লিখাঃ Kamruzzaman Anik
আজ রহমান সাহেবের সন্তান হবে। সবাই হাসপাতালে আই সি ইউর
সামনে দাড়িয়ে আছে। এই রহমান নামের
সাথে সাহেবটা এসেছে অনেক খাটুনির পর। আজ থেকে ১০ বছর আগে এই
রহমান সাহেব ছিল শুধুই রহমান আর নামের
সাথে ছিল অগাধ দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্রতা আর সরলতা!
- এই রহমান। আমার কাজটা করে দিস আর রাত্রে এসে খেয়ে যাস
- আচ্ছা ভাইজান।
এমন হাজারো আবদার সরলতার সহিত পূরণ করে যেত এই রহমান। তবে ওর
মূলনীতি ঠিক ছিলো। কোন দু নম্বরি করা যাবেনা; কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করা যাবেনা; কারো সাথে রাগ করা যাবেনা; সবসময় হাসিমুখে থাকতে হবে আরো অনেক
যার একটাও নেগেটিভ না। আল্লাহ্ হয়তো এই জন্যই আজ সেই রহমানকে আজ
রহমান সাহেব বানিয়ে দিয়েছেন।
- আপনার ছেলে হয়েছে।
- আলহামদুলিল্লাহ্!
- বাচ্চার মা কেমন আছে?
- স্যরি! আমরা উনাকে বাঁচতে পারলাম
না।
রহমান সাহেবের মাথায় যেন বাজ পরলো। সে তাঁর সবচেয়ে বড় আমানতটাকে বাঁচারে পারলোনা। ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে স্ত্রীকে দাফন
করে নতুন করে বাঁচতে শুরু করলেন তাঁর একমাত্র ছেলে সাহির কে নিয়ে। এই
সাহিরকে উচ্চশিক্ষিত করার শখ রহমান সাহেবের; তবে সার্টিফিকেটধারী
না উচ্চ মনের একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান। ৬ বছর পর........
- সাহির, আয় স্কুলে যাই।
- আসছি বাবা।
- তাড়াতাড়ি আয়, সময় হয়ে গেল তো।
- এইযে এসে পড়েছি।
- এবার কাঁধে উঠ।
- আচ্ছা।
- স্কুলের শিক্ষকদের সম্মান করবি; যেখানে দেখবি সালাম দিবি; সব
বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে চলবি; কোন পড়া না পারলে স্যারের কাছে জিজ্ঞাস করবি।
(ছেলেকে কাঁধে রেখেই বলে চলেছেন)
- বাবা, আমার মুখস্থ হয়ে গেছে এগুলি।
- মুখস্থ হলে হবেনা, যেভাবে বলেছি সেভাবে করতে হবে।
- করিতো। আচ্ছা, স্কুল এসে গেছে এবার আমি যাই।
- আচ্ছা যা।
সাহির দৌড়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছে আর রহমান সাহেব
পেছনে থেকে দেখছে তাঁর ছেলে কত বড় হয়ে গেছে। এখন ওর মা থাকলে কতই
না ভালো হত? ওর মা, রহমান সাহেবের স্ত্রী আর
রহমানের ছোট ম্যাডাম। সাহিরের নানা গফুর সাহেব এই এলাকার ১ম
সারির একজন ছিলেন। গরীবদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। উনিই রহমানকে নিজের
বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। প্রচন্ড
বিশ্বাস করতেন রহমানকে আর সেই বিশ্বাসের সূত্র ধরেই
তিনি মৃত্যকালে তাঁর মেয়েকে রহমানের
হাতে তুলে দিয়ে রহমান সাহেব বানিয়ে দিয়ে গেছেন। গফুর সাহেবের
সেই শেষ অবলম্বনটুকুও রহমানকে ছেড়ে চলে গেছে আর দিয়ে গেছে মিষ্টি একটা উপহার।
১১ বছর পর........
- এই স্বপ্ন, কেমন আছিস?
- আর্রে, রোহান বাবু??? কেমন আছেন? আপনার ব্যাকসাইডটা একটু ক্লিয়ার
করেন তো! মনে হয় ধুলো পরে আছে, পরিষ্কার করে দিই।
- যাহ্! কি বলিস? সবার সামনে তুই
ময়লা পরিষ্কার করবি? ছি ছি!!!
- ইসরে সবার সামনে লাজ-লজ্জার গিট
খুলেইইইইই গেলো! হা হা হা হা (সবাই
একসাথে)
- দেখ স্বপ্ন, লিমিট ক্রস করিস না।
- এই শালা, লিমিট কি রে?
তোরে বললাম ওর নাম্বার যোগার
কইরা দিবি, করছোস?
- তুই বললি আর হইয়া গেলো, মামুর
বাড়ির মোয়া নাকি?
- বাদ দে, (সামনে থেকে ওকে সরিয়ে)
সামনে দেখ আগুনের ফুলকি!
- (ওদিকে দেখে সাথে সাথে) একদম
ঠিক! আসলেই আগুনের ফুলকি!
প্রিন্সিপাল আগুন, আর তাঁর
মেয়ে তো আগুনের ফুলকি হবেই!!
- ওকে আমার চাই-ই চাই। (কঠোরভাবে)
- অসম্ভব।
- তবে তুই আছিস কেন?
- পারবনা বাপ, আমি গেলাম।
পরের দিন...........
- এই রোহান, একটা লাভ লেটার লেখ।
- তোকে আমি লাভ লেটার
লিখবো কেন?
- আমাকে না ওকে লিখবি।
- ওর উপর তো তুই ক্রাশ খাইছিস,
তো আমি লাভ লেটার লিখবো কেন?
- আব্বে শালা, তুই আমার পক্ষ
থেকে লিখবি।
অতঃপর মিশন আজকেও ব্যার্থ.....এবং
এভাবে প্রায় দুইবছর...........
এইচএসসি পরীক্ষার আর মাত্র একমাস
বাকি কিন্তু স্বপ্ন এখনো তার
স্বপ্নে মজে আছে। পরীক্ষার কোন
চিন্তাই ওর মাথায় নেই। পরীক্ষা এলো,
সবাই পরীক্ষা দিলো; স্বপ্নও। কিন্তু
পরীক্ষার পর আজকের অনুভূতিটা অন্য
কোন সময় হয়নি। অন্যসময় পরীক্ষার পর ভাবতো প্রথম তো হবেই, ২য় জন থেকে কত
মার্কস বেশি পাবে তা ভাবতো। কিন্তু আজকে ভাবছে ৩৩ করে পাবেতো?
রেজাল্ট অতঃপর.........
রহমান সাহেব বসে আছেন তাঁর আরাম কেদারায়। ভাবছেন সাহিরের কথা।
ছেলেটা কি খাচ্ছে, কি করছে, কবে গেলো এখনো ফোন করেনি;
অস্থির লাগছে। পরীক্ষা খারাপ দিলো বলে কি মানুষ খারাপ
হয়ে গেলো? রেজাল্ট খারাপ হল বলে কি চরিত্র নষ্ট হয়ে গেলো?
ছেলেটা কেমন যে করছে এমন, আমি কি ওকে কিছু বলেছি?
প্রায় ১০ বছর আগে............
- বাবা, স্যার বলেছে আমি খুব ভাল
মানুষ কারন আমার রোল ১।
- দেখ বাবা, রোল দিয়ে মানুষের
তুলনা করা যায়না। মানুষ শিক্ষিত হলে তার মধ্যে অনেক ধরনের অক্ষর
থাকে। ভাল সহজ অক্ষর 'ব' এর মত; কঠিন অক্ষর 'ক্ষ' এর মত। তুমি দুটো অক্ষরই
শিখতে পারবে কিন্তু কোনটার মত
হতে ইচ্ছে হয় তোমার?
- আমার কোনটার মতই হতে ইচ্ছে হয় না।
আমি আমার বাবার মত হতে চাই।
বর্তমান...........
রহমান সাহেব বেড়িয়ে পড়লেন তাঁর ছেলের খুঁজে। ১ সপ্তাহ খুঁজার পর
জানতে পারলেন ওর এক বন্ধুর বাসায় আছে ও। ওখানে হঠাৎ
করে গিয়ে উপস্থিত হলেন। উনাকে দেখেই সাহির পালানোর
চেষ্টা করতে লাগলো।
- থাম বাবা! এই বুড়ুটাকে আর কত কষ্ট
দিবি?
- বাবা, আমি পারিনি। আমি আমার স্বপ্নের স্বপ্ন হতে গিয়ে স্বপ্নও
হতে পারিনি আর তোমার সে সাহিরও
হতে পারিনি।
- তাতে কি তুই তো তোর তুই
হতে পেরেছিস?
- বাবা, আমি তাও হতে পারিনি।
আমায় ক্ষমা করে দাও।
- শোন বাবা, ক্ষমার কিছু নেই। তুই
তো তেমন কিছুই করিসনি। তুই একদিন বলেছিলি না, তুই 'ব' বা 'ক্ষ' এর মতও হবিনা। আমিও এই অমূল্য অক্ষরের মত তোকে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুই
নিজের নিজেকে চিনতে পেরে তোর অক্ষরের মধ্যে থাক।
- বাবা, আমায় ক্ষমা করে দাও। আমি সব ছেড়ে তোমার মত অমূল্য অক্ষর
হয়ে বেঁচে থাকবো, যাকে সবাই ভালবাসবে স্বার্থহীন ভাবে।
- এইতো আমার লক্ষ্মী বাবা, আয়
বুকে আয়। অতঃপর বাবা ছেলে তাদের নিষ্পাপ ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাবা তাঁর
ছেলেকে অমূল্য অক্ষরের ভালবাসা শিখিয়ে দিলো,
যে ভালবাসা কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়;
সবার জন্য।