লিখা > মহাকালের সৈনিক..
রাত দশটা ।।ময়মনসিংহ স্টেশন থেকে পু
ঝিক ঝিক করে ছেড়ে গেল জামালপুর
গামী আন্তঃনগর ট্রেন
তিস্তা এক্সপ্রেস ।।প্লাটফর্মের পাশেই
শুয়ে আছে কিছু শিশু ।যাদের আমরা পথ
শিশু বলেই জানি ।।আজকাল পথ শিশু
বলতে বোঝায়
যারা গরীব ,বস্তিতে থাকে তারাই
পথশিশু ।কিন্তু আমি যাদের
কথা বলছি তারা সত্যিই পথশিশু..
.
চার পাঁচটা শিশুর
মধ্যে সর্বডানে যে মেয়েটির
গায়ে গেরুয়া রঙের জামা পড়া সেই
মেয়েটির নাম শাহানা ।
একটা কাপড়ের পুটুলির ওপর
মাথা রেখে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে শাহানা ।
তার পাশেই ঘুমোচ্ছে শাহানার আট বছর
বয়সী ভাই শাহিন...
.
শাহিনের বয়স যখন চার তখন তাদের
মা মারা যায় ।তাদের
মা মারা যাওয়ার কিছুকাল পড়েই
তাদের বাবাও হঠাৎ নিরুদ্দেশ
হয়ে পড়ে ।দুই ভাই বোন মিলে অনেক
খুঁজেছে তাদের বাবাকে কিন্তু
কোনো হদিস মেলে নি ।ফজল চাচার
কাছে শাহানা শুনেছিল তাদের
বাবা নাকি কোন
একটা মহিলাকে বিয়ে করে ঢাকা চলে গিয়েছে...
তাদের বাবা নিরুদ্দেশ হওয়ার একমাস
পর বস্তির মালিক , ভাড়া না দেওয়ার
কারণে শাহানা আর
শাহিনকে বস্তি থেকে বের করে দেয় ।
তাদের জন্মের পর
থেকে তারা নিজেদের কোন আত্মীয়
স্বজনকেও দেখে নি ।একদিন
রাতে শাহানার মা যখন পাশের
বাড়ির চম্পার মা কাকীর
সাথে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল
তাকে ধরে এনে বিয়ে করেছে শাহানার
বাবা তখন মার কথা শুনে সে বুঝেছিল এ
পৃথিবীতে বাবা মা ছাড়া আপন
বলতে তাদের কেউ নেই...
.
বস্তি থেকে বের করে দেওয়ার পর
শাহানা আর শাহিন এই স্টেশনেই
থাকে ।থাকে বললে ভুল হবে ,
বলতে হবে শুধু রাতটা কাটায় ।।।কারণ
তারা টোকাই ,পথে পথে ঘুরে তারা বিভিন্ন
ধরনের ফেলনা জিনিস সংগ্রহ করে ।
তারপর সেই টুকায়িত বস্তু গুলো ইসমাইল
চাচার
দোকানে কেজি দরে বিক্রি করে...
.
আগে শাহানা পথে পথে ফুল
বিক্রি করত ,পার্কে ,বোট্যানিক্যাল
গার্ডেনে যেয়ে চিপস ,চানাচুর
বিক্রি করতো ।কিন্তু এখন সে এই
ব্যবসা করে না ।কারণ এতে লাভ
বেশি হলেও ঝুকি প্রবল...
একদিন শাহানা আর শাহিন চিপস আর
চানাচুর নিয়ে গেল বোট্যানিক্যাল
গার্ডেনে ।"এই
খাবেন ,খাবেন ;চিপস ,চানাচুর
আচারররর..."
বাঁশ ঝাড়ের নিচে সান গ্লাস
পড়া একটা ছেলে ডাক দিল ,"এই
মেয়ে ,এদিকে শোন ।চানাচুর আছে ???
মালটা এখনও আসতেছে না ।খেয়ে সময়
কাটাই..."
সামনের ১৪দাঁত বের
করে শাহানা বললো ,"হো ভাইজান ,আছে ।
ধরেন..."
"এই নে আট টাকার জায়গায় বিশ
টাকা দিলাম "...হাত বাড়িয়ে যখন
টাকাটা নিতে যাবে তখনই হঠাৎ
ছেলেটা শাহানার হাত
ধরে হ্যাচকা টানে নিজের
কোলে বসিয়ে ফেললো ।আর মুখে এক
হাত দিয়ে চেপে ধরে শাহানার
কচি শরীরের নিষিদ্ধ জায়গাগুলোতে...
বোনের এই হাল দেখে শাহিন ঐ
ছেলেটার কাঁধে কামড় বসিয়ে দেয় ।
ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত হতেই ছেলেটার
হাত
থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ভাইকে নিয়ে দৌড়
দেয় শাহানা...কিন্তু ছেলেটি তাদের
পিছনে দৌড় দেয় নি ।শার্ট ঠিক ঠাক
করে চুপ করে বসে থাকে ।আর দৌড়
দিবেই বা কেন !!!একটু পর তো ও আসবেই
তখন আর জোরাজুরির দরকার নেই...এখন
যা পেল তাতেই লাভ....
.
রাত ১১.৩০ ।।। মশার কামড়ে ঘুম
ভেঙ্গে গেল শাহানার ,"ঊফ আইজকা এত
মশা ক্যা ।ইট্টু ঘুমাইবারো দিত না ।আর
মশাডি কি বুইত্তা বুইত্তা রে বাবা ।
এইডি নিচ্চিত এসিড মশা...(এডিস
মশাকেই বুঝাচ্ছে...)"
একা একা কথা বলছে শাহানা "যাই কল
তে ইট্টু পানি খায়া আই.."
.
শাহানার বন্ধুরা বলে শাহানার
গানের গলা খুবই সুন্দর ,মায়াবী ।আর
সে নিজেও সারাদিন গুনগুন করে গান
গায় ।।।পানি খেয়ে আসার সময়
সে খোলা গলায় গাইতে লাগল
"হায়রে মানুষ রঙ্গীন ফানুস ,দম
ফুডাইলে ঢুস...তবুও যে ভাই কারোরই নাই
একটুখানি হুসস...হায়রে মানুষ ,রঙ্গীন
ফানুষ..."
.
এক দম্পতি ১২টার ট্রেনের অপেক্ষায়
বসেছিল স্টেশনের বেঞ্চগুলোর
একটিতে ।শাহানার গান তাদের মন
ছুয়ে গেল...
স্বামী স্ত্রী একে অপরের
দিকে তাকালো ।চোখে চোখে কিছু
একটা কথা হল তাদের মাঝে ।।
মহিলাটি শাহানাকে ডাক দিল...
>এই মেয়ে শুনো তো..
>কি !
>তোমার নাম কি ,কোথায় থাকো ?
>শাহানা ।থাহি এইহানেই ।ক্যা ?
>তোমার বাবা মা নাই ?
>মা মইরা গেছে ।আর বাপ আরেক
বেডিরে লয়া ভাগছে ।
>তোমার কেউ নেই ?
>আছে ।আমার ছুডু ভাই ।।।কিন্তু ক্যা ,এত
কতা জিগাইতাছুইন ক্যা ?
আফনেরা কি ছেলে দরা ??
>হা হা হা...না মা ।তোমার আঙ্কেল
একজন সঙ্গীত শিক্ষক ।তোমার গান খুব
পছন্দ করেছে ।
>হ ,বেহেই কয় ।
>শোন মা ,আমাদের কোন সন্তান নেই ।
থাকবে আমাদের সাথে ?যাবে ?
আঙ্কেল তোমাকে গান
শেখাবে ,স্কুলে ভর্তি করবে ।তোমার
ভাইকেও স্কুলে ভর্তি করাবে ।একদিন
তুমি সিনেমাতে গান গাইবে...
>চাচী আফনার চক্ষে পানি ক্যা ?
আফনারে আমি বিশ্বাস করলাম ।
গরীবরা মানুষ চিনবার পারে ।এক
দেহাতেই বুজবার পায় কেডা কিরম ।।।
আফনেরা বইন আমি আমার
ভাইডারে লইয়া আই আর রাজিয়াগোর
কাছে কইয়া আই...
.
.
কি ভাবছেন ???ফরিদ সাহেব ও তার
স্ত্রী পাচারকারী অথবা অন্য কিছু !!!
না ,তারা যা বলেছে ঠিকই বলেছে ।
দুনিয়াতে খারাপ মানুষের সাথে ভাল
মানুষও আছে ।এই ভাল মানুষগুলোর জন্যই
এত জটিলতার মাঝেও বলতে পারি ,
হ্যা আমরা ভাল আছি...
.
আটবছর পর...
.
>মা ,মা .আমি স্টুডিওতে যাচ্ছি ।দোআ
করে দাও...
>আচ্ছা মা ।দুপুরে বাপ বেটি কোথাও
খেয়ে নিস...
ঠিক ধরেছেন ।।।
কথাগুলো বলছে শিল্পী শাহানা তার
মা ,তথা ফরিদ সাহেবের স্ত্রীকে..
______________________
.
আমাদের চারপাশে শাহানার মত
অনেক প্রতিভাই ছড়িয়ে আছে ।কিন্তু
তাদের প্রতিভা প্রকাশের মত
যে সুযোগটা দরকার তা সবাই পায় না ।
তাই প্রতিভাগুলো অঙ্কুরে থাকতেই
বিনষ্ট হয়ে যায় ।।।মাঠে অনেককেই
দেখি অসম্ভব ভাল ফুটবল খেলে ,ক্রিকেট
খেলে ;যাদেরকে সঠিক প্রশিক্ষণ
দিলে একদিন তারাই পারবে বিশ্বের
দরবারে এদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে ।কিন্তু
সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ,সুযোগের
অভাবে তারা তাদের
প্রতিভা বিকশিত করতে পারে না ।
ফলে আমরা হারাই অনেক প্রতিভা ।
তাই সরকার সহ সমাজের উচ্চ পদস্থ
বিত্তবান লোকদের উচিত এই বিষয়টার
দিকে নজর দিতে ।।।৫৫০০০ হাজার
বর্গমাইলের এই দেশে জনসংখ্যা ষোল
কোটির অধিক ।এই ষোল কোটি মানুষের
মাঝে যদি এক
কোটি মানুষকে প্রতিভা প্রকাশের
সুযোগ দেয়া যেত তবে বাংলাদেশ
বিশ্বের দরবারে সগৌরবে মাথা উঁচু
করে থাকতো...