লিখেছেন - মোরশেদা কাইয়ুমি
***
এই রিক্সা !এই ! দ্রুত হেঁটে সামনের রিক্সাটাকে ধরতে চায় নিধি । পেছনে থেকে ডাকায় ওর চোখে পড়েনা রিক্সায় বসা নিষাদকে । নিষাদই রিক্সাটা থামিয়ে দিয়ে পেছন ফিরে বলে > কিরে? দেরি হয়ে গেছে ??আয় তোকে নামিয়ে দিয়ে যাই। > স্যরি ভাইয়া!আমি আপনাকে দেখিনি ।আমি চলে যেতে পারবো,আপনি যান । নিষাদ আর কিছু না বলে চলে যায় ।জানে যে বলেও কোন লাভ হবেনা ওকে ।যা বলে তার থেকে কেউ সরাতে পারেনা কোনদিন। সেই ছোট থেকে দেখে আসছে কেমন যেন জেদী একটা মেয়ে ।তবে নিজের কথাটা ধরে রাখলেও এমনিতে যথেষ্ট শান্ত একটা মেয়ে।
নিধিকে দেখলে কেমন জানি অসহায় লাগে নিষাদের ।মনে হয় ও খুব বেশি অন্যায় করেছে নিধির সাথে। কিন্তু ওর কি ই বা করার ছিলো??সেও তো কিছু বলেনি মুখ ফুটে আর প্রান্তিকে দেখে মাথাটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো । নিষাদের রিক্সার পেছন পেছন হাঁটতে থাকে নিধি ।অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে এরইমধ্যে। সে কি চাইলেই উঠতে পারতোনা নিষাদের রিক্সায় ?? নাহ্ !দেরি হবে হোক ।সারা জীবনের পথ যেখানে আলাদা হয়ে গেছে সেখানে কি হবে এইটুকু পথ একসাথে চলে ?? নিধি জোরে পা চালিয়ে ক্লাসটা ধরার ট্রাই করে। দেরি হলে পুরো টাইমটা ম্যাম বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবে। অসহ্য লাগে ছেলেদের বিটলামি মার্কা হাসিটুকু। এতটা বদমেজাজী কেমনে হয় মানুষ?? পথেই আবিদের সাথে দেখা , > কিরে? আজো দেরি ??দৌঁড় লাগা নাইলে খবর আছে । > আর পারিনারে! বিরক্ত লাগে প্রতিদিন এই পিচ্চিদের মত দৌঁড়ে দৌঁড় ক্লাস করতে আসতে। এই ম্যামের মাথা থেকে বদমেজাজি ভুতটা তাড়াতে কি তোরা কিছু করতে পারিসনা?? > হাহাহা!! কি করবো বল?ঘর বাড়ি থেকে জ্বিন ভুত তাড়াতে বন্দ করে যে ওভাবে কি ম্যামরে ও করা লাগবে? > দুর শয়তান। যা ক্লাসে ।নাইলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লাগবে ।
নিধির বন্ধু বলতে এই এক আবিদই। তাও শুধুই বন্ধু তারা ।আবিদ যদিও এরইমধ্যে কয়েকবার কাচুমাচু করে ভালবাসার কথা বলতে চেয়েছে! কিন্তু নিধির নির্লিপ্ততায় বেশি দূর এগুতে পারেনা ।ও ভয় পায় শান্ত সৌম্য মায়াবী এই মেয়েটার হালকা পাতলা জেদটাকে ।হয়তো দেখা যাবে তাদের বন্ধুত্বাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।এসব ভেবে কিছুদিন ঠিক থাকলেও তারপর ও মনটাকে কিছুতেই মানাতে পারেনা।
নিধির ছোটবেলার রাজকুমার এই নিষাদ ।ভালবাসা কি বুঝে উঠার আগেই সে নিষাদের চোখে খুঁজে পেয়েছিলো ভালবাসার এক বিশাল সাগর । একসাথে বেড়ে উঠার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে নিধির। এমন কোন খেলা ছিলোনা তারা খেলেনি ছোট্টবেলার দিনগুলোতে । একঝাঁক পিচ্চির অলিখিত সর্দার ছিলো নিষাদ। কখনো ফুলকুমার সেজে নিধির হৃদয় আকাশে উড়ে বেড়াতো,কখনো বা কানামাছি খেলতে গিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিতো নিধির উড়ন্ত চুলগুলোকে। পিচ্চি আদুরে বুড়ির মনে তখন এসব ভালবাসার অনুভুতির জন্ম নেয়ার কথা না ,নেয়ওনি। ওরা শুধু জানতো সব খেলাতেই তাদের জুটি হতে হবে,জানতো একজন না খেললে আরেকজনের খেলার সব আনন্দই মাটি হয়ে যায়। একটু একটু করে বেড়ে উঠে দুজন ,বেড়ে উঠে তাদের ভেতরে ভালবাসাটাও । নাহ্ কখনোই মুখ ফুটে বলেনি নিধি "ভালবাসি"। এটা যে মুখে বলার মত কোন বিষয় তার মাথায় ও আসেনি কোনদিন। হয়তো এটাই তার জন্য কাল হয়ে গিয়েছিলো। নিধির ভাবনা ছিলো ভালবাসাটা মুখে বলার মত কিছু হতে পারেনা ।যাকে কিনা ভালবেসে আসছে ছোট থেকেই ,তাকে কেন এই বড়বেলায় এসে ভালবাসি বলে ন্যাকামি করা লাগবে ?? ভালবাসাটা নিধির কাছে ছিলো ভালবাসার এক অনুভুতির নাম !যেটা কিনা দুটো হৃদয় অনুভব করে নেবে। এখানে মুখে বলার মত কিছু থাকতে পারে নাকি?? কিন্তু নিধির মনে একটিবার ও আসেনি যে তার ছোট্ট ফুলকুমারটা আর ছোট্টটি নেই। সেও আর ছোট্ট বুড়িটি নেই যে তাকে ছাড়া নিষাদের হাসি আনন্দ সব মাটি হয়ে যাবে। তারা যে শুধুই খেলার সাথী ,খেলার জুটি ,বাস্তবের কিচ্ছুইনা এটা বুঝে আসতে অনেক দিন লেগে যায় নিধির। নিষাদ কি তাকে কখনোই ভালবাসেনি ??তাকে কি শুধুই খেলার সাথী হিসেবেই দেখতো? না তার শারিরীক দুর্বলতাই তাকে নিষাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু সত্যিকারের ভালবাসায় এটা কি করে বাঁধা হতে পারে ??
সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে চলন্ত একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় নিধি। আঘাতটা ঠিক কোথায় লাগে বুঝা যায়না তখন। রক্তে ভেসে যায় চারপাশ।
পেছনেই ছিলো আবিদ, তার কয়কজন বন্ধুর সাথে ।ওরা দৌঁড়ে এসে নিধিকে নিয়ে হাসপাতাল যায় ।নিধিকে বাঁচানো গেলেও ওর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায় ।বাম চোখটা পুরাই নষ্ট হয়ে যায় নিধির। ডান চোখে ও এখন কি পুরো পৃথিবীটা দেখতে পায়? ওর অর্ধেকটা পৃথিবী জুড়ে ছিলো নিষাদ আর বাকি অর্ধেকে বাকি সব । এমনিতেইতো ওর পৃথিবী অন্ধকারে ঢেকে গেছে অনেক আগেই !কি আর হবে বেঁচে থেকে ?
আবিদ তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যায় নিধিকে একটু ভাল রাখার ,আরো বেশি বেশি ভালবেসে যাওয়ার। আবিদ অনেক চেষ্টা করেও নিধির মনের ঘরে একটা টোকা পর্যন্ত দিতে পারেনা । নিধি নিজেকে পুরা বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে । নিষাদ ও তাকে নিয়ম করে বিকেলে দেখে যায় ।সাথে কখনোবা ওর সুন্দরী বউটা থাকে ,কখনোবা মায়াবী মেয়েটা । নিধির মাথার কাছে বসে থাকে নিষাদের বউটা ,তাকে ঠিক ছোটবোনের মতই ভালবাসে ।
খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে খালাতো বোনটার চাপে দশ দিন কাটিয়ে এসে শুনে নিষাদ পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে! তারই কলেজের একটা অতি সুন্দরী মেয়েকে। মনে পড়ে কয়েক মাস আগেই ওকে একা পেয়ে বলেছিলো > বুড়ি কি করি বলতো?? আমিতো একটা মেয়ের প্রেমে হাত পা ভেঙ্গেই পড়ে গেছি। নিধির কলিজাটা ধক করে উঠেছিলো নিষাদের কথা শুনে । ঠোঁট উল্টে বলে > কি করবা আমি কি জানি??মেয়েটার মনের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাও । অদ্ভুত একটা আবেগে শিহরিত হয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো সেদিন। একটি বারের জন্যও কল্পনা করেনি যে মেয়েটা সে নয়। সেই দিন থেকে ও নিষাদের একটি ডাকের অপেক্ষায় ছিলো ।একটিবারের জন্যও কল্পনা করেনি ,ছোট্টবেলার শ্যামলা বরন মায়াবী এই বুড়ির চেয়ে ওর কাছে কলেজের আধুনিকা সুন্দরী মেয়েটার মূল্য অনেক বেশি। একটিবারের জন্যও কি ওকে ভালবাসেনি নিষাদ ?? তা কি করে হয় ??
নিষাদের বিয়ের পর থেকে অনেকটা এলোমেলো হয়ে যায় নিধি ।পড়ালেখায় ও মন বসাতে পারেনি অনেকদিন ।সেই সময়টায় আবিদ ছিলো ছায়ার মত পাশে! প্রতিদিন বাসা থেকে বের হতো , ক্লাস করতোনা অনেকদিন ।উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতো সারাটাদিন। মনে পড়ে কতবার যে গাড়ির নিচে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো এই আবিদের জন্যই । কিন্তু শেষ রক্ষা হলো আর কই ? সেইই তো পড়লোই ,চোখ ও হারাতে হলো শেষে।
ছায়ার মত পাশে থাকা আবিদকে অনেক চেষ্টা করেও নিষাদের জায়গায় বসাতে পারেনি নিধি । মানুষের মনটা এমন কেন? যার কাছ থেকে অবহেলা ছাড়া কিছু পেলোনা ,সেই ছোট্ট বেলার খেলার সাথীটাকেই এখনো মনে ধারন করে আছে? অথচ যে মানুষটা পাগলের মত ভালবেসে ছায়ার মত পাশে থাকে তাকে কিনা একটিবারের জন্যও বন্ধু ছাড়া কিছু ভাবতে পারলোনা! সত্যি বলতে আবিদ কে ঠকাতে ইচ্ছে করেনা ওর। ও কি পারবে নিষাদকে ভুলে আবিদকে ভালবাসতে পুরোপুরি? কি করে ও এমন একটা ভালবাসার পাগলের সাথে ও অভিনয় করবে?
আবিদ আর মায়ের পাগলামীতে বাধ্য হয়ে চোখের অপারেশন করতে রাজি হয় নিধি । এরই মাঝে একদিন গ্যাস্টিকের ব্যাথা উঠে। পাগলামীর দিন গুলোতে খাওয়া দাওয়ার চরম অনিয়মে অনেক দিন হলো এই অবস্থা। মায়ের বকুনির ভয়ে কখনো ভাল ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। কলেজের পাশে ফার্মেসি থেকেই এটাসেটা অসুধ খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে এতটা দিন ।তাছাড়া সামান্য গ্যাস্টিক কে পাত্তা দেয়ার মত মন মানসিকতাও ছিলোনা ওর তখন। বরং নিজেকে নিত্য নতুন ভাবে কষ্ট দেয়ার বুদ্ধি বের করতো । আলসার ধরা পড়ায় চোখের অপারেশনটা পিছিয়ে যায়। জীবনটাকে ওর আর টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করেনা। অসহ্য কষ্টগুলো ওকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে থাকে । এখন মায়ের ভালবাসা আবিদের পাগলামী ও ওর কাছে অসহ্য যন্ত্রণার মনে হয় । যে সময়টুকু নিষাদের বাচ্চাটা ওর কাছে থাকে সে সময়টুকুই কেবল ও প্রাণ ভরে নি:শ্বাস নিতে পারে ,হাসতে পারে পিচ্চিটার দুষ্টুমিতে ।
প্রায়ই নিধির কাছে আসলে যেতে চায়না নুহা ।নিধি ওকে নানা নামে ডাকে, বুড়ি হচ্ছে ওর প্রিয় ডাক। ওকেও যে তার রাজকুমার বুড়িই ডাকতো।
নিষাদ বউকে নিয়ে বেড়াতে যেতো মাঝে মাঝে নুহাকে নিধিদের বাসায় রেখে। নিধি ইদানিং ওদের ভালবাসা দেখে নিজের কষ্টটুকু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। থাকুক, ভাল থাকুক ওরা ,ভাল থাকুক ভালবাসা। বসন্ত উত্সবে যাবে বলে অনেকদিনের প্রস্তুতি চলছিলো নুহার আম্মু প্রান্তির। নিধিকেও জোর করছিলো খুব। আবিদও একবার বলে আর সাহস পায়নি নিধির নির্লিপ্ততায় ।তবু বাসন্তি শাড়ি চুড়ি আর ফুল নিয়ে এসে নিধির পাশে বসে থাকে চুপচাপ। বলেওনি নিধি এগুলো পরে আসবি একটু ??প্রাণ ভরে দেখতাম একটু। একটু আগেই মোটর সাইকেলে করে বেরিয়ে গেছে ভালবাসার যুগলবন্দী দুজন ।নিধি চোখ ভরা জল মুছে একটু হাসি নিয়ে ওদের এগিয়ে দিয়ে এসে আবিদের পাশে বসে। দুজনের কারো মুখেই কথা জুটেনা ।নিধিই হাত বাড়িয়ে আবিদের আনা সব কিছু নিয়ে বলে >কেন এমন পাগলামী করিস ??মানায় আমাকে এসব ??একচোখ না থাকা অসুন্দর এই মেয়েটার কি বাসন্তি সাজে সাজার অধিকার আছে বল? আবিদের চোখে জল এসে যায়।বলে .. >দোহাই তোর! পরিস না পরিস নিজেকে এভাবে ছোট করিসনা প্লিজ।আমার কাছে তুই কি আর কতটা সেটা তুই না জানিস ,না বুঝিস ঐ উপর ওয়ালা ঠিকই জানে। নিধি কি ভাবে কে জানে। আলতো করে সবকিছু নিয়ে ওর রুমে গিয়ে পরে নেয়। বাসন্তী সাজে বসন্তের রাণী হয়ে বেরিয়ে আসে। মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে আবিদের চোখে মুখে। এই প্রথম নিজেকে সফল একজন মানুষ মনে হতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে দুজন। আবিদ বের হতে চাইলেও নিধির শরীরটা ভাল লাগছিলোনা বলে ও রাজি হলোনা। একটু পর নিধির খারাপ লাগায় সোফাতেই শুয়ে যায়। তাও নুহাকে নিয়ে দুজনেই খুনসুটিতে মেতে থাকে।
রাত দশটা পেরিয়ে গেলেও নিষাদদের আসার নাম নেই দেখে নিধির আম্মু টেনশন করতে থাকে।নিধিকে বলে কল করে খোঁজ নিতে এত দেরি করছে কেন ?? নিধি বলে > মা,থাকনা। নুহা তো কাঁদছেনা।আসুক ওরা ঘুরে ফিরে আস্তে ধীরে।
একটু পর নিধির মায়ের টেনশন দেখে আবিদই কল দেয় নিষাদকে। অনেক বার কল করার পর রিসিভ করে অপরিচিত একজন লোক। অনেক মানুষের হইচই চিল্লাচিল্লিতে যতটুকু বুঝতে পারে নিষাদরা এক্সিডেন্ট করেছে।
ফেরার পথে পেছনে বোমার শব্দে আতংকিত নিষাদ এলোমেলো ভাবে মোটর সাইকেল চালিয়ে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো। কিন্তু মৃত্যুই তাদের ডেকে নিয়েছে পরম মমতায় ।সাজিয়ে দিয়েছে রক্তলাল বাসন্তী সাজে।
আবিদ নিষাদদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লোকটির সাথে কথা শেষ করে খবরটা দেয়ার জন্য রুমে ঢুকে।দেখে নুহা হামাগুড়ি দিয়ে নিধির বুকে উঠে মাম্মা মাম্মা বলতে বলতে নিধির চোখের চশমাটা হাত দিয়ে ফেলে দিয়ে ওর নাকে কামড় দিচ্ছে! আর নিধি খিলখিল করে হাসছে ॥