লেখাঃ নাজমুল হাসান অয়ন
শিরীন আহমেদ একজন ব্যাস্ত মানুষ। সংসার আর চাকরির বিভিন্ন ঝামেলা নিয়ে
তাকে ব্যাস্ত থাকতে হয়। তার নাম আগে শিরীন আবেদীন ছিল। বাবার নাম ফখরুল
আবেদীন এর সাথে মিল রেখে। কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর নামের সাথে মিল রেখে
নামটা শিরীন আহমেদ হয়ে যায়। তার স্বামী ডক্টর শারাফাত আহমেদ ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমিক্সের শিক্ষক। তাদের দুজনের বিয়েটা হয় হঠাৎ করে।
শিরীন তখন গাজীপুর মহিলা কলেজের ইংরেজীর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী ছিলেন। আর
শারাফাত আহমেদ তখন পিএইচডি করতে কানাডা যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
কিন্তু শারাফাত সাহেবের বাবা সালেহ আহমেদ চাচ্ছিলেন দেশ ছাড়ার আগে ছেলের
বিয়ে দিতে। তাই তড়িঘড়ি করে মেয়ে দেখা শুরু হয়।
শিরীন আহমেদের অনেক গুন ছিল। কিন্তু তার যে গুনটিকে শারাফাত আহমেদকে
আকৃষ্ট করে তা ছিল তার শারিরীক সৌন্দর্য্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের
মেয়ে হলেও তার বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের কারণে উচ্চবিত্ত পরিবারের শারাফাত
আহমেদ তার সাথে বিয়েতে রাজী হয়ে যান। তবে শিরীন আহমেদ খুব ভাল ছবি আঁকতে
ও গান গাইতে পারতেন। ছবি আঁকা বা গান গাওয়া কোন ব্যাপারেই তার কোন
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তার বাবা ফখরুল আবেদীনেরও সামর্থ্য ছিল না
মেয়েকে লেখাপড়ার বাইরে অন্য কোন ধরনের সৃজনশীল কাজের শিক্ষার ব্যাপারে
টাকা খরচ করার। তবু শিরীন আহমেদ শুধু নিজের ইচ্ছার জোরেই রবীন্দ্র সঙ্গীত
আর বিভিন্ন চিত্রাংকন প্রতিযোগীতায় স্কুল জীবন থেকেই ভুড়ি ভুড়ি পুরষ্কার
জ়েতেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় ভর্তি হবেন।
কিন্তু তার পিতার আর্থিক অস্বচ্ছলতা এর পেছনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ফখরুল
আবেদীনের সামর্থ্য ছিল না মেয়েকে ঢাকায় রেখে পড়ানোর। তাই তিনি বাসার
কাছেই গাজীপুর মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে যান।
বিয়ের পরে শিরীন ঢাকায় তার শ্বশুর বাড়িতে চলে আসেন আর বিয়ের ঠিক একুশ দিন
পড়ে শারাফাত আহমেদ কানাডা চলে যান। দেশে ফিরে আসেন ঠিক তিন বছর পড়ে। এই
তিন বছরে তার আর শিরীন আহমেদের মাঝে মধ্যে ফোনে ছাড়া অন্য কোন ভাবে
যোগাযোগ হয় নি। শিরীন আহমেদও গ্রাজুয়েশন কম্পলিট করে একটা প্রাইমারী
স্কুলে চাকরি পেয়ে যান। কিন্তু তার শ্বশুর সালেহ আহমেদ যিনি কর্মজীবনে
সুপ্রীম কোর্টের জজ ছিলেন তিনি চাইতেন না যে তার পুত্রবধু স্কুল শিক্ষকের
কাজ করুক। তার বড় ছেলে ব্যবসায়ী সেলিম আহমেদের স্ত্রী একজন ডাক্তার ও ছোট
মেয়ে রুবাইয়া আহমেদ একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সের
ছাত্রী। কাজেই পুত্রবধু প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন এ কথা বলতে তিনি
লজ্জা বোধ করতেন। দেশে ফেরার পর শারাফাত আহমেদও চাইতেন যে তার স্ত্রী
স্কুল শিক্ষকের চাকরিটা ছেড়ে দিক। কিন্তু শিরীন আহমেদ রাজি ছিলেন না।
তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতেই যে শুধু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তা নয়। তিনি তার
সামান্য বেতন দিয়ে নিজের অসুস্থ পিতা ও একমাত্র ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচও
চালাতেন। কাজেই তিনি কখনোই চাকরি ছেড়ে দেবার পক্ষপাতি ছিলেন না। এ নিয়ে
তার ও শারাফাত আহমেদের মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য হত। তাছাড়াও শিরীন
আহমেদের পরিবারকেও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন খুবই অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখতেন।
যা নিয়েও শিরীন আহমেদের মনে অসন্তোষ ছিল।
শারাফাত আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে
জড়িত। একটি বিশেষ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি তিনি। স্ত্রীর সাথে রাতে
খাওয়ার সময় ছাড়া তার খুব কমই দেখা বা কথাবার্তা হত। স্কুল থেকে ফিরে আসার
পর শিরীন আহমেদ বাকি সময়টা ছবি আঁকার পেছনে ব্যয় করতেন। সালেহ আহমেদের
বাসায় অনেকগুলো কাজের লোক থাকায় শিরীন আহমেদকে রান্নাবান্নার কাজে খুব
একটা সময় ব্যয় করতে হত না। যদিও কাজগুলো তিনিই তদারকি করতেন। আর বাকি
সময়টা তিনি ছবি আঁকতেন। যদিও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এটাকে নিছক একটা
পাগলামো ছাড়া অন্য কিছুই মনে করতো না। কাজেই শিরীন আহমেদ যখন জানতে
পারলেন যে অপেশাদার চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে দৃক গ্যালারীতে একটা
চিত্র প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে এবং তিনি যখন এতে অংশ নেবার ইচ্ছার কথা
প্রকাশ করলেন তখন কেউ কোন কথা বলল না। অবশ্য কেউ এ বিষয়ে কিছু বলবে তা
তিনি আশাও করেন নি। তার স্বামীর এ ধরনের কথা শোনার সময়ই নেই। বাকীরাও খুব
একটা গা করল না। কাজেই তিনি নিজের আঁকা বেশ কিছু ছবি নিয়ে চিত্র
প্রদর্শনী কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তার আঁকা ছবি গুলো মনোনীতও
হয়ে গেল।
কিন্তু তিনি ভুলেও ভাবেননি যে তার আঁকা ছবিগুলো এত প্রসংশা পাবে। তিনি
মূলত এবস্ট্র্যাক্ট পেইন্টিং করতেন। যাদের চিত্রশিল্প সম্পর্কে ধারণা নেই
তারা ছবিগুলোর মূল সৌন্দর্য্য ধরতে পারত না। কিন্তু যেহেতু অনেক নামীদামী
শিল্পী প্রদর্শনীতে এসেছিলেন তাই তার আঁকা চিত্রগুলো ভুয়সী প্রসংশা পেল।
কাজেই প্রদর্শনীর শেষ দিন তাকে সেরা চিত্র শিল্পী হিসেবে মনোনীত করা হল
এবং বেশ কিছু টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকের সামনে কথা বলতে হল। বলাই
বাহুল্য তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এতে বেশ অবাক হলেন। কিন্তু তারা কিছুই
ঘটে নি এরকম একটা ভাব নিয়ে তার সাথে ব্যবহার করতে লাগলেন। শিরীন আহমেদ
এতে মোটেও অবাক হলেন না বরং মনে মনে বেশ মজাই পেলেন। ঘটনাটি এখানেই শেষ
হয়ে যাবে ভেবেছিলেন। কিন্তু যখন কদিন পর হঠাৎই অপরচিত নাম্বার থেকে তার
মোবাইলে ফোন এল তখন শিরীন আহমেদ আর অবাক না হয়ে পারলেন না। ফোনের অপর
প্রান্ত থেকে ইয়ুশি নাকামাতা নামক জ়নৈক ভদ্রলোক ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে
জানালেন যে, তিনি জাপানের একটি আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ এবং বর্তমানে
বাংলাদেশে আছেন। তিনি শিরীন আহমেদের আঁকা ছবিগুলো দেখেছেন এবং খুবই পছন্দ
করেছেন এবং তার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তিনি তার আঁকা বাকি ছবিগুলোও
দেখতে চান। শিরীন আহমেদ তার আনপত্তির কথা জানালেন এবং তাকে বাসার ঠিকানা
দিলেন। জনাব ইয়ুশিও পরবর্তী শুক্রবারে তার বাসায় আসার দিন তারিখ ধার্য্য
করলেন।
কাজেই পরবর্তী শুক্রবার ইয়ুশি নাকামাতা যখন দামী গাড়িতে করে সালেহ
আহমেদের বাসার সামনে এসে নামলেন এবং শিরীন আহমেদের খোঁজ জানতে চাইলেন তখন
সালেহ আহমেদ ও তার পরিবারের লোকজন অবাক না হয়ে পারলেন না। শিরীন আহমেদ
হাসি মুখে তাকে নিয়ে নিজের ঘরে তার আঁকা পেইণ্টিংগুলো দেখাতে লাগলেন।
ইয়ুশি নাকামাতা গভীর মনোযোগ নিয়ে চিত্রগুলো লক্ষ্য করলেন এবং কোন ধরনের
ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্বেও এত ভাল ছবি আঁকার প্রসংশা করলেন। তিনি যখন
সালেহ আহমেদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন তখনও সালেহ আহমেদ, শারাফাত
আহমেদ ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা অনেকটা বিষ্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে
তাকিয়ে ছিলেন। শারাফাত আহমেদ নিজের স্ত্রী সম্পর্কে কখনোই খুব একটা উচ্চ
ধারণা পোষন করতেন না। কিন্তু এই ঘটনার পরে সালেহ আহমেদের পরিবারে শিরীন
আহমেদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটলো। তারা তাকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতেই
দেখতে লাগলেন। কিন্তু যখন মাসখানেক পরে আবারও শিরীন আহমেদের সেলফোনে
অপরিচিত নাম্বার থেকে (এবারে বিদেশী নাম্বার) ফোন এল তখন শিরীন আহমেদ,
সালেহ আহমেদ বা শারাফাত আহমেদ কেউ-ই অবাক না হয়ে পাড়লেন না। মিস্টার
নাকামাতা জানালেন যে টোকিওতে খুব বড় একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন হতে
যাচ্ছে। এবং তিনি খুবই খুশি হবেন যদি শিরীন আহমেদ তার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে
প্রদর্শনীটিতে অংশগ্রহন করেন। শিরীন আহমেদের যাতায়াতের যাবতীয় খরচ
কর্তৃপক্ষ বহন করবেন। শিরীন আহমেদ কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তিনি তার
পরিবারের সাথে কথা বলে এই বিষয়ে তাকে জানাবেন বলে বললেন। কাজেই ঐদিন রাতে
খাবার সময় শিরীন আহমেদ যখন মৃদু স্বরে তার টোকিও যাবার আমন্ত্রনের কথাটি
বাসার সবার সামনে তুললেন তখন কয়েক মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলল না। শারাফাত
আহমেদ মৃদু স্বরে বললেন যে, ঘরের বউ এর ঘরে থাকাই ভাল। একা একা তিনি
এতদুর যাবেন এটা তার আর তার পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। শিরীন
আহমেদ এমন কিছুই আশা করেছিলেন। তিনিও মৃদু স্বরে বললেন যে, শারাফাত আহমেদ
যদি তিন বছর কানাডা কাটিয়ে আসতে পারেন তাহলে তিনি মাত্র পনের দিনের জন্য
বিদেশে যেতে চান তাহলে দোষ কোথায়? কিন্তু এই বিষয়ে ফেরদৌস আহমেদ কোন জবাব
দিলেন না। শিরীন আহমেদ নিঃশব্দে খাবার টেবিল ছেড়ে ঊঠে পড়লেন। শিরীন আহমেদ
খুব ভাল করেই জানতেন যে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই উচ্চশিক্ষিত হলেও
কেউই স্বশিক্ষিত নয়। কাজেই তাদের এ ধরনের আচরণ আশা করাটা বোকামি নয়।
কিন্তু বিষয়টা এতদুর গড়াবে তা তিনি কল্পনাতেও ভাবেন নি। রাতে ঘুমাতে
যাবার সময় তিনি যখন শারাফাত আহমেদের সামনে বিষয়টি পুনরায় তুললেন তখন
শারাফাত আহমেদ আস্বাভাবিক খারাপ আচরণ শুরু করলেন। এমনকি ইয়ুশি নাকামাতার
সাথে তার শারিরীক সম্পর্কজনিত কথাও বলতেও বাকি রাখলেন না। শিরীন আহমেদ
জানতেন যে তার স্বামী একজন নিম্ন রুচির মানুষ। কিন্তু এতোটা নিম্ন রুচির
তা তিনি কল্পনাও করেন নি। কাজেই রাতের বেলা তিনি চুপচাপ ঘুমাতে গেলেন এবং
পরের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও তার আঁকা
ছবিগুলো নিয়ে ফেরদৌস আহমেদের বাসা থেকে বেড়িয়ে এলেন।
তিনি গাজ়ীপুরে বাবার বাসায় পৌছালে তার বাবা খুব অবাক হলেন। তিনি বললেন
যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মাঝে মাঝে ঝগড়া বিবাদ হয়। এগুলোকে খুব বেশি
গুরুত্ব দেয়া ঠিক না। শিরীন আহমেদের মা বেঁচে থাকতেও তাদের মধ্যে ঝগড়া
বিবাদ হত কিন্তু শিরীন আহমেদ কোনদিনই তার বাসা ছেড়ে চলে যান নি। কাজেই যা
হয়েছে তা নিয়ে তিনি শিরীনকে আর মাথা না ঘামানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু
শিরীন আহমেদ স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে তিনি আর ঐ পরিবারে ফিরে যাবেন না।
ফখরুল আবেদীন ভেবেছিলেন যে তার জামাতা দুদিন পরে ঠিকই শিরীন আহমেদকে নিতে
আসবেন। তখন তিনি শিরীনকে জ়োর করে হলেও তার সাথে পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু
পরবর্তী পনের দিনেও যখন শারাফাত আহমেদের পরিবার থেকে কেউ তাদের সাথে
যোগাযোগ করলো না তখন ফখরুল আবেদীন সত্যিই চিন্তায় পড়লেন। কিন্তু শিরীন
আহমেদের মধ্যে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। বরং তিনি এই পনের দিনে
ইয়ুশি নাকামাতার সাথে যোগাযোগ করলেন এবং নিজের পাসপোর্ট, ভিসা সংক্রান্ত
যাবতীয় কাগজ পত্র তৈরী করলেন। আর পাসপোর্টে নিজের নাম শিরীন আহমেদ না
লিখে শিরীন আবেদীন করে নিলেন। অবশেষে তার টোকিও যাবার সময়ও ঘনীয়ে এল।
যাবার দিন গাড়ি করে শিরীন আবেদীন ও ফখরুল আবেদীন এয়ারপোর্টে চলে এলেন।
পথের মধ্যে তারা দুজনই তেমন একটা কথা বললেন না। কিন্তু এয়ারপোর্টে সি-অফ
করার সময় ফখরুল আবেদীন নিজের চোখের জল সামলাতে পারলেন না। শিরীন আবেদীনও
নীরবে নিজের চোখের জল সামলে বাবাকে স্বান্তনা দিয়ে প্লেনে ঊঠে গেলেন।
কিন্তু প্লেনে ওঠার পর জীবনে প্রথমবারের মত আকাশ পথে ভ্রমনের উত্তেজনা
ছাপিয়ে তার চোখে ঠিকই অঝোর ধারায় জল নেমে এল।
টোকিওতে যথাযথ ভাবেই শিরীন আবেদীনকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে ইয়ুশি
নাকামাতার লোক ছিল। সেখান থেকে তাকে হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন মিস্টার
নাকামাতা তার সাথে হোটেলে দেখা করতে এলেন ও তার ছবিগুলো নিয়ে গেলেন। পরের
তিন দিন শিরীন আবেদীন টোকিও শহরটা মোটামুটি নিজের মত করে দেখে নিলেন।
এরপর প্রদর্শনী শুরু হল। প্রদর্শনীর প্রথম দিনই শিরীন উত্তেজনার সাথে
লক্ষ্য করলেন যে এতদিন যেসব চিত্রশিল্পীর কথা তিনি পত্রপত্রিকায় বা
ইন্টারনেটে পড়েছিলেন তাদের অনেকেই এই প্রদর্শনীতে এসেছেন। নিজের বিষ্ময়
আর উত্তেজনা সামলে শিরীন বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললেন। তারাও তার ছবির
প্রসংশা করলেন। দেখতে দেখতে পনের দিন পার হয়ে গেল। অনেক ভাল লাগা আর
অসংখ্য স্মৃতি মনে জমা করে অবশেষে শিরীন আবেদীন ঢাকার উদ্দ্যেশ্যে প্লেনে
উঠলেন।
কিন্তু যাবার সময় আর ফেরত আসবার সময় বিমান ভ্রমন মোটেই একরকম ছিল না।
যাবার সময় মোটামুটি মেঘহীন আকাশে পুরোটা পথ পাড়ি দিয়েছিলেন শিরীন। কিন্তু
আসবার সময় আকাশের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। প্লেন বারবার বাম্প করতে লাগলো।
আকাশে বজ্রপাতও দেখা দিল। যাত্রীরা অনেকেই শোরগোল শুরু করে দিল। কম্পনরত
প্লেনে নিজের সীটে শক্ত করে বসে ছিলেন আর একমনে স্রষ্টাকে স্বরণ করে
যাচ্ছিলেন শিরীন আবেদীন। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা ঠিকই ঘটে গেল। হঠাৎই
প্লেনের ভিতর প্রচন্ড শব্দ শোনা গেল এবং শিরীন আহমেদ দেখতে পেলেন তার
চোখের সামনে পুরো প্লেন ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড বায়ুচাপে
যাত্রীরা এক এক করে প্লেন থেকে ছিটকে পড়ছে আর এমন সময়ই কোন কিছুর সাথে
প্রচন্ড আঘাত পেয়ে শিরীন আবেদীন জ্ঞান হারালেন।
ঠিক কতক্ষন, কতঘন্টা বা কতদিন পর জ্ঞান ফিরলো শিরীন আবেদীন তা বুঝতে
পারলেন না। চোখ মেলে তিনি দেখতে পেলেন যে তিনি একটা পুরনো আমলের বাড়িতে
শুয়ে আছেন। বাড়ির ছাদ কাঠের। আসবাবপত্রগুলো খুবই পরিচিত এবং এগুলোকে
কোথায় যেন তিনি দেখেছেন। তিনি একটি পুরনো জীর্ণ বিছানায় শুয়ে আছেন। শিরীন
বিছানা থেকে নামলেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তার শরীরে বিমান দুর্ঘটনার
কোন চিনহ নেই। এমনকি শরীরে কোন ব্যাথাও নেই। কেমন করে তিনি এখানে এসে
পৌঁছালেন তাও তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না। শিরীন ধীরে ধীরে ঘরের চাপানো
দরজা ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন তার সামনে একটি বারান্দা এবং
বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে তিনি পুরোপুরি অবাক হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন
তিনি তাদের গাজীপুরের বাসার এলাকার কোন একটি দোতালা বাড়ির বারান্দায়
দাঁড়িয়ে আছেন এবং এখান থেকে তাঁদের বাসাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবে
সবচেয়ে অবাক করার মত বিষয় হল এই ভরদুপুরেও বাসার সামনের রাস্তায় কোন
মানুষজন নেই। শিরীন দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় চলে এলেন এবং নিজেদের
বাসার দিকে হাঁটতে লাগলেন। রাস্তাটা অনেকটা তার স্কুল জীবনের রাস্তার মত।
রাস্তায় বর্তমানে যেসব বিল্ডিং বা দোকানপাট থাকার কথা সেগুলো নেই। বরং
শিরীনের কৈশোরে রাস্তাটা যেরকম ছিল প্রায় ঠিক সেই রকম। হাঁটতে হাটঁতে
শিরীন রাস্তায় একটা ভিডিও গেমের দোকান দেখতে পেলেন। দোকানটা উঠে গেছে
প্রায় দশ বছর হল। কিন্তু এখানে কি জন্য দোকানটা আবার দেখা গেল তা তিনি
ভেবে পেলেন পেলেন না। এই দোকানে আগে পাড়ার ছেলেরা এক টাকার কয়েনের
বিনিময়ে ভিডিও গেম খেলত। দোকানটাতে সবসময় বাচ্চা ছেলেদের ভিড় লেগেই থাকত।
কিন্তু এখন দোকানটা পুরোপুরি খালি। শুধু যে খালি তাই নয় রাস্তার অন্যান্য
দোকান ও বাড়িগুলোকেও সেই স্কুল জীবনের দোকান বা বাড়ি মনে হচ্ছে। কিন্তু
সেগুলোও খালি। কাছেই মোহনা শপিং মল নামে একটা পাঁচতলা শপিং মল থাকার কথা।
শিরীন সেটা খুঁজলেন কিন্তু পেলেন না। বরং সেই জায়গায় তার স্কুল জীবনের
সময়কার বিশাল খেলার মাঠটা দেখতে পেলেন। পাশে একটা ছোট পুকুর ভরাট করে
একটা দোতলা বিল্ডিং হয়েছিল। সেই বিল্ডিংটাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু
পুকুরটা ঠিকই আছে। শিরীন আর সময় নষ্ট করলেন না দৌড়ে তাদের নিজেদের বাসার
দিকে গেলেন। গিয়ে যা দেখলেন তাতে মোটেও অবাক হলেন না। বাড়িটার অবস্থা ঠিক
তার স্কুল জীবনের মত। শিরীনের বিয়ের সময় বাড়িটাতে নীল রঙ করা হয়েছিল।
কিন্তু বাড়িটা এখন যেন সেই পুরনো আমলের একতলা সাদা বাড়ি। বাড়িতে তালা
লাগানো নেই বা ভেতর থেকে লকও করা নেই। শিরীন দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। সেই
পুরনো আমলের আসবাব পত্র। তার স্কুল জীবনের পর বাসায় যেসব পরিবর্তন হয়েছিল
তার কোনকিছুই এই বাসায় নেই। এবার শিরীন একশত ভাগ নিশ্চিত হলেন যে তিনি
তার পুরোনো কৈশোর জীবনের পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন যেখানে সবকিছু আগের মতই
আছে শুধু কোন মানুষ নেই।
শিরীন নিজেরদের পুরো বাসাটা ঘুরে দেখলেন। তার মা খুব ছোটবেলাতেই মারা
গিয়েছিলেন। তাকে খুঁজে পাবার আশা ছেড়েই দিলেন। কিন্তু তার বাবা বা ছোট
ভাই তাদেরকেও পাওয়া গেল না। অবশ্য পাওয়া যাবে এরকমটা তিনি খুব একটা আশাও
করেন নি তিনি। শিরীন ভেতরে ভেতরে খুব অবাক হলেন। তিনি প্রচন্ডভাবে
স্রষ্টায় বিশ্বাস করেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লেও মৃত্যুর পরের জীবন,
বেহেশত, দোযখ এগুলোতেও খুব বিশ্বাস করেন। এবার তার মনে হল তিনি বিমান
দুর্ঘটনায় মারা গেছেন এবং মৃতুর কোন কারণে পরে তিনি জনমানববিহীন তার
কৈশোরের পৃথীবিতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এমনটা কেন হল? ভাবতে ভাবতে তিনি
নিজের রুমে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং অনেকটা ভুত দেখার মত চমকে
উঠলেন। আয়নায় ঠিক যেন পনের বছর বয়সের শিরীনের প্রতিচ্ছবি। চেহারায় সেই
কমণীয়তা! সেই তারুণ্যদীপ্ত আভা! সংসার জীবনের পোড় খাওয়া শিরীনের চেয়ে একশ
গুন সুন্দর আয়নার ঐ শিরীন। এতক্ষন লক্ষ্য করেন নি কিন্তু তার গায়েও তার
কৈশোর জীবনের একটা লাল থ্রী-পিস। শিরীন তার নিজের বিছানায় বসলেন এবং
ভাবতে শুরু করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। কিন্তু একটা বিষয়
তাকে খুবই অবাক করল। তিনি যদি মৃত্যুর পর তার কৈশোরের পৃথিবীতে ফিরেই
আসেন তবে নিজেদের বাড়িতে না এসে অজানা অচেনা এক দোতলা বাড়িতে ফিরে আসবেন
কেন? যদিও ঐ বাসার আসবাব পত্রগুলো খুবই পরচিত মনে হচ্ছিল। সাথে সাথেই
শিরীন উঠে দাঁড়ালেন। ঐ বাসায় আবার যেতে হবে। শিরীন নিজেদের বাসা থেকে বের
হয়ে আবার সেই বাসাটির সামনে দাঁড়াতেই এক ঝলকে যেন সবকিছু মনে পড়ে গেল।
আরে! এটাতো স্বপন ভাইদের বাড়ি। কৈশোরের সেই দুর্দান্ত স্বপন ভাই! তাদের
বাসা থেকে কয়েকটা বাসা দুরেই স্বপন ভাইরা থাকতেন। ঝাকড়া, কোঁকড়ানো চুলের,
মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া, দুধের মত ফরসা শরীর আর একটু হালকা পাতলা গড়নের
স্বপন ভাই। এই সেই স্বপন ভাই যে পড়াশোনা, খেলাধুলা সবদিক দিয়েই এক
নাম্বারে ছিল। স্কুল ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন, ক্লাসের ফার্স্ট বয় তুখোড়
বিতার্কিক। শিরীনের মনে আছে সে ছোটবেলা থেকেই স্বপন ভাইয়ের কাছে সে
কতকিছু শিখেছিল! শিরীন ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিমনা ছিলেন। গল্প লেখা,
কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্ক সবকিছুতেই তিনি অংশ নিতেন। ছবি
আঁকা আর গান গাওয়া বাদে আর সবকিছুই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিত স্বপন ভাই।
কারণে অকারণে শিরীন দৌড়ে যেতেন স্বপনদের বাসায়। সেই স্বপন ভাই! শিরীন
আরেকবার ভাবলেন। যার জন্য তিনি জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। স্বপন ভাইয়ের
পুরো নাম ছিল স্বপন মন্ডল। তারা হিন্দু ছিলেন। কিন্তু শিরিন তাকে দাদা না
বলে ভাই বলে ডাকতেন। স্বপনরা প্রথম এই এলাকায় আসেন যখন শিরীন মাত্র ক্লাস
ফোরে পরতেন। তখন থেকে পরিচয়। এরপর কিভাবে কখন যে তিনি তার প্রেমে পড়ে যান
তা তিনি নিজেও জানেন না। স্বপন বয়সে তার থেকে দুবছরের বড় ছিলেন। আর ছিলেন
অসম্বভব মেধাবী। শিরীনের মনে আছে যখনই তাদের বাসায় যেতেন তখনি দেখতেন কোন
না কোন বই নিয়ে বসে আছেন স্বপন ভাই। বেশিরভাগ সময়ই তার হাতে থাকত বিজ্ঞান
বিষয়ক কোন না কোন মোটা ইংরেজী বই। শিরীন খুব ভাল করেই জানতেন তার স্বপন
ভাইয়ের প্রতি যেমন অনুভূতি ছিল তেমনি স্বপন ভাইয়েরও প্রায় একইরকম অনুভূতি
ছিল তার প্রতি। কিন্তু দুজন দুই ভিন্ন ধর্মের হওয়ায় কখনোই কেউ কাউকে সাহস
করে মনের কথাটা বলেন নি। কারণ তারা দুজন খুব ভাল করেই জানতেন যে সমাজ
তাদের এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। তবে তাদের অব্যাক্ত প্রেমটা খুব বেশি দিন
স্থায়ী হয় নি। স্বপন যখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র এবং শিরীন যখন
মাত্র ক্লাস নাইনে পড়েন তখন এরকমই এক দুপুর বেলায় স্বপন একদিন খেলার
মাঠের পাশের পুকুরটাতে ডুবে মারা যান। পুকুরটা বেশ বড় আর গভীর ছিল। আর এক
প্রান্তে ছিল কচুরীপানা। স্বপন সাঁতার জানলেও কিভাবে জানি কচুরীপানায়
তিনি আটকে যান। নিশ্চয়ই মৃত্যুর আগে তিনি সাহায্যের জন্য একবার হলেও
চিৎকার করেছিলেন। কিন্তু বিশাল খেলার মাঠটা ছাপিয়ে কারও কানে সেই চিৎকার
পৌঁছায় নি। একটু হলেও শিরীনের চোখ জলে ভিজে উঠলো। স্বপন ভাইকে নিয়ে কত না
স্বপ্ন ছিল তার! তিনি ভাবতেন স্বপন ভাইকে নিয়ে তিনি দুরে কোথাও পালিয়ে
যাবেন। যেখানে তিনি আর স্বপন ভাই ছাড়া আর কেউ থাকবে না। আচ্ছা এমন কি হতে
পারে যে মৃত্যুর পরে তার স্বপ্ন সত্যি হল? শিরীন দুরু দুরু বক্ষে স্বপন
ভাইদের বাসায় ঢুকলেন। তার মনে পড়লো স্বপন ভাইয়ের মৃত্যুর দিন সকালেও এই
লাল জামা গায়েই তিনি স্বপন ভাইদের বাসায় এসেছিলেন। সেদিন স্বপন ভাই তাকে
প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে বেশ জ্ঞান দিয়েছিলেন। কথায় কথায় শিরীনকে
জ্ঞান দিতে স্বপন ভাই খুবই পছন্দ করতেন। শিরীনেরও এই জ্ঞানের কথা শুনতে
বেশ লাগত। তবে কি মৃত্যুর পরে তিনি এমন কোন প্যারালাল ইউনিভার্সে চলে
এসেছেন যেখানে তিনি ছাড়া আর কোন মানুষ নেই? আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে
তার সাথে এই দুনিয়ায় স্বপন ভাইও আছেন।
শিরীন ধীরে ধীরে দোতলায় উঠলেন। তার মনে পড়লো তিনি যে ঘরটাতে এই নতুন
দুনিয়ায় জেগে উঠেছেন সেই ঘরটাতেই স্বপন ভাইয়ের সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল।
মূলত ঐ ঘরটাতেই তারা দুজন আড্ডা দিতেন। স্বপন ভাইয়ের ঘরটা ছিল ছাদের উপর
চিলেকোঠায়। শিরীন আসলে তিনি চিলেকোঠার ঘর থেকে দোতালায় নেমে আসতেন। শিরীন
ঘরটা খুলে ভিতরে উঁকি দিলেন। কেউ নেই। শিরীন দ্রুত ছাদে ওঠার সিঁড়ির দিকে
দৌড়ালেন। ছাদে উঠেই কালবিলম্ব না করে চিলেকোঠার ঘরে উঁকি দিলেন। না, কেউ
নেই! প্রবল হতাশায় শিরীনের বুকটা যেন দুমড়ে মুচড়ে গেল। ঘর থেকে বেড়িয়ে
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যাবেন এমন সময় পরিচিত একটা গলার স্বর শুনে শিরীন
চমকে উঠলেন। "কি? আমাকেই খুঁজছিস?" শিরীন দ্রুত পেছন ফিরে তাকালেন। ছাদের
অন্যপাশ থেকে তার দিকে হেঁটে আসছেন স্বপন ভাই। চেহারা ঠিক আগের মতোই আছে।
সেই উশকোখুশকো চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা আর হাতে ধরা মোটা একটা বই। "আমি
জানতাম একদিন তুইও আসবি। এতদিন তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।" একটু থামলেন
স্বপন ভাই। "দ্বিতীয় জীবনে তোকেও স্বাগতম।" শিরীন এক মুহূর্তের জন্য
নির্বাক হয়ে গেলেন। আর পরের মুহূর্তেই তার চোখ থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু।