মেনু

Drop Down MenusCSS Drop Down MenuPure CSS Dropdown Menu

সংকলন ২১২- হারিয়ে যাওয়া ঘাস ফড়িং

লেখাঃ মোরশেদা কাইয়ুমী


হাসবেনা হাসবেনা করেও শেষ মূহুর্তে ফিক করে হেসে উঠলো মৌরি। নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরা ক্লাসরুম। কিছু একটা ঘটার আশংকায় সবাই রীতিমত আতংকে চুপচাপ বসে থাকে।
কে? কে হাসলো এমন করে?? আমি কি কৌতুকের আসর বসিয়েছি এখানে?? হুংকার দিয়ে উঠলেন বাঘা স্যার। একজন একজনের দিকে তাকাচ্ছিলো ,মৌরি ও খুব অবুঝ নিরপরাধ বালিকার মত করে চুপ করে খাতা খুলে এলো পাথাড়ি লিখতে আরম্ভ করলো। স্যার আবার হুংকার দিয়ে বললো কে হাসছো ?স্বীকার করো ,নইলে সবাইকে শাস্তি পেতে হবে । সবাই তখনো নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকলেও রাফিকে দাঁড়াতে দেখা গেল। সবাই যখন হতবাক ,ও কি না কি বলে এই ভয়ে! তখনি সমির উঠে বলে স্যার আমিই হেসেছি ,ভুল হয়ে গেছে আর হবেনা এমন। স্যরি স্যার । তুই ??তুই আবার মেয়েলি কন্ঠের অধিকারী কবে থেকে হয়ে গেলিরে ??আমাকে বোকা বানাস ?? না স্যার ,সত্যি স্যার ।আপনার পেছনে...কথা শেষ না করে হাসতে থাকে সমির।ওর হাসির ধরণে সবাই হেসে উঠে । ঘন্টা ও পড়ে গেলে স্যার বিব্রত হয়ে বেরিয়ে যায়। এই স্যারের পেছনে কিরে ?? মৌরিই এগিয়ে এসে জানতে চায় । লাথি খাবি হারামি .,নিজে দোষ করে আবার আসছিস জিগাইতে ?? হিহিহিহি! তোরে কে বলছে আমার দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে হিরোগিরি দেখাইতে ? দেখ স্যারের পেছনে কি ?? বলে একটা দুমড়ানো কাগজের টুকরো মেলে ধরে সবার চোখের সামনে । মৌরি দেখে একটু আগে ছুঁড়ে পেলা তারই লিখা কাগজ ! সমির জোরে জোরে পড়ে শুনায় , আমাদের স্যার এমনিতে যথেষ্ট ভালো হলেও যখন হুংকার দিয়ে পড়াতে থাকেন মনে হতে থাকে বন থেকে কোন বাঘ এসে হালুম হালুম করছে লেজ নাড়িয়ে ।স্যার লেজ নাড়িয়ে পড়াচ্ছেন এটা মনে হতেই তখন এভাবে হেসে উঠছি। লিখাটা শুনে সবাই একজোরে হোহো করে হেসে উঠে । মৌরির ভাই মিঠু এগিয়ে এসে বলে আচ্ছা এই ব্যাপার ??স্যারকে বলবো ,বাসায় যা মাকে ও বলবো ॥ ভাইয়ের কথায় খুব একটা পাত্তা দেয়না মৌরি, র্ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ,যা ভাগ্ টিকটিকি। মিঠু রাগে কটমট করতে করতে বেরিয়ে যায় । মৌরি বন্ধুদের সামনে পাত্তা না দিলেও খুব জানে আজো তার কপালে দু:খ আছে। এ আর নতুন কি ??সেই ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছে তার মাকে কারণে অকারণে দিন রাত তাকে মারতে। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে। মাঝে মাঝে ভাবে মৌরি সে আসলে কে?? তার মায়ের পেটের সন্তানতো??কে জানে । কেন ছেলে মেয়েকে এতটা আলাদা চোখে দেখে মা?? কাঁদে খুব মৌরি ,কেঁদে কি হবে ?? কিচ্ছুই না ,কেউ নেই তার কষ্ট গুলো কে দুর করতে পারে ।হয়তো আছে .কিন্তু নিজের মা যে তার সন্তানকে এমন অত্যাচার করতে পারে তা কি কেউ বিশ্বাস করবে?? আর বিশ্বাস করাতেই বা সে যাবে কেমন করে ?? পৃথিবীতে একমাত্র বাবাই তার আপনজন ।বাবাই যেন তার মা ,মায়ের মমতা নিয়ে তাকে আগলে রেখেছেন সেই ছোটবেলা থেকেই। রাতে পড়তে বসে মৌরি ,নাহ্ ইদানিং আর ভয় ডর ও লাগেনা মায়ের এসব পিটুনি আর গালিকে। কিছুটা চিন্তিত দেখায় মৌরিকে ,আঘাতটা ঠিক কখন কোন দিক থেকে আসতে পারে ভেবে পায়না। কারণ মা নিত্য নতুন কৌশলে তাকে শাস্তি দেয়। অংক খাতাটা টেনে নিয়ে অংকে ডুবে যায় মৌরি। এই একটা সাবজেক্টেই সে মজা পায়! হঠাত্ চুলের মুঠি ধরে মা তাকে চেয়ার থেকে টেনে তুলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। বেসিনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে বেসিনটাই ভেঙ্গে যায় ।মা রেগে গিয়ে ভাঙ্গা বেসিনের টুকরা দিয়েই মৌরিকে মারে খুব । কপাল থেকে রক্তের ঝর্না বয়ে যেতে দেখে আস্তে করে সরে যায় মা। মিঠু দুর থেকে ভেঙ্গছি দিতে থাকে । মায়ের হাতের পিটুনি খেয়েও এতক্ষণ নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছিলো মৌরি !মিঠুকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারলোনা ।দেয়ালে মাথা ঠুকিয়ে রক্তাক্ত কপালটা আরো থেতলে দেয়। দাদী দৌঁড়ে এসে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। দাদী নাতনির কান্নাটা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। রাতে দুজনেই না খেয়ে শুয়ে যায় ।নাহ্ মা ভুলেও একটিবার ডাকেনা কাউকে খেতে ,মিঠুর প্লেটেই বড় মাছের মাথাটা তুলে দিয়ে নিজেও খেতে বসে যায় । সকালেও না খেয়ে স্কুলে যায় মৌরি ,কেমন যেন একটা জেদ চেপে যায় ওর। ঠিক করে আজো কিছু একটা করবে স্কুলে। অংক স্যারটা স্কুলে এসেছে মাত্র কিছুদিন হলো। তার কেন যেন ধারণা পৃথিবীর কোন ছেলে মেয়ে অংক বুঝেনা। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তিনি হুংকার দিয়ে ক্লাসে অংক করান ।

বোর্ডে অংক একটা করে তিনি চেয়ারে বসে পা দুলাতে থাকেন আর ছেলে মেয়েদের আরো কয়টা করতে দেন। মিঠু বরাবরের মতই আজো একটা অংক ও করতে না পেরে মৌরির দিকে তাকায় অসহায় দৃষ্টিতে। মৌরি আজ নিজেও করে বসে ছিলো না দেখিয়ে। ও একটু ভেবে আস্তে করে খাতাটা এগিয়ে দেয় টেবিলের নিচ দিয়ে। মিঠু অংক করে স্যারকে দেখাতে যায় খুশি মনে! সাথে আরো অনেক ছেলেমেয়ে ।মৌরি পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় ,খাতাটা এগিয়ে দেয় মিঠুর আগেই ।আসার সময় স্যারের একটা জুতা ডায়াসের একদম নিচে ঠেলে দেয় পা দিয়ে ।মাত্রই স্যার জুতা খুলে পাটা উপরে রাখছিলেন। মিঠু পাশে দাঁড়ানো তখনো ,স্যার আবার নিচে না তাকিয়েই জুতা পরতে গিয়ে চমকে উঠেন । একটা জুতো নেই !! এই আমার জুতা কে নিছিস ??হুংকার ছাড়েন স্যার । সবার দৃষ্টি মিঠুর দিকে তখন ।সবাই এক যোগে বলে উঠে স্যার আমরা দেখিনি । দেখিসনি মানে কি ??এটাক কি পাখা গজিয়েছে নাকি যে উড়ে চলে গেছে ?? মৌরি অসহায় চোখে বলে ভাইয়া তুই নিছিস স্যারের জুতাটা ?? মিঠু ভয়ার্ত চোখে বলে না না আমি দেখিনি । স্যার মিঠুর মাথা ধরে মাটির দিকে নামিয়ে বলেন দেখিসনি না?দেখ নিচে খুঁজে ,এটার পা গজায়নি ,পাখাওনা । মিঠু উপুড় হয়ে মাথা নিচু করে খুঁজতে থাকে।একসময় আরো কয়টা ছেলে এসে খুঁজতে থাকে ,স্যার অনবরত ছেলেমেয়েদেরকে ধমক দিতে থাকেন ।কেউ স্বীকার করেনা জুতার কথা । রাতুল খুঁজে পায় জুতাটা ,মিঠু এতক্ষণ যে দিকে দাঁড়ানো ছিলো ওদিক থেকেই বের করে আনে । স্যারের সন্দেহটা পুরাপুরি মিঠুর দিকেই যায় ।ইচ্ছে মত মিঠুকে মারতে থাকেন তিনি । মৌরি কেন যেন খুশি হতে পারেনা ,ওর চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে। স্যার চলে গেলে মিঠুর হাত ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে বলে ভাইয়া বিনা দোষে পিটুনি খাওয়াটা কতটা কষ্টের বুঝছিস ?? আর আমাকে প্রতিদিন এভাবেই তোর জন্যই পিটুনি খেতে হয় । সেই অংক স্যারের প্রিয় ছাত্রী হতে খুব একটা দেরি হয়নি মৌরির। স্যার ওর মেধা দেখে অনেক বেশি খুশি হয়ে ওর সব দোষ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তবু ও ভেতরে কেমন যেন একটা শূণ্যতা কাজ করতো তার। দাদীও না ফেরার দেশে চলে গিয়ে তাকে যেন আরো একা করে গেলেন। একটু মায়ার পরশ ,বড় বোনের একটু স্নেহের শাসনের অনেক বেশি অভাববোধ করতে থাকে মৌরি। ক্লাসের সবাই তার বন্ধু হলেও সত্যিকার অর্থে তার কোন বন্ধুই তার ছিলোনা যার সাথে সব কষ্ট শেয়ার করা যায় ,যাকে আপন ভেবে ভালবাসা যায়। এভাবেই স্নেহ মায়া খুঁজতে খুঁজতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে মৌরি । কলেজ থেকে ফেরার পথে প্রায়ই জয়ীতাকে চোখে পড়ে মৌরির। বিকেলে একটা টিউশনি করে বলে বাসায় ফিরতে মাঝে মাঝে রাত ও হয়ে যায় । তেমনি একটা রাতে জয়ীতাকে দেখে চুপচাপ একটা পার্কের বেঞ্চে বসে কাঁদতে ।পাশে তারই মত আর একটা মেয়ে। মেয়েটাকে দেখে চিনতে পারে মৌরি,তাদের কলেজেরই মিতু। ও এগিয়ে গিয়ে ওদের পাশে বসে। মৌরির কেমন যেন একটা মায়া লাগে জয়ীতাকে দেখে। চোখের ইশারায় জানতে চায় ব্যাপারটা কি। মিতু ওকে নিয়ে উঠে যায় ওখান থেকে। মিতুর কাছেই সব জানতে পারে মৌরি। মিতুর জয়ীর কাজিন। সব শুনে জয়ীতার জন্য কেমন যেন অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করে মৌরির ভেতর।

...................­....................­.......... ....................­....................

রাত ঠিক কত হবে জানেনা জয়ী। একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছে অনেক্ষণ হলো। এমনিতে যথেষ্ট ভীতু হলেও ঘোরের মধ্যে আছে বলেই হয়তো এমন নির্ভয়ে হয়ে হেঁটে চলেছে ঠিকানাহীন। ফেব্রুয়ারি মাসটা অনেকের কাছে খুব প্রিয় মাস হলেও ওর কাছে সব হারানোর মাস। খুব মনে পড়ে সেও একটা সময় এই মাস এলে পাগলের মত হয়ে যেতো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে। তার ও একটা ফুলের মত জীবন ছিলো ।ছিলো ঘাস ফড়িং এর মত উড়ার জগত । নাহ্ এখন আর উড়তে পারেনা সে ,ডানা ভেঙ্গে গেলে ঘাস ফড়িং যে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। কারো ভাগ্যে হয়তো শেষ সময়টাতেও ঘাসফুলের মায়া জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এতটা ভাগ্যবতী সে কখনোই ছিলোনা,কখনোইনা । পড়ালিখা আর টুকটাক কবিতা নিয়েই মেতে ছিলো তখনো। তার ভেতরের শিল্পি সত্তাটাই বরং বেশি প্রাণবন্ত ছিলো তখন। কলেজের এমন কোন অনুষ্ঠান ছিলোনা যেখানে ওর শৈল্পিক বিকাশ ছিলোনা। মাত্র পরীক্ষা শেষ করে উড়ার স্বপ্ন দেখছিলো জয়া । এরই মধ্যেই বাড়ি থেকে জরুরী তলব ।তবে ওর মাথায় তখনো আসেনি ঠিক কেন তাকে এমন করে ডাকা হলো । একসপ্তাহের মধ্যে তাকে অজানা অচেনা একজন গর্ধবের গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হলো ।অবাক করা ব্যাপার হলো সে লোকটার নামটা পর্যন্ত জানতোনা সে। সে তখনই বুঝতে পারলো সে যত পড়াশুনাই করুক না কেন এখনো পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছে তার এক ফোঁটা মতামতের দাম নেই। এখন ভাবে ,তখন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে আজ তাকে এমন পাগলের বেশে রাত দুপুরে হাঁটতে হতোনা। জয়ীতাকে একটু পর দেখা যায় রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা ছোট্ট একটা শিশুর পাশে বসে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করতে কিছু বলতে। বিয়ের পর পরই সে বুঝতে পারে তার বাবা মা তাকে একটা মুখোশ পরা এক দানবের সাথে বিয়ে দিয়েছেন । বাইরে ভদ্রতার মুখোশ পরা ওর শ্বশুর বাড়ির প্রতিটি লোক। বিয়ের দুদিন পর জয়ীর সাথে দেয়া পিঠার ঝুড়িটা তার শ্বাশুড়ির পছন্দ না হওয়ায় ঘরেও তুলতে দেয়নি। মায়ের হাতে বানানো গভীর মমতা মাখা পিঠে গুলো নিয়ে বিয়ে বাড়িতে আসা একঝাঁক কুকুর ভোগের আসর বসায়। জয়ী এতদিন ধরে শুনে আসা নাটক উপন্যাসের শ্বাশুড়ির বাস্তব রুপ দেখে কাঁদতে থাকে চুপচাপ। তার ধারণা ছিলো ওসব লেখকদের বাড়াবাড়ি কল্পনা মাত্র। শ্বাশুড়িওতো মা ই ,তিনি শুধু শুধু কেন মেয়ের সাথে এমন করবেন ??বউ কি মেয়ে নয় ?? জয়ী যত যাই করুক বিয়ের আগের রিলেশনে বিশ্বাসী ছিলোনা । স্বপ্ন দেখতো একটা ছোট্ট সুখি সংসারের। সন্ধ্যায় ঘামে ভিজে ঘরে ফেরা মানুষটার বিশাল বুকে মুখ গুঁজে সুখ খুঁজার। ছোট্ট দুটো বাবুই ছানার কিচির মিচিরের ভরে উঠা সুখের প্রাঙ্গন। স্বপ্নগুলো বাস্তবে পাওয়ার মত এতটা ভাগ্যবতী সে ছিলোনা বলেই হয়তো বিয়ের একমাসের মাথায় তার বরের মুখোশটা পুরাটাই খুলে যায় জয়িতার সামনে। বুঝতে পারে টুটুল তাকে বিয়ে করেছে পুরাই ফ্যামিলির চাপে। তার ভালবাসার মানুষটার সাথেই এখনো চলে তার প্রেমলীলা। জয়িতার সাথে টুটুলের সম্পর্কটা গভীর রাতে শুধু ক্ষুধার্ত হায়েনার সামনে থাকা এক অসহায় শিকারির। বিয়ের ছয় মাস না যেতেই শুরু হয় নতুন অত্যাচার। মনে হতে থাকে যেন তার বিয়ের ছয় বছর হয়ে গেছে আর তার বাচ্চা হচ্ছেনা। উঠতে বসতে চলে মানসিক নির্যাতন। চুপচাপ কাঁদে শুধু সে ,কাউকে বলতেও ইচ্ছে করেনা তার। আর বলবেইবা কি করে? তাকে যেমন বাবার বাড়িতে যেতে দেয়া হতোনা তেমনি তার মোবাইলটাও কেড়ে নিয়েছিলো তার ননদ । শ্বশুরের রুমে খাওয়ার নিয়ে যাওয়ার সময় তার মামা শ্বশুরের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় জয়ী। এই বুড়ো ভামটা তাকে মামনি মামনি বলে মুখের ফেনা তুলে এখানে আসছে এখন কুটনামি করতে। রাগে জয়িতার গা কাঁপতে থাকে ।বুঝতে পারে টুটুলই মামাকে পাঠিয়েছে বাবার কাছে । বউয়েরতো মনে হয়না বাচ্চা কাচ্চা হবে কিছু। টুটুলের আবার বিয়ে দিলে ভাল হতোনা দুলাভাই ?? মামার সাথে শ্বাশুড়িও যোগ করে ,আমি আগেই বলেছিলাম রানুকে নিয়ে আসি টুটুলের জন্য,শুনলেন নাতো । কেন রানুকে আনলে কি এখন ঘর ভর্তি বাচ্চা হতো নাকি ??কেমনে বুঝলা এটা?? "না মানে, আমি কি সেটা বলছি নাকি ??মনেতো হয় বউ বাঁজা টাজা হবে ।দেখেন চিন্তা করে ।আমি আমার নাতি নাতনির মুখ না দেখে মরবো নাকি ?? জয়ীতা খাওয়ার নিয়ে ঢুকে পড়ায় তারা সবাই চুপ হয়ে যায় । মামনি কেমন আছো ?? মামা শ্বশুরের প্রশ্ন শুনে একটা শীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকায় জয়িতা ॥ ও কিছু বলার আগেই তার শ্বশুর তাকে বলে মা এই নে তোর নাপা ।এইভাবে জ্বর বাঁধালে হবে?? 53 minutes ago ইচ্ছে ঘুড়ি হাত বাড়িয়ে নাপাটা নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে আসে জয়ী ।এখনো অনেক কাজ ,সবার খাওয়া বাকি। সেই কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গে শ্বাশুড়ির বকবকানিতে । সেই যে শুরু করে দাসীর খাটুনি সারাদিন চলে,ঘুমাতে যেতে অনেক রাত হয়ে যায় । কাজ সব শেষ করে রুমে এসে শুয়ে পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে যায় সীমাহীন ক্লান্তিতে। একটু আগে শোনা কথাটা নিয়ে ভাবার ও এতটুকু অবসর নেই যেন তার । বাবা মায়ের অতি আদরের মেয়েটির জীবন আজ দাসীর মত। যাকে কিনা নিজ হাতে ভাতটুকু পর্যন্ত বেড়ে খেতে হয়নি ,যাকে কিনা এখনো বাবা পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিতে চান তার আজ এ কোন জীবন ?? বাবা মাকে এতটুকু দোষারোপ করতে ইচ্ছে করেনা তার,সব দোষ তার ভাগ্যের। না হয় সে কেন স্বামীর ভালবাসাটুকু পর্যন্ত পেলোনা ?? টুটুল রুমে ঢুকে তাকে মাতালের মত জড়িয়ে ধরায় ঘুমটা ভেঙ্গে যায় জয়ীর ।এই সময়টুকুতে পর্যন্ত টুটুলের ভালবাসা দেখেনি ও ,স্বার্থপরের মত নিজের চাহিদাটুকু আদায় করে যায় হায়েনার মতই। নিজেকে কেমন যেন ধর্ষিতাই মনে হতে থাকে ওর। কয়েকমাস পরেই নিজের ভেতর অন্য একটা স্বত্তার অস্তিত্ব টের পেয়ে বিবাহিত জীবনের প্রথম খুশিতে মনটা ভরে উঠে জয়ীতার। এই প্রথম মনে হতে থাকে বেঁচে থাকাটা আসলে খুব একটা কঠিন না। নিজের ভেতর একটু একটু করে বেড়ে উঠা এই ছোট্ট ঘাস ফড়িং এর ডানায় সে তার হারিয়ে যাওয়া সুখটুকু খুঁজে নেবে । তার সবটুকু কষ্ট আধো আধো বুলুতে ফু দিয়ে উড়িয়ে দেবে তার এই বাবুই ছানাটা । খবরটা শুনে টুটুলকে তেমন একটা খুশি মনে হয়না ওর। বাবাকে রাজি করিয়ে রানুকে পাওয়ার শেষ সুযোগ হাত ছাড়া হতে দেখে তাকে বরং চিন্তিতই মনে হলো । তাও জয়ীর তেমন একটা বিকার হয়না ।

অনেক দিন পর সে একটা কিছু পাওয়ার খুশিতে মেতে উঠে। সেই জ্বরটুকু কমার কোন লক্ষন দেখেনা ও। নতুন মা হওয়ার খবরে আদর যত্ন দুরে থাক ,জ্বর নিয়ে সারাদিনের খাটুনির এতটুকু কমতি হয়না। দিন দিন অসুস্থ হতে থাকে জয়ীতা। যখনই প্রচন্ড কষ্টে অসহ্য লাগে ও পেটে হাত দিয়ে ওর বাবুর সাথে কথা বলে ।ওর ঘাস ফড়িংটা মায়ের কষ্ট দেখে কি কাঁদে ??কে জানে ,হয়তো কাঁদে চুপচাপ। টুটুল তাও কোন ডাক্তার দেখানোর নাম করেনা ,সেই আগের মতই সকালে বেরিয়ে রাতে ফিরে আসে ।কথা ও বলেনা খুব একটা । একরাতে মাত্র এসে শুয়েছে জয়ীতা। টুটুল এসে ধরতে গেলে প্রথম বারের মত সরে যায় সে। শরীরটা আজ অনেক বেশিই খারাপ। বমি করে এসেছে মাত্রই। টুটুলের মেজাজটাও কেন যেন অনেক খারাপ আজ।হয়তো নতুন কোন প্যাঁচ লাগিয়েছে হয়তো তার মা বোন । টুটুল ডাকে আবার ,জয়ী কান দেয়না। কাঁথা দিয়ে মাথাটা ঢেকে নিয়ে ছোট্ট একটা বাবুর মত গুঁটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। প্রচন্ড রেগে গিয়ে খাট থেকে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় টুটুল। লাল টকটকে চোখ দুটো থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে তার । সেই সাথে চলে অশ্লীল গালিগালাজ । জয়ী চিত্কার করে মাগো বলে কেঁদে উঠে পেট ধরে। লাথিটা পেটেই পড়েছে তার। টুটুল খাট থেকে নেমে ওকে গালি দিয়ে বলে "ঢং না করে উঠে ঘুমা যা।" জয়ী কান্না ভেজা চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি নিয়ে মানুষ রুপি হায়েনাটাকে দেখতে থাকে। সেই রাতেই জয়ী কে ছেড়ে চলে যায় তার বাবুটা ,তার ঘাস ফড়িংটা। দুহাতে পেট চেপে ধরে মেজেতেই বেঁহুশ হয়ে যায় তার পর পরই। অনেক চেষ্টা করে ও আগলে রাখতে পারেনি ওর অভিমানী বাবুই ছানাটাকে।কত বার বলেছে যাসনা সোনা ,তোর দু:খিনী মাকে ছেড়ে যাসনা । স্থানীয় একটা ছোটখাটো নামে মাত্র হাসপাতালে নিয়ে যায় তাকে তার শ্বশুর । সকালে কার কাছে যেন খবর পেয়ে ছুটে আসে তার বাবা মা। হাসপাতাল থেকেই চিরদিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে আসে জয়ীতাকে। আসার সময় জয়ীতার শ্বশুরকে শুধু বলে আসেন ,আপনার ও মেয়ে আছে বেয়াই সাহেব ।আমার আদরের মেয়েটার সাথে আপনারা এতটা না করলেও পারতেন। কেন ছেলের অমতে বিয়ে করালেন ?? সেই থেকে জয়ীতা বাবার কাছেই আছে । ওর পুরা সুস্থ হতে অনেক দিন লেগে যায় । ওকে একটা বেসরকারী অফিসে ঢুকিয়ে দেন তার বাবা। তবে ওকে প্রায়ই দেখা যায় বাচ্চাদের স্কুলের পাশে এলোমেলো হাঁটতে কখনোবা বস্তির পাশে ফুটপাতের পাশে কাকে যেন খুঁজতে ।

মৌরি অনেক বার চেষ্টা করেও জয়ীতার মুখোমুখি হতে পারেনা।সেই দিন থেকেই জয়ীতাকে দেখে দুর থেকে ।কথা বলতে চেয়েও খুব একটা কাজ হয়না ।মিতুর কাছে জেনেছে এই মাসেই জয়ীতা এমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। কারো সাথেই খুব একটা কথা বলেনা সে। তাও হাল ছাড়েনা সে ,কেন যেন তার হারানো সবটুকু মায়া জয়ীতার মাঝে খুঁজে পায় মৌরি ।

.................. সেই বিকেলেও জয়ীতা একা চুপচাপ বসে কাঁদছিলো পার্কে বসে । একটু পর এসে এক মায়াবতী তাকে দুহাতে জড়িয়ে নেয়। জয়ীতার চোখে মুখে একটা উচ্ছাস ছড়িয়ে পড়ে। বিড় বিড় করে বলে ঘাস ফড়িং আমার ঘাস ফড়িং। জয়ীতাকে দেখে মনে হয় সে তার হারানো ঘাস ফড়িংকে খুঁজে পেয়েছে ॥