কৃষ্ণ পক্ষের একটুকরো চাঁদ যেনো আকাশ থেকে ক্লান্তভাবে ঝুলে পড়েছে।
নিকষ কালো অন্ধকার । আকাশে মেঘ
জমেছে। মাঝে মাঝে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ছে চাঁদ।
বাইরে ভূতুরে হলদে আলো ছড়াচ্ছে ল্যাম্প
পোষ্টের পুরনো বাতিটি। সবখানে ভয়ংকর নিস্তব্দতা। এমন সময়
ঝুপ করে শব্দ হল। নীচু দেয়াল
টপকে কবরস্থানের ভিতরে নামল মজিদ। মাথাটা নীচু করে দেয়ালের
সাথে চেপে রইল। হাপাচ্ছে মজিদ।
হৃদপিন্ড হাতুরির মতো বাড়ি খাচ্ছে বুকে। আজ একটুর জন্য ধরা পড়ে গিয়েছিল। দশ বছরের
কাজের জীবনে তার এমন কখনো হয়নি। মানুষজন সব চালাক হয়ে গেছে। সব সময় কানখাড়া থাকে,একটু শব্দ হলেই
জেগে যায়। আজ তো কাজের কাজ কিছুই হলো না মাঝখান থেকে এতবড়
বিপদের মধ্যে পড়ল। বাইরে মানুষের
শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মজিদ মাথাটা আরও একটু নীচু করে প্রায়
শুয়ে পড়ল। মাথার উপর দিয়ে তিন
ব্যাটারির তীব্র টর্চের আলোটা বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল।
বেশ কিছুক্ষন কোলাহলের শব্দ পাওয়া গেল। তারপর সব থেমে গেল।
আগের মতো সুনসান,চুপচাপ। গুড়–ম গুড়–ম শব্দে মেঘ ডাকছে।
চাঁদটা আবার ঢেকে গেছে মেঘে।
জোর বাতাস বইছে। ঠান্ডা বাতাস।
মজিদের গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।
মজিদ সোজা হয়ে বসেছে। কয়েকবার
উঁচু হয়ে দেয়ালের বাইরে দেখল।
নাহ, লোকজন মনে হয় চলে গেছে।
কিন্তু সে ঝুকি নিতে চায় না,আরও
কিছুক্ষন অপেক্ষা করবে। বড় বড়
ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে।
চুল গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে ।
গা-গতর ভিজে চুপসে গেছে। এবার
ওঠা দরকার। এমন সময় নিভে গেল
বাইরের ল্যাম্প পোষ্টের বাতিটি।
গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল চারদিক।
চাঁদটা আবছা আলো ছড়াচ্ছে। খুব
মৃদুভাবে। চাঁদের আবছা আলোয় আরও
রহস্যময় লাগছে চারদিক।
মজিদ যাওয়ার জন্য উঠে দাড়িয়েছে।
এমন সময় চোখে পড়ল ব্যাপারটা।
পাথরের মতো জমে গেল মজিদ। গলা শুকিয়ে কাঠ।
ভয়ে,আতঙ্কে দু”ঠোট ফাঁক
হয়ে গেছে। অন্ধকারে কিছু স্পষ্ট
দেখা যায় না। চাঁদের অস্পষ্ট
আলোয় দেখা গেল,সবকটি কবর ফাঁকা।
দেখলে মনে হয় ভিতর থেকে কেউ চাপ
দিয়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে।
অদ্ভুদ একটা শব্দ হতে হচ্ছে,মৃদু ভাবে। যেন
কাউকে গলা টিপে মারা হচ্ছে। আর
সে চেপে ধরা গলায় চিৎকার করছে।
শব্দটা আস্তে কিন্তু খুব
তীক্ষ্ম। মজিদের পা জমে গেছে।
মাথা কাজ করছে না। কিছু
একটা করতে হবে দ্রুত। দেয়াল
টপকে বের হয়ে যাবার জন্য ঘুরে দঁড়াতেই মজিদ
পা হড়কে পড়ে গেল একটা কবরের
মধ্যে। সাথে সাথে আবার সব চুপচাপ।
অসহ্য নীরবতা। বের হবার জন্য মজিদ
উপরের মাটি ধরে আকুপাকু করছে।
কবরের মধ্যে কাদায় পা আটকে গেছে।
মজিদ উঠতে পারছে না। ঠিক তখনি বের হল জিনিসটা। ফুট দশেক
দূরে একটা পুরনো কবরের
মধ্যে থেকে। প্রথমে একটা হাত বের
হল। তারপর হাতের উপর ভর দিয়ে ঠিক
মানুষের মতো করে উঠে দাঁড়াল।
জিনিসটা বড় না। এই এক-দেড় বছরের
একটা বাচ্চার সমান,ফুট দেড়েক।
গা থেকে লালচে আলো বের হচ্ছে।
মোমের মতো শুভ্র শরীর। চোখ দুটো পাকা মরিচের
মতো টকটকে লাল। এগুচ্ছে জিনিসটা। মজিদ পাগলের
মতো লাফাচ্ছে। ফলে কাঁদাটা আরও
চেপে ধরছে। কিছুতেই উঠতে পারছে না। দ্রুত
পা ফেলছে জিনিসটা। ছোট ছোট
পা ফেলে পুতুলের মতো এগুচ্ছে।
হাত চারেকের মধ্যে চলে এসেছে। ভক
করে একটা গন্ধ আসল মজিদের নাকে।
পঁচা মাংসের সাথে কর্পূরের গন্ধ।
মুখ ফাঁক করছে জিনিসটা। মুখের
ভিতর গনগনে চুলার মতো লাল। কোন
দাঁত নেই। মজিদের হাতের
চাপে ভেঙ্গে পড়ছে কবরের পাড়ের মাটি। থেমে গেছে জিনিসটা।
চাপা গোঙ্গানীর মতো শব্দ করছে। কবরের মধ্যে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে মজিদ,নড়াচড়ার মতো কোন শক্তি। মুখ রক্ত
শূন্য,ফ্যাকাসে। তারপর হঠাৎ পিঠ
বাঁকা করে অদ্ভুদভাবে লাফ দিল
জিনিসটা। মজিদের
কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে। মজিদ দু’হাত
দিয়ে জিনিসটাকে ঠেকাতে চেষ্টা করছে,পারছে না।
কণ্ঠনালীতে প্রচন্ড চাপ অনুভব
করছে মজিদ। ফুসফুস একটু বাতাসের
জন্য আকুপাকু করছে। শরীরের
পেশীগুলো অসাড় হয়ে আসছে।
শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে মজিদ
জিনিসটাকে একটা প্রচন্ড
ধাক্কা দিল। উড়ে দূরে গিয়ে পড়ল
জিনিসটা। পড়ার সাথে সাথে সব শব্দ থেমে গেল।
ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল
জিনিসটা। মজিদ কবরে হেলান
দিয়ে হা করে নিঃম্বাস নিচ্ছে।
বৃষ্টির বেগ কমে গেছে। ঝিরঝির করে নামছে। মজিদ দ্রুত
পা’টা ধরে কাঁদার মধ্যে থেকে টেনে তোলে। তারপর
ঝটকা দিয়ে উপরে উঠে পড়ে। জুতার
মধ্যে কাঁদা গিয়ে পা ভারী হয়ে উঠেছে।
হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মজিদ দেয়ালের
দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
পিছনে আবার অদ্ভুদ শব্দটা শুরু হয়।
খুব মৃদুভাবে। বাড়ছে কমছে আবার
বাড়ছে। মজিদ সম্মোহনের
মতো হয়ে যায়। চোখে ঘুম চলে আসে।
নিজের অজাস্তেই আবার
দাঁড়িয়ে যায়। আবার
ফিরে আসে জিনিসটা। একা না।
অসংখ্য। প্রত্যেকটা কবরের
মধ্যে থেকে একটা করে উঠতে থাকে।
লালচে আভায় ভরে যায়
পুরো কবরস্থান। এগুতে থাকে ওরা।
পচাঁ মাংস আর কর্পূরের
গন্ধে গাঁ গুলিয়ে আসে মজিদের।
অতি কষ্টে আবার পা বাড়ায়
দেয়ালের দিকে। ওরা দ্রুত
এগুচ্ছে। মজিদ শরীরটা তুলে দেয়
দেয়ালের উপর। পিছন
থেকে পায়ে ঠান্ডা শক্ত স্পর্শ
অনুভব করে মজিদ। প্রচন্ড
চাপে অসাড় হয়ে আসতে থাকে পা।
দেয়ালের উপর বিছানো কাঁচের
টুকরায় ছড়ে যাচ্ছে পেট,হাটু।
প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। পিছন
থেকে চাপ বাড়তে থাকে। অসংখ্য
শীতল স্পর্শ অনুভব করে মজিদ। পিছন
থেকে টানছে ওরা। তীব্র
চাপে মনে হয় হাড় গুড়ো হয়ে যাবে।
দেয়াল ধরে হাচরে-
পাচড়ে এগুতে চেষ্টা করে,পারে না।
গলাকাটা মুরগীর মতো ছটফট
করতে থাকে। দেয়ালের
কাঁচগুলো শরীরের
গভীরে গেঁথে যাচ্ছে। আর সহ্য
করতে পারে না মজিদ। দেয়াল
ধরে প্রচন্ড জোরে সামনের
দিকে ধাক্কা দেয় ।
হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায় দেয়ালের
বাইরে। আর পিছনে তাকানোর সময়
নেই। পালাতে হবে,দ্রুত।
উঠতে গিয়ে পায়ে তীব্র যন্ত্রনায়
বসে পড়ে। হামাগুড়ি দিয়ে কুকুরের
মতো এগুতে থাকে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। অনেক দূর
থেকে ক্ষীণ
স্বরে ভেসে আসছে আজানের শব্দ।
মজিদ থামে না,এগুতে থাকে