লেখাঃ সুষমা আপ্লুত
কিছু কিছু বিকেলের গায়ে বিষণ্ণ একটা রোদের চাদর মাখানো থাকে, আর কোন কোন বিকেলে উগ্র একটা তেজী রোদ গাল ফুলিয়ে জাপটে ধরে রাখে বিকেলটাকে , যেন সন্ধ্যেটা নামতে গেলেই ভীষণ রেগেমেগে একটা কান্ড বাঁধাবে । কিঅদ্ভুত যে লাগে শেফার। পরপর দুটো দিন, কি ভীষণ অন্যরকম। প্লাস্টিকের জুতোর র্যাক থেকে স্লিপারটা নিয়ে পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে পড়ে শেফা টিউশনিতে যাবে বলে। শীতের শেষে বিকেলের এই সময়টা দ্রুত হাঁটতে খুব একটা খারাপ লাগেনা, কিন্তু আজ রোদের তেজটাও বেশি, চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। তার উপর বাসা থেকে বের হতেই অনেকখানি দেরি হয়ে গেছে আর পরপর দুটো বাসে এত ভিড় যে উঠতেই পারল না । দেরি হয়ে যাবে বলে অনেকখানি হেঁটে মিরপুর রোডের একটা বাসে উঠতে পারে শেফা । অনেকদিন ধরেই একটা সানগ্লাস কিনবে বলে মনে মনে ভেবেছে সে কিন্তু কেনাটা আর হয়ে উঠছে না। হ্যান্ডব্যাগের একটা চেইন ছিঁড়েগেছে, পায়ের স্লিপারটার অবস্থাও সুবিধার না, কবে যে আবার ছিঁড়ে যায় কে জানে। ছোটবোন রাফার ছাতাটা ভুলে কলেজে রেখে এসেছিল বলে শেফা ওরটা দিয়ে দিয়েছে। কত কি যে কেনার বাকি! টিউশনির টাকাটা মাসের বিশদিন যেতেই কোন ফাঁকে যে ফুড়ুৎ হয়ে যায় বুঝেই পায়না। তবু এ মাসে বেতন পেলেই সবার প্রথমে সানগ্লাস কিনবে বলে মনে মনে ঠিক করে শেফা। সানগ্লাস শব্দটা শেফার একদমই পছন্দ না , রোদচশমা শব্দ টা কি সুন্দর না? মনে হয় চশমার গায়ে রোদের ওম ওম মিষ্টি গন্ধ লেগে থাকে!
টিউশনি শেষ করে ফিরবে, এমন সময় তার ছাত্রী ইতু ওর দিকে একটা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলল, মিস, কাল আমরা সবাই খালামনির বিয়ের জন্যনানুবাড়ি যাচ্ছি, তাই এ মাসের বেতনটা আপনাকে মা দিতে বলেছে। আর কবে পড়াতে আসতে হবে, আমরা বাসায় ফিরে আপনাকে ফোন দেব, তার আগে আর আসতে হবেনা। একে কয়েকদিন টিউশনির ছুটি, তারপর প্রায় খালি হাত থাকা অবস্থা কয়েকদিন আগেই বেতন, কোনটাতে যে বেশি খুশি হওয়া উচিৎ ভেবেই পেলনা শেফা। ছাত্রীর বাসা থেকে বেরিয়ে সরাসরি নিউমার্কেট। চশমার দোকানে ঢুকে যে সানগ্লাসই পছন্দ হয় দোকানী এমন দাম বলে যে সেটা কিনতে গেলে অর্ধেক মাস তার না খেয়ে থাকতে হবে। শেষমেশ মন খারাপ করে শেফা অনেক বেছে দামাদামি করেমোটামুটি পছন্দসই একটা সানগ্লাস কিনে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ৭টা, শেফার ছেলেমানুষি ইচ্ছা হয় সানগ্লাসটা চোখে দেয়ার। বিশাল এই শহরের আলো ঝকমকে নিয়ন ,সোডিয়াম বামার্কারীর ছটায় নিতান্ত এলেবেলে ফ্যাশন জ্ঞানহীন একজন শেফা কেন এই রাতেরবেলা সানগ্লাস চোখে দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বা তাকে কেমন মানিয়েছে সেটা দেখার সময় এই শহরের কারো কি আছে?
বাসায় ঢুকতেই ছোট বোন রাফার সাথে দেখা। রাফা এসে ছোঁ মেরে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। তারপর রাফাকে রাগাতে বলে, মিস ভেটকি মাছ, এই সানগ্লাসটা তো সেরকম হয়েছে। তোর চয়েস যেরকম ক্ষ্যাত, এইটা কেম্নে কিনলি!আমাকে দিয়ে দে না, তুই আরেকটা কিনে নিস। বলেই রাফা শেফার পারমিশনের থোড়াই কেয়ার করে সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে মাকে দেখাতে চলে গেল। রাফা অবশ্য ঠিকই বলেছে, জামাকাপড় কিংবা এই জাতীয় ফ্যাশনেবল জিনিস কেনাকাটায় শেফা একদম আনাড়ি।ছোটবেলা থেকেই তার গল্পের বইয়ে আগ্রহ বেশি। তাছাড়া সেটা তার কাছে বেশ অপচয় ও লাগে,ম্যাচিং নেইল পলিশ বা একটা পায়েলের দামে অনায়াসে একটা গল্পের বই কেনা যায় । যেসময়ে এত্তটুকু রাফা মায়ের ড্রেসিং টেবিল থেকে লিপস্টিক নিয়ে গালে মুখে লাগিয়ে ভূত সাজত, সেই সময়েও শেফার ইচ্ছে হয়নি এসব ছুঁয়ে দেখার।কিন্তু হঠাত এতকিছু রেখে সানগ্লাস কেনার ইচ্ছের পিছনের কারণটা বেশ অদ্ভুত!
সেদিন বিকেলে একটা বই পড়ে তার প্রথম সানগ্লাস কিনতে ইচ্ছা জাগে । বইয়ের তরুনী মেয়েটা একদিন দুপুরবেলা কলেজ থেকে বাড়ি না গিয়ে তার ভালবাসার মানুষটির সাথে বেড়াতে বের হয়। সারাদিন ঘুরাঘুরি , ইতং বিতং গল্প শেষে সন্ধ্যার মুখে যখন উচ্ছ্বল মেয়েটা এক লাখ একটা স্বপ্নের ঘোর নিয়ে বাড়ি ফিরবে, ঠিক তখন ছেলেটা মেয়েটাকে বলে, দেখ, তোমাকে কিছু কথা বলি। আজকেই আমাদের শেষ দেখা। তারপর নিতান্ত তুচ্ছ কিছু পারিবারিক কারণ দেখিয়ে সম্পর্কের ইতি টেনে আর মেয়েটার মনে উড়তে থাকা হাজারো প্রজাপতির ডানা কেটে কাপুরুষ ছেলেটা মেয়েটাকে রেখে চলে যায়, কে জানে হয়তো অন্য কোন মেয়ের স্বপ্ন ভাঙবে বলে। হতবিহ্বল মেয়েটা কিছুক্ষণ একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর গলার কাছের দলা পাকানো কান্নাটা ক্রমশ চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।হাজার চেষ্টা করেও মেয়েটা থামাতে পারেনা, ঠিক তখন বাকি সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি থেকে বাঁচতে সানগ্লাসের আড়ালে চোখ ঢেকে বাড়ির পথ ধরে।
ওই গল্পের বই পড়ার পর থেকেই শেফার ইচ্ছে হয়েছে সানগ্লাস কেনার। সানগ্লাস দিয়ে তাহলে দুঃখ ও ঢেকে রাখা যায়! শেফার মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কোন সাদামাটা তরুণীর জীবনে যখন তখন কোন কান্নার উপলক্ষ্য চলে আসাটা তেমন বিচিত্র তো কিছু না।
শেফার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়েছে মাস সাতেক হল,এর মধ্যে কম করে হলেও শ’খানেক জায়গায় এপ্লাই করেছে, সিভি ড্রপ করেছে, বেশ কয়েকটা সরকারি চাকরির লিখিত পরীক্ষাও দিয়েছে। কিন্তু কেন যেন সকলের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। কয়েকটা চাকরির ইন্টারভিউতে গিয়ে মনে হয়েছে এবারে নিশ্চয় চাকরিটা তার হবেই, কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা তার জীবনে এখনো আসেনি। নিজের খরচ, ছোটবোনটার টুকিটাকি আর সংসারের এটা সেটার খরচ চালাতে দুইটা টিউশনি করে শেফা। কিন্তু বছরের শেষের দিকে সব স্কুল ছুটি বলে আপাতত ইতুর টিউশনিটাই আছে। কলেজ জীবন থেকেই টিউশনি করে আসছে সে।একলা বাবার কাঁধে এই ঢাকা শহরে সংসারের ভার বড্ড বেশি, এইজন্যই শেফার খুব বেশি চাকরিটা দরকার। তার উপর বাবার দোকানটার ব্যাবসাপাতিও এই অবরোধ, হরতালের কারণে খুব বেশি ভাল না। শেফার মাঝে মাঝে মনে হয় মাথার উপর বিশাল একটা হিমালয় নিয়ে চলাফেরা করতে হয় তার, কবে যে একটা সুসংবাদ পাবে!
পরদিন বিকেলে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ইন্টারভিউ থেকে বের হবার পর শেফার যতটুকু মন খারাপ হওয়ার কথা ছিল, সেরকম কিছুই হলনা। সে জানে, এই চাকরিটা তার হবেনা। পড়াশুনা, রেজাল্ট এসবের বাইরেও হয়ত কিছু ব্যাপার থাকে যার মাপকাঠিতে শেফার মত নিতান্তই সাধারণ মেয়ে জুতসই না। এই সমাজে সুন্দরী মেয়ে বলতে যেমন বোঝায় বা বইয়ের পাতায় নায়িকার বর্ণনা যেমন থাকে, শেফা সেই দলে পড়েনা কখনোই। চটপট করে অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলতে পারেনা, বন্ধুদের সাথে কখনো সখনো বড় শপিং মলগুলোতে গেলে উইন্ডো শপিং এর বৃত্ত থেকে বের হবার সাধ্যটুকু শেফার পার্সের কখনো হয়ে ওঠেনা বলেই কিছুটা আড়ষ্টতা থেকেই যায়। সে সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারেনা, অন্যের সাথে খাতির জমিয়ে নিজের কাজ আদায় করতে পারেনা। বন্ধুদের সাথে একসাথে ঝালমুড়ি বা ভেলপুরী খেয়ে অন্য সবার মত আমি সবার বিল দিচ্ছি বলতে বলতে অন্যেরা টাকা বের করা পর্যন্ত ব্যাগ হাতড়ানোর কৌশলটাও তার জানা নেই । বন্ধুদের আড্ডায় রিসেন্ট ট্রেন্ড, ফ্যাশন, নতুন মুভির একশন হিরো বা ফেসবুকের চ্যাট হিস্ট্রি এই বিষয়ে বলার মত কোন নেই শেফার। শেফা যেটা ভাল পারে তা হল বইয়ের মাঝে নাক ডুবিয়ে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে দিতে, সেখানে লাগাম থাকেনা, সেখানে শেফার পৃথিবীর বৃত্তের পরিধি চাইলেও ছোঁয়া যায়না।
আনমনা হয়ে ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতেই মোবাইলে কল আসে শেফার। বাসা থেকে কল দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করেই রাফার গলা শুনতে পায়। রাফা হড়বড় করে যা বলে তার সারমর্ম হল বাবার দোকানের সামনের রাস্তায় কারা পেট্রোল বোমা মেরেছে। বাসের একটা জ্বলন্ত টুকরো ছিটকে দোকানে পড়ে। দোকানে কাগজের ব্যাগ রাখা ছিল ওখানে, সাথে সাথে আগুন ধরে যায়। আগুন নিভাতে নিভাতে দোকানের অনেকখানি পুড়ে গিয়েছে,বেশ মালপত্র নষ্ট হয়েছে । বাবা দুপুরের খাবার পর তখনো ফেরেননি, কিন্তু দোকানের ছেলেটার হাতের বেশ খানিকটা জায়গা পুড়ে গিয়েছে।
আগেরদিন পাওয়া টিউশনির টাকাটা ব্যাগেই ছিল,বের করতে মনে ছিলনা। শেফা সেই টাকাটা নিয়ে ছুট লাগায় হাসপাতালে। বার্ন ইউনিটে জায়গা নেই, অনেকে মেঝেতে বিছানা পেতে আছে, দেয়ালের দিকে দেখতে পায় বাবার দোকানের কর্মচারী সুমন কে। যন্ত্রণাকাতর মুখে বসে আছে। পাশে শেফার বাবা। কিছুক্ষণ পর শেফা টাকাটা বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলে, বাবা সুমনের ওষুধগুলো কিনে ফেল। আমি একটু আসছি। বাবাকে কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে হাসপাতালের বাইরে চলে আসে শেফা। সে জানেনা, পরের মাসে বেতন পাওয়ার আগ পর্যন্ত কিভাবে চলবে। ব্যাগ, স্লিপার, ছাতা কিংবা দু-চারদিনের খাবার ছাড়াই এই শহরে বেঁচে থাকার জন্যই হাজার মানুষ বেঁচে আছে। নিজের অজান্তেই কখন চোখে পানি চলে এসেছে জানেনা সে। গালে গরম পানির ছোঁয়া বুঝতে পেরেও মুছার চেষ্টা করেনা। একদম স্বার্থপরের মত শেফার মনে হয়, রোদ, বৃষ্টি, জ্যোৎস্না কিংবা জনসমুদ্রে নিভৃতে কাঁদার জন্য তার কি অন্তত একটা রোদচশমা থাকতে পারত?