মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ১৮০- শেষ বিকেলের আলোয়

লিখেছেন - জয় কবির


"ভাই, এক্ষুনি কলেজে আসেন, গণ্ডগোল হইছে, মারামারি লাগবো ..."

আমার জানালা দিয়ে সবে মাত্র মিষ্টি এক চিলতে এসে রোদ পড়েছে বিছানায়। আরামদায়ক আলস্যে সকালের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কম্বলের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলাম, এই সময় রাসেদের ফোনটা এলো। চরম বিরক্তিভরা কন্ঠে "আসছি" - বলে ফোন রেখে দেই। উঠে গিয়ে শার্ট আর জ্যাকেট গায়ে দেই। এরপর বিছানার নীচ থেকে ছোট ট্রাঙ্কটা টেনে বের করি। আমার স্মিথ এন্ড ওয়েসন রিভলবারটা বিট্রে করেনি কোনদিন আমার সাথে। চার ইঞ্চি ব্যারেল আর কাঠের গ্রিপের শাসনে বন্দি ছয় মৃত্যুদুত এক এক করে প্রতিবারেই ছুটে গেছে লক্ষ্যের দিকে। এটা হাতে নিলেই নিজেকে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী লাগে। সাবধানে লোড করে জিন্সের পকেটে বাড়তি কয়েকটা গুলি নেই। রিভলবার কোমড়ে গুঁজে উঠে বসি বাইকে।

সবাই বলে - আমি বাইক চালাই না, ওড়াই। গতি আমার আজন্ম সাথী। মা বলতেন খুব দ্রুত কথা বলা, উঠে দাঁড়ানো আর হাঁটা শিখেছিলাম আমি। সাইকেল চালানো শিখেছিলাম এক দিনেই। সাতবছর বয়সে একা নদীতে সাতার কাটতে গিয়ে স্রোতের টানে চলে গিয়েছিলাম কয়েকমাইল দূরে। দুরন্তপনার খ্যাতি অবশ্য তার আগে থেকেই জুটেছিল কপালে। সেই ধারায় স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই ঠাণ্ডা মাথার ক্রিমিনাল খাতাবটা বাগিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কলেজে উঠে এমপি চাচার কল্যানে দল থেকে পোস্ট আর অস্ত্র পেতে কোন সমস্যা হয়নি, তা না হলেও এই জিনিস যোগার করা একটু কঠিন হয়ে যেত।

ক্যান্টিনের পাশে পার্ক করি বাইকটা। রাসেদ, আরিফ, লিটন বসে ছিল থমথমে মুখে, আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। "বস্‌ - অবস্থা ভাল না, কামালরা কাইল রাইতে গেছে শাহীনের রুমে, গিয়া ট্যাহা চাইছে, পরে থাপ্পড় দিছে ..." - রাসেদকে থামিয়ে দেই হাত তুলে, আমি জানি কি ঘটেছে কাল রাতে। কলেজ এলাকায় নতুন কোন পাখি বাসা বাঁধলেও আমার অজানা থাকেনা। রাসেদকে থামিয়ে দিতে দেখে কথা বলে আরিফ - "একটু আগে কথা হয়েছে রানার সাথে, ওরা শো ডাউন করবে আজকে, আমাদের কাউকে পেলে মারবে, আর ওরা এইবার রেডি ..."। আরিফ ছেলেটাকে এই জন্যেই ভাল লাগে আমার, সে জানে আমি কতটুকি শুনতে চাই।

চায়ের কাপ হাতে দ্রুত চিন্তা করে নেই ... ওদের শো ডাউনের আগেই আমাদের যা করার করতে হবে। সাধারন ছাত্রছাত্রীর সামনে অন্য কোন শক্তিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবার মানে আমাদের অবস্থান সামান্য হলেও নড়িয়ে দেয়া। আমি তা কোনভাবেই হতে দেবোনা। আবার দলের ছেলেদের কাছেও নিজের অবস্থানের প্রমাণ আরেকবার দেয়ার লোভ সামলাতেও কষ্ট হচ্ছে। কাজেই ... আমি নিজেই যাব, একা একাই। এক চুমুকে শেষ করি আগুন গরম চা, বাইকে উঠে বসার আগে আলতো করে হাত বুলাই কোমরে গোঁজা রিভলবারের ঠান্ডা হাতলে, আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা বেড়ে যায় কয়েকগুন।

সাধারনত বাইকটা এক বারেই স্টার্ট হয়, কিন্তু এখন কেন যেন চারবার কিক করার পরে স্টার্ট নিলো আমার বাহন। অশুভ কিছু ইঙ্গিত করছে কি প্রকৃতি? করলেও কিছুই করার নেই, আমাকে যেতেই হবে, জীবনে বহুবার চূড়ান্ত বিপদে পড়েছি, বেঁচে এসেছি সম্ভবত মায়ের দোয়ায়। মা আমার প্রতিবার নামাজ পরে দোয়া করেন, সন্তানের মঙ্গল চান। চোখ বন্ধ করে এক মুহুর্ত মা'র মুখটা কল্পনা করি, অশুভ চিন্তাটা উধাও হয়ে যায় মাথা থেকে। তারপর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেগুলোর মাঝ থেকে বেড়িয়ে আসি বাইক নিয়ে।

কলেজ এলাকা থেকে একটু দূরে ভুট্টোর চা দোকানে আড্ডা দেয় কামালরা। আমাদের কারনে কলেজের দিকে বেশী দুর এগুতে পারেনা ওরা, কিন্তু স্বপ্ন দেখে একদিন কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা জমাবার। কিন্তু এই অছাত্র গুলোকে কলেজে ঢুকতে দিয়ে কলেজের পরিবেশ খারাপ করতে দিতে নারাজ আমরা। যে কোন ভাবে ওদের রুখে দেয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকে কলেজে, মানে কলেজ এলাকায় আমাদের কেউ না কেউ থাকেই। একই ভাবে আমরাও ওদের আড্ডাস্থলের আশে পাশে যাইনা, এলাকাটা ওদের, অনেক কিছুই হতে পারে, সেই কারনে। কিন্তু আজ আমি যখন ভুট্টোর দোকানের সামনে বাইকটা পার্ক করলাম, তখন কেন যেন হঠাৎ থমকে গেল পুরো এলাকা, অথবা আমার মনের ভুল। শীতের এই সকালে এমনিতেই রাস্তায় খুব বেশী মানুষের চলাচল করার কথা না।

"ভুট্টো, কেমন আছিস? এক প্যাকেট বেনসন দে তো" - হতভম্ব ভুট্টোর দিকে বাড়িয়ে দেই একশ টাকার নোট। "ভা... ভালা আছি ভাইজান ... দেই... আম্নে আছুইন কেমন ..."। ভুট্টোর গলার অস্বাভাবিক কাঁপুনিটুকু নজর এড়ায় না আমার। আমি এমন কোন টেরর টাইপ ক্যারেক্টার না যে আমাকে দেখে তোতলাতে হবে ভুট্টোর। আর যাদের দোকানে পলিটিকাল আড্ডা হয়, সেই সব মুদী দোকানীরা খুব ভাল অভিনেতা আর শক্ত নার্ভ যুক্ত হয়, এরা এত সহজে ভয় পায়না কিছুতে। তাহলে ওর ভয় পাবার পেছনে কারন কি? ভুট্টোর বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে সিগ্রেট আর টাকা নিয়ে চা'এর অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে পরি। যে কোন সমস্যাকে সামনে থেকেই ফেইস করার স্বভাব আমার।

আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয় ভুট্টো। আমার সাবধনী চোখ ওর নকল হাসিটার পেছনে লুকিয়ে থাকা ভয়টাকেও দেখতে পায়। কখনও কখনও মানুষের চোখের ভাষা পড়তে সাইকোলজিস্ট না হলেও চলে। চাপা একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরে আমাকে। টি-স্টলটার আশে পাশে অনেকটা জায়গা ফাঁকা, কেউ আকাশ থেকে উদয় না হলে দেখতে পাবো নিশ্চিত। আর আমাকে হিট করতে হলে ওরা নিশ্চই দু'একজন আসবেনা। আমার এখানে আসার খবর এতক্ষনে ওদের জানা হয়ে যাবার কথা। চমকে যাবে নিশ্চই, আর আমিও সেটাই চাই। আজকে শো ডাউনটা করতে না পারলে কালকে আর ওদের সেই জোস থাকবেনা।

"ভূট্টো, কামালরা কই রে? ওদের দেখিনা ক্যান" - খুব নিস্পৃহ ভাবে জিগেস করি। এটা আসলে ভাওতা, ভাবটা এমন, যেন ওরা পাত্তা দেয়ার মত কেউ না। এতে আর যাই হোক না কেন, ওদের ভয়টা আরেকটু বাড়বে। ভুট্টোর দায়সারা গোছের উত্তরটা শোনার অপেক্ষা না করেই বাইকে চেপে বসি। এলাকাতে একটা চক্কর দিয়ে ফিরে যাব কলেজে। যদি আমার ধারনা ভুল না হয়, ওরা শো ডাউন করবেনা আজকে আর, আমি কেন এসেছিলাম, কি করেছি, না জেনে ওরা এক পা-ও দেবেনা কলেজের দিকে। কামালকে আমি অনেকদিন থেকেই চিনি।

বাইকটা স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় ওঠার সাথে সাথেই বাইকের গা ঘেঁসে ঘ্যাচ করে শব্দ করে এসে দাঁড়ায় সাদা মাইক্রোটা, সামলে নেবার আগেই টেনে হিঁচড়ে আমাকে মাইক্রোর ভেতর তুলে নেয় শক্তিশালী কয়েকটা হাত, বাইকটা পরে থাকে ভুট্টোর দোকানের সামনে। মাইক্রোর ভেতর আলো আধারিতে আমাকে চেপে ধরে থাকা হাতগুলোর মালিকদের একজনকেও চিনতে পারিনা, তবে ওদের কঠিন মুখগুলোই বলে দেয় যে ওরা ভালভাবেই জানে ওদেরকে কি করতে হবে। মুহুর্তে ভুট্টোর চোখে ভয়ের ছায়ার রহস্যটা পরিস্কার হয়ে যায় আমার কাছে, আর তখনই মাথায় শক্ত কিছুর আঘাতে পৃথিবীটা দুলে ওঠে আমার।

কতক্ষন অজ্ঞান হয়ে ছিলাম জানিনা। চোখ খুলতেই মাথার পেছনে তীব্র ব্যথা অনুভব করি। হাত নড়াতে গিয়ে টের পাই হাত দু'টো পেছনমোড়া করে বাঁধা, পায়েও তাই। বালির মধ্যে শুয়ে আছি আমি, চারপাশের ঘন শনের ঝোপ বলে দিচ্ছে নদীর চরে নিয়ে আসা হয়েছে আমাকে। আশে পাশে কারও উপস্থিতি টের পাচ্ছিনা। তার মানে দিনের আলো থাকা পর্যন্ত আমাকে এখানেই রাখবে ওরা, রাত নামার পর এই অবস্থাতেই পানিতে ভাসিয়ে দেবে। আমাকে খুন করার কোন চিহ্নই থাকবেনা। একটু নড়ে উঠতেই আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি কোমড়ে গোঁজা ছোট্ট রিভলবারটার আস্তিত্ব। হয়তো এটা কেড়ে নিতে ভুলে গেছে ওরা, অথবা ইচ্ছে করেই নেয়নি - পরে নেবে বলে। জানে হাত পা বাঁধা অবস্থায় কিছুই করতে পারবোনা আমি এটা কাছে থাকলেও।

ওদের প্লানটা বুঝতে পারছি এখন আমি। কামালরা বুঝেই গেছিলো যে আমি থাকা অবস্থায় কলেজে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করা বৃথা। কিন্তু ওদের পক্ষে আমাকে সরিয়ে দেয়া অসম্ভব। কাজেই বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে এনেছে, সম্ভবত প্রফেশনাল খুনি এরা। সেদিন শো ডাউনের কথা থাকলেও আসলে কলেজে যেত না কামালরা। সবার কাছে অচেনা এই গ্রুপটাকে দিয়েই আমাকে তুলে আনতো যে কোন ভাবে। ওদের পাড়ায় গিয়ে আমি ওদের জন্য কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছি। আত্মবিশ্বাসের চরম সীমায় পৌছে গেছিলাম আমি, আগে পরের কিছুই না ভেবে পা দিয়েছি ওদেরই পাতা ফাঁদে। তার চাইতেও বড় বোকামি করেছি কাউকে বলে না এসে। কেউ জানবেনা আমি কোথায় গেছি, আর কেউ ভুল করেও খুঁজতে যাবেনা আমাকে ওদের পাড়ায় অথবা এই চরের মধ্যে। কথাটা মনে হতেই অনেক দিন পর ঘাড় থেকে শীতল একটা স্রোত নেমে যাবার অনুভূতি টের পেলাম।

বিপদে আমি আগেও পড়েছি অনেকবার, কিন্তু সে বিপদ এবারের মত না। এখন আমার হাত পা বাঁধা, সামনে অর্ধমৃত নদী, শত্রু - একদল ভাড়াটে খুনী - যারা টাকার জন্য কাজ করে, মানুষ চেনেনা। আমি পড়ে আছি চরের ভেজা বালিতে, আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে জন বসতি নেই, কাজেই চিৎকার করে সাহায্য পাবার আশা প্রায় শুন্যের কোঠায়। দ্রুত চিন্তা করতে থাকি, কোন উপায় কি নেই? সময় বেশী নেই আমার হাতে, সন্ধ্যে হতে আরও কয়েক ঘন্টা বকি। এই সময়ের মধ্যেই আমার যা করার করতে হবে।

আমার হাত পা বাঁধা চিকন কিন্তু শক্ত নাইলনের রশি দিয়ে, বেশী জোরাজুরি করলে কব্জি কেটে বসে যাবে রশি, লাভ কিছুই হবে না, ফলে সে চিন্তা আপাতত বাদ। ধারালো কোন কিছু বা কোন পাথরও নেই আশেপাশে যা দিয়ে ঘষে ঘষে দড়ি কাটার চেষ্টা করা যায়। হঠাৎ করে একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। নদীতে এই সময় পানি বেশী থাকেনা, বাতাসও থাকেনা তেমন, কাজেই বড় ও মাল বোঝাই নৌকার মাঝিরা শ্রমিকদের দিয়ে গুণ টানায়, কয়েকজন লোক নদীর পাড় ধরে হেটে হেটে নৌকাটাকে টেনে নিয়ে যায়। আমি যদি গড়িয়ে গড়িয়ে নদীর কাছাকাছি চলে যেতে পারি, তবে এ যাত্রা বেঁচে যাওয়া সম্ভব হতে পারে, ওরা হেঁটে যাবার সময় গান করে, আমি যখন ওদের গান শুনতে পাবো, ওরাও তখন নিশ্চয়ই আমার চিৎকার শুনতে পাবে।

এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে গড়াতে আরম্ভ করি, কিন্তু আমার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ঘন কাশের ঝাড়, অসম্ভব শক্ত গোড়া কাশের, সেগুলোর ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া তো দুরের কথা, নড়ানোই যায়না। এঁকেবেকে যাওয়ার চেষ্টা করার ফলে আঘাত পাই হাতে, মুখে। রক্তের নোনতা স্বাদে ভরে যায় মুখ। কিন্তু জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে এসব নিয়ে ভাবলে চলবেনা, চেষ্টা চালিয়ে যাই। কিন্তু আনুমানিক আধ ঘন্টা পরে থেমে যেতে বাধ্য হই, এভাবে এগুনো সম্ভব না।

সারা শরীরে কেটে যাওয়া জায়গা গুলো জ্বলতে থাকে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই, অসার শরীর নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া। ক্রমেই মনে হতে থাকে ফেলে আসা দিন গুলির কথা। ছোট বেলা থেকে এখন পর্যন্ত। নিজের কাছেই প্রশ্ন করি, আমার কি এভাবে মরবার কথা? ছেলেবেলার দুরন্তপনা আর বড় হয়ে রাজনৈতিক কারনে প্রচুর মারামারি করেছি। কিন্তু তাই বলে নিজের বিবেককে বিসর্জন দেইনি কখনও। আমার হাতে খুন হয়নি কেউ আজ পর্যন্ত। আমার পরিকল্পনায় প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলার মত বিষয়টা আসতো না, বরং ওদের কি করে সর্বোচ্চ পরিমান ভয় দেখানো যায়, তা নিয়ে ভাবতাম বেশী। অধিকাংশ মারামারিতে যখন আমি রিভলবার নিয়ে একা সামনে এগিয়ে গিয়ে ফায়ার করেছি, তখনই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে প্রতিপক্ষ। জীবনের মায়া প্রত্যেকেরই আছে।

হঠাৎ ঝোপঝাড় ভেঙ্গে কারও এগিয়ে আসার শব্দ শুনি। সম্ভবত কোন প্রানী। এই বিজন চরে শেয়ালের আড্ডাখানা। আমাকে এ ভাবে পড়ে থাকতে দেখলে এই দিনের বেলাতেই হিংস্র শেয়ালগুলো ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে আমার। আতঙ্কে নড়তেও পারছিনা। ক্রমেই এগিয়ে আসছে প্রানীগুলো, শনের শুকনো পাতা আর ডাল মাড়িয়ে দেবার মড়মড় শব্দ যেন আমার মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। অপেক্ষায় আছি, যেন যুগ যুগ ধরে আমি অপেক্ষায় আছি সেই সময়টার জন্য।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় এক সময়। ঝোপঝাড় ভেঙ্গে প্রথম শেয়ালটার কুৎসিত মাথা বেড়িয়ে আসে। হিংস্র নোংরা চোয়ালটা থেকে লালা ঝড়ে পড়ছে প্রানীটার। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি আমার অসহায়ত্ব, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ওরা বুঝে যাবে যে আমার পক্ষে ওদের বাধা দেয়া অসম্ভব। চিৎকার করে ওদের কিছুক্ষন হয়তো দূরে রাখা যাবে, কিন্তু সেটাও খুব বেশী সময় না। তারপরেও শরীরের শক্তি একত্র করে জো্রে চিৎকার করে উঠি, ভয়ে ছুটে পালায় শেয়ালগুলো, কিন্তু কয়েক মুহুর্ত পরেই আমার খুব কাছে আবার ঝোপঝাড় ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে অসার হয়ে আসে শরীর।

ভয় পাবার একটা মাত্রা আছে, সেটা পরিয়ে গেলে মানুষ ভয় পেতেও ভুলে যায়। আমার এখন সে রকম একটা অবস্থা চলছে। শিকারী প্রানীরা শিকারের গন্ধ ঠিকই পায়, বুঝে যায় যে এটাকে কায়দা করে ফেলা যাবে। আমার সামনে বসে থাকা তিন চারটা ক্ষুধার্ত শেয়ালের লালা ঝরা মুখের দিকে তাকিয়ে গা গুলিয়ে ওঠে আমার। মনে মনে বলি - নে, শুরু কর। যে কোন ভাবেই হোক, আজ মরতে আমাকে হবেই।

হঠাৎ করেই কেমন যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে শেয়ালগুলো। নাক উঁচু করে কিসের গন্ধ শোঁকে ... তারপর একে একে উঠে দাঁড়ায়। কেন যেন হাসি পেয়ে যায় আমার, নিশ্চিত আরেকদল শেয়াল আসছে ... ওদের সাথে মারামারি করে আমাকে ছিঁড়ে কে কতটা মাংস নিয়ে যেতে পারে তার প্রতিযোগিতা শুরু হবে এখনই। হাত পা বাঁধা একটা মানুষ যে কি পরিমান অসহায়, তা আজ বুঝতে পারছি। আচ্ছা, খুব বেশীক্ষন কি সহ্য করতে হবে আমাকে? কোথায় বসাবে প্রথম কামড়টা? গলায় বসালেই ভাল, তাহলে বেশী কষ্ট পাবোনা।

কাশের ঝোপের মধ্যে দিয়ে কোন একটা প্রানীর দ্রুত ছুটে আসার শব্দ শুনতে পাই, লক্ষ্য করি শেয়ালগুলিও কেন যেন পিছিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। ওদের সামনের তাজা খাবারটাকে রেখে দূরে সরে যেতে ওদের বাধ্য করছে কিছু, নিচু গলায় কুঁই কুঁই শব্দ করে ওরা জানান দিচ্ছে বিরক্তির।

হঠাৎ কুকুর ডেকে ওঠে কাছে কোথাও, সেই ডাকটা ক্রমেই এগিয়ে আসে, আর শিয়ালগুলোও অদৃশ্য হয়ে যায় কাশের বনে। মুহূর্তকাল পরে আমার সামনে এসে দাঁড়ায় মিশমিশে কালো একটা মাঝারি আকারের দেশী কুকুর। বুঝতে পারি শেয়াল গুলোকে তাড়া করতেই এর আগমন, কিন্তু এখানে আমাকে এভাবে পরে থাকতে দেখে বেচারী কুকুর বেশ ভড়কে গ্যাছে। কাছে এসে কুকুরটা আমার সারা গা শুঁকে দেখে। তারপর তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়।

বেঁচে থাকবার শেষ আশাটা উঁকি দিয়েছে। আমার আশে পাশে ঘুরে ঘুরে ঘেউ ঘেউ করছে কালো কুকুরটা। আশা করছি ওর সাথে ওর মনিব আছে ধারেকাছেই কোথাও। সে জন্যেই কুকুরটা চাইছে যেন ওর মনিব আমাকে দেখতে পায়। জানিনা সেটা সম্ভব হবে কি না। কিন্তু আমার মাথায় চলছে অন্য আরেকটা চিন্তা। যদি বেঁচেই যাই, আমি কি কামালের ওপর ঠিক এমনি করে প্রতিশোধ নেবো? জীবনের চূড়ান্ত যে রুপটা আমি আজ এই চরের বালিতে শুয়ে শুয়ে দেখলাম, তা কি আমি কামালকেও দেখাবো? মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখার পর আমি কি পারবো আর কারও দিকে স্মিথ এন্ড ওয়েসন রিভলবারটা তুলে ধরে ভয় দেখাতে? মৃত্যু যে কত ভয়াবহ, তা নিজের সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে উপলব্ধি করছি আমি।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আট নয় বছরের ছেলেটি। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওকে দেখে অস্ফুটে কেবল বলতে পেরেছিলাম "পানি"। ছেলেটা দৌড়ে গিয়ে আঁজলা ভর্তি পানি এনে দিয়েছে আমাকে। ওর ছোট্ট হাতের ফাঁকা দিয়ে অনেকটা পানিই পড়ে গিয়েছে, কিন্তু এই চরের মাটিতে জমে থাকা পচে যাওয়া বৃস্টির সেই পানি টুকুই যেন আমার জীবনটা ফিরিয়ে দিল আজকে। শেষ বিকেলের এই ম্লান আলোতে আমি যেন নতুন করে জন্ম নিলাম। অনেক অজানাকে জানতে পারলাম, নিজেকে চিনতে পারলাম, উপলব্ধি করতে পারলাম জীবনের গুরুত্ব।

উবু হয়ে ছেলেটার দিকে পেছন ফিরে বসেছি আমি। ছেলেটার হাতের শন কাটা ধারালো কাঁছি এগিয়ে আসছে আমার হাত দুটোকে বাঁধনমুক্ত করতে। আমি চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছি মুক্তি পাবার।