লেখাঃ ঋচীক তুর্য
প্রায় ছয় মাস পর দেশের বাড়ি যাচ্ছি ।
তাই অন্যদিনের তুলনায় মনটা আজ বেশ
ভালো । ছোট বোনটা ফোনে বলেছিল তার
জন্য কিছু নিতে । তাই কিছু চকলেট
নিয়েছি । আর মা'র জন্য
দুটো শাড়ি এবং বাবার জন্য
পান্ঞ্জাবী কিনেছি ।
.
সকাল দশটায় ট্রেন ।
প্ল্যাটফর্মে সাড়ে নয়টায় গিয়ে পৌছালাম
। টিকিট স্বল্পতা । অনেক দূরের পথ টিকিট
না কাটলে সমস্যা হতে পারে । তাই
ব্ল্যাকে একটা টিকিট কিনলাম । অনেক
দামে ।
.
সাড়ে দশটা বাজতে চললো কিন্তু ট্রেন
আসার কোনো নাম গন্ধই নেই ।
.
যাই হোক অবশেষে এগারটার দিকে ট্রেন
এসে ষ্টেশনে থামলো । আমি আমার
সীটে গিয়ে বসলাম । কিছুক্ষন পর এক
দম্পতী আমাদের বগীটাতে উঠলো ।
সাথে তাদের চার বা পাঁচ বছরের
একটা বাচ্চা । চেহারাতে কেমন দুষ্টু ভাব ।
সে তার বাবাকে বলছে আব্বু আইসক্রীম
খাবো । আর তিনি তাকে নানা রকম অজুহাত
দেখিয়ে দমিয়ে রাখছে ।
.
তাদের সীট আমার সীটের
ডানপাশে মুখোমুখী । কিছুক্ষণের
মধ্যে ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে চলা শুরু করে ।
আমি বাহির পানে তাকিয়ে আছি ।
ক্ষানিক্ষণ বাদে আমার
হাতে আরেকটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম ।
চমকে উঠলাম । কারন হাতটা খুব ঠান্ডা ।
তাকিয়ে দেখি পাশের দম্পতীর পিচ্চিটা ।
আমাকে দেখে খিলখিলিয়ে একটা হাসি দিল। আমিও একটা মৃদু
হাসি দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলাম ।
-- কি নাম বাবু তোমার ?
-- পুচকি
-- হেসে বললাম তাই? অন্য কোনো নাম নেই?
-- আছে তো । মৌ
-- খুব সুন্দর তো নামটা ।
-- আইসক্রীম খাবো
-- আমার কাছে তো আইসক্রীম নেই, বাবু ।
বলাতে পিচ্চিটা মুখ বাকিয়ে নেয় ।
-- চকলেট খাবে?
-- সে আরেকটা হাসি আমাকে উপহার
দিয়ে হাত পাতে । আমি ব্যাগ
থেকে একটা চকলেট বের করে দিলাম ।
তারপর সে দৌড়ে তার বাবার
কাছে গিয়ে বলে । আব্বু আব্বু ঐ
ভাইয়াটা না খুব ভালো । দেখ
আমাকে চকলেট দিয়েছে ।
.
লোকটা আমার
দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল । তারপর
আমার দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেইক
করলো । তাদের সাথে পরিচিত
হয়ে জানতে পারলাম তারা সিলেট
যাচ্ছে মাজারের উদ্দ্যেশ্যে ।
.
ট্রেন চলছে কথা-বার্তাও চলছে তাদের
সাথে । ইতিমধ্যে তারা আমাকে তাদের
বাড়ি যাবার জন্য নিমন্ত্রন জানিয়েছে ।
একটু পর পিচ্চিটা আবার এসে আমার প্যান্ট
ধরে টানছে ।
-- বলো বাবু
-- একটা চকলেট দিবা? পিচ্চিটা এত মায়া মায়া করে কথাটা বললো যে আমি তাকে আরো দুইটা চকলেট দিতে বাধ্য হলাম ।
-- বেশি খেলে কিন্তু দাঁতে পোকা ধরবে
-- আচ্ছা । আর খাবো না ।
ভাইয়া তুমি না খুব ভালো ।
-- তুমিও খুব..
.
বলার আগেই প্রচন্ড রকমের এক ধাক্কায়
পুরো ট্রেন কম্পিত হলো । আমি লোহার কিছু একটার সাথে খুব জোড়ে ধাক্কা খাই ।
তারপর মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাই । যখন জ্ঞান ফিরে তখন
আমি নিজেকে একটা ট্রেনের বগির নীচে অর্ধেক চাপা অবস্থায় আবিস্কার
করি । ডান হাত আর বাম পা নাড়াতে পারছি না । মাথা খুব
ব্যথা করছে ।
.
চারদিকে রক্ত । কত লাশ । অনেকে ব্যাথায়
কাঁতরাচ্ছে । সামনে দেখতে পেলাম
আরো একটা ট্রেন উল্টে আছে । মানে দুই
ট্রেনের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়েছে । হঠাৎ ঐ
পিচ্চিটার কথা মনে পড়লো । ওর কি হয়েছে? ওর মা-বাবার কি হয়েছে?
নিজেকে চাপা পড়া অবস্থা থেকে উদ্ধার
করার চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না ।
.
লাশের উপর লাশ পড়ে আছে । দুইটা লাশ দেখে আমার বুকের বাম
পাশটা মোঁচরে উঠলো । লাশ দুটো ওই
পিচ্চিটার মা-বাবার । তাহলে পিচ্চিটারও
কি । না না । আর ভাবতে পারছি না ।
.
হঠাৎ চোখ গেল আমার থেকে কয়েক গজ
দূরে একটা লাশের স্তুপের এক পাশে পড়ে থাকা একটা বাচ্চার দিকে ।
রক্তে তার পড়নের জামাটা ভিজে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে ।
.
আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে বগীর নীচ থেকে মুক্ত করি । সরীসৃপের
মতো নিজের দেহটাকে মাটির সঙ্গে ঘসাতে ঘসাতে বাচ্চাটার
কাছে গেলাম । মুখটা তুলে দেখলাম মৌ ।
.
মৌ.. মৌ.. । দেখ তোমার ভাইয়া এসেছে ।
চোখটা খুলো না, মৌ । তুমি বলেছিলে না আইসক্রীম খাবে ।
আমি তোমাকে আইসক্রীম খাওয়াবো । তুমি শুধু চোখটা খুলো কথাগুলো বলে কাঁন্নায়
ভেঙ্গে পড়লাম ।
.
হঠাৎ দেখলাম মৌ আমার দিকে নিভো নিভো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
আমি যে তাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাবো সেই সামর্থ্যটুকু এখন আমার
নেই ।
.
মৌ'র কান বেয়ে রক্ত পড়ছে । আমি সাহায্যের জন্য চিৎকার দিচ্ছি ।
কিন্তু কেউ আসলো না । যে যার মতো ব্যস্ত। দেখলাম মৌ'র চোখগুলো ছোট
হয়ে আসছে । একসময় সে চোখ বুজে গেল । আর খুললো না ।
.
আমি ব্যর্থ হলাম । ওর প্রাণ রক্ষার্থে । ওকে শেষ কথাটুকু বলতে পারলাম
যে সে কতটা কিউট, কতটা মায়াবী ।।