রতিদিনই অনলাইনে স্পেনের খোঁজখবর নেই, যে কোন দুর্ঘটনা ঘটলো কিনা? বন্ধু বান্ধবরা সান্তনা দিয়ে বলত যে এমনটাই হবার কথা ছিল, আমিও জানতাম সেটা কিন্তু আমি মেনে নিতে পারি নি ।
দু সপ্তাহ পর একদিন মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার ।
- হ্যালো?
- নিষাদ?
- কে বলছেন?
- নিষাদ, আমি লিয়ানা ।
- তুমি? কোথায় ছিলে তুমি এ কয়দিন?
- আমি আসলে নতুন একটা লম্বা ট্যুরের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম ।
- ট্যুর? কোথায়?
- বাংলাদেশে । আমি এয়ারপোর্টে । আমাকে এসে নিয়ে যাও ।
আমার বাসার পাশে ঘুরঘুর করা বেড়ালটা যদি মানুষের মত কথা বলা শুরু করত তাহলেও বোধহয় আমি এত অবাক হতাম না । কতদিন পর আমি ওকে আবার দেখলাম, ও যখন আমাকে এয়ারপোর্টে জড়িয়ে ধরল তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না । মনে হচ্ছিল ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে গেছি, আর এই স্বপ্নটা দেখছি । ওকে সেদিন হোটেলে পৌছে দেই । ও বেশ লম্বা ছুটি নিয়ে এসেছিল, আমিও ক্লাস-টাস বাদ দিয়ে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাংলাদেশ দেখতে । ওর সাথে দেড়মাস আমি ঘুরে বেড়িয়েছি সমুদ্র থেকে মেঘে ঢাকা পাহাড়ে, সবুজ ধানক্ষেত থেকে ইট কাঠের জঙ্গলে । বান্দরবানে গিয়ে ও যখন আমাদের নিচ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘগুলো দেখে ছোট্ট মেয়ে হয়ে গেল তখন আমি বুঝলাম ওই জায়গার আসল রূপ কোথায়, কিংবা সেন্টমার্টিনের চন্দ্রাহত সৈকতে সে যখন হঠাৎ বিষন্ন হয়ে গেল তখন আমার মনে হলো আমার মনের হাহাকারগুলোই সাগরের ঢেউয়ে চেপে ফিরে ফিরে আসছে । ওই সময়টুকু ছিল আমার জীবনের সেরা সময় । কত জায়গায় ঘুরেছিলাম আমরা, প্রতিটা দিনে আমরা নতুন করে বুঝেছি যে আমরা আসলে একে অপরকে ছাড়া কতটা অচল । তারপর চলে এল বিদায়বেলা ।
- নিষাদ, তুমি স্পেনে কবে আসবে? ওই দেশটাও কিন্তু কম সুন্দর না ।
- জানি না অতকিছু । স্পেনে গেলে শুধু একটা জিনিসই দেখার জন্য যাবো
- কি? বুলফাইট?
- না, তুমি ।
একথা শোনার পর লিয়ানা কি বলবে সেটা আমি জানতাম । সে বলেছিল “নিষাদ, তোমাকে আমার অসম্ভব পছন্দ । কিন্তু তুমি যেটা চাইছো সেটা আসলে হবার না । আমার স্বপ্ন সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াব অভিযাত্রী হয়ে । আমার কি পিছুটান রাখলে চলে? বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ । আর আমাকে ভুল বুঝ না । ” আমি চেষ্টা ছাড়াই বুঝেছিলাম । আমি বাস্তববাদী, বাস্তবতা যখন লিয়ানার রূপ ধরে এসে সামনে দাড়ায়, আর কটাক্ষ করে তখন আমি সেটা হাসিমুখেই মেনে নেই । তার ঠোঁটের শেষ স্পর্শ অনুভব করে আমি অনেকটা বছর পার করি ।
প্রায় দেড় বছর পর আজকের পহেলা বৈশাখে আমার ঘুম ভাঙ্গে আরেকটা ফোনে, ওপাশ থেকে সেই সুরেলা কন্ঠ বলে ওঠে, “নিষাদ, আমি তোমার শহরের একটা হোটেলে উঠেছি । আমাকে নিতে আসো প্লিজ । তোমার সাথে আমার অনেক কথা জমে আছে” । আমি আবার মোহগ্রস্তের মত এটাকে স্বপ্ন ভেবে বেরিয়ে পড়ি । যখন লিয়ানা আমার সামনে বাঙ্গালী মেয়ের মত বৈশাখের শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমার তখনও নিজেকে নেশাগ্রস্ত মাতাল মনে হয় ।
-তুমি? কবে এল এখানে?
-গতকাল । শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?
-অন্যরকম । তুমি শাড়ি পরা শিখলে কোথা থেকে?
-আমেরিকায় গিয়েছিলাম । ওখানে এক বাঙ্গালী মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছিল, উনি শিখিয়েছেন
-এবার কতদিন থাকবে?
-তুমি যতদিন রাখবে
-মানে কি?
-মানে হলো, নিষাদ আমি তোমার কথা বুঝতে পেরেছি । তোমার সাথে সেই বিদায়ের পর আমি আরও কয়েক দেশ ঘুরে ফেলেছি, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন, নায়াগ্রা ফলস, রকি মাউন্টেন, অস্ট্রেলিয়া এতকিছু দেখেও আমি আগের মত প্রকৃতিকে বুঝতে পারি নি । প্রতিটা জায়গায় আমার খালি মনে হচ্ছিল ছবির একটা রং বাদ পড়ে গেছে । তারপর আমি বুঝতে পারলাম তুমিই ঠিক বলেছিলে, প্রকৃতি সুন্দর, বিচিত্র । তার চেয়েও বিচিত্র মানুষ । আমি আমার সবচেয়ে পছন্দের রংটাই এখানে ফেলে গেছি, আমার তো পাহাড় নদী ভাল লাগবে না এই রং ছাড়া । আমার সারা দুনিয়া চষে বেড়ানোর দরকার নেই, আমার সারা দুনিয়া এখানেই রয়ে গেছে ।
লিয়ানা শক্ত মেয়ে । ও নাকি কান্নাকাটি করে না খুব একটা । কিন্তু আজ সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল । ও যেখানকার মানুষ ওর জন্য পাবলিক প্লেসে এমনটা কোন ব্যাপার না , আমার জন্য তো বিরাট কিছু । আশেপাশের সব মানুষ তাকিয়ে আছে । থাক, কাদুঁক সে । মাঝে মাঝে কান্নাকাটির দরকার আছে । আমার চোখে কি জানি পড়েছে একটা, পানি টলটল করছে । মাঝে মাঝে চোখে কিছু পড়ার দরকার আছে ।