লেখাঃ→ চন্দ্রাহত মৃন্ময় (Mostafa aL Hridoy)
এই রিজু তুমি আমাকে বাসায়
দিয়ে আসবা প্লীজ? আমার খুব জ্বর জ্বর
লাগছে,একা যেতে পারব না!
তনিমা কাতর স্বরে জিজ্ঞাসা করল
রিজুকে ।আচ্ছা তুমি তো রিতু (রিতু
তনিমার বান্ধবী)
কে নিয়ে যেতে পার, আমি গেলে একটু
কেমন দেখায় না? ইতস্তত হয়ে রিজু
জবাব দেয়। রিজুর জবাবে হতাশই হতে হয়
তনিমাকে । আচ্ছা এই ছেলেটার
অনুভূতি বলতে কি কিছুই নেই? কারও জ্বর
আসছে শুনলে তো কপালে হাত
দিয়ে অন্তত দেখে। এটাও
কি বুঝিয়ে দিতে হবে, ভাবে তনিমা।
তার জ্বরটর কিছুই না। ১৪-ইফেব্রুয়ারিত
ে ইচ্ছে রিজুর সাথে রিক্সায় একটু
ঘুরে বেড়াবে। কলেজে ভর্তির সেই
প্রথম দিন থেকেই এই অদ্ভুত
ছেলেটাকে ভালবেসে বসে আছে সে।
ও যেমন হাসি খুশি রিজু ঠিক তার
উল্টো, সে চুপচাপ থাকতেই বেশী পছন্দ
করে। তাই তনিমাকেই
নানা অজুহাতে গিয়ে কথা বলতে হয়।
ক্লাস নোট নেয়া,স্যার
কি পড়াল,পিকনিকে যাবে কিনা,কলেজে আসেনি কেন
নানা অজুহাতে গায়ে পরে কথা বলতে হয়
তার। কি আর করা ক্লাসের সবাই বুঝলেও
যে বুঝার সেই যদি না বুঝে। রিতু
তো প্রায়ই বলে বাদ দে তো ওই বলদটার
কথা, কত ছেলে পরে আছে তোর জন্য আর তুই কিনা ওই
হাবাগোবা বলদটাকে নিয়ে আছিস।
তনিমা কাউকে বুঝাতে পারেনা।
ছেলেটার গম্ভীর হয়ে চুপচাপ থাকাটাই
যে ওর বেশী ভাল লাগে। ভাল
লাগে ছেলেটা যখন এলোমেলো চুল
নিয়ে ক্লাস এ এসে একটা কোনায়
বসে থাকে, টিফিন পিরিয়ডে মাঠের
এক কোনায় বসে আকাশ দেখে।
ইচ্ছে করে গিয়ে বলতে, এই
আমাকে তোমার আকাশটা দিবে? রিতু
তার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে ঘুরতে যাবে, সো তোমাকেই
যেতে হবে বলে রিক্সা থামায়
তনিমা, রিজুর হাত ধরে টেনে রিক্সায়
উঠায়। এই তুমি রিক্সার পাশঘেষে আছ কেন? আমার
ছোঁয়া লাগলে কি তোমার কষ্ট হবে??
বলে হাঁসতে থাকে তনিমা। লজ্জায়
রিজুর গাল লাল হয়ে যায়। তনিমার
ইচ্ছে করে ছেলেটার গাল ছোঁয়ে সব
লজ্জা ভেঙ্গে দিতে কিন্তু কি আর করা, এমন
একটা ছেলেকে সে ভালবেসেছে তার
কাছে যদি বলা হয় আমার না রাতে ঘুম
হয়না, খেতে ইচ্ছে করেনা,
খালি উদাসী হয়ে যায়, মন খুব খারাপ
থাকে,কি করব বলত? সে নিশ্চিত
বলবে তো আমি কি করব, ডাক্তার
দেখাও। তনিমার অনেক
ইচ্ছে ছেলেটার হাত ধরে রেল
লাইনে হেটে দিগন্তে হারিয়ে যেতে,
বাদল দিনে এক ছাতার
নিচে গা ঘেঁসে অনেক টা পথ
হেটে যেতে। মাঝে মাঝে মাথার
উপর থেকে ছাতা সরিয়ে দিবে বৃষ্টি ভিজবে বলে।
জোছনা রাতে সাগর তীরে রিজুর
কোলে মাথা রেখে জোছনা পোহাবে আর
বিয়ের পর দুজন মিলে ভুত এফ এম শুনবে।
ভুতের ভয়ে যখন তনিমার শরীর থরথর
করে কাঁপবে তখন রিজু দুহাতে শুক্ত
করে তার বুকে জড়িয়ে রাখবে,
তনিমা তখন রিজুর বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরবে।
তনিমা সব সময় নিজে রান্না করবে আর
ওরা একি প্লেট এ একসাথে খাবে এজন্য
মা রান্না ঘরে আসতে দিতে না চাইলেও
সে রান্না শিখছে। এখন অনেক কিছুই বানাতে পারে সে।
একদিন রিজুর জন্য তার প্রিয়
খাবারটা রান্না করে নিয়েও
এসেছিল। কিন্তু সেদিন রিজু
কলেজে আসেনি। সেদিন
যা কান্না করেছিল তনিমা। তারওপর
আবার ভালবাসা দিবস, সবাই যার যার
মত ভালবাসার মানুষের
সাথে ঘুরতে বের হয়েছে তারও
ইচ্ছে ছিল রিজুর সাথে ঘুরে বেড়াতে।
কিন্তু রিজুকে বললে তো সে আর
যাবে না তাই জ্বরের অভিনয়টা করতে হল।
সেতো একটা মেয়ে, আর
একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে একটা ছেলেকে প্রপোজ
করবে। সে যদি না করে দেয়,আর
কথা না বলে, এমনিতেই ফাজিল
রুপা রিজুর সাথে টাংকি মারার চান্স
এ থাকে। ওর কাছে থেকে নোট
নিয়ে যায়, রাতে ফোন দেয়, সারাক্ষণ
রিজুর আশপাশে থাকার চেষ্টা করে।
দেখে মাঝে মাঝে গা জ্বলে যায়
তনিমার। কিন্তু কি করবে সে কান্না করা ছাড়া।
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার
সামনে চলে আসে ওরা। পথে তেমন
কোন কথাও হয়না। রিজু বাসায় আস, আম্মুর
সাথে দেখা করে যাও বলে তনিমা।
আরেক দিন যাবে বলে হাটা শুরু
করে রিজু। পাশেই ওর বাসা হেটেই
যাওয়া যায়। রিজুর চলে যাওয়া দেখে তনিমার মনে হচ্ছিল
হৃদয়ের একটা বড় অংশ যেন ওর কাছ
থেকে দুরে হারিয়ে যাচ্ছে,
মনে অসাড় একটা অনুভূতি।
কি করবে বুঝতে পারছিল না সে। দম বন্ধ
হয়ে আসছে তনিমার, কিছুতেই
দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না,ভীষণ
কান্না পাচ্ছে । সে কি আবার
রিজুকে ডাকবে? রিজু একা যেও
না আমাকেও সাথে নিয়ে যাও প্লিজ?
আমার পৃথিবী যে এখন
তোমাকে ঘিরে । বাসায়
এসে শাওয়ার নিতে নিতে অনেক
কাঁদল সে, কিছুতেই
কান্না থামাতে পারছিল না, এমন কেন
হচ্ছে? ও তো ভালই ছিল, কেন
ভালবাসতে গেল, সে তো কার জন্য
কাঁদতে চায় না, চায়
না কারো ভালবাসায় হারাতে তবুও এমন কেন হয়।
বালিশে মাথা গুজে কাঁদতে কাঁদতে কখন
যে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম
থেকে উঠে বারান্দায় আসল সে।
বিষণ্ণ বিকেল। এই সময় টা ওর মন খারাপ
থাকে খুব, নিজেকে খুব একা মনে হয়। ঝুপ
করে সন্ধ্যা নামলেও মন কিন্তু আর ভাল
হয়না। রাতের ঘুম নাই হয়ে গেছে সেই
কবে। নিজেকে ইদানীং জম্বি জম্বি লাগে তার,
সাজতে ইচ্ছে করে না, কার জন্য
সাজবে সে? কত দিন শপিং করে না।
শপিং এ গেলে খালি রিজুর জন্য
টি শার্ট কিনতে ইচ্ছে করে, রিজুর জন্য
অনেক গুলো কিনে রেখেছে কিন্তু
দিতে পারেনি ভয়ে, যদি ফিরিয়ে দেয়। বন্ধুদের
সাথে আড্ডাও এখন পানসে মনে হয়।
বই মেলায় যাবে যাবে করেও
যাওয়া হচ্ছে না। ক্ষুধা লেগেছে,
ফ্রিজ থেকে খাবার বের
করতে গিয়ে শুনে ওর নামে একটা গিফট
এসেছে। কে দিতে পারে ভাবতে ভাবতে গিয়ে প্যাকেট
টা হাতে নিল দেখে নাম নেই।
প্যাকেট খুলে দেখে অনেক সুন্দর
একটা ব্রেসলেট। জিনিশটা অনেক
পরিচিত লাগল। নিচে একটা ছোট্ট
চিরকুট। লিখা, তনিমা প্রথম তোমাকে যেদিন
দেখি কলেজে ভর্তি ফর্ম নেবার সময়,
সেদিন তোমাকে মোটেও আমার ভাল
লাগেনি। একটা মেয়ে এতটা চঞ্চল হয়
কিভাবে? আমার যে চুপচাপ শান্ত
মেয়ে ভালো লাগত। কিন্তু
ভর্তি পরীক্ষার দিন তুমি যখন আমার
সামনের কোনে বসে চুপচাপ
পরীক্ষা দিচ্ছিলে তখন
আমি পরীক্ষা ভুলে তোমার
দিকে স্মমোহনের মত তাকিয়ে ছিলাম।
সেদিন থেকে তোমার কথা বলা,
বন্ধুদের সাথে তর্ক, তোমার হাসি,
তোমার স্নিগ্ধটা, তোমার সব কিছুই
আমার আমার ভীষণ ভাল লাগতে শুরু
করে। তখন আমার মনে হয়েছিল
তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।
তোমার হাত ধরে তোমার কথা শুনেই
সারাটা জীবন আমি কাটিয়ে দিতে পারব।
আমি জানিনা তুমি আমাকে কতটুকু পছন্দ
কর বা সেটা শুধু ক্লাসমেট হিসেবেই
নাকি অন্য কিছু সেই ভয়ে কখনো বলা হয়নি। আমার
যে হারাবার ভয় বেশী।
আচ্ছা ব্রেসলেট টা পছন্দ হয়েছে?
মনে আছে আমারা সব ক্লাস
মেটরা সেদিন বসুন্ধরা সিটি গিয়েছিলাম,
একটা দোকানে তুমি ব্রেসলেট টা পছন্দ
করেছিলে, টাকা ছিল না বলে কিনতে পারনি। সেদিনই
আমি কিনে রেখেছিলাম, কিন্তু
ভয়ে দিতে পারিনি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও,
যদি জিজ্ঞেস কর কোন
অধিকারে তোমাকে দিতে গেলাম।
তনিমা কত রাত যে কেটে গেছে তোমার ভাবনায়।
প্রতিটা মুহূর্তে ভাবি শুধু তোমায়।
তুমি যদি সামনে থাক তাহলে আমার
পৃথিবী আলোকিত থাকে, চলে গেলেই
মন খারাপের দেশে হারিয়ে ফেলি নিজেকে।
তনিমা, এর নাম যদি ভালবাসা হয়, মনের
অজান্তে আমি তোমাকে অনেক
ভালবেসে ফেলেছি। আমি জানিনা না তোমাকে পাব
কিনা তবুও আমি তোমার বাসার
নিচে অপেক্ষা করছি প্লিজ একটু আস।
নাইবা ভালবাসলে তবুও আজকের মত
তোমাকে দেখি। নিচে লেখা নামটা দেখে ভীষণ
বিরক্ত হয় তনিমা। মোস্তফা আল হৃদয়,
ক্লাসে মোস্তফা আল হৃদয় নামে দুইজন
আছে। দুটাই পেইন সারাক্ষণ ভ্যান ভ্যান
করে। কোন গাধা টা এটা দিল
ভাবছে সে। এই গাধাটা কি জানে না সে যে রিজুকে পছন্দ
করে? ক্লাসের সবাই যেখানে জানে সেখানে না জানার
তো কথা না। নাকি রিজুকে যে পছন্দ
করে সেটাকে মজা হিসেবে ভেবেছে।
এখন নিচে গিয়ে বুঝিয়ে বলে আসতে হবে।
কারো ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে খারাপ
ই লাগবে ওর!।!
সিঁড়ি থেকে নেমে দেখে টি শার্ট
পরা একটা ছেলে উল্টো দিকে মুখ
করে দাঁড়িয়ে আছে পার্কিং লটে,
আশে পাশে আর কেউ নেই। ওর দিকে মুখ
ফিরে তাকাতেই কি যেন হয়ে যায়।
তনিমা দৌড়ে ছেলেটার
বুকে ঝাঁপিয়ে পরে, দু'হাতে শুক্ত
করে জড়িয়ে ধরে। তনিমার প্রথম
ভালবাসা আজ পাশে এসেছে।
অভিমানে বলে এত দিন বলনি কেন?
আমি যে তোমার অপেক্ষায় ছিলাম।
আমাকে এত কষ্ট দিতে পারলে তুমি।
হতভম্ব ছেলেটা আলিঙ্গন থেকে বের
হতে চায়, তনিমা আরও শুক্ত
করে জড়িয়ে রাখে। কেউ
দেখলে দেখুক। এই ছেলেটা ওকে অনেক
কষ্ট দিয়েছে, সেই শাস্তি আজ
তাকে পেতেই হবে। কোন ভাবেই
ছাড়বে না সে। এখন মনে পড়ল রিজুর আসল
নাম মোস্তফা আল হৃদয়!
অপ্রত্যাশিত আনন্দে তনিমার
চোখে পানি চলে আসে। অবাক
হয়ে দেখে লাজুক ছেলেটার চোখেও
পানি। তনিমা বলে,
--এই গাধা তুমি কাঁদছ কেন?
রিজু জবাব দেয়
--আমার বাবুই টা যে কাঁদছে। তনিমার
বিকেলটা এখন আর বিষণ্ণ নেই, মেঘমুক্ত
ভালবাসাময়।